সময়ের একটা মূল্য আছে না, আজ কাল সময়ের সে মূল্যটা যেন কোনো আট পৌঢ় জীবনের রোজনামচা গল্পের ইতিবাচক প্রেমানুভবে হারিয়ে গেছে। স্বপ্নের তীরে রফিকের সে পরিবারটাই যেন তেমন মনে হয়। রফিকের দাদা করিম সাহেবের চার ছেলে ও চার মেয়ে ছিলেন। তাদের মধ্যে রফিকের বাবা আকরাম সাহেব সবার বড়। তিনি খুব বুদ্ধিমতির অধিকারী। সংসারের প্রতি যেমন তার টান ছিল তেমনি ভাই-বোনদের প্রতি ভালোবাসাও ছিল অটল। তিনি খুব পরিশ্রমী ছিলেন। পরিশ্রমকে খুব ভালোবাসতেন। তার পরিশ্রমের পারিশ্রমিক দিয়ে তিন ভাই ও চার বোনকে মানুষ করছেন। আকরাম সাহেব সে সময়ের এইচএসসি পাস করে স্কুলে চাকরি নিয়েছেন। বর্তমানের মত এমন ঘুস সে সময় ছিল না, অভিজ্ঞতাই ছিল শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী; কিন্তু বেশি দিন তার এ চাকরি সে সমাজে টিকিয়ে রাখতে পারলেন না তিনি। সে সময়ের রাজনীতিবীদেরা তাকে রাজনীতি করতে বলেছে। কারণ তিনি এমন একজন ভালো শিক্ষক ছিলেন, তার কথায় গ্রামের প্রায় সবাই সাড়া দিতো। রাজনীতিবীদের সাড়ায় কান না দেওয়ার কারণে, মিথ্যা কোনো অবিযোগে তাকে আটকে ফেলল। পরে সে চাকরী থেকে তিনি বিরত হয়ে গেলেন, আর কোথাও চাকরীর জন্য আবেদন করেন নাই। এরপর খুব কষ্ট করে ভাই-বোনদের মানুষ করছেন।
অনেকে বলছেন- তুমি যে এত কষ্ট করে, এত পরিশ্রম করে, খেয়ে না খেয়ে তাদের মানুষ করতে যাচ্ছ তারা কি তোমায় দেখবে? তোমার কষ্টের সময় তারা কি পাশে থাকবে? বিপদের সময় তোমার কাছে আসবে?
আকরাম সাহেব বলল- কি যে বলেন ভাই; সেটা তো পরের কথা, আগে তো তাদের মানুষ করতে হবে, ভালো কিছু শিক্ষা দিতে হবে। তারা দিবে বা না দিবে, থাকবে বা না থাকবে সেটা তাদের ইচ্ছা, কিন্তু এদের মানুষ করার পিছনে আমার যে কষ্ট রয়েছে তার মূল্যটা নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর কাছে পেয়ে যাব।
.
ভাই-বোনদের মানুষ করা শেষে ৩২ বছর বয়সে আকরাম সাহেব বিয়ে করেছেন পাশের গ্রামের মরিয়ম বিবিকে। মরিয়ম বিবিও বেশ কারুশিল্পী। যেমন চালাক তেমনি ছলাকলায় নিপুণ। আকরাম সাহেব ও মরিয়ম বিবির মুখ উজ্জ্বল করে জন্ম নিল রফিকেরা ভাই-বোন ছয় জন। ধীরে ধীরে আকরাম সাহেবের দায়িত্ব বেড়ে যাচ্ছে। তার ভাবনা হল- ভাই বোনদের মানুষ করতে পেরেছি, কিন্তু ছেলে মেয়েদের মানুষ না করতে পারলে কেমন হবে? তাদেরকে ভালো কিছু শিক্ষা দিতে না পারলে সমাজে আমাকে মুখোশ পড়ে চলতে হবে। তার ইচ্ছা ছিল- তিনি পুরোপুরি না পারলেও তার ভাই বোনেরা তাকে সাহায্য করবে। দুরো বোনেরা তো অন্যের সংসারে চলে যাবে, তারা তো আর দিতে পারবে না; তিনটি ভাই এর ভবিষ্যৎ উজ্জলের পিছনে আমার কষ্ট ছিল সব চেয়ে বেশি, নিশ্চয়ই তারা একদিন আমাকে সাহায্য করবে।
..
তার এ স্বপ্ন একদিন দুঃস্বপ্নে ভর করলো, ইচ্ছা আর আসক্তি চরম বিষণœতার রুপ নিলো; আর জন্ম হল আগ্নেয়গিরির লাভা ও ঘনঘটা মেঘ র্বষা! কষ্টের কথা মনে হলে শুধু অনলের চাপ আসক্তির রুপ নেয়, আর দু’চোখে অঝোর শ্রাবনের মেঘ র্বষার সৃষ্টি হয়।
দিন ফুরায় অত্যাধিক পরিশ্রমে আর রাত কাটে খুব আশঙ্কা নিয়ে। সূর্যের রোদকে বরফ, বৃষ্টিকে রোদের প্রতিচ্ছায়া আর শীতকে গরম ভেবে শত কষ্ট আর পরিশ্রমের বিনিময়ে চারটি সন্তানকে মোটামোটি মানুষ করতে তার জীবনের চার ভাগের তিন ভাগ যেন চলে গেছে। ছেলেদেরকে কখনও কষ্ট দিতেন না। কখনও রোদে যেতে দিতেন না- রোদের তাপ ছেলেরা সহ্য করতে পারবে না, বৃষ্টিতে পাঠাতেন না; সর্দি হতে পারে। মাথায় বোঝা উঠাতে দিতেন না- মাথায় ব্যথা পাবে,মাথা ফেটে যাবে, তাড়াতাড়ি বড় হতে পারবে না এমনটা ভেবে।
তাদের মধ্যে মেয়ে দু’জনকে ভালো ও শিক্ষিত সংসার দেখে ইতিমধ্যে বিয়ে সেরে ফেলছেন। সংসার দু’টো খুব ভালো ছিলো এ জন্য আকরাম সাহেব খুব গর্বিত। বাকি আছে দুই জন; একজন ছেলে ও একজন মেয়ে।
..
দিনটা আজকাল তার জন্য খুব কঠিন যাচ্ছে। সুখ যেন তার জন্য বিধাতা সাত দিনের সে রাত্রে লিখেন নাই। তিনি মনে করেন- মায়ের উদর থেকেই আমি দুঃখ নিয়ে পৃথিবীতে আসছি। ছোটো বেলা মা-বাবা আমাদের আট ভাই-বোনকে রেখে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছেন। দুঃখটা যেন পৃথিবী থেকে কেনা আমার প্রিয় আপনজন।
জীবনে চলার পথে সবারই বন্ধু-বান্ধব থাকে। যার যে অবস্থা, তার সে অবস্থার ওপর নির্ভর করে কিছু কিছু প্রিয় মানুষের আস্তানা। তবে কষ্টের ভিতরে যারা পাশে এসে দাঁড়ায়, সুন্দর একটু কথা বলে, মিষ্টি একটু হাসির মাঝে অন্যের কান্নাকে হাসিতে পরিনত করে তাদের কথা যেন কখনও ভুলা যায় না। স্মৃতি হয়ে থাকে তারা রুপ-লাবণ্যের এ পৃথিবীতে।
সবচেয়ে কাছের একজন বন্ধু ছিল বাবর। তাদের বন্ধুত্ব আজ কালকের নয়, ছোটো বেলা থেকে। বন্ধুত্বের একটা টান আছে না; এক বন্ধুর কষ্ট হলে অন্য বন্ধু সহ্য করতে পারে না। তার কষ্টের পাশে আসি দাঁড়ায়। বাবর সাহেবের সংসার মোটামোটি ভালো। দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। বড় ছেলে রিপন বিদেশে থাকে দুই বছর হয়েছে। এ দিকে আকরাম সাহেবের কষ্ট দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। বড় ছেলে শফিক ও মেঝো ছেলে বিপু একজনও কোনো চাকরি করে না। শফিক চাকরির জন্য বিভিন্ন জায়গা ইন্টারভিউ দিচ্ছে, কিন্তু ঘুষের জন্য কোথাও চাকরি হচ্ছে না।
একদিন বাবার এতটা কষ্ট দেখে নিরবে কাঁদছেন। বাবা আমাদেরকে কত কষ্ট করে টাকা উপার্জন করে শিক্ষা অর্জন করাতে বাধ্য হয়েছেন, কোথাও এক টাকা রাখার মত সুযোগ আমরা তাকে দিতে পারিনি। আমাদের জমি গুলো পর্যন্ত বিক্রি করে আমাদের পড়ালেখার পিছনে ব্যয় করছেন, তিনি আজ কিভাবে এত টাকা ঘুষ দিয়ে আমাদেরকে চাকরি নিয়ে দিবেন? বাবার এ বুড়ো বয়সেও আমরা বাবাকে সাহায্য করতে পারছি না। শফিক খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে পথ চলছে। বড় ছেলের ভাবনাটা বাবা ধরে ফেলছেন। বাবর সাহেবকে আকরাম সাহেব এ কথা গুলো বলছেন। বাবর সাহেব মনে মনে চিন্তা করলেন- আমার বড় ছেলে রিপনের কাছ থেকে যদি একটি ভিসা নিয়ে দিতে পারি তাহলে সমস্যা কি? আমার বন্ধু যদি সুখে থাকে একদিন আমার জন্য নিশ্চয়ই দোয়া করবে, হয় তো এর বিনিময়ে আমি স্বর্গও পেতে পারি। এমন চিন্তা ভাবনা করে রিপনকে এ কথা বললেন আর আকরাম সাহেবের কষ্টের কথা জানালেন।
তুই যেমনে পারিস শফিকের জন্য একটা ভিসা পাঠাবি কিন্তু; আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, চেষ্টা করবো। পরের সপ্তাহে তার জন্য একটি ভিসা পাঠালো। এ কথাটি আকরাম সাহেবকে বাবর সাহেব জানালেন- ভাই একটি কথা বলবো- কি কথা ভাই?
আমি তো আপনার কষ্টের জীবন দেখছি; আপনার বড় ছেলের জন্য আমার বড় ছেলে একটি ভিসা পাঠাইছে, ভিসা ও নাকি খুব ভালো। পাশাপাশি থাকবে দু’জন। যদি আপনি ইচ্ছা করেন তাহলে পাঠাতে পারেন।
আকরাম সাহেব বললেন- ভাই আপনি আমার অনেক বড় উপকার করতে যাচ্ছেন। নিজের কথা মত তো আর সব কিছু হয় না, সবার সাথে মত বিনিময়েরও দরকার আছে। কমপক্ষে ছেলেকেও জিঙ্গাসা করার দরকার। বাবর সাহেব পান দিলেন। পান খেতে খেতে আকরাম সাহেব বাড়ি রওনা দিছেন। বাড়িতে আসি সবার সাথে মত বিনিময় করছেন আর বড় ছেলেকেও জিঙ্গাসা করছেন। সে রাজি হয়ে গেছে। তার পাসপোর্ট করা ছিল, তাই মেডিকেল শেষ করে কিছু দিনের ভিতরে যাওয়ার দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেল।
.
এ দিকে মেঝো ছেলে বিপু চাকরি খোঁজছে, কিন্তু কোনো চাকরি মিলল না। চাকরি মিললেও ঘুস মিলে না। জীবনটা যেন অবাক করা এক অভিযাত্রীক কাহিনী। শিক্ষিত হয়েছি; মাটিও কাটতে পারি না, রাস্তায় কাজও করতে পারি না, রিকসাও চালাতে পারি না, ক্ষেত- খামারেও কাজ করতে পারি না। আবার কোথাও বসে দশ মিনিট আড্ডাও দিতে পারছি না। ইদানীং নিন্দুকের অভাব নাই, তারা শুধু মানুষের দোষ খোঁজে আর খোটা দেই। কাজ করতে গেলেই সবাই বলবে- আকরাম সাহেব কত কষ্টের কাজ করে ছেলে গুলারে মানুষ করছেন; আর তারা দেখছি রাস্তায় রাস্তায় কাজ করছে, রিকসা চালাচ্ছে আর আড্ডা দিচ্ছে। একেবারে শিক্ষিত, একটি চাকরি নিতে পারে না। তাদেরকে পড়া-লেখা শিখানোটাই যেন আকরাম সাহেবের অনর্থক। এমন চিন্তা- ভাবনা করে বিপু সময় কাটাচ্ছে। শুধু নিজের ক্যারিয়ার গড়ার জন্য নয়, সংসারের অভাব মিটানোর জন্য হলেও তো কাজ করা দরকার। শিক্ষিত হলে কি হয়েছে, ক্ষেত খামারে কাজ করা যায় না?
আর কত দিন পরিবারের দুঃখ গুলো মেনে নিব?
সংসারের অনটন আর দেখতে ভালো লাগে না। দুরো নিজেরটা বাদ দিলাম, কিন্তু যে বাবা ওষুকের ভিতরেও আমাদের খাবারের জন্য, আমাদের সুখের জন্য, আমাদের মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য বুকে ভর করে মাঠে কাজ করে টাকা ইনকাম করেছেন তার জন্য হলেও তো একটু কষ্ট করা দরকার।
কি করবেন বিপু, সেটা নিয়ে খুব চিন্তিত আছেন আর চাকরির পিছনে পিছনে দৌড়াচ্ছেন।
..
এ দিকে শফিকের সময় হয়ে গেছে। কালকেই তাকে বিদেশে যাওয়ার জন্য রওনা দিতে হবে। ঠিক সময় মত শফিক শাহ জালাল বিমান বন্দরে পৌছলেন এবং নির্দিষ্ট সময়ের ভিতরে কাতারে পৌছালেন। সেখান থেকে রিপন তাকে নিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে প্রায় এক মাসের মত তাদের সাথে আকরাম সাহেব ও বাবর সাহেবের কথোপকথন হয়। এরপর থেকে তাদের সাথে আর কোনো যোগাযোগ নেই। এ যেন আর একটা বিরহের অনল চাপা অভিতপ্ত মন আকরাম সাহেবের ঘরে বাসা বাধলো।
..
অন্যদিকে বিপু ভাবলো বড় ভাইয়ের কোনো খোঁজ খবর নাই, কি যে করি! কিছু ভালো লাগে না!! পরিবারের কষ্টটা দিন দিন বেড়ে চলছে। বাবাও আগের মত কাজ- কর্ম করতে পারছে না। আমি আর কতদিন বসে বসে খাব। শেষ পর্যন্ত নিজের এলাকায় চাকরি না পেয়ে শহরে যাওয়ার জন্য বাবা- মায়ের কাছে অনুরোধ করলো। তারা অনিচ্ছুক তাকে যেতে দিবে না, এক জনের খোঁজ খবর নাই, আবার আর একজন শহরে গিয়ে আমাদের কথা মনে রাখবে না।
শহরে যাওয়া লাগবে না। শহরে গেলে সবাই নষ্ট হয়ে যায়।
আসলে মা তুমি যা ভাবছো তা না, সব কিছু নিজের ইচ্ছা। আমি কথা দিচ্ছি আমি নষ্ট হব না। আমি সব সময় তোমাদের খোঁজ খবর নিব। তোমরা নিশ্চিত থাকো- তোমাদের এ ছেলে নষ্ট হবে না। মা তুমি বাবাকে বোঝাও না।
বিপুর মা অনেক বোঝানোর পরে আকরাম সাহেব রাজি হয়েছেন। এরপরের দিনই বিপু চট্টগ্রামে উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সে তার এক বন্ধুর বাসা যাবে, সেখান থেকে চাকরির খোঁজ নিবে। তার সাথে ছিল- পুরো শিক্ষা জীবনের সার্টিফিকেট, জীবন বৃত্তান্ত সহ বিভিন্ন কাগজ পত্র। মাঝ পথে গাড়ির ব্রেক ফেইল করলো এবং পাহাড়ের পাশে এক্সিডেন্ট করলো। সে গাড়িতে প্রায় চল্লিশ জনের মত যাত্রী ছিল। তাদের ভিতরে বিপু সহ পাঁচজন পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়ে চলে গেছেন।
এ খবর পরের দিন পত্রিকায় আসলো। সে এলাকার জমিদার আবরার প্রতিদিন পত্রিকা পড়া যেন তার একটি নেশা। সে পত্রিকাতেই তাদের লাশ, নাম সহ পরিচয় দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে আবরার খবর পৌছে দিলেন- আকরাম সাহেবের কাছে। বিপুর কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী সরকারের পক্ষ থেকে সে লাশ বাড়ি পৌছে দিল। আকরাম সাহেবের পরিবার অনেক কান্নাকাটির পর, নিজের এলাকায় মসজিদ সংলগ্নে তাকে কবর দিছেন।
.
শফিকেরও কোনো খোঁজ- খবর নাই, বিপু পৃথিবী থেকে চলে গেছে। বাকি আছে- রফিক। রফিকের ছোটো বোনটা বড় হয়ে গেছে। তার বিয়ের জন্য প্রায় সব জায়গা থেকে লোক আসে। কিন্তু টাকা পয়সাও নেই। হাতখড়ি বলতে শূন্য। দিন আনে দিন খায়, বাকি টাকা জোগাড় করারও তেমন সামর্থ্য হয় না। সবে মাত্র ভাই-বোন দুই জন ইন্টার শেষ করছে। রফিক খুব ভালো ছাত্র। পরীক্ষায় রেজাল্ট- গোল্ডেন এ প্লাস, কিন্তু বাবা তাদের পড়া লেখা করার পিছনে খরচ করার মত আর সামর্থ্য নেই। তাই ভাই-বোন দুইজন এখানে সমাপ্ত করতে যাচ্ছে তাদের শিক্ষা জীবন। অন্যদিকে, বোনটাকে বিয়ে দেওয়া দরকার। রফিকের এক খালা লাভনি, তার একজন মাত্র ছেলে। সে রফিকের ছোটো বোনকে খুব পছন্দ করে। তাই বেশি কিছু দেওয়া লাগবে না, সামান্য নুন ভাতে রফিকের ছোটো বোনটার বিয়ে শেষ করলো।
..
বাবর সাহেব তার পুত্রের খোঁজ না পাওয়ায় ছেলের জন্য পাগল হয়ে গেছেন। তার মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কর্ম ব্যাহত হয়ে গেছে। তাই তিনি আজ কাল পাগলের মত আচরন করছেন।
রফিকের গাছের বাদাম খাওয়া যেন বেশ একটা শখের ব্যাপার। বাহিরের আবৃত জিনিসকে দুরে সরিয়ে ভিতরে ছোটো এইটুকু জিনিস খাওয়া খুব মজার। সবাই চাই তার মজার জিনিসটি। একদিন ঠিক দুপুর বেলায় রফিক বাদাম গাছ তলায় গেছে বাদাম কুঁড়ানোর জন্য। যখন সে বাদাম নিতে উপুড় হয় তখনই কি যেন তাকে দুই- তিনবার করে ধাক্কা মারে। কোনো দিনও কেউ এক ব্যাগ বাদাম নিয়ে ফিরে আসেনি এ বিশাল বাগান থেকে, কিন্তু সে আজ এক ব্যাগ বাদাম নিয়ে ফিরে এসছে আর আবোল-তাবোল কি যেন বকছে। ধীরে ধীরে সে অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তার দিকে তাকালে মনে হয়- চোখ গুলো দৈত্যের চোখের মত, চেহারাটা আগুনের মত জ্বলকে। দুর দুরান্ত থেকে অনেক ফকির, কবিরাজ আসছে তাকে ভালো করার জন্য, কিন্তু কোনো কাজ হল না। ঘরবাড়ি সব বিক্রি করে ছেলে ভালো করতে চেয়েছেন, কিন্তু কোনো কাজ হল না। অনেকে বলে পরীদের আঁচড় লাগছে। সব সময় চোখে চোখে রাখুন, সুযোগ পেলেই এরা নিয়ে যাবে।
..
এ দিকে রফিকের বাবা খুব বেহুশ। বড় ছেলের আজ পর্যন্ত কোনো খোঁজ নাই, মেঝো ছেলে পৃথিবীতে নাই আর ছোটো ছেলের এ অবস্থা। বেহুশ হয়ে পড়লে সংসার দেখবে কে, আমাকে বেহুশ হওয়া দেখলে সবাই বেহুশ হয়ে পড়ে থাকবে। আমাকে এ জগৎ সংসারে নিষ্ঠুর হতে হবে। জাগতিক এ খেলনাটা যেন অন্য রকম এক অভিশাপ, কিন্তু এর ভিতরের মজাটাই যেন আকাশ কুসুম পার্থক্য। আমার মন শক্ত করতে হবে, আর সবাইকে শান্তনা দিতে হবে। সবাইকে শান্তনা দিচ্ছেন- আল্লাহ যা করেন মানুষের ভালোর জন্য করেন। হয় তো এমনটা আমার কপালে নসিব হয়েছে, তাই তিনি করতে বাধ্য হয়েছেন।
.
প্রায় সময় মাঠে কাজ করে আর উচ্চ সুরে এই গানটি গায়। গানটি নি¤œরুপ-
আমার গোলপাতারই ঘরে আষাঢ় মাইসা পানি পড়ে রে,
আমার গোলপাতারই ঘরে আষাঢ় মাইসা পানি পড়ে রে;
মাটির দাওয়ায় পরের জায়গায় আমি শুইয়া থাকি,
আমার মনের যত আশা নিয়া খোদা তোমায় ডাকি
গোলপাতারই ঘরে খোদা তুমি আসবা নাকি?
আমার গোলপাতারই ঘরে খোদা তুমি আসবা নাকি?
.
আমার কেনো এমন হল, ত্রিভুবনে কেউ না রইলো রে?
আমার কেনো এমন হল, ত্রিভুবনে কেউ না রইলো রে;
বল কত কষ্ট আছে বাকি
বল কত কষ্ট আছে বাকি ,
গোলপাতারই ঘরে খোদা তেুমি আসবা নাকি?
আমার গোলপাতারই ঘরে খোদা তুমি আসবা নাকি?
.
যার আছে যত বেশি তারে দাও তোমার খুশি গো,
যার আছে যত বেশি তারে দাও তোমার খুশি গো;
আমারে দিও না তুমি ফাঁকি
আমারে দিও না তুমি ফাঁকি,
গোলপাতারই ঘরে খোদা তুমি আসবা নাকি?
আমার গোলপাতারই ঘরে খোদা তুমি আসবা নাকি?
.
আসলে তার জীবনটাই আজকে গোলপাতার ঘরে কাটে। নিজের থাকার মত কোনো জমি নেই। অন্যের জায়গায় তার গোলপাতা দিয়ে তৈরি ছোটো এ ঘরেই জীবন-যাপন। যে গানটা পুরোপুরি তার জীবনের সাথে মিলে যায়...!!