কিছু বৃষ্টি আর একটি মানচিত্রের গল্প

ভালবাসা (ফেব্রুয়ারী ২০১১)

Arif Ahmed Fahim
  • ২৬
  • 0
  • ৬৮
১.
সকালটা শুরু হল ফোটা ফোটা বৃষ্টি আর শিরশির বাতাস নিয়ে। স্বভাবতই অনেক ভালোলাগার কথা কিন্তু কেন জানি বিরক্ত লাগছে। বয়সের একটা সময় হয়তো এই বোধটাই বেশি হয়। রুনুকে অনেকদিন হল কোন চিঠি লেখা হয় না। রুনু আমার চিঠি অনেক মমতা নিয়েই পড়ে কিন্তু দীর্ঘ একটা সময় পাশে না থাকায় যে দূরত্ব কিংবা অভাবের সৃষ্টি হয় তাতে কি একটি বারের জন্যও ভালবাসার সমুদ্রে তার পা ডুবাতে মন চায়না? আহ অনুভূতি!
প্রিয় রুনু
কেমন আছ। জানি তোমার অভিমানের পাহাড়ের ঐ স্তুপকে ভেঙে আমার পুরনো অস্তিত্বকে জাগানো আমার পক্ষে অসম্ভব। তবু আগের সেই সমস্ত আকুলতা আজো আমি আমার মত করেই আমার ভেতরে পুষি। অনেকদিন পর তোমাকে লিখতে বসলাম। কাঞ্চনপুরের এই সরকারী বাংলোতে আসার পর এই প্রথম তোমাকে চিঠি লেখা। ৩০৪, ৩১৪ কিংবা ৩০২ ধারার কঠিন রায় লিখতে লিখতে আর ভাল লাগেনা। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সব ছেড়ে কক্সবাজার চলে যাই। কৈশোরের সেই দিনের আবেগের মত খোলা সমুদ্রের তীরের বালু দুহাতে উড়িয়ে নিজেকে মুক্ত করি।
রুনু,
অনেকদিন হয়ে গেল তোমাকে পাশে বসিয়ে কোন সুখ কিংবা দুঃখস্মৃতির গল্প বলি না- আজ কেন জানি খুব ইচ্ছে করছে। অবশ্য আমার কাছে কোন গল্প নেই আর আমি কোন গল্প বানিয়েও বলতে পারিনা। তা নিয়ে তুমি তো কত মজাই না করতে। সারাদিন যে কাটখোট্টা বিষয়ের ভিতর নিজেকে ডুবে রাখি সেই নিয়েই বলি- মাস তিনেক আগে অস্ত্র আইনের একটি মামলা আমার কোর্টে আসে। ঝামেলার কারণে না পড়তে পাড়ায় পেশকার সাহেব সেদিন তারিখ দিয়ে দেন। ১৫ দিন পর মামলাটির আবার তারিখ পড়লে একটি জামিনের পিটিশন আসে। পি.পি সাহেব তার সীমিত বক্তব্যে যা বললেন- তাতে বিষয়টি এইরকম- ছেলেটি স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিভাগে সদ্য মাস্টার্স পাস করা ছাত্র। বয়স ২৮ বৎসর। ছেলেটি নিজে অস্ত্র হাতে পুলিশের কাছে গিয়ে দাবী করে যে- তার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। এটা তার বাবার অস্ত্র। তার বাবার এই স্মৃতিটুকু ধরে রাখতে সে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছে কিন্তু কেউ তাকে কোন সাহায্য করেনি। সর্বশেষ সে কোথাও না পেরে থানায় এসে অস্ত্রটি জমা দিতে গেলে পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করে। রাষ্ট্র পক্ষের বক্তব্য- স্বাধীনতার এত বৎসরের এই দীর্ঘ সময়ে কেন অস্ত্রটি জমা হল না, তার বাবা কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছে কিংবা কোন মুক্তিযোদ্ধার সনদ কেন তার বাবার নেই যার কোন সঠিক প্রমাণ কিংবা কোন ব্যাখ্যা। আসামী পক্ষের কোন ল-ইয়ার না থাকায় মামলার তারিখ দিয়ে দিই। সেদিন রাতের খাবার শেষে সিগারেট ধরিয়ে মামলার নথি সিগনেচার করতে গিয়ে চোখে পড়ে ছেলেটির পাসপোর্ট সাইজের একটি ছবি। অসম্ভব মমতায় মাখা দুটি চোখের গভীরে তাকালে মনে হয় না যে ছেলেটি অপরাধী। পুরো এজাহার বেশ কয়েকবার পড়েও কোন কিছুই বুঝতে পারলাম না। একটি মামলায় আসামীকে সাজা কিংবা খালাস দিতে গেলে নির্দিষ্ট কোন এভডিন্সে লাগে। ছেলেটি খুব বেশি মেধাবী না হলেও অতটা খারাপ ছাত্র না যা তার মামলার এজাহারের সাথে সংযুক্ত কপি দেখেই বোঝা যায়। অল্প বক্তব্যের বর্ণনায় তেমন কোনকিছুই স্পষ্ট না হওয়াতে আরো একটি তারিখ চলে যায়। তার পরের তারিখে ছেলেটির পক্ষে আবার জামিনের আবেদন আসে। কিন্তু তার আবেদনের সাথে কোন যুক্তিযুক্ত কিছু না পাওয়ায় আমি আবেদনটি নাকচ করে দিই। তার কিছুদিন পর আমি জেল পরিদর্শনে গেলে ছেলেটির সাথে আমার দেখা হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে সমস্ত কিছুই জানতে চাইলে সে কিছুই বলে না। কিন্তু অভিমানের কান্নায় তার চোখ ছিল ভেজা ও অস্পষ্ট। আমি চলে আসার ঠিক আগের মূহুর্তে সে কি জানি বলতে চাইল কিন্তু কি ভেবে জানি চুপই রয়ে গেল।
রুনু- তোমার কি মনে আছে পাগলের মত বৃষ্টি ভেজার সেই স্মৃতি? এক ভোরবেলায় তুমি হঠাৎ আমাকে ডেকে তুলে বলেছিলে- চল- আমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবে। ঘুম ভাঙা চোখে অবাক হয়ে তাকানোর সময়টুকু না দিয়ে আমার হাত ধরে নেমে পড়লে ঝুম বৃষ্টিতে। আমি যতই না করি তোমার বাধ ততই বাড়তে থাকে। বৃষ্টি শেষে আমার কানে কানে তুমি বলেছিলে- আমাদের যে বেবিটা হবে তার নাম রাখব বাদল। আমি বলেছিলাম- যদি মেয়ে হয়? তুমি বলেছিলে নাহ! আমার ছেলেই হবে। বাদল দিনের এই তীব্র আক্ষেপকে সৃষ্টিকর্তা কখনো মিথ্যে হতে দেবে না। কি নিয়তি! তোমার সেই চরম দুঃসময়ে আমি ভেকেশনে জজ হিসাবে চলে গেলাম সিলেট। একটি বারের জন্যও তোমার মাথায় হাত রাখার সুযোগটি পেলাম না। অথচ তোমার বাদল ঠিকই বাদল দিনে তোমার কাছে এসেছিল কিন্তু কোন মমতার স্পর্শের অভাবেই হয়তো সৃষ্টিকর্তা সেদিন তোমার বাদলকে তোমার কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিল...।
রুনু- এখন আমাকে উঠতে হবে। কোর্টের সময় হয়ে গেছে। ভালোবাসার অভাব যে কি তা কখনো তুমি বোঝনোই বলেই হয়তো পূর্ণ ভালবাসার স্তম্ভ কখনোই আমি তোমার হাতে তুলে দিতে পারিনি.....।
এইটুক লিখে কেন জানি মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল। হওয়াটাও হয়তো স্বাভাবিক। আমরা আমাদের অস্তিত্বকে খুব সহজেই অনুভব করতে পারি বলেই হয়তো আমাদের অনুভূতির কাছে আমরা আজীবন পরাজিত ।
২.
রুনু-
কোর্ট শেষ করে বাংলোয় ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো। পুরো বাংলোতে আমি একা। একা থাকার তীব্র আকুলতা নিজের ভেতর পুষতাম বলেই হয়তো শেষ বয়সেই নির্বাসিত হলাম। চা খেতে খুব ইচ্ছে করছে কিন্তু তোমাকে লিখতে বসেছি বলেই উঠতে ইচ্ছে করছে না। তখন ছেলেটির প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলাম তাই শেষও করছি তার কথা দিয়েই। ছেলেটির আজ সাজা হয়েছে। এজলাসে মামলার রায় শোনার পর ছেলেটি একটিবারের জন্যও কারো দিকে তাকায়নি। কি মনে করে জানি সে হঠাৎই এক পলক কেবল আমার দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে চলে গেল। প্রচন্ড ইচ্ছার তোড়ে ছেলেটিকে আমার কোর্ট রুমে নিয়ে আসতে বলি। আমার অনেক প্রশ্নের জবাবে সে আজকেও কিছুই বলল না শুধু চলে যাবার সময় একটি চিঠি দিয়ে যায়। চিঠিটি তার বাবার লেখা।
বাবা বাদল, তারিখ ২৭.০৭.১৯৭১ ইং
মুক্তি সেনাদের ক্যাম্প থেকে লিখছি। কেমন আছিস বাবা। জানি তুই হয়তো অনেক অভিমান বুকে নিয়ে আছিস। কারণ তোকে কিছুই আমি বলে আসতে পারিনি। আমি যখন চলে আসি তুই তখন ঘুমচ্ছিলি তোর দাদীর কোলে। তোর দাদীর বুকে জমে রাখা পাহাড় সম ব্যথাকে চাপা দিয়ে তোর কপালে একটি চুমু খেয়ে চলি আসি। শত্রুর আক্রমণের মুখে দাড়িয়ে রক্তের ভেতর যে আগুন জ্বলে তা কি বাবা তুই কখনো বুঝবি? তোর মা বেচে থাকলে আজ এখানে থাকতাম কিনা জানিনা। তবে আজকের এই ব্যাংকার থেকে ব্যাংকার ঘুরে বেড়ানো, বোমা মেরে শত্রুর মাংস উড়িয়ে দিয়ে যে পরিতৃপ্তি পাই তার একাংশ অনুভূতি কোন একটা সময় হয়তো তুই বুঝতে পারবি। তুই চিন্তা করিস না। আমার লক্ষ্মী সোনা তুই ভাল থাকিস। তোর দাদীকে আমার সালাম পৌঁছে দিস। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি, তোর বাবা।
পুনশ্চঃ যেদিন বিজয়ের পতাকা হাতে নিয়ে ফিরব সেদিন একটি মানচিত্রের চাদর তোকে দিব যা গায়ে জড়িয়ে সারাটা জীবন তুই গর্বের সাথে বলবি- তুই এক বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আর দেখবি তখন এই দেশের মানুষ তোকে কোন শ্রদ্ধার আসনে তুলে রাখে। ভাল থাকিস।
চিঠিটি আমি বেশ কয়েকবার পড়ি। রুনু আমি কখনো সহজে কাঁদিনি যা তুমি জান। কিন্তু কেন জানি চোখের পানি আমি ধরে রাখতে পারিনি। এটুকু ভেবে আমি অবাক হই হাজার নির্যাতনের মুখেও এই ছেলেটি একটি বারের জন্যও তার বাবার সর্বশেষ স্মৃতিটুকু কারো হাতে তুলে দেয়নি? স্বাধীনতার এই দীর্ঘ ৪০ বছরে আমরা কি এই নিরপরাধ ছেলেকে শিউরে উঠা ভয় আর গুমরে থাকা কান্নাই দিতে পেরেছি?
আমি জানি এই প্রশ্নের অস্তিত্বের কাছে সারাজীবন আমি বন্দি থাকব। রুনু- পরম মমতায় পাওয়া এক বাদল কে সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর মুখ দেখানই। সেই সময়ের এতদিন পর অন্য এক নিরপরাধ বাদলের কাছ থেকে বাকী জীবনটা কেড়ে নিলো কালো রুমালে বাঁধা চোখের নিঃপ্রাণ স্ট্যাচু।
রুনু- ভাল থেকো।
৩.
বাইরে ভালই বৃষ্টি নেমেছে। খুব ইচ্ছে করছে বৃষ্টিতে ভিজতে। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে এই বৃষ্টিতে ভেজার কোন অধিকার আমার নেই। গভীর মমত্ববোধ ভেতরে লালন করেও যে মানুষটি ছকে বাঁধা কলমের কাছে পরাজিত হয় তার আকুল তৃষ্ণা মিটাতে এই বৃষ্টির কোনরকম ইচ্ছা নেই।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Rokshana yasmin ভিসন ভালো লাগলো লেখাটা
মোঃ আল-মামুন শেখ এখানে সাধীনতার শ-ও নাই. তবে ভাল হইছে.
sumon অসাধারন।কিছু বলার ভাষা নেই শুভকামনা রইলো
বিষণ্ন সুমন শুভকামনা রইলো
ভালো লাগেনি ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১১
নীল আকাশ সজীব Thanks a lot, carry on more and more . Wish your all the best.
ভালো লাগেনি ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১১
farhana nipa Very nice.Best wishes for u.
A.H. Habibur Rahman (Habib) khub, khub khubi sundor hoyeche....sei cheletir jonno amra hoyto kichuy korte parbo na, tobu khub kache theke dekha akjoner sakkhoi proman kore.....amader onek kichuy korte ichce kore, sudhu pathore prithibitay badha hoye daray......suvao kamonaro roilo apnar jonno.
ভালো লাগেনি ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১১
মিজান meddah শুব কামনা সবার জন্য... মিজান মিদ্দাঃ ০০৯৬৬৫৬৯৬৮৭৮১১ আমি এক জন নতন আসচি এই web সিদে ...
ভালো লাগেনি ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১১
বিন আরফান. তোমার লেখার মত আকাশের দুটি তারা চেয়ে থাকে মোর পানে আমি নিশিথে তন্দ্রাহারা .শুভ কামনায়, বিন অরফান.
ভালো লাগেনি ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

১৯ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪