গভীর বনে একটা করাতিয়া ক্যাম্প আছে 
তার দূরগামী চোখ আমাকে গ্রাস করে 
আমি করাতকলের দিকে তাকিয়ে থাকি 
করাতিয়া দল একদা কাঠ এবং গাছ ছিলো 
নপুংসক বনস্পতির ঝাড়ে শুকনো রতিরঙ 
আমার ডান কাঁধে বসে বাঁ পাশের প্রহর 
প্রহর একদিন করাতের দাঁতে ক্ষয়িষ্ণু শব্দ 
ভাবি করাতের ভীষণ এক দাঁত হয়ে যাই 
করাতিয়া আর মৃত্যু যুগলবন্দী নাচ 
আমাকে ঘিরে সাজিয়ে চলে অমৃত ক্রন্দন 
দেখি আমার শিকড় বিস্তারিত করেছে বন 
০১. 
আমি অন্ধকার আকাশের খাতায় নক্ষত্রের দীপ্ত কবিতাগুলি পড়ে পড়ে চোখ ক্ষয় করি, ওরা আমার তিরিশ লক্ষ হারানো সজন। আমার মাথায় কোনো গল্প আসে না। দুইদিনের মধ্যে নয়নার কাছে গল্প লিখে জমা দিতে হবে। বিজয় দিবসের সংকলন বেরোবে কদিন পর। আর আমার মাথা ফাঁকা। 
০২. 
গল্প কই? 
দিবো... 
এইবার বিজয়দিবসে তুই কি পাঠ করবি রে? 
আমি খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম নয়নার দিকে। তাকে বলতে মন চাইছে না যে আমি কবিতা পাঠ ছেড়ে দিয়েছি; সে কষ্ট পাবে। মিথ্যে করে বললাম, কেউ কথা রাখে নি।
শালা! বিজয় দিবসে পড়বি এই কবিতা? আর তাছাড়া তোর বয়স কি তেত্রিশ হয়েছে নাকি? 
কবিতাটা আমার প্রিয়। এই কবিতাটা পাঠের কথা উঠলেই নয়না বয়সের কথা তোলে। আমি এইবার বললাম, আমার তেত্রিশ হয় নি তো কি হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার তো তেত্রিশ পার হয়ে গেছে... 
নয়না আনত চোখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো আমার কাছটায় এসে। আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম আলতো করে। 
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমি তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিলো শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে... 
আমার মনে হয় কি জানিস? ওই গানের কোনো অন্তরাই ছিলো না। 
আমাদের স্বাধীনতার মতো। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস গুম করলাম। 
নয়না ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকালো, মানে! 
মানে কিছু না। বলে হাসলাম। চল, চা খাই,তেষ্টা পেয়েছে খুব। 
ঝুপড়িতে বসেছি বাইরে। চা খেতে খেতে নয়না সহসা হাতের ইশারায় জারুল তলার দিকে কী যেনো দেখালো। আমি তাকালাম, মুক্তিযোদ্ধা কাজী আব্দুর রহিম হেঁটে যাচ্ছে ফ্যাকাল্টির দিকে। এখানে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই লোকটাকে দেখি প্রায়ই আসে, গলায় তিনটা প্লেকার্ড ঝুলানো। একটা সাহায্যের আবেদন, একটা ইংরিজি বড় অক্ষরে লেখা, ফ্রিডম-ফাইটার। অন্যটা লেমিনেটেড সনদ, নয় নম্বর সেক্টরে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে পেয়েছেন। লোকটা কথা বলতে পারে না। গলায় একটা গুলির দাগ আছে, উরুতে একটা। সে এইসব দাগটাগ দেখিয়ে, যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশলের অঙ্গভঙ্গি করে ভিক্ষে করে বেড়ায়। 
নয়না বললো, লোকটার জন্যে মায়া হয়। স্বাধীনতা মানে কী রে? 
বললাম, ফ্রিডম ফাইটার আব্দুর রহিম। 
না না, আমি সত্যিই জানি না। জানি হয়তো বুঝি না। 
নয়নাকে বাচ্চাদের মতো মনে হলো। 
শামসুর রাহমানের কবিতায় পড়িস নি? 
কোন কবিতা? 
স্বাধীনতা তুমি। 
পড়েছি। নয়না মনে হলো আমার উত্তরে সন্তুষ্ট নয়। 
স্বাধীনতা মানে রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়েরে অবাধ সাঁতার 
অবাধ সাঁতার? 
নয়না কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর যেনো ঘোরের মধ্যে চলে গেলো। বলতে লাগলো, অবাধ সাঁতার মানেই তো তিনজোড়া খলচোখ তাকিয়ে আছে আড়াল হতে, ধর্ষক লুকিয়ে আছে পুকুরপাড়ের সঘন বাঁশঝাড়ে, এসিডের বোতল হাতে ঘাটে অপেক্ষমান নরপশু... 
আমি তাকে ডাকলাম, নয়না, নয়না... 
সে চমকে তাকালো, কি... 
ওইসব বাদ দে তো। একটা মজার কথা বলি শোন, জীবনে কখনও দাড়ি না কামালে নাকি স্বর্গে লাইলিমজনুর বিয়ে খাওয়া যায়... 
যাহ্! বোগাস। 
জানি তো। এইসব বলতো, আমাদের স্কুলের নূরুল্লা স্যার, বলার সময় তার কখনো না কামানো দাড়িতে হাত বুলাতেন। থেমে বললাম, নূরুল্লা স্যার রাজাকার ছিলো। 
তুই কেমন করে জানলি? 
স্যার নিজেই ক্লাসে বলতো গর্ব করে, আমি রেজাকার ছিলাম, রেজাকার মানে সাহায্যকারি... 
ছি! 
এইবার আসল মজার ঘটনাটা তোকে বলি, সেদিন টিভিতে দেখলাম স্যার বক্তব্য রাখছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের এক সমাবেশে। শুনেছি স্যার নাকি এখন সরকারি দলের বিরাট নেতা, মন্ত্রীটন্ত্রি হওয়ার সম্ভাবনা... 
আমাকে কথা শেষ করতে দিলো না নয়না। অস্ফূটকণ্ঠে বললো, স্টপ ইট! 
সে ঘড়ি দেখলো। তারপর তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়লো, যাইরে! আমাকে দেড়টার ট্রেন ধরতে হবে। 
কেনো আজকে হঠাৎ... 
ঘরে কেউ নেই; মা অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। তুই তো আড়াইটা, না? নয়না রিক্শা নিলো। 
আমি রিক্শাটার চলে যাওয়া দেখলাম। 
০৩. 
তিনচারদিন নয়নার দেখা নেই। ক্যাম্পাসে যাচ্ছে না, শিল্পকলায়ও না। পার্টি অফিসেও আসে নি এর মধ্যে। সেলফোনও বন্ধ। ভাবছি ওর ঘরে একবার খোঁজ নেবো। বের হবো এমন সময় রাসেল এসে ঢুকলো, হাতে একগাদা পোস্টারপেপার। 
তুই? 
পোস্টার লিখতে হবে। 
কেনো? 
জানিস না, ভর্তিফর্মের দাম পঞ্চাশটাকা বাড়াচ্ছে? কুড়ি তারিখ হতে তিনশোটাকায় ফর্ম বিক্রি হবে। 
শালা! যে হারে বেতন ফি বাড়তেছে, দুইদিন পর আমাগো মতো লোয়ার মিডলক্লাসকে কলেজপাস দিয়ে বসে থাকতে হবে। 
এইসবই তো জেনারেল স্টুডেন্টদের বলতে হবে। 
ওই যে আইতাছে তোর জেনারেল স্টুডেন্ট। 
কবির ঘরে ঢুকলো। রাসেল হ্যান্ডশেক করলো, কেমন আছো কবির? 
আমি বললাম, কি রে কবির, হঠাৎ এইদিকে? 
চারুকলার নোট দরকার। আমার সামনের মাসে পরীক্ষা। 
চারুকলা অনুষঙ্গী নাকি? কিন্তু আমি তো নোটঠোঁটের কারবার করি না, গুরু! 
শালা! নোটের সাথে ঠোঁটের কী সম্পর্ক রে? 
আরে! আছে আছে। 
কথার মধ্যে রাসেল ঢুকে পড়লো, কবির বসো, তোমার সাথে কথা বলি। ইদানীং তো তোমাকে দেখাই যায় না। খুব পড়ছো নাকি? 
আমি বুঝতে পারছি রাসেল সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইছে, তাই রসিকতার মাঝখানে ঢুকে পড়েছে। আমি চুপ মেরে গেলাম। কবির বসলো। 
জানো তো ভর্তি ফর্মের দাম বাড়াচ্ছে আবার। আমার এর প্রতিবাদে কাল ক্যাম্পাসে মিছিল করবো, ভিসির কাছে স্মারকলিপি দেবো। তুমি থেকো। 
না, ভাই। আমি ওইসব পলিটিঙ্রে মধ্যে নেই, তোমরা করো। আমার পড়াশোনা আছে। 
আমার ইচ্ছা হলো কবিরের মুখে প্রচণ্ড একটা ঘুষি মারি। রাগ চাপতে চাপতে বললাম, শালা! পড়াশোনার পরিবেশই নেই, আবার পড়াশোনা। 
কবিরের মুখটা একটু ম্লান হলো। রাসেল বললো, হঁ্যা, কবির, পড়াশোনার পরিবেশ আসলেই নেই। তাই প্রত্যেক স্টুডেন্টের উচিত পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেদের অধিকার আদায় করা। মনে আছে, আমরা ভর্তি হয়েছিলাম চৌদ্দোশো বারোটাকায়। আর এখন ভর্তি হতে লাগছে চার-পাঁচহাজার টাকা প্রায়। 
তোমরা রাজনৈতিক ব্যানারে ডাকলে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রিরা আসবে কেনো; কমন ব্যানারে কিছু করতে পারো না? 
বললাম, তুই করে দেখা না? খালি বড় বড় সমালোচনা। বছরবছর বেতন ফি বৃদ্ধি, সারাবছর স্টুডেন্টদের নানা সমস্যা এইসব নিয়ে তো আন্দোলন আমরাই করি। আর সুবিধা ভোগ করো তোমরা, সো কল্ড জেনারেল স্টুডেন্ট্স। কই, তোরা তো বর্ধিত বেতন-ফি কেউ দিস না। আমরা আন্দোলন করে কমাবো, আর তোমরা ব্যাংকে গিয়ে পুতু পুতু করে টাকা জমা দেবে; শালা! 
কবিরের মুখটা ফ্যাকাসে লাগছে। রাসেল বললো, আসলে কবির, ব্যাপারটা হলো অধিকাংম মানুষই আত্মকেন্দ্রিক, শুধু সমালোচনা করেই গা বাঁচায়? কিন্তু উচিত কি জানো, নিজে কোনো আন্দোলন দাঁড় করাতে না পারলে মন্দের মধ্যে ভালো যেটা তাতে যোগ দিয়ে কাজ করা। ওয়াটএভার, অনেক কথা বলে ফেললাম। কী যেনো নোটের জন্যে এসেছিলে? রাসেল আমার দিকে তাকালো। বললাম, আমার কাছে নোট নেই কবির, বইটই আছে, নিয়ে যা। 
কবির চলে গেলো। রাসেল চুপ করে আছে। বললাম, দেখলি তো, তোর জেনারেল স্টুডেন্ট! সব শালা সুবিধাভোগী। থেমে বললাম, মঞ্জুরি কমিশন নাকি বরাদ্দ কমিয়ে দিচ্ছে? 
হ্যাঁ, আস্তে আস্তে দেখবি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সব প্রাইভেট হয়ে যাবে। 
এই জন্যেই বাবা বলতেন, স্বাধীনতা পেয়ে কী হলো? পাকিস্তান আর বাংলাদেশের মধ্যে পার্থক্য তো বোঝা যায় না। বাবা যুদ্ধে একটা হাত হারিয়েছিলেন। সেই হাতের দিকে তাকিয়ে মরার আগ পর্যন্ত এইসব বলে বলে হাহাকার করেছেন। 
তোর বাবার কথাগুলি কিন্তু এক অর্থে সত্যি। স্বাধীনতার আগে যে শ্রেণির হাতে ক্ষমতা ছিলো, এখনো কিন্তু সেই শ্রেণির হাতেই ক্ষমতা। তখন তারা ছিলো পাকিস্তানি, আর এখন বাঙলাদেশি। মাঝখানে ত্রিশলাখ প্রাণ ব্যর্থ। তখন বাইশ পরিবার শোষণ করতো, আর এখন করে বাইশহাজার পরিবার। অথবা আরো বেশি। 
বাদ দে তো। আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে। নয়নার খোঁজ করা দরকার। তুই বরং রুমের চাবিটা নিয়ে যা। প্রবীরকে পাঠিয়ে দে। ও এসে লেখা শুরু করুক। আমি এসে বাকিটা ধরবো। খাটের তলায় রঙ ব্রাশ সবি আছে। 
রাসেল উঠে দাঁড়ালো। বললো, তাড়াতাড়ি ফিরিস। আজ রাতেই কিন্তু শাটলট্রেন কাভার করতে হবে। নয়নাকে বলিস পোস্টার মারার সময় যেনো থাকে। 
০৪. 
নয়নার ব্যাপারটা কী কে জানে! ওর মা আরো অসুস্থ হয়ে পড়লো নাকি, মাঝে মাঝে এমন হয়; একেবারে উন্মত্তের মতো আচরণ করে, ভাঙুর করে তখন ঘুমের অষুধ দিয়ে রাখতে হয়। উনি যুদ্ধের সময় স্বাধীনবাঙলা বেতারে মুক্তির গান করতেন। জুন মাসে পাকবাহিনির হাতে ধরা পড়ার পর ছয়মাস কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ছিলেন। উনার সবচেয়ে বড় পরিচয় উনি একজন বীরাঙ্গনা। যুদ্ধের পর নয়নার বাবার সাথে যখন বিয়ে হয় তখন উনি প্রাগন্যান্ট। বাচ্চাটা তিনবছরের মাথায় মারা গেলে উনি দারুণ শক পান। সেই থেকে প্রায় মাঝে মাঝে মেন্টালিডিসঅর্ডার থাকেন। 
কোন গেইটে নামবেন মামা? 
আমি রিক্শা হতে নেমে পড়ি। 
দরজা খুলে দেয় নয়না। কেমন বিবর্ণ তার মুখ! নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। 
কী হয়েছে তোমার? 
নয়নার দুচোখ চোখের জলে ভিজে আছে। সে হাঁটতে হাঁটতে খাটে গিয়ে বসলো। আমি তার মুখোমখি বসলাম। তার কাঁধে হাত রাখলাম। 
মা মারা গেছে। 
কখন? 
সে এই প্রশ্নের উত্তর করলো না। বললো, আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। 
সে তো জানি। 
কিন্তু কেমন যোদ্ধা ছিলেন জানি না। 
এইসব কী কথা, নয়না? 
তোকে তো বলেছি আমার এক দিদি ছিলো। তিনবছর বয়সে মারা যায়। আমি মিথ্যে বলেছিলাম, সে মারা যায় নি, তাকে খুন করা হয়েছিলো। 
কে? আমি চমকে উঠলাম। 
নয়না অস্ফুটে বললো, আমার বাবা। 
০৫. 
বিজয়মেলার মঞ্চে বোমা হামলা হয়েছে একটু আগে। ষোলোজন স্পটডেড। আমার মাথা কাজ করছে না। নয়নার কথা মনে হচ্ছে। ওর বাড়িটা ওদিকেই। ওর কাছে যাওয়া দরকার। কিন্তু ওদিকে কারফিউ এখন। আমি বের হয়ে গলিপথ ধরলাম। নয়নাদের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখলাম সে গেইটে দাঁড়িয়ে। সে বললো, মনে হচ্ছে ফ্যানাটিকদের কাজ। 
আমার মাথা এখনো কাজ করছে না। আমি তার হাত ধরলাম। 
নয়না, আমার এইসব ভালো লাগছে না। চল্, আমরা এই ধর্মের রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যাই। 
কী বলছিস তুই, মাথা ঠিক আছে তোর? 
হঁ্যা, ঠিক আছে। আমি তার হাত ধরে টানলাম, চল্, এখনই যাই। 
নয়না এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো, এস্কেপিস্টদের মতো কথা বলছিস কেনো? 
আমি তখন আরো ক্ষ্যাপা, কী করবি তুই, অঁ যা, বোমা হামলার প্রতিবাদে মিছির করবি; তারপর বোমাহামলার শিকার হবি? 
নয়না এসে আমার কাঁধে হাত রাখে, তারপর যেনো প্রাণের গভীর থেকে বলে, এই ছাড়া যে আর কোনো পথ নেই রে... 
আমি শুধু বললাম, ঠি আছে; যাই।