সকালের রোদে পিঠ করে বারান্দায় বসেছে রতনের পাঁচ বছরের দুটো যমজ শিশু সন্তান । ওদের সামনে স্টিলের বাটিতে মুড়ি । ওরা ওদের ছোট্ট মুঠিতে মুড়ি নিয়ে মুখে পুরছে । কুড়মুড় শব্দে মুড়ি চিবাচ্ছে । শেষ বসন্তের সকালের উদার রাঙা সূর্যের আলো তাদের কুচকুচে কালো পিঠে চিকচিক করছে । অদূরে কুয়ো তলায় ছাই দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে বাচ্চা দুটোর দিকে প্রশান্ত চিত্তে তাকিয়ে আছে রতন । আহা ! ভারী দুটো দুধের বাচ্চা । অবোধ , নিষ্পাপ । রতনের মনটা মুহূর্তে ডুকরে উঠে বাচ্চা দুটোর জন্য । সে দাঁত ঘষায় বিরতি দিয়ে নিবিষ্ট মনে বাচ্চা দুটোকে দেখে । গায়ের রঙটা ওদের যদিও লোকে কাল বলে , সে কিন্তু মানতে পারে না । লোকে যে কালো আর শ্যামলা রঙের পার্থক্যই জানে না । এতেই তার মনস্তাপ । রতনের ধারণা বাচ্চা দুটো গায়ের রঙ পেয়েছে ওদের দাদুর থেকে । মহেশখালির বিখ্যাত লাঠিয়াল ছিলেন ওদের দাদু । যেমনি বাবড়ি চুলের বাহার , তেমনি বলিষ্ঠ শরীর । লাঠি খেলার সময় যেন তার শরীরে দৈব শক্তি ভর করত । শূণ্যে ভোঁ-ভোঁ শব্দে লাঠি ঘুরিয়ে আক্রমণ করত । আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ত প্রতিদ্বন্দ্বী । টিকতে পারত না মোটেও । অমন তেজ , অমন পালোয়ান দশ গাঁয়ের মানুষ আর পায় নি । লাঠি খেলার সময় গাঁয়ে প্রায় মেলা বসত । দূর দূরান্ত থেকে মানুষ জন আসত তার লাঠির কেরামতি দেখতে । খাসা মানুষ ছিলেন একজন । রতনের বাপের বরেই রতনকে গাঁয়ের মানুষজন সমাদর করে । বিভিন্ন পালা পার্বণে আচার অনুষ্ঠানে মাঝে সাঝে নিমন্ত্রণের ডাক আসে । রাস্তাঘাটে গাঁয়ের মুরব্বিরা আজও রতনের বাপের কীর্তিগাথা আওড়ায়---" মানুষ একটা ছিল বসির মিয়া ।" শুনে রতনের বুক গর্বে তৃপ্তিতে ফুলে ওঠে । সেই মানুষটার নাতি এরা । এই অবুঝ শিশু দুটি । ওদের একজন ঘাড় ঘুরিয়ে রতনের দিকে তাকায় । ছোট্ট আঙুলের তর্জনী রতনের দিকে দেখিয়ে সরল হাসি হাসে । "বাবা " বাবা " বলে ডাকে । মুখের মত ওদের কাজল কালো মায়াবী চোখ জোড়াও যেন হাসে । হাসি ছড়িয়ে পড়ে সকালের নির্মল বাতাসে , নরম রোদে , ঘরের চালে , গাছের ডালে , নির্মেঘ গাঢ় নীল আকাশে । আহ্ঃ কি যে শান্তির পরশ পায় রতন বলে বোঝানো সম্ভব না । আর বাচ্চা দুটোর চোখও হয়েছে অবিকল ওদের মায়ের রকম । সেই কাজল কালো দুটি চোখ । দীর্ঘ পল্লব । মায়া মায়া চাহনি । তেমনি গভীর উচ্ছল চোখের দৃষ্টি । তেমনি হাসে চোখ দুটি ।
বাচ্চা দুটোর মায়ের কথা ভাবতেই রতন উন্মনা হয়ে তাকাল মাথার উপর নিম গাছটার দিকে । নিমের ডালে ফুটেছে সাদা সাদা তারার মত অসংখ্য ফুল । মৃদু বাতাসে কাঁপছে গাছের চিড়ল সবুজ পাতা । রোদের সাথে কানামাছি খেলছে যেন । স্মৃতিগুলোও যেন কানমাছি খেলছে ওর সাথে । ওকে ঘিরে স্মৃতিরা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে । কত শত ফেলে আসা মিষ্টি , মোলায়েম, হাসি , আনন্দ , গাঢ় বেদনার স্মৃতি । উঠতি বয়সী যুবক তখন সে । ঘরে মন টিকতো না । বাবার মত লাঠিয়াল হতে পারে নি তাতে কি , ওর মত ভবঘুরে স্বভাবও লোকে আর দেখে নি । আজ এখানে তো কাল অন্য কোথাও । বসির মিয়া কড়া মানুষ । রাশভারী স্বভাবের । ছেলেকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আচ্ছামত শাসন করে দিলেন । ছেলে এক মাস কি দেড় মাস বড় জোর দু মাস বেশ গৃহী হয়ে থাকল । সাংসারিক কাজে কর্মে তখন তার মত একনিষ্ঠ দ্বিতীয়টি নেই । বাবাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন । ভাবলেন এবার ছেলেকে একটা বিয়েশাদি দিয়ে সংসারী করা দরকার । পরদিন মোরগ ডাকা সকালে বসির মিয়া দেখলেন রতনের ঘর খালি । দরজা হাট করে খোলা । ছেলে নিরুদ্দেশ । কোথায় কোথায় যেত রতন তার লেখাজোখা নেই । সেসব দিনের কথা মনে পড়লে আজও রোমাঞ্চ জাগে রতনের নিস্তেজ মনে । আজও সে শিহরিত হয় ।সার্কাস পার্টির সাথে গাঁয়ে গঞ্জে ঘুরা , যাত্রার দলে নাম লেখানো , চাঁটগায় ম্যাচের ফ্যাক্টরীতে কাজ , পঞ্চগড়ের পাথর ভাঙার মজুর , সমুদ্রের মাঝ ধরা জেলে । একবার তো বঙ্গপোসাগরে ট্রলারে মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়ের কবলে মরতেই বসেছিল । চোখের সামনে জেলে সঙ্গীদের মরতে দেখেছিল । ভাগ্যের জোরে ফিরে এসেই নিয়ত করল ওসব আর না । বিয়ে করে সংসারী হবে । কিন্তু ততদিনে বসির মিয়া ইহলোকের মায়া সাঙ্গ করেছেন আর রতনেরও বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই । সম্বল বলতে বাপের সুনাম , খড়ের খান দুই চালা ঘর , একটা গোয়াল ঘর , বিঘে খানেক ফসলী জমি এই তো । কে প্রাণে ধরে তার মেয়েকে এই ছন্নছাড়ার হাতে তুলে দিবে । শেষকালে তার পত্নী ভাগ্যে জুটলো বছর চৌদ্দর এক বালিকা । আফসানা বেগম । চড়পাড়ার মেয়ে । ছোটবেলায় মাকে হারায় । বাবারও নাকি পাত্তা নেই । লোকে তো এমনও কানাঘুসো করে আফসানার মায়ের বিয়েই হয় নি । কোন এক লম্পটের সাথে সম্পর্ক ছিল । আফসানার জন্মের আগেই সমূহ বিপদ টের পেয়ে চম্পট দেয় হারামজাদা । আফসানাকে পৃথিবীর মুখ দেখিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করলো ওর মা । সেই থেকে সে মামা মামীর মাঝেই মানুষ ।অহর্নিশি পাড়া পড়শীর মুখে আফসানার জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে সন্দিহান কটু কথা শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ মামা মামী অপেক্ষার প্রহর গুনছিল । কবে মেয়ে একটু বড় হবে আর কবে তাকে সংসার থেকে বিদায় করা যাবে । ভদ্র অভদ্র চোর গুন্ডা যা হোক এক প্রকার পাত্রস্থ করতে পারলেই হয় । মামা মামীর তাগাদায় তাড়াহুড়োয় বিয়েটা হল । রতন বাছ বিচার দূরে থাক ভাবী বধূকে চোখের দেখাও দেখলো না নিজের স্বভাবসুলভ উদাসীনতার কারনে । বিয়েটাও হল অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ার মত ।
বিয়ের প্রথম রাতের স্মৃতি রতনের সবচেয়ে নিবিড় পরিচর্যায় মনের সুপ্ত কোটরে খুব যত্নে আজও অমলিন রয়েছে । রাত তো কতই এসেছিল তার জীবনে । ঘোর বর্ষার রাত , ভরা পূর্ণিমার রাত , মাঘের কনকনে হাওয়ার রাত , আসমান ভরা তারার রাত , গুড়ুগুড়ু মেঘের রাত , আচমকা কোকিল ডাকা বসন্তের রাত । কিন্তু সেই রাতটি তার জীবনের সকল রাতের থেকে সম্পূর্ণ মৌলিক , স্বতন্ত্র , উদ্বেগ , কৌতূহল এমনকি বিষন্নতায় পরিপূর্ণ । ফুলশয্যায় গুটিসুটি ঘোমটা টেনে আনত মুখে বসে আছে নব বধূ । ছোট খাটো গড়ন । মূর্তিমতি নিশ্চল বসার ভঙ্গি । রতন এই ঘোমটা টানা জড়সড় বালিকা বধূর পাশে বসে উসখুস করতে লাগলো । কি বলবে সে একে ? দুজনের বয়সের ব্যবধানও রতনকে দ্বিধাগ্রস্ত করে তুললো ।অথচ একটা কিছু হোক সেটা খুব সাধারন , খুব অপ্রয়োজনীয় , অকিঞ্চিৎকর তাকে বলতে ইচ্ছা করছে আবার বাধো-বাধো ঠেকছে । এতদিন সে পরিবার পরিজনহীন এই এক টুকরো বসত ভিটায় নিজের নিয়মে যথেচ্ছভাবে থেকেছে ।কাউকে নিয়ে এমনকি নিজেকে নিয়েও ভাবনা চিন্তার বালাই ছিল না । জীবন যাপন সম্পর্কে একটা নিস্পৃহ ভাব এসেছিল মনে ।গতকালও এই ঘর , ঘরের মাঝে সদ্য দখলকৃত নববধূর জায়গাটি ছিল খালি । আর আজ একজন নতুন কেউ যাকে প্রায় চোখের দেখাও দেখেনি , যার ভাল মন্দ পছন্দ অপছন্দ কিছুই জানে না সে, দুদিন আগেও যার কথা কল্পনাও করেনি সে তেমন একজন তার ঘরে , তার বিছানায় উপবিষ্ট । ব্যাপারটার মধ্যে একটা নতুনত্ব আছে , কৌতূহলের উদ্রেক আছে , নতুনত্বকে ছুঁয়ে দেখার সহজাত ইচ্ছা আছে আবার প্রবল জড়তাও আছে । অস্বস্তি নিয়ে রতন খাট ছেড়ে উঠে ঘরের মেঝেতে শান্ত গম্ভীর ভাবে পায়চারি করল । মনে মনে কয়েকবার চর্চা করে নিল তার অস্বস্তির নিচে চাপা পড়া কথাগুলো । পরক্ষণেই মনে হল তার কিছুই বলবার নেই চৌদ্দ বছরের এই বালিকা বধূটিকে । সে হেটে জানলার ধারে দাড়ালো । জানালার গায়ে হাত রেখে বাইরে তাকালো । বাইরে তখন অন্ধকার রাত্রি ।অস্পষ্ট আঁধারে আচ্ছন্ন ফসলের মাঠ থেকে ব্যাঙের ঘ্যাগর,,,, ঘ্যাগর অবিরাম ডাক ভেসে আসছে । দূরে হাউসখালী নদী । আবছা জেলে নৌকার আলো দেখতে পেল সে ।নদীর বুক থেকে ভেসে আসা জেলেদের ডাকহাক প্রতিধ্বনির মত শোনাল । সেদিক থেকে হু হু বাতাস ঝাপ্টা দিল তার চোখে মুখে । আর তখনি মনে হল সে একা । বিছানায় মুখ গুঁজে বসে থাকা বালিকা বধূটিকে মনে হল যেন রক্ত মাংসের নয় , যেন মূর্তি । পাথরে গড়া । নিষ্প্রাণ । যেন তার কোন জীবন্ত অস্তিত্বই নেই । পিদিমের সীমিত আলোতে সেই মূর্তিমতির ছায়া পড়েছে মাটির দেয়ালে । নিষ্কম্পন ছায়া । এত দীর্ঘ আর বিষন্ন লেগেছিল রতনের সেই রাত অথচ বুকের মাঝে অদ্ভূত একটা আন্দোলনও হচ্ছিল । শেষ রাতে তন্দ্রার মত এসেছিল । ঝিঁমুনি দিয়ে টেবিলে মাথা ঠুকতে রতনের ঘুমের ঘোর ছুটে গিয়েছিল । তখনও ঘোমটা টেনে কুন্ঠিত হয়ে বসে আছে বধূটি । পিদিমের শিখাও কমে গিয়ে মিটমিট জ্বলছে । আবছা আলোতে ঘরের মাঝে নির্ঘুম নির্বিকার ভাবে বসে থাকা বধূটিকে দেখে রতন বিস্মিত হল ।স্বার্থপরের মত ঘুমিয়ে পড়ার জন্যে একটু অনুশোচনাও হল তার। সে জিজ্ঞেস করলো-" ঘুমাও নি এখনও ? " । মূর্তিমতি যেন এবার নড়েচড়ে উঠলো । পাথুরে শরীরে এবার যেন প্রাণ জোগালো । মাথা দুলালো সে আস্তে করে এপাশ ওপাশ । "সেকি ! কেন ? নতুন জায়গায় এসে বুঝি ঘুম পাচ্ছে না । মামা মামীর জন্য মন কেমন করছে? " আফসানা এর কোনটারই জবাব দিল না । অত্যন্ত নীচু মোলায়েম প্রায় শোনাই যায় না এমন সুরে বলল-" আমার খিদে পেয়েছে" । এই অতি ক্ষীণ অথচ কোমল কাতর নিবেদনে , এই একটিমাত্র সরল সাধারন বাক্যে বালিকা নববধূটির জন্য রতনের বুক ব্যথায় , করুণায় , ভালবাসায় ভরে গিয়েছিল ।
বিয়ের পরবর্তী দিনগুলো কাটতে লাগলো ভোর রাতের ক্ষণস্থায়ী মধুর স্বপ্নের মত । যেন রেলগাড়ির চাকায় বাঁধা সময়--দেখতে দেখতে দূরে মিলিয়ে গেল । ধূলো ঘড়ির মত হাতের মুঠোয় নিতেই আঙুলের ফাঁক গলে পড়ে গেল । এই স্বল্প সময়ের পরিধির মাঝেই দুজন অসম বয়সের অপরিজ্ঞাত মানুষের পরস্পরকে জানা , কাছে আসা ,পরস্পরের ব্যক্তহীন ভালবাসা, ছোট খাটো অভিমান , ছোট খাটো দুঃখ , সরল সাদাসিধে আনন্দ ,প্রতিটা দিনকে নতুন করে পাবার শিহরণ , প্রাত্যহিক ব্যবহার্য জিনিশপত্রের মাঝে লেগে থাকা সুখ স্পর্শ ---যা সময়কেও হারিয়ে দিল । বিয়ের প্রথম দিকে রতন সারাক্ষণ তার বালিকা বধূটির জন্য কি উপযোগী , কি পেলে সে আনন্দ পাবে তার ভাবনা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকত । মাটির পুতুল , খেলনা বাটি ভাড়া কুড়ো , পাঁচ পয়সার টিপ ,কাঁচের চুড়ি , আলতার কৌটা আরও কত কি । আফসানা তার স্বামীর বুদ্ধি খাটিয়ে আনা উপহার সামগ্রী দেখে আড়ালে মুখ টিপে হাসত । কিছু দিন যেতে রতন উপলব্ধি করতে পারল যে আফসানার বয়স চৌদ্দ হলে কি হবে তার আচার আচরণে , কাজে কর্মে মোটেও বালিকাসুলভ অনভিজ্ঞতা নেই । বরং সাংসারিক দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল একজন পূর্ণবয়স্কা পতিব্রতা যেন । কতটুকুই বা বয়স । এর মধ্যেই ঘরকন্নার নিয়ম কানুন সব আয়ত্ত করে ফেলেছে । রতন শুরুর দিকে তাকে নেহাৎ ছেলে মানুষ ভেবে সে অনুযায়ী সম্বোধন করেছে, কথা বলেছে । ছেলেমানুষি দুষ্টুমি করেছে । কাজে কর্মে ত্রুটি বিচ্যুতি দেখলে স্নেহ ভরে ভৎর্সনা করেছে , নবীশের মত শিখিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে । কিন্তু কিছুদিন যেতেই রতনের ভ্রম ঘুচে গেলো আফসানার সাংসারিক জ্ঞানে । কাজে কর্মে কর্তব্যনিষ্ঠায় যেন সে তার চৌদ্দ বছরটিকে ছাড়িয়ে গেছে অনেক দূরে । রতন দেখলো বালিকা বধূর মাটির খেলনা পুতুল ভাড়াকুড়োর চাইতে দুপুরে খাবার পর মাদুর পেতে সেলাই নিয়ে বসতে উৎসাহ বেশী । বিকেলবেলা ধলচাতালের ডাঙায় ওর বয়সী মেয়েদের চিঁ বুড়ি খেলার চাইতে , উঠোনের পেছনে জমিতে লাউ কুমড়ো মরিচ পরিচর্যায় ওর আকর্ষণ বেশী । আহারের সময় পাখা বাতাস করা , আহারের পর রতনের জন্য পান সাজিয়ে আনা , রাতে ঘুমাবার সময় ওর পায়ে তেল মালিশ করা , হাত পাখায় রঙিন সুতোয় রতনের নাম লিখা , ফুল পাখি লতা পাতার সূচি কর্ম , সিগারেটের প্যাকেট লুকিয়ে রেখে দিনে তিনটার বেশী সিগারেট রতনের হাতে না দেয়া এমন বিবিধ কর্মপটুতা দেখে রতন খুশি হবার বদলে কিছুটা যেন ক্ষুন্ন হয়েছিল । অপরপক্ষে মাতৃ পিতৃহীন আশৈশব মামা মামীর সংসারে অবহেলা অনাদরে অল্প বয়সেই কৈশোরের চপলতা উচ্ছ্বলতা হারিয়ে ফেলা এই হতভাগীটির জন্য করুণায় , সহানুভূতিতে রতনের অন্তর পরিপূর্ণ হয়েছিল ।
দেখতে দেখতে ঋতুর পালাবদল ঘটলো । আষাঢ় শ্রাবণ গড়াল , কার্তিকে মাঠ ভরা আমনে ছেয়ে গেল , মাঘের উত্তরীয় হাওয়ায় কাঁপন জাগালো , ফাল্গুনে ঝরা বন নতুন সজীব পাতায় সাজলো , কোকিলের কুহু বেজে উঠলো নির্জন দুপুরে , চৈত্রের খাঁ খাঁ রোদে মাঠ ঘাট ফেটে চৌচির হল ।তুলির আচড়ে আঁকা যেন এক একটা দিন ।আকাশের গায়ে রঙের খেলা । প্রতিনিয়ত রঙ ঘুলছে মিশছে মুছে যাচ্ছে আবার নতুন রঙের আবির্ভাব ঘটছে । প্রকৃতি ও নিসর্গের মাঝেও বৈচিত্রের ছোঁয়া লাগছে প্রতিনিয়ত । এই রঙ , রূপ বৈচিত্র মানব মানবীর চোখে আচমকা ধরা পড়ে যায় । কাজে কর্মে একঘেয়ামী ক্লান্তিতে একটু অবসরের জন্য , সামান্য আরাম বোধের আশায় হয়ত কাজ থেকে মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকায় আর তখনি সে অবাক হয়ে ভাবে "আজ আকাশটা এত নীল কেন ! " অথবা " কি মেঘ জমেছে ! এই বুঝি বৃষ্টি আরম্ভ হবে ।"এভাবেই ছোট ছোট সূক্ষ্ণ তুলির আচড়ে অতি মৃদু গতিতে কোন কিছু বুঝে ফেলার আগেই আবার ঋতু চক্রে ফিরে এলো বৈশাখ । রতন গঞ্জের হাট থেকে সবে ফিরেছে । ঘামে চিটচিটে জামাটা সবে খুলে বারান্দার দড়িতে মেলে দিয়েছে । আফসানা লাজুক লাজুক মুখ করে খুব ইতস্তত ভাবে রতনের কানে ফিসফিসিয়ে কি যেন বললো । শুনে মুহূর্তে রতনের ঘর্ম ক্লান্ত মুখখানা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো । আফসানাকে নিবিড় বাহু যুগলে আবদ্ধ করলো সে । কলতলার নিম গাছটায় কি যেন একটা হলদে পাখি ডেকে উঠলো মিষ্টি সুরে । আফসানা বাহু বন্ধনে আবদ্ধ থেকেই পাখিটা দেখে জিজ্ঞেস করল-" কি নাম গো পাখিটার ? ভারী সুন্দর দেখতে । "
কনকনে শীতের রাত । ঘন কুয়াশায় সম্মোহিতের মত আচ্ছন্ন হয়ে আছে চারপাশ । আকাশে মেঘের ফাঁকে ঘোলাটে চাঁদ । শাপগ্রস্তের মত ফিকে আলোয় তাকিয়ে আছে মর্ত্যলোকে । ঘরে অসহনীয় প্রসব বেদনা কাতর আফসানা বেগম । ওর যন্ত্রণা কাতর চিৎকার কুয়াশার ঘন আস্তরণ ভেদ করে হারিয়ে যাচ্ছে দূরে বাশঝাড়ের মাঝে । সেখান থেকে প্রতিধ্বনী হয়ে আবার ফিরে আসছে ।গায়ে চাদর জড়িয়ে উঠোনে দ্রুত পদে পায়চারি করছে রতন । হাড়কাপানো শীতেও সে ঘামে প্রায় নেয়ে ফেলেছে । বুকের মাঝে অদ্ভূত এক তোলপাড় । আশঙ্কা আর সম্ভাবনার মিলিত ঢেউ বুকের মাঝে ফুলে ফেপে উঠছে । বিয়ের প্রথম রাতের মতই সেই রাতটিকে বড় বেশী দীর্ঘ বিষন্ন মনে হয়েছে রতনের । যেন মনে হয়েছে বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে আফসানার আর্তচিৎকার আর থামবে না , এই বিষাদগ্রস্ত দীর্ঘ শীতের রাতটির আর অবসান হবে না । সময়ের কাটা যেন থমকে গেছে নিয়তির হাতে । চাপা অবসাদ , দুশ্চিন্তা আর ক্লান্তিতে প্রায় অচৈতন্যের মত উঠোনের পিদিম কখন ম্লান হয়ে গেছে , কখন দরজার ওপাশে আফসানার চিৎকারে থেমে গিয়ে সদ্যজাত শিশুর কান্নায় অনুরনিত হয়েছে আকাশ বাতাস , কখন বন্ধ দরজা খুলে গিয়ে দাই বুড়ি বেরিয়ে এসেছে উঠোনে , কখন চাঁদ হেলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে গাছগাছালির মাথায় রতন টেরই পেল না । সে যেন একটা ঘোরের মাঝে , স্বপ্নের মাঝে ডুবে ছিল । দীর্ঘ ক্লান্ত বিষন্ন স্বপ্ন । ক্লান্তিকর ,ভীষণ ক্লান্তিকর স্বপ্নের পরিসমাপ্তি ঘটলো বিয়ের রাতের সেই মূর্তিমতি বালিকা বধূটির দিকে চেয়ে । সেই মুখ , সেই চোখ , দীর্ঘ পল্লব ঘেরা ।কাজল কালো মায়াকাড়া ।স্থির দুটো চোখ । নির্জীব , নিষ্প্রাণ শরীর । বিয়ের প্রথম রাত্রির মতই জড়সড় । যেন পাথরে গড়া কোন মূর্তি । হয়ত এখনি মূর্তির মাঝে প্রানের সঞ্চার হবে । হয়ত সেই রাত্রির মতই অতি ক্ষীণ কোমল নীচু স্বরে বলে উঠবে-" আমার খিদে পেয়েছে " । রতন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো আফসানার পাংশুটে বিবর্ণ মুখের দিকে । সেখানে মৃত্যু যন্ত্রণার স্পষ্ট ছাঁপ তখনও বর্তমান । আফসানার বুকের পাশে দুটি ক্রন্দনরত মানবশিশু । জানালার ফাঁক গলে ম্লান চাদের প্রথম আলো পড়েছে ওদের বিস্মিত চোখে মুখে । রতন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো । উঠোনে কুয়ো পাড়ের নিম গাছটার তলায় গিয়ে দাড়ালো । রাত্রি তখন প্রায় শেষ। চাঁদ দূরের বাশবনের মাথায় ঢলে পড়েছে । দূর মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আযানের ধ্বনি । একটা দুটো পাখি জেগেছে । তাদের কিচির মিচির কানে আসছে । মৃদু বাতাসে ঘরের পেছনে আমের পাতা ঝড়িয়ে দিচ্ছে রাতভর জমে থাকা শিশির । শিশির নয় , যেন বুকের রক্ত ক্ষরণ । টুপ্ ,,,,,, টুপ্,,,,,,টুপ্,,,,,,,,টুপ্
চোখ বুজলে রতন আজও সে রাতের শিশির পতনের মৃদু মন্থর শব্দ শুনতে পায় । এত টাটকা আর সতেজ লাগে শব্দটা যেন এই মাত্র ঝরে গিয়ে তার অন্তরে সেই শব্দের রেশ বর্তমান ।সূক্ষ্ণ অনুভূতির আঙুলগুলো যেন সেই পতন মুহূর্তটিকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে ।কী বাস্তব ! কী জীবন্ত ! কী প্রাণবন্ত ! অথচ কাছে থেকেও যে স্পর্শের বাইরে । ধরতে গিয়েও যে হাতের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় । অনুভূতির মাঝেও যে অনুভবের বাইরে । এই অতৃপ্তি , এই না পাওয়ার বেদনাটুকুই হয়ত জিইয়ে রাখে তাকে । পাওয়ার চাইতে পাবার তীব্র আকাঙ্খাই তাকে বাঁচিয়ে রাখে যুগ যুগ ধরে । এই অপূর্ণতা , এই অসম্পূর্ণতা আছে বলেই হয়ত পথ চলতে ভাল লাগে , আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগে , ঘাসের ঘ্রাণ , মাটির গন্ধ , বৃষ্টির কোরাস ভাল লাগে । এই অপূর্ণাঙ্গ বোধ বেঁচে থাকার জন্য একটা কারণ , একটা উদ্দেশ্য , একটা নিমিত্ত খুঁজে পাওয়া । স্মৃতির ধূসর মিছিল থেকে বেরিয়ে আসতে রতনের ঝাপসা চোখ জোড়া ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগলো । সে কল তলায় সেভাবেই বসে আছে ।নিম গাছটায় ঠেস দিয়ে বসা । হাতে মাজনের ছাই । চৈত্রের রোদটা আরেকটু চড়ে বসেছে উঠোনে । খড়ের চালায় ঝুলছে সবুজ পাতার আড়ালে কচি সবুজ লাউ । বারান্দায় বাচ্চা দুটো কি নিয়ে যেন হৈ চৈ করছে । ওদের মুড়ির বাটি উপুড় হয়ে পড়েছে । দু তিনটা মুরগী ঠুকে ঠুকে খেয়ে যাচ্ছে বারান্দায় পড়ে থাকা মুড়ি । সেদিকে বাচ্চাদুটোর ভ্রুক্ষেপ নেই । তারা তাদের নিজের জগৎ নিয়েই ব্যস্ত । হঠাৎ খুব চেনা মিষ্টি সুরে , যেন অতীতের তীর হতে আনা সুর---খুব পরিচিত সুরে ভেসে এলো পাখির গান । এমন অপ্রত্যাশিত চেনা সুরে ধক্ করে উঠলো রতনের বুক । স্রোত বয়ে গেল বুকের উপর দিয়ে । আবার সেই মিষ্টি সুর ভেসে এলো । সেই চির চেনা । বারান্দায় বাচ্চা দুটোর হৈ চৈ বন্ধ হল । ওরা তাকালো নিম গাছটার ডালে । দেখলো একটা হলদে পাখি বসেছে সেখানে । সেটাই মিষ্টি সুরে ডাকছে । বাচ্চা দুটো খুশিতে লাফাতে লাফাতে উঠোনে নেমে এলো । রতনকে উদ্দেশ্য করে বলল- " বাবা দেখো কি সুন্দর হলদে পাখিটা ! " রতন চমকে গিয়ে মাথার উপর নিম গাছটায় তাকালো । হ্যাঁ , সেই পাখিটা । অনেক অনেক বছর আগে আরও একবার এসেছিল তাদের উঠোনে । বসেছিল নিমের সেই ডালে । বৈশাখের এমনি এক দিনে মিষ্টি সুরে ডেকেছিল । আলিঙ্গনরত আফসানা বাচ্চা দুটোর মতই সেদিন এই হলদে পাখিটা দেখে অভিভূত হয়েছিল । আনন্দ পেয়েছিল । কি অদ্ভূত প্রত্যাবর্তন । কি আশ্চর্য নিয়মে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে সব কিছুর । শুধু সেই মানুষটার পুনরাগমন নেই---সত্যি কি নেই ? না , আছে । টুকরো স্মৃতির মাঝে , অনুভূতির মাঝে , উষ্ণতার মাঝে সেই মানুষটিরও পুনরাবৃত্তি ঘটছে । চিরকালের অদৃশ্য চক্রে পুনরাবৃত্তি ঘটছে । বাচ্চা দুটোর একজন প্রশ্ন করলো ---" বাবা কি পাখি এটা ? " আফসানার সেই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি । শুধু প্রশ্নকর্তা বদলেছে । না , রতন পাখিটার নাম জানে না । আফসানাকে সেদিন পাখিটার নাম বলতে পারে নি । আজও পারল না । তাতে কি । বাচ্চাদুটোর এই আনন্দ টুকু , আফসানার সেদিনের সেই আনন্দ টুকু সেটাই কি যথেষ্ট নয় । মুহূর্তের এই আনন্দ টুকুই নিখুঁত , খাঁটি , নির্ভেজাল ।বাচ্চা দুটো খুশিতে হাত তালি দিতেই হলদে পাখিটা ডানা মেলে উড়ে পালালো রোদে । সেই সাথে ছড়িয়ে দিয়ে গেল চিরন্তন অনাবিল অম্লান আনন্দের পরশ । আনন্দ ছড়িয়ে পড়লো গাছের ডালে , ঘরের চালে , উঠোনের ভরপুর রোদে , বাচ্চা দুটোর মনে । পার্থিব জীবনে বেঁচে থাকার জন্য বোধ হয় এটুকুই সম্বল ।