মিষ্টি একটি গন্ধ সারা ঘরময় ম ম করছে......... অপরাজিতার নাসারন্ধ্রে ঘ্রাণটা পৌঁছুতেই কেমন যেন পুরো শরীরে শিহরণ খেলে গেলো। পরিবেশটা আজ স্বর্গীয় অনুভূতিতে অন্য এক রঙ ধারণ করেছে, সেই রঙের নেই কোন নাম, কল্পনাতেই যার অস্তিত্ব। এমন কল্পনার রঙ অপরাজিতা ব্যতীত কেউ বুঝতে পারে না বৈকি।
অপরাজিতা, মিষ্টি একটি মেয়ে্, চঞ্চল তার চোখ; উৎসুক তার দৃষ্টি, নিস্তব্ধতা তার অনন্য বৈচিত্র্য। কেউ তার বয়স জিজ্ঞেস করলেই এড়িয়ে যায় সে। সে ভাবে বয়স বললে সবাই তাকে বুড়ি ভাববে... যতসব অদ্ভুত ভাবনা তার ছোট মাথায় খেলা করে, অবসরে সে তার বন্ধুদের সাথেই দিনটা কাঁটায়... কোন বন্ধু গান শুনায়, কেউবা মড় মড় আওয়াজ করে আনন্দ দেয় আবার কেউ বা ছায়া দিয়ে তাকে স্বস্তি দেয়। কিন্তু একটাই সমস্যা!!!!! তার বন্ধুগুলো কেউ তার মতো প্রাণ খুলে মনের কথাগুলো বলতে পারে না, সে ই শুধু বলে বেড়ায় আর বন্ধুগুলো কেবল শ্রোতা। অপরাজিতার ও ইচ্ছে হয়, তার এই বাকশক্তিহীন বন্ধুগুলোর কথা শুনতে, তাদের হাসি কান্নার গল্পগুলোকে স্মৃতি করে রাখতে। কিন্তু সে বুঝতে পারে কখন তার বন্ধুগুলো কষ্ট পায় আবার কখন বা আনন্দে থাকে। যখন কোন বন্ধু কিচিরমিচির করে উঠে তখনই সে ধরে নেয় সে আজ আনন্দে আছে, আবার যখন কোন বন্ধুর গা বেয়ে পানি ঝরে, তখন সে বুঝে নেয় তার বন্ধুটি কষ্টে আছে। এমন করেই তার দিনগুলো কাটছে... বেশ ভালোই কাটছে বলা চলে...... মিষ্টি ঘ্রাণের রহস্য উদ্ঘাটনে সে তার মায়ের শরণাপন্ন হল।
“ মা, ও মা.....................শুনছো????”
“ হ্যাঁ মা, বল......... কি হয়েছে??”
“ আচ্ছা মা, আজ সকাল থেকে কেমন যেন একটি মিষ্টি গন্ধ বেশ নাকে লাগছে...... তুমি কি টের পেয়েছ??
“ হ্যাঁ রে, পেলাম তো... কেন ?? কি হয়েছে??”
“ আচ্ছা, গন্ধটা কিসের???”
“ও...... এই কথা!!! ওটা তো আমাদের পাশের বাগানের হলুদ ফুলের গন্ধ...”
“ হলুদ ফুল!!!!!! এতো ফুলের নাম শিখলাম, কই এমন ফুলের নাম তো শিখি নি???”
“ আরে পাগলি... ফুলটা হলুদ গাছে বছরে একবার ফুটে, সচরাচর বর্ষাকালে এটি ফোটে বেশি”
“ একটা কথা বল তো মা, ঐ ফুলটার নাম শুনিনি কেন??”
“ সেটার উত্তর কিভাবে দি, বল তো মা??? এখন তো জানলি... তাই না??”
মা এর উত্তর শুনে অপরাজিতা কিছুটা অবাক হলেও সত্যিই তো... এখন তো ফুলের নামটা শুনেছে সে।। এখন ফুলটাকে তার দেখতেই হবে। প্রকৃতি যেখানে তার আত্মায় মিলেমিশে একাকার, এমন ফুলের নাম শুনে সে দেখবে না!!! তা কি কখনও হয়?? কিন্তু কিভাবে সে ঐ ফুলটাকে দেখতে পাবে?? ফুলটা যে পাশের প্রতিবেশিদের বাগানের!!! কিন্তু তার দেখা লাগবেই... কেমন সে দেখতে।। কি তার রূপ??? এতো সুবাস কিভাবে ছড়ায় সে!!! তাই সে মনে মনে চিন্তা করলো, আজ সে তার বাবাকে এই আবদারটা করবে।। গত বছর ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করায় বাবা তাকে উপহার দিতে চেয়েছিল... কিন্তু অপরাজিতা অত্যন্ত বিজ্ঞের ন্যায় বলেছিল ,তার যখন লাগবে তখন সে চেয়ে নিবে। আজ সময় হয়েছে তার উপহার চেয়ে নেয়ার............... সন্ধ্যে হয়ে এলো বলে... কিছুক্ষণ পর অপরাজিতার বাবা বিনোদবাবু বাসায় প্রবেশ করলেন। নিত্যদিনের মতো তার পরীকে এসে খুঁজছেন ... এসেই ডাক দিলেন, “আমার মা-মনি কই, আমার হলুদ পরীকে দেখছি না কেন???, ও মা... কই তুমি??” অপরাজিতাও বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আর চুপটি করে বাবার কাঁধে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে রাখে। বাবা-মেয়ের এই অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখে দু’জন বোধহয় মুচকি হেসে উঠেন... প্রথমজন অপরাজিতার মা আর অপরজন উপরে যিনি বসে এই অপ্রকাশিত অনুভূতি প্রত্যক্ষ করেন, হয়তো বা তিনিও আজ খুশি এমন অনুভূতি মানুষ নামক প্রাণীর মধ্যে সৃষ্টি করতে পেরে।। এই অনাবিল ভালো লাগা বেঁচে থাকুক অনন্তকাল। বিনোদবাবু বলে উঠলেন, “ মা-মনি দেখ, কি এনেছি তোমার জন্য?? তোমার প্রিয় চকলেট এনেছি, বেলুন এনেছি...”
অপরাজিতা বলে উঠল, “ বাবা, ও বাবা, আমার কিছু চাই না... একটি গিফট চাই... দাও না, প্লিজ!!!”
“ হুম , তোমার তো একটা গিফট পাওনা ছিল ,মা... বল ...”
অপরাজিতার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে... “ বাবা, পাশের বাগানের হলুদ ফুলগুলোকে দেখবো, কেমন তাদের রঙ, গন্ধ ... তুমি সুযোগ করে দাও না!!” বিনোদবাবু মেয়ের আবদার শুনে অট্টহাসি দিলেন। তিনি জানেন মেয়ে তার প্রকৃতিকে খুবই ভালোবাসে। কেঁদেকেটে সে কত রাত গুজরান করে বাবার বুকে ঘুমিয়ে পড়েছে, তার ইয়ত্তা নেই... তাই ছোট একটি বাগান ও করে দিয়েছেন পাশের বারান্দায়। বাগানের সেই ফুলগুলোকে দেখে তার কি আনন্দ!!! “ ও!! এই কথা!!! অবশ্যই... কেন নিয়ে যাবো না???” অপরাজিতা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলছে, “ আমার লক্ষ্মী বাবা!!! তুমি কিন্তু হাসবে না, বলে দিলাম” বলেই সে বাবার বুকে চুপটি করে মুখ লুকলো...
পরেরদিন খুব ভোর সকালে বিনোদবাবু ঘুম হতে উঠে তার হলুদ পরীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে গেলেন। কিন্তু সূর্যের রক্তিম মিষ্টি আভা যখন তার পরীর চোখে মুখে ঠিকরে পড়ছে, পুরো ঘরময় যেন এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য ভর করেছে। বিনোদবাবু যে কাজের জন্য এসেছিলেন, তা ভুলে তার হলুদ পরীর মায়ের বুকে ঘুম জড়ানো দৃশ্য দেখে খানিকটা থমকে গেলেন, মনে মনে হয়তো বলছিলেন, “ঈশ!!! এই মুহূর্ত যদি কয়েক কল্প ধরে স্থির করে রাখা যেত!!!” কয়েক সেকেন্ডের কল্পনা হতে বাস্তবে ফিরে এসেই তিনি আস্তে করে মাথায় হাত বুলিয়ে অপরাজিতাকে ডাকতে লাগলেন, “ মা-মনি, উঠো তো......আজ না তুমি হলুদ ফুল দেখতে যাবে!!! উঠো বাবুনি, না হলে সূর্যের মিষ্টি রোদটা যে চলে যাবে, আর তোমার ও ফুলটা দেখতে ভালো লাগবে না...” বিনোদ বাবুর এহেন কথা বলার কারণ, মেয়ে তার ভোরের সূর্যের প্রথম আলোয় ফুল দেখতে ভালোবাসে... ক্ষণিক সময় পর, বাবার আদুরে ডাক শুনে আড়মোড়া ভেঙে বাবার হলুদ পরী উঠলো......চোখ কচলাতে কচলাতে সে ঘুমকে তাড়ানোর বড্ড চেষ্টা করছে, কিছুটা পারলেও পুরোটা পারেনি বটে। বিছানা হতেই দু হাত সমান্তরালে তার বাবার দিকে এগিয়ে দিলো। বিনোদবাবু তার আধো ঘুমন্ত পরীর কাণ্ড দেখে মুচকি হেসে উঠলেন... দেরি না করে মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন। মেয়ে বাবার কাঁধে মাথা রেখেই আবার ঘুমোচ্ছে। বিনোদবাবু মেয়ের চোখে মুখে জল ছিটিয়ে মুখটা তোয়াল দিয়ে মুছে দিলেন। এখন অনেকটাই বিতাড়িত হয়েছে তার পরীর ঘুম। বিনোদবাবু গায়ে শার্ট একটা জড়িয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে পাশের বাড়ীর দিকে রওনা দিলেন। অপরাজিতার চোখে মুখে এক চাপা উত্তেজনা কাজ করছে, এতো আনন্দ সে আগে অনেকবার পেয়েছে... তাও এবারের আনন্দটা কেন যেন তার মনে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। দরজায় টোকা দিতেই বাড়ির কর্তা বেরিয়ে এলেন আর বিনোদবাবু মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে পুরো ঘটনা বললেন কায়সার সাহেব কে। তিনি তো হাসতে হাসতেই শেষ...... তিনি তার কর্ত্রীকে ডেকে বললেন ব্যপারটা। তখন অপরাজিতাকে কাছে ডেকে কর্ত্রী নিজেই তাকে নিয়ে গেলেন বাগানে, পিছু পিছু বিনোদবাবু আর কায়সার সাহেব ও গেলেন... অপরাজিতা সেই ফুলের কাছে যেতেই এক অকৃত্রিম সুবাস তার পুরো শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ তুলছে, ফুলটার কাছে গিয়ে সে কি যেন পরখ করছে আর রূপ, রস, গন্ধগুলোকে কাছে পাওয়ার এক নিরন্তর প্রচেষ্টা করছে। ফুলটাকে সে আদর করতে লাগলো আর বিনয়ের সুরে বাড়ির কর্ত্রীকে বলছে সে, “আন্টি, আমাকে প্রতিদিন ভোরে এই ফুলটা দেখতে দিবে?? আমি না ফুলটাকে খুব পছন্দ করে ফেলেছি...” কর্ত্রী ঈষৎ হাসি হেসে বললেন, “ ধুর পাগলি, এটার জন্য এভাবে বলা লাগে!!! চলে আসবি তোর যখন মন চায়, ঠিক আছে??” অপরাজিতার মুখে বিশ্বজয়ের হাসি, সেই আনন্দে অনেকটা নাচতে নাচতে বাবার সাথে সে বাসায় গেলো আর মন খুলে আধো আধো বোলে গাইছে সে , “ আহা!!! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে!!!!” হলুদ পরীর হলুদ ফুল প্রীতি দেখে বাবা-মা দু’জনই কেবল হাসে আর উপরের দিকে তাকিয়ে মনের অজান্তেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আর কৃতজ্ঞতার কারণ??? তাদের দু’জনের কাছেই তোলা থাক। জীবসত্ত্বা আর সর্বময় সত্ত্বার যে নির্বাক কথোপকথন হয়, তা বোঝার ক্ষমতা এই ইহকুলে কোন প্রাণীর আছে বলে বোধ হয় না।প্রতিদিন অপরাজিতা তার প্রিয় বন্ধুটির সাথে কথা বলে, গন্ধ নেয়, রূপ দেখে বারংবার মুগ্ধ হয় আর আনমনে তার বন্ধুটির সাথে সারাদিনে জমে থাকা কথা বিনিময় করে
“ হলুদ ফুল, জানো?? প্রথম দেখাতেই আমি না তোমার প্রেমে পড়ে গেছি, বাবা আমাকে হলুদ পরী ডাকে, তোমার গায়ের রঙ ও হলুদ, কি মিল আমাদের, তাই না!!!! আমাকে সবাই খারাপ বলে, আমি নাকি কারো সাথে কথা বলি না, সব সময় চুপচাপ থাকি। আচ্ছা তুমিই বল, তোমরা ছাড়া আমার কারো সাথেই কথা বলতে ভালো লাগে না, কেন যেন মনে হয় আমাকে কেউ বোঝে না, আমার কথাগুলো কেউ শুনে না। মাঝেমধ্যে নিজেকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করি, সবার সাথে প্রাণ খুলে হাসি-আনন্দে কথা বলতে চাই। কিন্তু পারি না...... তাই তোমাদের সাথেই ভাব করি। এরপর ও কত অভিযোগ, অনুযোগ আমার উপর!!!! থাক সে সব কথা... আমার ব্যপারে তো অনেক কিছুই বলে ফেললাম, এখন বল, তুমি কেমন আছো?? ...... ওহ... ভুলেই গিয়েছিলাম... তুমি তো বলতেই পারো না...... আমার জন্য সেটাই ভালো। তোমার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে বেশ ভালোই আছো... কত সুন্দর করে চুপটি করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছো সেই এক জায়গাতেই... এই বাগানের বুকে শুধু মিষ্টি সুবাসই ছড়িয়ে যাচ্ছ, দেখতে হচ্ছে না কোন দুঃখ, কষ্ট, রাগ, অভিমান... আর দেখলেও বা তোমার কি!!!! দেখেও সেই দাঁড়িয়েই থাকবে আর সুবাস ছড়াবে।। নাহ, মন্দ বলা চলে না... আমার কষ্ট হলে সেই তোমার কাছেই ছুটে আসবো, আর যত রাগ, অভিমান, কান্না তোমাকে সাথে নিয়েই ভুলে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাবো। তোমার আর আমার মধ্যে পার্থক্য কি জানো??“ বিরক্তিবোধ” নামক কোন শব্দই তোমার অভিধানে নেই। আমি খারাপই বলি আর ভালোই বলি, সেই মাথা ঝুঁকিয়ে খালি ইশারা করে জানান দিবে তুমি শুনছো... আচ্ছা আজ যাই তাহলে।। মা আবার বকবে... কাল কথা হবে...কেমন??? ভালো থেকো”
এই হল অপরাজিতা...... তার অব্যক্ত কথাগুলো সে অবলীলায় বলতে থাকে তার অবোধ বন্ধুদের সাথে।। এভাবে দিন যায়, রাত আসে। হলুদ পরী তার কাছের বন্ধুটির সাথে প্রতিদিন ভাব বিনিময় করে ...... নানা রঙের গল্প শুনায়, তার স্বপ্নগুলোকে কল্পনায় পূর্ণতা দেয়... আর হলুদ ফুল!!! সে বেচারা শ্রোতা হয়ে তার মানুষ নামক বন্ধুটির গল্প শুনে... সময়ের চাকায় আজ এক বছর পূর্ণ হতে চলল... অপরাজিতার খুব কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছে এই হলুদ ফুল...
একদিন ভোরে ভোরে অপরাজিতা তার বন্ধুটির সাথে দেখা করতে আসে।। দরজা খুলেই কায়সার সাহেবের চেহারা দেখে সে বুঝতে পারে, এতো সকালে বিরক্ত করার জন্য তিনি বেশ রাগান্বিত হয়ে আছেন।। সে ভয়ে ভয়ে উনাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো বাগানে...যথারীতি তার বন্ধুটির কাছে যায় আর বলতে থাকে...... “ বন্ধু, আজ একটু তাড়াতাড়িই চলে আসলাম... আমি মাসির বাড়ীতে যাচ্ছি। বেশ কয়েকদিন দেখা হবে না।। তাই আগেই চলে আসলাম। আজ তোমার এতো বেশি সময় নষ্ট করবো না। শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়েই চলে যাবো... বেশ কিছুদিন একটা প্রশ্ন আমাকে বেশ পীড়া দিচ্ছিল, এতগুলো ফুল থাকতে কেন তোমাকেই আমার এতো পছন্দ হল, শুনলে হয়তো তোমার অবাক লাগবে আমি কিন্তু তোমার নাম কখনই শুনি নি বা শিখি নি... সেটার উত্তর আজ পেয়েছি।মা বলে, তুমি নাকি বছরে একবার এই পৃথিবীর বুকে আস, আর এতটাই দুর্লভ তুমি তোমার দেখা পাওয়া টা সত্যি দুষ্কর। তাই হয়তো বা তোমার খোঁজ কেউ রাখে না কিংবা আমার মতো অন্য কেউও তোমাকে চিনে না। আজ বুঝতে পারলাম ভালো লাগা আর ভালোবাসার মধ্যে এক বিস্তর ব্যবধান আছে। তোমার বিশেষত্ব হল, সবার আড়ালে থেকে অগোচরে তুমি গন্ধ বিলিয়ে যাও আর একটি সময় ব্যবধানে আবার হারিয়ে যাবে। কিন্তু নামটি কেউ মনে রাখবে না তোমার, হয়তো বা এটাও ভুলে যাবে দিনের আলোয়, রাতের চন্দ্রালোকে এক ছন্দময় কাব্য ছিলে তুমি। আমরা বড্ড নিষ্ঠুর, সেটা কি তুমি টের পাচ্ছ?? আর দেখ তোমার গাছটাও খুব অপ্রতুল নয়, কিন্তু কাজটি হল লাখ টাকা দামের সমান। বেশ অবাক হচ্ছ, তাই না!!! মন ভালো করে দেয়ার কাজটা তো তুমি নিমিষেই করো, তাইতো বারে বারে তোমার কাছেই ছুটে আসি, কারো মনকে ভালো রাখা সেটি কি চাট্টিখানি কথা!!!!!! তোমার মায়ার প্রেমে পড়ে গেছি গো......জানি না, তোমায় ছাড়া এই কয়দিন কিভাবে থাকবো!!! আমায় ছাড়া তুমি থাকতে পারবে??? কিছুত বল...... এভাবে নির্বাক হয়ে আমায় শুধু শুনেই গেলে......... ধুরর ভালো লাগে না!!!!” অশ্রুসজল চোখে মুখ সরিয়ে নিতেই অপরাজিতা শুনতে পেলো দু-এক ফোঁটা জলের শব্দ। ফিরে দেখতেই সে স্তম্ভিত হয়ে গেলো...... তারপর........................
আজ প্রায় এক সপ্তাহ গত হলো...... অপরাজিতা মাসীর বাড়ি থেকে ফিরে এসেই কাপড় চোপড় না খুলে তার হলুদ ফুলকে দেখার জন্য দিল ছুট। বেশ জোরেশোরে প্রতিবেশির দরজায় কড়া নাড়ছে সে...... আর তার ইতস্তত পায়চারি। মিনিট পাঁচেক পর দরজা খুলতেই সে এদিক ওদিক না দেখে দিলো একটা ভোঁদৌড়...... কিন্তু মিসেস কায়সার কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন। সে সময় দিলে তো!!! অপরাজিতা হলুদ গাছের কাছে পৌঁছুতেই কিছুটা পর্যবেক্ষণ করে ধপ করে মাটিতেই বসে পড়লো............ সে কথা বলার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছে............ শুধু লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস এ বলে বেড়াচ্ছে “............হ......লু......দ...ফু......ল.........ল.........ল............” বাগানের আশেপাশে গগনবিদারী চিৎকার শুধু প্রতিধ্বনি হয়েই ফিরে আসছে.........বিনোদবাবু মেয়ের আর্তনাদ শুনে দ্রুত ছুটে আসলেন... দেখলেন মেয়ে তার কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে প্রায় লুটিয়ে পড়েছে......ব্যপারটা দেখতে তিনি যখন ছুটে গেলেন হলুদ গাছটির কাছে, তখনি দেখলেন তার মেয়ের প্রিয় হলুদ ফুলগুলো আর নেই... পরিস্থিতি বুঝতে পেরে তিনি মেয়েকে কোলে নিয়ে বাসায় চলে আসলেন... মেয়ে রাগে,ক্ষোভে কান্নাজরিত কণ্ঠে বলছে, “ বাবা, ওরা আমার হলুদফুল কে মেরে ফেলেছে, আমার বন্ধুগুলকে মেরে ফেলেছে...... ওরা ভালো না......... খুব পচা...” আবার সেই কান্না ... “ আমি এখন কার সাথে কথা বলবো, সুখ-দুঃখগুলো কার সাথে ভাগাভাগি করবো??????????”
তার কান্না দেখে প্রকৃতিও কেঁদেছিল কিনা তা জানি নে তবে এটা সত্যি উপরে যিনি বসে আছেন তাঁর মনও হয়তোবা প্রকৃতির আদলে বেড়ে উঠা এই মানবশিশুর জন্য কিঞ্চিৎ হলেও কেঁদে উঠেছিলো আর নীরবে ধিক্কার দিচ্ছিলেন মানুষ নামক প্রাণীটিকে, একটাই শব্দই হয়তোবা উনার মুখ হতে ধ্বনিত হচ্ছে, “ ছি!!!! ছি!!!!!”......
ছয় মাস গত হয়ে গেলো। প্রকৃতি তার আপন নিয়মে সাজাচ্ছে এই ধরিত্রীকে, পাখিগুলো গাইছে গান, শুকনো পাতাগুলোও মড় মড় আওয়াজে জানান দিচ্ছে তাদের অস্তিত্ব, নদীর স্রোতধারা বয়ে চলেছে আপন গতিতে, ফুলগুলো ফুটছে আর গন্ধ বিলোচ্ছে তাদের সময় করে...... সবাই তাদের নিজ নিজ গতিতে এগিয়ে চলেছে......কিন্তু অপরাজিতা??????? শোনা যায়, বিগত ছয় মাস ধরে তাকে বাড়ির বাইরে বেরুতে দেখা যায় নি।। নীরবে নিভৃতে ঘরের কোণে বসে সে আজো সময়ে অসময়ে কাঁদে আর বিড় বিড় করে বলে উঠে,
“আমি করেছি কি কোন ভুল??
ভেবে তো পাই না কোন কূল;
ও আমার হলদে ফুল” ;
কথিত আছে কায়সার সাহেবের বাড়ির উঠোনের বাগানে হলুদ ফুল আর কখনো ফোটে নি........... সত্যি!!!! প্রকৃতি পারেও বটে!!!!!!