যদি কখনও রাজশাহী না গিয়ে থাকেন তো শহরে নেমেই একটা ধাক্কা খাবেন। পরিচ্ছন্ন রাস্তা, কোলাহল তেমন নেই একটা, প্রশস্ত বেশ। যেহেতু পূর্বে যাননি কোন দোকানি বা রিকশাওয়ালার কাছ থেকে আপনার ঠিকানাটা জেনে নিতে হবে। তাকে প্রশ্ন করেই আরেক ধাক্কা। প্রমিত বাঙলা ভাষা বাংলাদেশের নয়, পশ্চিমবঙ্গের ভাষা, পণ্ডিতেরা এই কথা বলে বলে আপনার কান পাকিয়ে দিয়েছে। আপনি এতক্ষণে রিক্সাওয়ালার সামনে ভদ্র সাজার আপ্রাণ চেষ্টা-রত। চোখটা বড় করলে দেখবেন, পশ্চিমবঙ্গের সমান্তরালে বাংলাদেশের বিশাল একটা অঞ্চলের ভাষা প্রমিত বাংলার অনেক কাছাকাছি।
আপনি এখানে পৌঁছার আগেই শিবিরের রগ কাটার কল্যাণে জেনে গেছেন রাজশাহী মৌলবাদের আখড়া। আসলে তা নয় এখানকার মানুষগুলো যথেষ্ট প্রগতিশীল, কেন যে মোল্লাদের এত লম্ফঝম্ফ! শহর থেকে সামান্য হাঁটলেই পদ্মা এসে সামনে দাঁড়াবে, মনটা ভাল হয়ে যায়। তবে আজকের মতো পদ্মা থাক আমরা আপাতত রেলস্টেশনে ঢুকছি। যথারীতি পরিষ্কার, সুপরিসর, যারা দেশের বিভিন্ন স্টেশন ঘুরেছেন তারা একটু অবাকই হবেন। একটু বেশিই সুন্দর এবং মানুষগুলোও!
ওয়েটিং রুমে চল্লিশ ছুঁইছুঁই এক যাত্রী পাশে ব্যাগ নিয়ে পরিবেশ মনোরম করে রেখেছে। অবশ্যই সুন্দরী আর মার্জিত। এই বয়সে অনেকেই এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব অর্জন করে ফেলে। আকাশী সিল্কের শাড়ি জড়িয়ে—যেন-বা আকাশ হতে নেমে এসেছে মনে হতেই পারে। এদিক সেদিক দু-চারজন বসে ঝিমচ্ছে, দুটো অল্প বয়স্ক ছেলে চটুল গান শুনছে ফোনে। দুটো বাচ্চার সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটি দীর্ঘকায়, লাগেজ টেনে একজন মহিলাসহ ওয়েটিং রুমে ঢুকল। সুন্দরীকে দেখে থমকে দাঁড়াল। আর সুন্দরীরা যা করে একটু তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিল। হয়ত তারা মনে করে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সৌন্দর্য ক্ষয়ে যায়। থমকে দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ থাকা যায়, সঙ্গে যদি মহিলা থাকে—বড়ই বিব্রতকর! আমি অবশ্য পথচারী সুন্দরীদের দেখে সৌন্দর্য নিয়ে আমারটির সঙ্গে আলোচনায় মশগুল হই। সে রাগ করে না, কখনও খামচি দেয় না, এমন কি কটমট করে তাকায় না পর্যন্ত। হয়ত তার মাথা মোটা, নয়ত ভাবে—আমি শিল্প-সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করছি। সে যাক এরা ইতোমধ্যে চারটি চেয়ার দখল করে ফেলেছে। ভদ্রলোক আড়চোখে সুন্দরীকে দেখার চেষ্টা করছে বুঝতে পেরে সুন্দরী ব্যাগের চেন খুলে একটা ম্যাগাজিন বের করল।
হঠাৎ ফোন... কার সঙ্গে কথা বলল তা আমাদের না জানলেও চলে। কথগুলো ছোটই—চিন্তা কোরো না, কোনও সমস্যা নেই, রাত পৌনে এগারটায় ছাড়বে। ম্যাগাজিনে ডুব দেয়ায় যেন-বা লোকটা সুন্দরীকে শুনিয়ে বলল, 'তোমরা থাকো, একটু চা-সিগারেট টেনে আসি।'
লোকটি সিগারেট ধরিয়ে একটু সামনে গিয়ে প্লাটফরমের পাকা বেঞ্চে বসে ধোঁয়া ছাড়ল আকাশের দিকে। তাই আপাতত প্রেমটাও জমে ওঠার সম্ভাবনা নেই। হয়ত ভাবছে, ট্রেনে সামনাসামনি সিট হলে কীভাবে ভাব জমাবে সেই কথা। ততক্ষণ না হয় আমরা কিছু খুচরো গল্পে মাতি—বেত না আসা পর্যন্ত কানমলা চলুক। এতে আমাদের মূল ঘটনা উপলব্ধি করতে সুবিধে হবে।
মাত্র এসএসসি শেষ করে নানাবাড়ি বেড়াতে গেছে চন্দন—সালটা না জানলেও ক্ষতি নেই। পাশের বাড়িতে সন্ধ্যাও এসেছে। সেও পরীক্ষা দিয়েছে। দুজনের নানা আপন চাচাতো ভাই। তাই ছোট বেলায় বিভিন্ন ছুটিতে দেখা হত। আবার নতুন করে পরিচয় হতে সময় লাগল না।
সেবার রেজাল্টের আগ দিয়ে শুরু হল বন্যা, আর প্রায়ই বৃষ্টি। এদিক সেদিক বেড়ানো চন্দনের বন্ধ হয়ে গল। কাজের মধ্যে চন্দন যায় সন্ধ্যার নানার উঠোনে গল্প করতে, নয়ত সন্ধ্যা আসে চন্দনের কাছে। তিন দিনের টানা বৃষ্টিতে ছোট ভাইবোনদের নিয়ে ওরা ক্যারাম খেলে অথবা দাবা খেলে কাটাল। দাবা খেলতে সন্ধ্যা যখন চাল দেয়া নিয়ে ভাবতে থাকে, চন্দন থাকে এক দৃষ্টিতে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে। সন্ধ্যা তা বুঝতে পারে সেদিকে না তাকিয়েও। এভাবেই চলছিল। এক দিন চন্দনের বড় মামার ঘরের বারান্দার চালে মই দিয়ে উঠল পেয়রা খেতে। ঝিরঝির বৃষ্টি তখনও। চন্দনের দেখাদেখি সন্ধ্যাও মই বেয়ে উঠতে গেল, কিন্তু এক পা চালে দিয়ে অন্য পা তুলতে পারছিল না। সন্ধ্যা হঠাৎ হাত বাড়িয়ে বলল—একটু ধরো-না! চন্দন হাত ধরে টেনে তুলল। একটু হাতের ছোঁয়ায় চন্দনের ভেতরে ভূমিকম্প ঘটে গেল। অভূতপূর্ব এক শিহরণ ছড়িয়ে গেল সমস্ত শরীরে। চন্দনের ঘোর কাটাতে একটু সময় গেল। ভাবল একটু হাত ধরাতেই এত ভাললাগা, এত আনন্দ! সন্ধ্যা বলে উঠল, ‘অনেক পেয়ারা!’
‘বৃষ্টির জন্য কেউ পারেনি তো...’ নিজের কম্পিত কণ্ঠে নিজেই ভয় পেয়ে গেল। চন্দন শুধু সন্ধ্যাকেই ভাবতে লাগল। এদিকে সন্ধ্যা নানা দুষ্টুমির কথা বলতে শুরু করেছে আর পেয়ারা খেয়েই যাচ্ছে। একটা পেয়ারা ছিঁড়ে চন্দনকে দিল সন্ধ্যা। চন্দন অর্ধেক খেয়ে সন্ধ্যার হাতে দিয়ে বলল, ‘ধরো ঐ ডাঁসাটা পারছি দেখো...’
সন্ধ্যা অর্ধেক পেয়ারাটি মজা করে খেয়ে চলেছে... সারা রাত চন্দনের ঘুম হল না।
দুজন বুঝতে পারল নিজেদের অজান্তেই ওর জড়িয় পড়েছে। একদিন ক্যারাম খেলতে চন্দন দুষ্টুমি করে সন্ধ্যার গালে বরিক পাউডার লাগিয়ে দিল। সে ওভাবেই রইল। চন্দন ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, ‘কেউ দেখে ফেলবে।’
‘দেখুক!’
চন্দন ইতস্তত করতে লাগল দেখে সন্ধ্যা গাল এগিয়ে বলল, ‘তাহলে মুছিয়ে দা-ও-ও?’
চন্দন ওড়নার আঁচল দিয়ে মুছে দিল। আর চারদিক তাকাতে থাকল। সন্ধ্যা হেসে বলল, ‘ঠিক আছে , শিক্ষা হয়েছে তো?’
দুই দিন পরের কথা—সন্ধ্যা ওর মামাতো পুঁচকে ভাইকে কোরে নিয়ে। চন্দন এটা-সেটা বলছিল আর পুঁচকেটাকে আদর করছিল। হঠাৎ কী মনে করে পিচ্চিটাকে চুমু দিতে গিয়ে সন্ধ্যাকে একটা চুমু দিয়ে দিল। ওর বুকের মধ্যে তখন ইট ভাঙ্গার শব্দ। দৌড়ে চলে গেল সেখান থেকে।
চন্দন ভাবল সন্ধ্যা আর কথা বলবে না। কিন্তু বিকেলে সন্ধ্যা চন্দনের ওখানে গেল।
‘কী করছ চন্দন?’
চন্দন কিছু না বলে এগিয়ে এসে সন্ধ্যার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। শেষে বলল, ‘ভেবেছিলাম আর কথাই বলবে না!’
‘কথা না বলার কী আছে, তবে সীমানা অতিক্রম কোরো না।’
চন্দন বাধ্য ছেলের মতো মাথা কাত করর।
চন্দন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করল। সন্ধ্যা ইডেন থেকে। যোগাযোগ তেমন ছিল না। মাঝেমাঝে শুধু চিঠি।
চন্দন চাকরি নিয়ে রংপুরে। সন্ধ্যার একটা চাকরি হল, পছন্দ না হওয়ায় জয়ের করল না। ঢাকায় থেকে চেষ্টা করতে লাগল। দুই পরিবারই ওরা একে অপরকে পছন্দ করে। এক সময় তারা ওদের বিয়ে ঠিক করে ফেলল। চন্দনের পরিবারই বেশি তাড়া দিচ্ছিল, চাকরি বিয়ের পরেও খুঁজতে পারবে।
দুজনের মধ্যে যোগাযোগ হয়, বিয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়। বাল্যবন্ধুকে জীবনসঙ্গী করতে পারবে এটা মনে হতেই ওরা স্মৃতি-কাতর হয়। সন্ধ্যা তার ভালবাসার মানুষটাকে একটা ছোট্ট চমক দেয়ার উদ্দেশ্যে কাউকে কিছু না বলে রংপুরের দিকে পা বাড়ায়। তখনও বঙ্গবন্ধু সেতু হয়নি। যমুনা পার হবার পর বগুড়ায় প্রচণ্ড গণ্ডগোল। বাস চলাচল বন্ধ, সামনে যাবে না। কেউ কেউ বুদ্ধি দিল—ট্রেনে যান।
ঈশ্বরদী পৌঁছার পর ট্রেন আর ছাড়ে না। খবর এল রাস্তায় রেললাইন তুলে ফেলেছে। সামনে দুদিন হরতাল। সন্ধ্যার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।
এক সময় ট্রেন ছাড়ল, কিন্তু সান্তাহার পৌঁছে ফের ট্রেন থামিয়ে বসে রইল। কোনও সঠিক উত্তর নেই, একেক জন একেক কথা বলে। সন্ধ্যা ভেবে রেখেছিল সন্ধে নাগাদ সে রংপুর পৌঁছে যেতে পারবে, চন্দনকে একটা চমক দেয়া যাবে। পরিকল্পনা ছিল চন্দনকে নিয়ে ওর বড় বোনের বাসা দিনাজপুর বেড়াতে যাবে। কিন্তু সব গরবর হয়ে গেল।
রাত হওয়াতে অনেকেই ট্রেন ছেঁড়ে চলে গেছে। যারা আছে প্রায়ই ঘুমে, শুধু সন্ধ্যার চোখে ঘুম নেই। রাত চারটার দিকে ট্রেন রংপুরের দিকে চলতে লাগল। সন্ধ্যা হাঁফ ছাড়ল।
অন্যদিকে সন্ধ্যা কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে গেছে সেটা রাষ্ট্র হতে সময় লাগল না। আত্মীয় বলে সেচা ঘটল আরও দ্রুত। চন্দনকে ফোন করে জেনেছে, সে কিছু জানে কি না? কোনও খবর নেই! দুই পরিবারে পলো বাওয়া খালের তোলপাড়। চন্দন অফিসে বসে ঘামে ভিজছে...
সকালে রংপুর নেমেই প্রথমে চন্দনকে ফোন করল সন্ধ্যা। ‘তোমার অফিস কোন... কোন পথে সুবিধে... স্টেশন হতে... আমি এখন ...’
‘হয়েছে আর অভিনয় করতে হবে না, যে মেয়ে বাইরে রাত কাটায়, তার সঙ্গে আমার কোনও কথা থাকতে পারে না, কেনও সম্পর্ক নেই!’
‘তুমি এসব কী বলছ!’
‘আর ভাল-মানুষী দেখাতে হবে না—আমি সব জেনেছি—দুশ্চরিত্র নষ্টা মেয়ে কোথাকার!’ ঠাস করে ফোন রেখে দিল চন্দন।
সন্ধ্যা দিনাজপুর চলে গেল। প্রথমে বড় বোনের গালাগাল—গলাধাক্কা বাকি ছিল। কোনও কথাই শুনতে চাইছিল না, সন্ধ্যা চিৎকার করে আসল ঘটনা বলল। ট্রেনের টিকেট বোনের চোখের সামনে দু হাতে ধরে বলল, ‘আমার কোনও কথাই তুমি শুনছো না কেন? আমি কী এতই...’ আর বলতে পারল না কিছু, হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল সন্ধ্যা।
বড় বোন শেষটায় মিটমাট করার উদ্যোগ নিতে চাইল কিন্তু বাধ সাধল সন্ধ্যা। ‘যে ভালবাসায় বিশ্বাস এত ঠুনকো তা জোড়া দেয়ার দরকার নেই।’
ট্রেনের সময় হয়ে এসেছে ভদ্রলোকটির। ওয়েটিং রুম থেকে বের হতে গিয়ে পেছন ফিরে তাকাল। সেই সুন্দরীও তাকিয়ে আছে, পরস্পরের দৃষ্টি একে অপরকে বল্লমের মত বিদ্ধ করল—ছাড়ানো যায় না! সুন্দরীটি বলতে চাইল, ‘তোমার বাচ্চা দুটি দেখতে খুব মিষ্টি।’ মুখে ফুটল না। স্বপ্নের মধ্যে যেমন হয়—চিৎকার করলেও কথা বেরোয় না মুখ দিয়ে। লোকটি ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল। বাচ্চা দুটো কথার ফোয়ারা ছোটাচ্ছে।‘দেখো বাবা ঐ আন্টি তার ব্যাগ থেকে এই চকলেটগুলো দিয়েছে।’
মা-টি বলল ‘আপার সঙ্গে অনেক গল্প করলাম, খুব ভাল লাগল।’ ভদ্রলোকটি চমকে উঠল। কিন্তু তা এক মুহূর্তের। নিজেকে সতর্ক করল, যাতে কেউ তার চমকে ওঠাটা দেখতে না পায়।