নিজেরে হারায়ে খুঁজি

আমার আমি (অক্টোবর ২০১৬)

সমাধিরঞ্জন
  • ৬৪
রাত ভোর হবার আগেই নিশান্তে বেরিয়ে পড়লাম। যদিও সে রাত প্রভাতের রবি রশ্মি দেখতো না। দৃশ্যত আকাশ লজ্জা নিবারণ করেছিল মসীমাখা জলদ চাদরে। আমি জানি, দেড় দু ঘন্টা পরেই বসুমতী ব্যস্ত হবে নির্লজ্জ নগ্ন অবগাহনে। এখানে কোথায় আমার স্বয়ং। বর্ষাস্নাত সামনে দিলাম পা বাড়িয়ে। আজকে আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা। নিজেকে হারিয়ে খোঁজার প্রয়াসে আমার সত্তা। আমি কোথায় লুকিয়ে। আজ যেকরে হোক আমার আমিকে পেতেই হবে। চিরাচরিত তথাকথিত মহামানবের আপ্ত বাক্য ‘আমি কে’ ‘কঅন হুঁ ম্যঁয়’ ‘হু অ্যাম আই’ ‘কোহম্‌’ আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারলো না।

অদূরেই বিনয়ী ঝুঁকে পড়া লাইটপোস্টের মুমূর্ষু ব্যল্বের আলোর তলায় প্ল্যাস্টিকের ছাদের নিচে জড়োসড়ো গোটা চারেক প্রাণ (এ বস্তিতে আহে আরও সজীব আত্মা)। যখনই মেঘনাদ তূণ থেকে বাণ ছোড়ে, এদের ছাদ যায় চিরে। কেউ লাঠি দিয়ে একদিকে কাৎ করে গর্ভবতী নারীর স্ফীতোদরের মতো সঞ্চিত জল এক কোণা থেকে বের করে দেয়। আবার জল জমে অন্য দিকে। সেখানে পাঁচ বছরের বালক খোঁচা দিয়ে জল ফেলে। চিমসে স্তন চোষা দু মাসের শিশু কাদঁতে ভুলে যায়। মা বারবার জলের ফোঁটা ছিন্ন আঁচল দিয়ে মুছে দেয়। ভাঙ্গাচোরা ঘটি বাটিতে জল তরঙ্গের তিক্ত সুরধনি। বর্ষায় এদের নিত্য এ ছবির মাঝখানে খুঁজে পাই আমার আমিকে। স্নেহপ্রবণা মাতৃ অঙ্কে। ওই তো আমি। আমার চোখের দু পাতা কখন এক হয়ে আসে।

প্লাবন ঘটিয়ে বারিদ-সেনা ধীরে ধীরে অপসৃয়মান। ধূসর বসন চিরে তপনের উঁকি। হাল্কা আলোয় চারপাশের গাছপালা ধানক্ষেত কানায় কানায় ভরা খাল চশমাহীন নজরের মতো যেন কুয়াশায় ঢাকা। কে যেন জমির আল ধরে খালের দিকে। কে ও, চায় কী, এই অন্ধ ভোরে। চোখ ছোট হয়ে আসে, তীব্র দৃষ্টি। মজুর গোছের। পাশের শহরে তার কারখানা। ঘন বর্ষায়ও তার মজুরি কাটা। কিন্তু পেছনে পেছনে কে ও, ছায়ার মতো! তিন বছরের তার আত্মজ। আর দু বাহুর ভরে? নোংরা দুর্বাস ছিন্ন কাঁথায় লেপটানো নিদ্রিত শিশু, হয়তো বা তিন মাসের। বাপ কি তবে সপরিবারে যায় কারখানায় শ্রমদানে? মা-ই বা কোথায়। সে চলে এল খালের কিনারে, একেবারে জল ছোঁয় ছোঁয়। সাফ দেখা যায় তাকে। শুধু বোঝা যায় না তার মন, কী পোষা বুকের ভেতরে। একটু তফাতে কাঁটা ঝোপের যবনিকার আড়ালে উঁকি। একী একী একী! কোলের সন্তান নিচে নামিয়ে, হেঁচকা টানে পেছনে দাঁড়ান তিন বছরের ছেলে, যে ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারে না, স্নেহ বাৎসল্য পিতার পরবর্তী পদক্ষেপ। সে হেঁচকা টানে ছেলেকে ছুঁড়ে মারল খরস্রোতা আকন্ঠ ভরা জলোচ্ছ্বাসের খালে। এবার কোলেরটা ... না না বলে তার কাছে পৌঁছনোর আগে, খালের অগ্রগামী হিংস্র জলধারা কোথায় অদৃশ্য করে ফেলল। এবার সে, কিন্তু ধরা পড়ল তার মণিবন্ধ আমার দৃঢ় মুঠোয়। ছিটকে সে বসে পড়লো খালের পাশে সদ্য ভেজা মখমল জমির ওপরে। দুজনেই হাঁপাচ্ছি। নির্বাক।

দু মাস কারখানা বন্ধ। বাচ্চাদের মা বিষ খেয়েছে গত রাত্রে। ঘরে বাসনপত্রও নেই বেচার। চারদিন স্রেফ জল খেয়ে, ঘাসের শিকড় সেদ্ধ করে গিলেছি। কেউ ভিক্ষে দেয় না।

আমি খুঁজে পেলাম আমাকে। এইতো আমি, জমিহীন, কর্মহীন, আয়হীন, খাদ্যহীন। আত্মা নেই আমার। আছি এই অসহায় মজুরের সত্তায়।

পেছনে স্মৃতি ফেলে এগোতে থাকলাম, দেখি আর কোথায় কোনখানে ঘাপটি মেরে পড়ে রয়েছে আমার আমি।

কদম কদমে চলে এলাম রাজমার্গে। বাতাসে আর জলকণা নেই। যদিও ত্রস্ত রোদ্দুর। দাঁড়িয়ে রাস্তার কিনারে। ক্ষণে ক্ষণে যান বাহন। কোথায় যাব, আমার সামনে কোন লক্ষ্য নেই, যে কোন ব্যসে উঠে পড়লেই হল। একটার পর একটা উপচে যাওয়া ভিড়। পাদানিতে পায়ের বুড়ো আঙুলের ভরে ঝুলন্ত দু চারটে তরুণ যুবক। তবু ব্যস থামছে নির্দিষ্ট স্থানে। দু একটা ছেড়ে ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ব্যস এল, পেছনে ভিড়ের কনুই। চলন্ত বাহনে অন্তর্লীন। এতো ঠাসাঠাসি, চোখ ঘুরলেও নজর ঘোরে না। এরি মাঝে একটি সন্তর্পণ হাত সামনের এক বাবুর পকেটে। পরের স্টপে নেমে গেল চোর, নামলাম আমিও। পকেটমারকে ধরে মুখে তর্জনি ঠেকিয়ে বোঝালাম, আমি তোমার ক্ষতি করবো না। আমি কেবল খুঁজতে চাই আমাকে।

ভিড়কে কিনারা করে অনতিদূরে, আমি আর সে।
- ‘জানো, এর তিন ভাগ নেবে ঠেকেদার। হিস্যা যায় অনেক ওপর অব্দি। আমিও জানি না। ঘরে ধর্ষিতা হাত পা কাটা বড়ো বোন। তার জারজ সন্তান। ভিখারি মা। বাপ টি.বি. রুগি। স্কুল আর শেষ হল কই। আমাদের ভূগোলের মাস্টার, সে ই তো ধাক্কা দিয়ে এ গর্তে ঠেলে দিলে। একদিন কানকাটা চুল ওঠা ঠেকেদারের সঙ্গে পরিচয় করে দিল।

নিস্তব্ধ আমি। এই ছেলেটির চেহারা যেন জ্যান্ত দর্পণের সামনে আমি দাঁড়িয়ে। পঙ্কিল আঠালো ফাঁদে পড়া চঞ্চল শশক। দরোজায় বাইরের কপাটে অর্গল। মুক্তির স্বাদে বঞ্চিত। আটকা পড়েছি আমি।

যত বেলা অস্তাচলের দিকে, টুকরো টুকরো মেঘ ঢাকছে আকাশ। ধীরে ধীরে মেঘেরা একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হচ্ছে। যেন বিশ্বব্যাপী কালো চাদরে আবৃত ধরণী। গোধূলি পার হয়ে নামল সন্ধ্যা, সঙ্গে নিল তূণভরা বারিদল। আবার সজোরে বৃষ্টি। প্রকৃতি বিরূপ হলে বিদ্যুৎ ধর্মঘটে নামে। আলো নেই আলো নেই, আকাশে কান ফাটা আওয়াজের সাথে ক্ষণপ্রভার ঝলকানি। রাস্তায় চলন্ত যানের মাথার ক্ষণিক আলো। তবুও দূরদৃষ্টি দূরে দেখে ফেলে আলোকের ঝর্ণায় এক বিশাল অট্টালিকা। অবশেষে সেখানে হাজির আমি, হয়তো পেতে পারি নিজেকে। ভেতরে এ এক অন্য দুনিয়া, এতদিন আমার অগোচরে ছিল। প্রকাশ বন্যায় এ ঘর প্লাবিত। মনেই হয় না বাইরে পাওয়ার-ক্যট। আকাশের কাছাকাছি যারা থাকে এ তাদের মনোরম সভা। সত্তর থেকে আট বছরের বালিকাও এতে সামিল। অর্থের প্রাচুর্য কার কত, চলে তার অব্যক্ত প্রতিযোগিতা। সোফার এক কোণে বসে আমি। সামনে দিয়ে অনবরত ট্রে হাতে য়ুনিফর্ম পরা রোবট বিভিন্ন রঙ্গিন গ্লাস নিয়ে। এক মহিলা গ্লাস তুলে নিলেন। পেছনের দৃশ্য; চকমকে ঝলমলে শাড়ির আঁচল বাঁ বাহু ঘুরে সামনে পেঁচানো। পৃষ্ঠদেশ মুক্ত স্বাধীন। কেবল সূক্ষ্ম সুতো হাল্কা গেরো। কারো কি আঙুলের স্পর্শের অপেক্ষা? খোলা পিঠে নেই কোন বক্ষাবরনীর ফিতে, তবে কি ব্রা হীনা ইনি? ভাবলাম তৈরি হই সম্মুখ সমরের জন্যে। আচমকা ৪৫ ডিগ্রি ঘুরে একেবারে চোখাচোখি। কয়েক লহমা। ক্সক্যুজ মি বলে পাশ কাটিয়ে এক সুদর্শন যুবককে লক্ষ্য করে এগোতে থাকলেন। যাক, আমার যা দেখার দেখে নিয়েছি। বুকের উপত্যকা ৪০% দৃশ্য। কটিদেশ থেকে ব্লাউজের দূরত্ব প্রায় ১২ ইঞ্চি। এই বিগতাযৌবনা নারী কি কোন পুরুষ-শিশ্নকে আহ্বান করছে না? ‘তবে কার লাগি মিথ্যা এ সজ্জা’। তবু বেচারা পুরুষ হিজড়ের মতো আচরণ করবে। নইলে বিশ্বের প্রমীলাকুল খঞ্জর খুলে উজ্জিবক পোশাকের পক্ষে যুক্তি।

এতো গেলো আভরণ। খিদে টেনে নিয়ে গেল বুফে টেবলে। এ খাবার কি শুধু পার্টিতেই বানানো হয়? ঘরে তো গিন্নীর চচ্চড়ি আর নিম বেগুন। ঘরের কথা মনে পড়তেই মন বিস্বাদ। নাঃ এখানে আমি কোত্থাও কোন কোণেও আমি নেই। ছিটকে বেরিয়ে এলাম বাইরের মুক্ত হাওয়ায়। ঝিরঝিরে হাল্কা বৃষ্টি। লোডশেডিং কেটে গেছে। বাইরে এসে মনে হল, ‘আলোকের এই ঝর্ণা ধারায় ...’ এইতো জীবন। আমার আমি এই খোলা উন্মুক্ত ধরণীতে।

এ পর্যন্ত বলে সে থামল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিগ্যেস করলাম, ‘তারপর...?’

কিছু না বলে চুপচাপ সামনের দিকে দূর দিগন্তে সে মিলিয়ে গেল। ফেলে গেল এক টুকরো কবিতার দুটি লাইন...

আমার আমি খুঁজলে হবে
ব্যর্থ, পাবে শূন্য
অলীক আলোর ঝলকানিতে
মন হবে তোর ক্ষুণ্ণ।
নেই সেখানে আমার আমি
ধন যেখানে গর্জে।

ছিন্ন শিকড়, আত্মহনন,
কৃষক ডোবে কর্জে,
ওপর থেকে পিছলে নিচে
পড়লে আমায় পাবি
নইলে খুঁজে সারা জীবন
কেবলই পস্তাবি।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সমাধিরঞ্জন আমাদের 'আ মরি' বাংলাভাষায় লেখার সময় বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। বাংলায় w বা v উচ্চারণের কোন অক্ষর নেই। ম্যানেজ করতে হয়। তেমনই ইংরেজি যে সব শব্দে i (sir), u (bus) ইত্যাদি আছে তাদের উচ্চারণ আ দিয়ে করা যায় না। ইংরেজি বলিয়ে বাঙ্গালী মাত্রই এই প্রতিবন্ধকতা স্বীকার করেন। সুতরাং কাছাকাছি উচ্চারণ স্যার, না করে স্যর বা বাস, না করে ব্যস করলে কিছুটা ঠিক হয়। যেমন h, eight এচ বা এয়ট বা এট বলাই ভালো। অবশ্য এনিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে।
কাজী জাহাঙ্গীর কবিতাকে 'জলবৎ তরলং' না করার জন্য কিছু কঠিন শব্দের বুননও গ্রহন যোগ্যতা পায়, এই গল্পটা পড়ার পর বঙ্কিমিয় ধাঁচটা স্পষ্ট হয়ে উঠে, বাংলাদেশের বাংলা এখন অনেক সহজ বোধগম্য ও সাবলীল রূপলাভ করেছে। ব্যস- বাস কোনটা ঠিক। তবুও দাদাকে ধন্যবাদ বৈকুন্ঠের উইল, মৃণালিনী'র শব্দগুলো স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য, অনেক শুভ কামনা।
নাঈম পড়ে খুব ভালো লাগলো, "এতদিন আমার অগোচরে ছিল। প্রকাশ বন্যায় এ ঘর প্লাবিত। মনেই হয় না বাইরে পাওয়ার-ক্যট। আকাশের কাছাকাছি যারা থাকে এ তাদের মনোরম সভা" অংশটা বেশ সুন্দর, সানন্দে ভোট দিলাম, আমার পাতায় আমন্ত্রণ রইল...
আহা রুবন চোখ, মাথা, হৃদয় একত্র করে পড়ার মতো গল্প। আমিকে সবার মধ্যে দেখার যোগ্যতা কয়জনার হয়। মানুষের প্রতি মানুষের মতো আচরণ খুব সহজ আবার কত কঠিন... সুন্দর একটি অনুভূতি নিয়ে গেলাম। ভাল থাকবেন।

১৭ মার্চ - ২০১৬ গল্প/কবিতা: ৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪