এই যে বাবার পদযুগল, বহুকাল আমার নয়ন জোড়া তা দর্শন করেনি, একটুখানি শীতলহাতে তা স্পর্শও করেনি ৷ তখনকার কথা মনে পড়ল, যে সময়টায় আমি কৈশোরের যাত্রী আর বাবা যৌবনের তীর থেকে বিদায়ী মুসাফির ৷ পা দুটো থাকত তার কাদামাখা ৷ ক্ষেতে খামারে লেগে থাকত সারাদিন, কাদা বালি পায়ের গোড়ালিদুটোকে ফেটে চৌচির করে দিয়েছিল৷ যেন নির্ভেজাল গেঁয়ো কামলা ৷ যেন নয়, সেটাই সত্যি ! শুধু মনখানি কাদার মত নরম, উর্বর আর খাটি ৷ অথচ আজ পা দুটো শুটকী মাছের মত শুকিয়ে গেছে, হয়ে গেছে চূড়ান্ত পর্যায়ের বিবর্ণ ! ছোট্ট ছোট্ট পা দুটো বেশ নিরীহ প্রকৃতির, উপরটা খরখরে আর তালুটা খসখসে ৷ যেমন নির্বিকার ভঙ্গি তেমন অসহায় ৷ যেন হাজার হাজার বছর ধরে অযত্ন আর অবহেলায় তার বেলা এখন ফুরিয়ে আসছে ৷ এই হাজারটা বছর তার খবর কেউ রাখেনি, যাদের খবর রাখার কথা ছিল তারাও কেউই কথা রাখেনি ৷ আর আজ তা রাখা বড়ই নিস্প্রয়োজন ৷ লোহার রডকে দু' খণ্ড করতে যে ভয়ংকর ওজনের হাতুরিটা ব্যবহৃত হয়, তারই আঘাত হয়তো তার বুকে পড়েছে এই হাজারটা বছর; তবুও সে মরেনি ৷ নিঃশেষ হয়েছে ধুকে ধুকে, হয়েছে বিলীন ৷ পরনের এই নোংরা আর আর ঝলসে যাওয়া কাপড়ের টুকরোগুলো যেন তার এই কুকড়ে যাওয়া দেহটাকে দেখে অপমানে নাক সিঁটকায় ৷ ইউনিভার্সিটির বারান্দায় গিয়ে নয়া সূর্যের আলোকরশ্মি দেখে বাবাকে বলেছিলাম, বাবা, তোমার জীবনে রোদ্রের আলো আসছে ! সামনে তোমার কষ্টের দিন ঘুচবে, দেখো ৷ কিছু একটা উপায় এবার হবে ৷ কিন্তু আমার পা গুলো দিন শেষে আড়মোড়া হয়ে আসে, ঘামগুলো গ্রন্থি থেকে বের হয়ে এসে ক্লান্তি নিয়ে ফের চামড়ার নিচে লুকোয়, পথের ধুলোবালি পায়ে লুটোপুটি খায় - কিন্তু উপায় বরাবরই নিরুপায় হয়েই থাকে ৷ সেই একটা কিছু করা আর হয়ে উঠেনা, রৌদ্র আসেনা বাবার জীবনে৷ ঝলমলে বা কুয়াশাচ্ছন্ন- কোনটিই না ৷ তবুও বাবাকে বলি, বাবা, চিন্তা করোনা ৷ বাবা জানায়- নাহ, চিন্তা কীসের ? তুই বেশী দুশ্চিন্তা করিস নারে বাপ্ ! ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছিস তো ? হুম, করছি৷ ক্যাম্পাসের ছ'টা বছর পার হয়েছে, এই ছ'টা বছরের মাথায় বাবার পেট আর বুকের রক্ত আজ মুখে চলে এসেছে ৷ এখন বাবার মুখ থেকে কাশির সাথে মাঝে মাঝে রক্ত উঠে আসে ৷
শেষের দিকে কোন এক দুপুরে যদি বাবাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতাম- বাবা, খেয়েছ ? হ্যা, পান্তা খেয়েছি ! দুপুরে কেউ পান্তা খায় বাবা ? নারে বাপ, এমনিতে খেতে ভালো লাগে, তাই.....৷ কখনকার ছিল ওগুলো ? কাল রাতের ৷ কাল রাতের ! কী শুরু করেছ বাবা ? নারে বাপ, নষ্ট হয়নি তো ! বেশ ভালোই তো ছিল ৷ দুটো কাচা মরিচ ডলা দিয়ে নিয়েছিলাম পাতে৷ পান্তা কি আজ নতুন খাইরে বাপ ? আলু ছানা খেতে দুটো আলু কেনার জন্য ঐ দুটো পয়সাই যে বাবার হাতে তুলে দিতে পারব না - সে আমার খুবই বোধগম্য ৷ তবুও অভিনয় করে বলি, এভাবে শরীরের অযত্ন করোনা বাবা ৷ এভাবেই আমি বাবার নাগালে না গিয়ে দূর দিয়ে পালিয়ে থাকি ৷ চোখের জল ফেলে মাকে মনে করে বলি, দেখেছ মা, বাবাও তোমার মতন কত সুন্দর করে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে পারে ! তুমি থাকলে পারতো অমন করে...... ৷ মা নিরুত্তর থাকে৷ মা আমার নিরুদ্দেশ হয় কোন এক শরতের রাত্রে, ঘোর অন্ধকারে, আমাকে আর বাবাকে ওরকমেরই এক চিরকালের অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে রেখেই৷ বাড়ির পেছনের ঐ বাঁশঝাড়ের মাঝে রেখে এসেছিলাম, ফিরে তো আর আসেনি ৷
হাসপাতালের এই ঔষধ ঔষধ গন্ধ বাবা কোনদিনও সহ্য করতে পারত না৷ অথচ আজ এই বেড থেকে কদিন ধরে কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে ৷ না কিছু খায়, না কিছু চায় ৷ চাওয়া পাওয়ার হিসেব যেন আজ তার শেষ ৷ হাত পা গুলো অসাড়, ঠিক যেন লাশ পড়ে আছে বেডে৷ কিন্তু লাশ নয়৷ দু চোখের কোণায় জল গড়ছে বিন্দু বিন্দু ৷ মুখে কোন শব্দ নেই ৷ বাবা কি আমার মত সন্তানকে দেখেই বাকরুদ্ধ ! হতে পারে, আমি সেরকমই এক সন্তান৷ যাকে জন্ম হবার পরপরই নূন খাইয়ে মারলে বাবার অন্তত কিছু শান্তি মিলতো হয়তো ৷ কিন্তু কাদা মাটির এই মানুষগুলো কখোনোই তা পারেনা ৷ কপালে হাত দিলাম বাবার ৷ কী বরফশীতল ঠাণ্ডা ! ডাকলাম, বাবা, বাবা ! কথা বলল না ৷ শুধু খানিকটা নড়ে উঠল ৷ কথা বললেই কাশি উঠে আর কাশি উঠলেই রক্ত উঠে আসে মুখে ৷ যেন একটা রক্তচোষা হায়না বাবার মুখে, আরেকটা বাবার বুকে বসে আছে ! আমি ভাবি, নাওয়া খাওয়া বিহীন এই শরীরে এত রক্ত আসে কোত্থেকে ৷ একবার কাশি উঠামাত্রই কাল বোশেখী ঝড় বাবার সবকিছুকেই তছনছ করে দেয় ৷ আচমকা বাবাকে বলি, বাবা, কিছু খাবে, ফলের রস ? বাবা আঙ্গুল উচিয়ে পানির গ্লাসের দিকে ইশারা করে ৷ কতকাল বাবা দিনের দিনের পর দিন বুঝি শুধু পানি খেয়েই দিনাতিপাত করেছে ৷ আজ বাবার চোখেও পানি ৷ বাবা আজ পানিবন্দী, সে পানি যন্ত্রণা সিন্ধুর, দুঃখ নদীর , কখনোই ফুরোয় না ৷ আর আমি আমার এই পানিবন্দী বাপকে তীরে আনতে পারিনি ৷ আজ এই শেষবেলায় আমি সেই সিন্ধুজল থালা হাতে সেচতে বসেছি যেন ৷ এক চুমুক পানি বাবা খেল কিন্তু কয়েক ফোটা দুগাল বেয়ে পড়ে গেল ৷ শীতল মাথায় হাত রেখে বাবাকে বলি, বাবা, আরেকটা কাঁথা কি গায়ে জড়িয়ে দেব ? বাবা চোখ বুঁজে৷ আরেকটা কাঁথায় বাবার বুক ঢাকতে গিয়ে দেখি সেই চেনা বুক আমার ৷ কত পরম যত্ন আর আদর দিয়ে বাবা আমায় জড়িয়ে রাখতো আমায় এই বুকের মাঝে, এখানেই কত রাত ঘুমিয়ে পড়েছি, যেন ওটি আমার দুনিয়ার শেষ আশ্রয়স্থল৷ কিন্তু আমার বুকটা বাবার জন্য অমন হয়নি৷ বাবার সেই বুক এখন শুষ্ক মরুভূমি, চামড়াগুলো লেপ্টে গেছে পাঁজরের হাড়ের সাথে; আর হাড়গুলো দাঁত খিচিয়ে যেন বলছে, এ তো মানুষ নয়, আসন্ন কংকাল ৷ শ্বাস নিলে বাবার বুক থেকে ঘরঘর আওয়াজ আসে ৷ ইট ভাঙ্গার মেশিনে ইট ভাঙলে যেমন শব্দ হয় তেমন নির্মম করে ৷ নিজের কাপুরুষত্বের জন্য চোখে জল নামে আমার ৷
জীবনে যাদের ফুটো পয়সারও উপকার পেয়েছি, দান দক্ষিণা পেয়েছি, আদর, স্নেহ, ভালোবাসা পেয়েছি- তাদের জন্য দু কদম হলেও হেটেছি৷ সেসব বিসন্ন মুখে প্রসন্নতা আনতে৷ শুধু বাবারই ভাগ্য হলোনা ৷ ফোন করে কত দেখতে চাইতো আমায়৷ মুখে বলেছি- হাতে অনেক কাজ কিন্তু হাতে টিউশনির যে কয়েকটা টাকা থাকত তার দিকে তাকিয়ে শুধু কাঁদতাম ৷ কাজ তো বাবারও ছিল, কিন্তু তবুও লাফ দিয়ে বাবার কোলে চড়লেই বাবা তার উদোম বুকে জড়িয়ে নিত কী পরম আনন্দে !
লাঙ্গল টেনে নিজের আর পরের জমি চেষে টিফিন, বই-খাতা, পরীক্ষার ফি এই কামলা মানুষটিই তার সাহেব ছেলের হাতে গুঁজে দিত ৷ বলতো, বাবা, ঠিকমত খাস্, ''যট্টুক সময় শরীর, তট্টুক সময়ই তুই বীর ৷ '' আমি কাপুরুষ, বাবা ৷ বীর নয় ! ডুকরে কেঁদে উঠি, নিজের কান্নাই নিজের কাছে বিষম লাগে ৷ হঠাৎ বাবা জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করে ৷ আমি দৌড়ে যাই ডাক্তারের কাছে ৷ ডাক্তার বলে, এরকম একটু হবেই ৷ কাঁপতে কাঁপতে বলি, বাবা বাচবে তো ? উপরওয়ালাকে ডাকুন, তিনি চাইলে অবশ্যই বাচবেন ৷
সেবার আমার অনেক জ্বর ৷ মা নেই ৷ বাবাই তখন মা ৷ একা একটা মানুষ বড় বালতি ভর্তি করে রাতভর আমার মাথায় পানি ঢালে আর বলে, বাপরে, একটু কি আরাম পাস্ ? আমি গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বলি, হুম ৷ পানির জন্য নয় বাবা, তোমার হাতের ছোয়ায় ! বাবার চোখে জল নেমে আসে ৷ হয়তো মাকে মনে পড়ে গিয়েছিল, বলতে ইচ্ছে করছিল- শোনো, তোমার পাগল ছেলের কথা ৷ কাঁদতে কাঁদতে বাবার চোখের জলমাখা যে চুমু সেদিন আমার কপালে জুটেছিল সেটাই আমার জীবনে পাওয়া পার্থিব জগতের শ্রেষ্ঠ আদর ! কিন্তু বাবার কপালে আমার আদর আমি না দিয়েই তাকে জীবনের শেষ প্রান্তে দাড় করেছি ৷ কতটা নিঠুর এই আমি ! আমার এই মন !
বিয়ে থা করলাম চাকুরিটা পেয়েই, বাবা অমত করলেন না ৷ ছেলের বয়স হয়েছে, বিয়েতো করবেই৷ কিন্তু হতভাগা সন্তান হিসেবে এটকুও জানতাম না যে, বাবার অমত বা মত কোনটাই ছিলনা ৷ হিসেবের সংসারে টান পড়ল, আর সে টানে দিনের পর দিন বাবাই হিসেবের বাইরে যেতে থাকল ৷ ওষুধ পথ্যে বাবার বুঝি মাসে হাজার পাঁচেক টাকা লাগতো, আমি যা দিতাম তাতে যোগান হত তার কিয়দংশই ৷ দেওয়ার সময় বুক ফেটে আসতো, বিবেক ভোঁতা হয়ে আসতো - আমার অভাবী বেতন আর সংসারের বোঝার জন্য আমার এত নরম মনের বাবাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য ৷ কখনো কখনো বাবা ওর সাথে আরও হাজার খানেক টাকা বেশী চাইলে আমি মেজাজ দেখাতাম৷ পারতামই না, একটু নরম করে বলতে, যেন নরপিশাচ এই আমি আমার বাবার সন্তান কিনা- তাতেই ঘোর সন্দেহ আছে ৷ অসুখের মরণ যন্ত্রণা , অর্থের অভাব, আমার মমতাময়ী মায়ের অভাব- এ সকল কিছু বাবার জগতটাকে অন্ধকার কূপে পরিণত করলো ৷ শেষমেশ মানুষের সহযোগিতা নিয়ে বাবার শামুকের মত ধীর লয়ে বেচে থাকাটা চলছিল , যাকে খোলাসা করে বললে বলা যায় - ভিক্ষা ! আজ, এখন, এই বিষাদময় রাত্রিতে বাবার জন্য স্রষ্টার কাছে হাটু গেড়ে বসে দু হাত তুললে কি ঐ রকম ভিক্ষার চাওয়ার মত অসহায় অসহায় মনে হবে ? আমার মনে হয়, না, কখনোই হবেনা ৷ তবুও আমি চেষ্টা করি, কিন্তু জানি এটা বৃথা চেষ্টা ৷ বাবার মত উদর জুড়ে পাশবিক ক্ষুধা ,রক্তবমির পিশাচ যন্ত্রণা, আপনজন বিহীন, মমতা ও আদরবিহীন পৃথিবীতে নুইয়ে পড়া শরীর নিয়ে অনবরত ক্ষয়ে যাওয়া মানবমূর্তির রূপ আমার পক্ষে কি এত সহজেই ধারণ করা সম্ভব ? হতে পারে, যদি আমার জীবন সায়াহ্নে সৃষ্টিকর্তা আমায় এই পাপমোচনের নিমিত্তে এর চাইতে জঘন্য কোন শাস্তি দেয়, তখন ৷ এখন একটা মোটা বেতনের চাকুরী, কর্মস্থল গ্রামের বাড়ি থেকে অনতিদূরেই, যাকে বলে ভালো থাকার মত অবস্থা ৷ বাবার খাওয়া-পরা, ওষুধের জন্য টাকার অভাব হয়তো নেই , ভালো হসপিটালে বাবা শুয়ে আছে, কিন্তু তবুও বাবাই সকল ভালো থেকে বঞ্চিত , ভাল-মন্দের স্বাদ, গন্ধ আর অনুভূতি সবকিছুই বাবার সকল আয়ত্বের উর্ধ্বে ৷
হঠাৎ বাবার তুমুল কাশি উঠে যায়, উঠে আসে দলা দলা তাজা রক্ত, রক্তবর্ণ হয়ে যায় আমার চক্ষুজোড়া, ছুটে যায় ডাক্তার ডাকতে ৷ ফিরে এসে দেখি বাবা আরও সংকটাপন্ন, কম্পমান আর উত্তেজিত হয়ে আমায় ইশারা করছে ৷ আমি নিথর হয়ে যাই, বাবা আমাকে ডাকছে- অবিশ্বাস্য ! ঘৃণিত অপরাধীর মত বাবার সেই পা দুখানা জড়িয়ে 'বাবা' বলে কাঁদতে শুরু করি ৷ বাবা ইশারায় শিয়রে , বাবার একদম কাছে ডেকে নেয় ৷ কাশতে কাশতেই খুব আলতো করে মাথায় হাত বুলোয় ৷ কী নির্মম দৃশ্য ! মুখে রক্ত, চোখে লোনা জল, কিন্তু অন্তরে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তার ছেলের জন্য ! সারাটা দুনিয়া বুঝি থমকে গেল এই দুষ্প্রাপ্য দৃশ্যখানি দেখে চোখ জুড়ানোর জন্য ৷ বাবার কাছে আমার সকল অপরাধের একটাই দণ্ড - বেকসুর খালাস ! বাবার এই হাত বুলানো আমার খুব পরিচিত৷ যখনই বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও বিদ্যে শিখতে বা অর্থ উপার্জনের জন্য চলে আসতাম, তখনই বাবা এইভাবে আমার মাথায় দুনিয়ার সকল আদরসমেত খসখসে হাত দুখানি ছুইয়ে দিত ৷ এর অর্থ- বাপ আমার, সকল কষ্টেও ভাল থাকিস্, আমার দুয়া রইলো ৷ এরপরে রাত্রিটুকু আমার কাছে অনেক দীর্ঘ মনে হয়, হাজার বছরের মত ! আমি আর কিছু মনেও করতে পারিনা !যেন কালি ফুরিয়ে যাওয়া কোন কলম আমি, শুধু শুধু অনর্থক উপরের ফ্রেমটা থাকে, ভেতরটা শুন্য ! আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ হওয়াটাই যার যথাযথ প্রাপ্য !