অনাগত

ত্যাগ (মার্চ ২০১৬)

তৌকির হোসেন
  • ৬১
প্রিয় অনাগত সন্তান,

প্রতিটা মূহুর্ত জ্বলছে। জ্বলতে জ্বলতে যখন নিভে যাবে সব মূহুর্ত তখন অপেক্ষার পালা শেষ হয়ে তুমি এসে নিশ্চয়ই ধরা দেবে ছেলে কিংবা মেয়ে হয়ে। তবে সত্যটা হলো তোমার মা, রোমেনার সন্তান হয়ে তুমি আমাকে দেখবে। প্রথম বাবা ডাকটা আমিই শুনতে পাব- এ আশায় আমার মধ্যে কত কৌতূহল! আমি প্রতিদিনই লিস্টি বানাই তোমার কী কী লাগবে- একটা ওমঘন তোয়ালে, পড়া সরষে, দুটো সেলাই করা কাপড় যে দুটো তোমার মা প্রতিদিন সময় পেলে বুনে চলেছে নিরন্তর ভাবে এই আশায় সে দুটোতে তুমি শুয়ে থাকবে, হাত নাড়বে, খেলা করবে আরও অনেক কিছু। আবার এও জানি, লিস্টের সবকিছু আমি তোমাকে এনে দিতে পারব না। কেন জান? জরায়ুতে বসে তুমি নিশ্চয়ই কিছু শুনতে পাও। নাকি পাও না?

কিভাবে পারব বলো? সময়টা এতো কঠিন, এত কষ্টের। একবেলা খেয়ে, দুই বেলা না খেয়ে এখন আমরা জীবন কাটাচ্ছি। খুব ভয় হয় তোমার মায়ের জন্যে আর সবচেয়ে বেশী তোমার জন্যে। রিলিফ ক্যাম্প থেকে আর কতটুকুই বা পাওয়া যায়। চিনা চালের মোটা ভাত পেটে রুচে না তবুও প্রাণের দায়ে চাবাতে হয়। এইতো গতকাল যখন রিলিফ ক্যাম্পে স্লিপ দেখালাম তখন শুনলাম সেদিনের সমস্ত ত্রাণ সরবরাহ করেছে সেই পশ্চিমের আমেরিকা নামের দেশটা। মনটা এমন কঠোর বিদ্বেষে ভরে গিয়েছিলো যে আমি তখনই সদ্য পাওয়া আতপ চালের হাতের ভারি পলিথিনটা ফেলে দিতে উদ্যত হয়ে গিয়েছিলাম। শেষতক আর ফেলা হয় নি।

শেষ কবে আমি প্রাণখুলে হেসেছিলাম জানো? গতমাসের ষোল তারিখ। শুধু হাসিনি, কেঁদেছিলাম পাগলের মতো। কত ক্ষয়, কত নির্ঘুম রাত, কত অনিশ্চয়তা ভরা দিনগুলোর পর সেই একটা দিনই আমি নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। অবশেষে স্বাধীনতা, প্রাণের স্বাধীনতা অন্তরে, বাইরে বাস্তবরূপে ধরা দিলো। তুমি যদি দেখতে, তুমি যদি দেখতে আমি নিশ্চিত ছিলাম তোমার প্রথম কথাটি হতো স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার জন্যেই আমি সবাইকে ছেড়েছিলাম এটা জানো? তুমি হয়তো বেরিয়ে দোষারোপ করবে আবার নাও করতে পারো- কিন্তু আমি খুশি, গর্বিত। আমার হাতে রাইফেল উঠেছিলো। মুক্তিবাহিনীর আমাদের এই এলাকার পাশের এলাকার কমান্ডার ছিলাম আমি। বর্ষনমুখর এক রাত্রির কথা মনে পড়ছে। সেই রাত্রিতে আমি ঠিক এরকমই একটা চিঠি লিখেছিলাম। চিঠিটা লিখে হ্যাজাক বাতিটার নিচে রেখে আমি ব্যাগ গোছাতে শুরু করেছিলাম। তারপর সেই গভীর নিশুতি রাতে প্রথমে গেলাম তোমার প্রয়াত দাদির ঘরে। তাঁর পায়ে হাতের আঙ্গুলগুলো ছুঁয়েছিলো কিনা বলতে পারি না খুবই তটস্থ কিংবা সতর্ক ছিলাম যাতে কেউ জানতে না পারে- মনে মনে দোয়া চেয়ে নিলাম। তারপর কোথায় এলাম আন্দাজ করতো? সেটা আন্দাজ করতে বেশী পরিশ্রম করতে হয় না। তোমার মায়ের ঘরে, যে ঘরে আমরা শুতাম সেই ঘরটাতে গেলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে রোমানার চোখদুটো মুদেছিলো গভীর শান্তিতে। সেখানে কোন ভয় ছিলো না। সেখানে ছিলো নিশ্চয়তা আর আশা।

রোমানা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তুমিও হয়তোবা ঘুমিয়ে ছিলে। আমার খুব ইচ্ছে করছিলো রোমানাকে ডেকে কানে কানে দুটো কথা বলতে, যে কথায় তার গালে টোল পরে রাঙা হয়ে উঠতো কিন্তু সেখানে বাধা থাকতো না আবেগের, প্রেমের...। আমি শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। তারপর বেরিয়ে গেলাম মায়ের টানে। দেশমাতার টানে। সে টানতো সহজে উপেক্ষা করবার নয়। বর্ষনমুখর রাত্রিতে যুদ্ধ করার অদম্য নেশা তখন রক্তে টগবগ করে ফুটছিলো যাকে প্রতিহত করবার কোন শক্তিই আমার সে সময়টায় ছিলো না।

আমি তোমাকে যুদ্ধস্মৃতি থেকে এখন কিছু বলব না। তুমি পৃথিবীতে আসো, স্বাগতম নাও, তারপর শুনো সেই কালো রঙে রাঙা স্মৃতিগুলো। শুধু তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই যাতে তুমি যেন বুঝতে পারো কতটা অনিশ্চয়তা, কতটা গ্লানির মধ্য দিয়ে তুমি আসতে যাচ্ছ।

দেশ স্বাধীন হবার চারদিন পরে আমি আমাদের পুরোনো বাসাটায় ফিরে আসি। আমাদের বাসাটার রং ছিলো হলুদ। দোতলা। উপরের ডানদিকের কোনাটায় আমরা তিনজন থাকতাম। সেই হলুদ বাড়িটা দেখে আমি আর চিনতে পারলাম না। কেন জানো? বাড়িটার দোতলাটা স্প্রিন্টারগুলোর তেজে সম্পূর্ণ ধসে গিয়েছিলো। একতলার ঘরগুলোর দরজা হাট করে খোলা, ভাঙ্গা। কোন বাধা নেই হুটহাট ঢুকে যাবার। আমি সেদিন অধৈর্য্য ছিলাম। ছিলাম দিশেহারা। ডান চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি বয়ে যাচ্ছিলো। সেগুলো কেউ দেখবারও ছিলো না। মুছবারও ছিলো না। তারপর শুরু হলো খোঁজা। রোমেনাকে আর আমার মাকে।

প্রথমেই আমি দৌড় দিয়েছিলাম (সত্যিই আমি দৌড় দিয়েছিলাম) রিলিফ ক্যাম্প থেকে যারা যারা দেশে ফিরে আসতে শুরু করেছিলো তাদের প্রাথমিক থাকার জায়গাটায়। সেখানে কোন আশা ছিলো না। খোঁজ নিলাম সেখানে যারা কর্তব্যরত লিস্টি তৈরীর কাজে। তাদের চোখে সমবেদনা ছিলো, সাহায্য করার আকাঙ্খা ছিলো কিন্তু সেই সাহায্য করার বাস্তবরূপটি ছিলো না।

আটদিন পরে তোমার মা-কে আমি পেয়েছিলাম ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অস্থায়ী হাসপাতালে। সেখানের ময়লা, ধূসর বেড কাপড়টার ওপর তোমার মা শুয়ে ছিলো। তার পাশে বুড়োমতো একজন নারী। মাথার সাদাচুলগুলোর বেশীরভাগই উঠে গিয়েছিলো। দেখতে অনেকটা টেকো টেকো লাগছিলো। আমাকে দেখে প্রথমটা রোমেনা চিনতে পারে নি। না পারারই কথা। দীর্ঘ কয়েকটা মাস যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটা মুখাবয়ব আমার তৈরী হয়ে গিয়েছিলো। মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফের সেই জঙ্গলটা এখন দেখতে পেলে তুমি নিশ্চয়ই আঁতকে উঠতে। পরিচয় দেবার পর নিথর দৃষ্টিতে রোমেনা তাকিয়ে থাকাটা আমার খুবই অসহ্য লাগতে শুরু করেছিলো। আমি ভেবেছিলাম সে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু সে ছিলো নিশ্চুপ।

বয়স্কা ধাত্রীটি আমাকে এক কোনে ডেকে নিয়ে তোমার মা সম্পর্কে কিছু কথা বললো আমাকে। জানি তুমি এতসব কিছু এখনো বুঝবে না। একটু বড় হও খালি?

সে যা বললো তার সারমর্ম এই ছিলো যে, তোমার মাকে পাকিস্তানি সেই আত্মদম্ভে দম্ভিত পশুগুলো ধরে নিয়ে যায় আমাদের পুরানবাগের সেই হলুদ বাসাটা থেকে। যাওয়ার সময় সেখানে গণহত্যার পুরানবাগ অধ্যায়টা তারা অবশ্যই সম্পন্ন করে ফেলেছিলো। আমার মাও সেখানে মারা গিয়েছিলেন। কোন উপায় ছিলো না পশুগুলোদের দয়া পাবার। তোমার মা চারটে পাকিস্তানির কুৎসিত আচরণ, নির্যাতনের শিকার হবার পর মার্টিন রোডের ফুটপাতের ওপর পড়ে ছিলো আবর্জনার বস্তুর ওপর। মার্টিন রোড এলাকায় সুইপারদের দলটি লাশ সরাতে আসলে জীবিত একজনকে দেখে ওই হাসপাতালটায় পৌঁছে দেয়।একসময় সে ধাতস্থ যখন হতে পেরেছে ঠিক সেই সময়টায় ধাত্রীটিকে এই ঘটনাটা বলে। মজার ব্যাপার কি জানো অনাগত?

যেদিন রোমেনাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো পশুগুলো সেদিনটা ছিলো আমি যাওয়ার ঠিক পরের দিন।

হে অনাগত, তুমি কী বুঝতে পারছ তুমি কার সন্তান?

হয়তোবা আমার। হয়তোবা কোন পশুর। যেদিন তোমার নাম রাখা হবে সেদিন আমি একটা খেলা খেলব তোমার সাথে। জাপানিরা তাদের বাচ্চাদের সাথে এই খেলাটা খেলে। তোমার দুইপাশে দুটো পতাকা থাকবে। একটা এই স্বাধীন বাংলার আরেকটা পাকিস্তানের। দুটো পতাকার মধ্যে তুমি তো একটাকেই বেছে নিবে। তাই না? যদি তুমি সেই চাঁদ তারা পতাকাটার দিকে হাত বাড়িয়ে দাও বুঝতে পারব তুমি আমার ঔরস থেকে আসো নি। এসেছে ওই কুখ্যাত উর্দুভাষীদের থেকে। আর যদি তোমার হাতে এই দেশটার পতাকা ওঠে তখন আমি ধরে নিব তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধার এবং একজন বীরাঙ্গনার সন্তান।

তোমার মা এখন এই হাসপাতালের সাদা বিছানাটায় শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে ব্যথায় চিৎকার করে উঠছে। প্লিজ, আর কষ্ট দিও না ওকে হ্যাঁ? হাজার হলেও ও তো তোমারই মা। কষ্ট থেকে একটু নিস্তার দাও।

আমি অপেক্ষায় আছি অনাগত। অপেক্ষায় আছি।

ইতি,

তোমার "হয়তোবা" মুক্তিযোদ্ধা পিতা
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ ইয়াসির ইরফান দারুণ লিখেছেন । মুগ্ধ হওয়ার জন্য যথেষ্ট ।
Fahmida Bari Bipu তোমাকে এখানে দেখে ভালো লাগলো। চমৎকার লেখনী তোমার। অনেকদূর যেতে পারবে নিঃসন্দেহে। তুমি বেশ জটিল এক্সপেরিমেন্ট করেছো। সংলাপনির্ভর ছোট গল্প মোটামুটি উৎরে যায়, বর্ণণাধর্মী সহজে নয়। খুব বেশিই পারদর্শীতার প্রয়োজন হয়। শুভেচ্ছা ও ভোট তোমার প্রাপ্য।
ধন্যবাদ আপু! :) এই ঘরে আপনিও আছেন দেখে মহা খুশি! :)
শিল্পী জলী খুব ভালো লিখেছেন, চমৎকার --আমি পড়লে ভোট দিতে সহজে ভুলি না।
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্ দো’য়া করি দীর্ঘজীবি হও । আর এই খেলাটার কথা তখন যদি স্মরণ হয় তবে তোমার লেখা এই গল্পটা আরেকবার পড়ে মিলিয়ে নিও নিজেকে । তোমার দেশপ্রেম তোমাকে মহান হতে যেন সাহায্য করে । ভাল লিখেছ । প্রাপ্যটা রেখে গেলাম ।
ফয়েজ উল্লাহ রবি প্রথম লেখা শুভেচ্ছা রইল।
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,আমার কবিতা ও গল্প পড়ার আমন্ত্রন রইল।ভোট রেখে গেলাম।

২৩ ফেব্রুয়ারী - ২০১৬ গল্প/কবিতা: ৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪