বেঞ্চিটার উপর অনেক্ষণ ধরে বসে আছে হীরক। আজ আকাশের আসার কথা এই খানে তাদের শেষ দেখা হয়ে ছিল। দু'বছর পার হল প্রায় হীরক এর থেকে দূরে সরে যাই আকাশ। হীরক অনেক সুশিক্ষিত একটি ছেলে সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনাই তার মস্তিষ্ক টাও সাহিত্যগত। একটি মেয়ের ভুল সিদ্ধান্ত আজ জীবনের মোড় টাই পালটে দিল। সব পুরনো সৃতি আজ দোল কাচ্ছে হীরক এর মাথায়। বিকাল মনোরম পরিবেশ চারিদিকে প্রেমিক যুগল, এসব দেখতে হীরকের ভালো লাগছে না আর। বেঞ্চিটার উপরেই শুয়ে পড়ল হীরক। স্তব্ধ হয়ে আবার সেই আগের দিনের সব সৃতি ভাবছে।
শুক্রবার হীরকের সাথে প্রথম দেখা হয় আকাশের মাঠের এক কোণে বসে ক্রিকেট খেলা দেখছে আকাশ। মাঝে-মাঝে আকাশ কে দেখতে পাই হীরক, আজ এগিয়ে এসে- এই ছেলে খেলবে আসো। আকাশ যেন অনেক কিছু খুঁজে পেল খুশিতে লাফিয়ে উঠে হীরককে, ধন্যবাদ!...
নাম কি তোমার? আকাশ...
এই ভাবে পরিচয় হয় তাদের।
হীরক এর সিগারেটের নেশা, দোতলা বিশিষ্ট "আলম মার্কেট"। তবে দোতলা হলেও নিচ তলা পুরো মাটির নিচে, মানে নদীর পাশে মার্কেট টা তাই দোতলার উপর তলা উপরে, নিচ তলা নদীর ধারে। নিচে সব গার্মেন্স কারখানা। নিচে গিয়ে সিগারেটের নেশা মেঠাই হীরক। তো নিচে যেতেই দেখে একটি কারখানায় কাজ করছে আকাশ। বেশি বড় নই ছোট ছোট তিন-চার টি কারখানা রয়েছে। দেখা হতেই হীরক আকাশ কে-
কিরে তুই এখানে?
হ্যা আমি এখানে কাজ করি। ও আচ্ছা ফ্রি থাকলে আয়। কারখানার সামনেই আধ দেয়াল বিশিষ্ট বারান্দার মত আছে ওখানে দেয়ালের ওপর বসেই হীরক সিগারেট খাই। আকাশ সবে কাজ শিখছে, বিষ্ণু দা যাবো? হ্যা যা দেখে আয় কেন ডাকল। বিষ্ণু হল আকাশের ওস্তাদ, তার কাছেই কাজ শিখছে আকাশ। হীরক ততক্ষণে সিগারেট ধরিয়ে টানছে আর সামনে নদীর ওপারে দেখছে, খুব সুন্দর পরিবেশ। আকাশ বলে উঠলো কি রে তুই সিগারেট খাস? হ্যা! কেন তুই খাস না? না।
কতদিন হল এখানে? আকাশের উত্তর এক সপ্তাহ। পড়াশুনা কতদূর করলি? নবম শ্রেণী উত্তীর্ণ করেই চলে এসছি। তোর কেও আছে এখানে? হ্যা, খালা। নানা প্রশ্ন করল আরো হীরক...
শেষ করে হীরক বলে চল আজ বিকালে নদীর ওপারে যাবো খুব সুন্দর দেখার মত জাইগা আছে।
আকাশ- ঠিক আছে যাব, বিষ্ণু দা কে বলে ছুটি নিয়ে নেব।
হীরক টা এখনো আসছে না কেন? বিকাল তো হয়ে এল। আকাশ ফেরী-ঘাটে দাঁড়িয়ে, নদীর ওপারে যাবে। এর আগে আর কখনো ফেরীতে চড়েনি আকাশ, এই প্রথম বার।
ওইত হীরক আসছে, কিরে এত দেরি? সরি দোস্ত। ওকে চল, নদী পাড় হয়ে আকাশ অবাক! হীরক যে রকম বলেছে তার চাইতে দ্বিগুণ সৌন্দর্য ভাসছে এখানে। কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ঢুকল দু'জন, বাগানে বসে এবার হীরক সিগারেট ধরিয়ে, কিরে খাবি? না দোস্ত।
হীরক- আচ্ছা ঠিক আছে বল এবার কেমনে আশা হল এই খানে?
সে আর এমন কি...!
নবম শ্রেণী পাস করার পর আমি মা'কে বলে চলে এসেছি পড়াশুনা ভালো লাগে না আর।
অনেক আড্ডাচলার পর এক পর্যায়ে বুঝা যাই, হীরক বড় লোকের ছেলে, আকাশ ও মধ্যবিত্ত।
এভাবেই তাদের বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হয়।
কাজের চাপ বেশি কারখানাই আরো দু-এক জন লোক বাড়তি হল তার মধ্যে একজনের নাম হাসান। আকাশের সাথে বন্ধুর মতই মিশে হাসান। হাসান ভাই সবসময় মেয়েদের সাথে টাঙ্গী মারে, এসব দেখে আকাশ ও সেদিন কৌতুহল হয়ে একটা মেয়ের নাম্বার চাইল। হাসান ভাই আপনি এত মেয়ের সাথে টাঙ্গী মারেন বিরক্ত লাগে না? নারে আকাশ মেয়েদের সাথে কথা বলে সময় পার করা, মজাই আলাদা। তাহলে আমাকে একটা নাম্বার দেন কথা বলি। এর আগে কখনো আকাশ ফোনে অপরিচিত কোন মেয়ের সাথে কথা বলে নি।
আমার কোন সে রকম নাম্বার নেই তবে একটা আছে ওটা আমার এক ছাত্রীর। ছাত্রী মানে- হাসান ভাইয়ের কাছে সেলাই কাজ শিখে। হাসান ভাই নাম্বার টা দিল আকাশ কে। হাসান ভাই মেয়ের নাম কি?
হাসান ভাই বলে দিল মেয়ের নাম বাণী!...
কারখানা বন্ধ শুক্রবারে, তাই হীরক আর আকাশ প্রতি বন্ধের দিনে নদীর এই পাড়ে "রায়খালী" চলে আসে। আজও শুক্রবার! দুই জন রীতিমত গল্প করছে কৃষি কেন্দ্রের বাগানে বসে, এর মধ্যে আকাশ হীরককে বাণীর কথা বলল। আকাশ হীরককে বলে- তুই একটু আমায় সাহায্য করিস এর আগে কখনও প্রেম করি নি। ফোন দিল আকাশ...
হ্যালো- কে? বাণী।
হ্যা বলছি। আপনি কে? আমি আকাশ। কেমন আছেন? হ্যা ভালো।
আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবেন না?
- আরে আপনি আচ্ছা মানুষ তো আগে পরিচয় দেন কে আপনি?
প্রথম প্রথম যা হয় আর কি।
পরে অবশ্য "আকাশ বাণী" দুজনের প্রেম অনেক গভীরতম হল।
আকাশ এর সাথে বাণীর এখন ফেসবুক- হোয়াস্টআপেও কথোপকথন চলে, সোজা ভাষাই চ্যাট চলে আর কি। বাণীর ছবিও পাটিয়েছে আকাশকে যেন কোন ডানা কাটা পরী। তবে আকাশ এর ছবি এখনো পায় নি বাণী। আকাশের ফেসবুক, হোয়াস্টআপ কোথাও ছবি নেই, দেখতে তেমন সুন্দর না আকাশ তাই হইত...।
একদিনও কথা না বলে থাকে না আকাশ, আজ কথার মধ্যে বাণী আকাশকে দেখা করতে বলল। শুক্রবার "জুম রেস্তোরা" (পার্কে) দেখা করবে আকাশ-বাণী। হীরককে সব খুলে বলল আকাশ। দুই জনেই যাবে পার্কে।
আকাশ আর হীরক পার্কে বসে। দুই জনের দুই হাতে দু'টো পটেটো ক্রেকার্স প্রায় এক ঘন্টা ধরে বসে আছে দু'জন। বাণীর আসার নাম নেই...
দূর থেকে নীল রঙের জামা পরিহিতা একটি মেয়েকে আসতে দেখা যাচ্ছে, হ্যা এটা তো বাণী আমাদের দিকেই আসছে।
আচ্ছা আপনাদের মধ্যে আকাশ কে! আমি হতবাক। চিনল কেমনে? ও মনে পড়েছে কাল রাত্রে ফোনে বলেছিলাম লাল শার্ট পরে আসব, তবে আমি এতক্ষন লক্ষ্য করি নি হীরকও তো লাল শার্ট...!
আপনি আকাশ না? হীরকের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল বাণী।
আমার আর কিছু বলার রইল না।
হীরক কিছু বলবে এমন সময় আমি বলে উঠলাম? হ্যা! ওই আকাশ। হা করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল হীরক, আরে ব্যটা হা বন্ধ কর মশা ঢুকে যাবে, বলতেই আবার এক পলক বাণীর দিকে তাকালো হীরক। কিছু বোঝার আগেই আমি ওদের একা ছেড়ে দিয়ে গেটের পাশে টঙ্গী টা থেকে একটা সিগারেট নিলাম। অভ্যাস নেই তবু মানুষ বলে টেনশনে থাকলে নাকি এসব কাজে দেই। এক টান দিতেই কেমন হাঁক দিয়ে উঠলাম। দূর... মাইনষে খাই কেমনে এসব তবু ষোল টাকার মালব্রো ফেলে দিব উপর থেকে হালকা হালকা টান দিলাম।
কিরে কিছু বল। মুখ ফুলিয়ে বসে আছে হীরক, সেই গার্ডেনে। কিছু বলছে না আমায়। জানি আমি- কেন তার এত অভিমান। দেখ হীরক তুই কিছু না বললে আমি চললাম।
দাড়া তুই এইরকম করলি কেন?
বাহ্! কি করলাম আবার। তুই আমাকে আকাশ বললি কেন মেয়ে টাকে? বলেছি কারন দেখলি না, আসলে ওর তোকেই পছন্দ হয়েছে। তুই আমার বন্ধু হিসেবে এইটুকু করার অধিকার আমার আছে।
তুইও তো মেয়েটাকে পছন্দ করেছিস, নাকি? মিত্যে বলবিনা। দেখ আকাশ আমি খুব ভালো জানি তুই অনেক ভালোবাসিস বাণীকে। এখনও কিছু বিগড়ে যাই নি সত্যি টা বলে দিব আমি বাণীকে। নাম্বার টা দে...?
- এই নে নাম্বার...। তবে একটা কথা দোস্ত তুই যদি সত্যি আমায় তোর বন্ধু ভাবিস তাহলে বাণীকে কিছু বলবি না।
আকাশ আজ আর কাজে যাই নি। রুমে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে, আর নীরবে শুধু অশ্রুজল ঝরাই যাচ্ছে। তার শুধু একটি প্রশ্ন? জগৎ সংসার কি আসলে এই রকম? বাণী মেয়েটিকে কত ভালোবেসে ছিল আকাশ। মনের গহীনে একখানা ঘর বুনেছিল আকাশ, বাণীর জন্য। মেয়েটি তার ভালোবাসার মানুষ্টিকে চিনতে ভুল করল। আধো কি বাণী আকাশ কে ভালোবাসত?...।
- হ্যালো মামা! আমি আকাশ বলছি... একটা যে কোন কাজের ভিসা রেডি করে দাও আমি বিদেশ যেতে চাই। আকাশ এর মামা 'কাতার' থাকেন। আকাশকে বিদেশ যাওয়ার জন্য অনেক জোরাজোরি করেছিল মামা, মায়ের অনিচ্ছাই আর যাওয়া হয় নি। তবে এইবার আকাশ আর দেশে থাকছে না। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আকাশ বিদেশ চলে গেলেও। তবে সেটা হীরক কে না জানিয়ে।
আর এদিকে হীরক শুধু নিজেকে একজন দোষী-লোভী বন্ধু ভাবছে, অনেক খোঁজ নিয়ে জানতে পারে আকাশ দেশের বাইরে। এবার হীরক আর চুপ থাকতে পারলো না। একটি মেয়ের জন্য তাদের কঠিন বন্ধুত্বে আঁচ পরতে পারে না।
কিছুদিন পর হীরক আকাশ সেজে আবার বাণীর সাথে দেখা করে, আর সব খুলে বলে বাণীকে। সব শুনে বাণী যে কথাটি বলল তা শুনার জন্য হইত প্রস্তুত ছিল না হীরক। কথাটি শুনে মূহুর্তে কেমন যেন স্বস্তি ফিরে পেল। আর উপরে তাকিয়ে- আল্লাহ্ তোমাকে অজস্র ধন্যবাদ...।
পেছন থেকে আকাশের ডাকে নির্বোধ কাটে হীরকের, কিরে ঘুমুলি নাকি কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি শুনছিস না।
- হীরক পেছনে চেয়ে দেখে আকাশ চলে আসছে। লাফ দিয়ে উঠে, আরে দোস্ত। যা ব্যটা তোর সাথে কথা বলব না দুই ঘন্ঠা ধরে অপেক্ষা করছি... অবস্য দু'ঘন্টা কী প্রায় দুই-তিন বছর পর দেখা।
- অপেক্ষা করছিস না ছাই, এসে তো দেখলাম চোখ মেলে ঘুমাচ্ছিস।
- নারে দোস্ত ঘুমাইনি। পেছনের সৃতিগুলো ভাবছিলাম। তারপর, বিয়ের কথা শুনে এসে পরলি? মেয়ে কিন্তু হেব্বি দেখতে, বাণীর থেকেও সুন্দর।
- না! তুই তো সব জানিস। ভেবেছিলাম আর হইত বিয়ে করব না। কিন্তু মায়ের কথা রাখতে...। আচ্ছা বাণী কেমন আছে? ওকে কিছু বলিসনি তো?
- খুব ভালো। তারপর কথা কাটিয়ে... এখন চল তোর খালার বাসাই যাব অনেকদিন যাওয়া হইনি কাল আবার মেয়ে দেখতে যাবি না? তোর হবু বউ...।
- চুপ কর...। (মুচকি হেসে, অনেকদিন পর আজ আবার আকাশের মুখে একটু হাসি দেখল হীরক)
সবাই এসছে তো? হ্যা। হীরকটা এখনও এল না সবকিছুতে ও লেট থাকবেই।
ঔইত হীরক, কিরে এত দেরি?... চল তারাতারি সবাই গাড়িতে তোর অপেক্ষা করছে। আজকে হীরকের মুখে অট্ট হাসি কি জানি কি বেপার? বিদেশ ফিরে ওকে যখন দেখছি সবসময় মহাখুশীতে আছে ও, কনের বাড়ী এসে পৌঁছালাম। মনে মনে ভাবলাম মেয়ে যে রকম'ই হোক বিয়ে করে নেব অন্তত বাণীকে ভোলার জন্য এর থেকে বড় দাবাই আর কি হতে পারে।
সবাই বসে আমরা, হীরক আমার পাশে। কনেকে ডাকা হল।
একি এখানে বাণী কেন? না মানে যে মেয়েটিকে আমাদের দেখানোর জন্য সাঝিয়ে নিয়ে আসছে বাণী তার পাশেই। কী রকম একটা রহস্যময় গন্ধ পাচ্ছি। দেখতে বাণীর চেয়ে একটু ফর্সা কম, তবে মুখে অনেক মায়া, যত দেখি শুধু দেখেই যাই। আমি হীরকের উরুর উপর হাত দিয়ে খামছে ধরলাম কিরে দোস্ত বাণী এখানে কেন?
চুপ থাক সব বুঝতে পারবি।
আমার মনে একটা বড়-সড় ধাক্কা খেল। নিশ্চয় কিছু একটা হতে চলেছে, যেটা আমার অজানা।
আমি মাকে হ্যা বলে দিলাম আমার এ মেয়ে পছন্দ। পাশে হীরকের পাশে দাড়িঁয়ে বাণী। তবু তার দিকে তাকাতে কেন জানি অস্বস্তি বোধ হচ্ছে।
লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছে মত- যে মেয়েটি কে সাঝিয়ে আনা হয়েছে সে মেয়েটি সবাইকে বলে উঠলো- আমি কি উনার সাথে একটু একান্ত কথা বলতে পারি? আমার তখন যেন লজ্জাই মাথা কাটা যাচ্ছে কিন্তু অবাক কান্ড সবাই হেসেই সম্মতি দিল।
- আপনার নাম কি?
- জ্বী! আ-আ-আকাশ।
- তাহলে উনি কে? হীরককে দেখিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল মেয়েটি।
- ওর নাম হীরক। তবে-
- তবে কি?
- ডাকনাম আকাশ। (তড়িঘড়ি করে বলে ফেললাম)
- আমার নাম জিজ্ঞেস করবেন না?
- জ্বী! আপনার নাম?
- বাণী!
- জ্বী..!
- এত জ্বী জ্বী করছেন কেন, বললাম না আমার নাম বাণী।
- এবার আমি বাণীকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তাহলে উনি কে?
- কেন মৃথীলা। তবে ডাকনাম বাণী।
- তার মানে তুমি!?
- হ্যা আমি বাণী...
- তাহলে ফেসবুক-হোয়াস্টাআপ, ছবি! এসব মৃথীলার?
- হ্যা।
- আমি বিশ্বাস করি না।
-
"গভীর কালো মেঘের পরে রঙিন ধনু বাঁকা,
রঙের তুলি বুলিয়ে মেঘে খিলান যেন আঁকা!
সবুজ ঘাসে রোদের পাশে আলোর কেরামতি
রঙিন্ বেশে রঙিন্ ফুলে রঙিন্ প্রজাপতি!"
কার লিখা বলেন তো??
- সুকুমার রায়।
আমার আর বুঝতে বাকি নেই এটাই বাণী। এই কবিতা তাকে আমি কোন এক বর্ষাই শুনিয়েছিলাম।