কয়েক দিন যাবৎ জাহান সাহেব অদ্ভুত ভ্রান্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। চারপাশের চেনা-জানা সব কিছুই যেন তাঁর কাছে অচেনা মনে হয়। অথচ এ-রকমটা হওয়ার কথা নয়। তিনি খুবই সচেতন একজন মানুষ। সর্বোপরি তিনি একজন লেখক। লেখকের যে অন্তর্দৃষ্টি থাকে-যাকে বলে থার্ড আই-সেই থার্ড আই যেন তার ভোতা হয়ে গেছে। লেখার জন্য বসলে মনে তার ভাব আসে না। চোখ বন্ধ করলে তিনি অসংখ্য আর্তনাদ শুনতে পান। কাগজের লেখাগুলো যেন তার দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপ করে, ব্যাটা! চারিদিকে এত অন্যায়, অত্যাচার আর তুমি ঘরে বসে সাহিত্য কচলাচ্ছ! তুমি তো নন্দলাল হয়ে গেলে!
জাহান সাহেব মাঝে মাঝে ভাবেন ডাক্তারের কাছে যাবেন। আবার ভাবেন এটা তার ক্ষণিকের বিকৃতি, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক তো হচ্ছে না। একজন লেখকের জন্য সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক কাজটি হলো কোন কিছু লিখতে না পারা। আর আশ্চর্য্যজনকভাবে জাহান সাহেব উপলব্ধি করতে পারছেন যে, শত চেষ্টা করেও তিনি কোন কিছুই লিখতে পারছেন না। নামকরা লেখক শুধুমাত্র কোন কিছু লিখতে না পারার মানসিক যন্ত্রণায় আত্মহত্যা করেছেন-তিনি এটা জানেন।
জাহান সাহেব দেখেছেন তার এই বিকারের কারণ তুচ্ছ সব ঘটনা। সামান্য সব ঘটনা তাকে এত নাড়া দেয় কেন তা তিনি ভেবে পান না। সকলে যা অনায়াসে পাশ কাটিয়ে যায়, তিনি তা পারেন না কেন! এইতো কয়েকদিন আগে পত্রিকায় তিনি সিরিয়ার অনাহারী, কংকালসার এক কিশোরের ছবি দেখেছেন। এরপর থেকে রাস্তায় শীর্ণ দেহের যত ভিক্ষুককে তিনি দেখেছেন, তার কেবলই মনে হয়েছে এরাও ওই কিশোরের মতো অনেক দিন যাবৎ না খেয়ে আছে। দেশে যেন ছিয়াত্তরের মনান্তর নেমে এসেছে! ঢাকা শহরের সব লোকই যেন প্রতিদিন সকালে উঠে খাবারের সন্ধানেই ছুটে বেড়াচ্ছে। হাইকোর্টের মাজারে এ-রকম একজন ফকিরকে দেখে তিনি কাছে যান। আহা রে! কতদিন যাবৎ খেতে পাও না বাবা! জাহান সাহেবের প্রশ্ন শুনে ফকির মুখ হা করে তার দিকে চেয়ে থাকে। সকাল থন কিছু খাই না বাবা! জাহান সাহেব যেন শুনতে পান, সাত দিন ধরে কিছু খেতে পাই না বাবা! তিনি পকেট থেকে একশ টাকার একটি চকচকে নোট বের করে ফকিরের হাতে দিয়ে দ্রুত হাঁটা শুরু করেন। কিছু দূর যেয়ে তার মনে হয়, তিনি এসব কি ভাবছেন। দেশে এখন কোন লোকই আর অনাহারে থাকে না। আর ঢাকা শহরের ফকিরদের তো অনাহারে থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
জাহান সাহেব টের পান দিন দিন তিনি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে পড়ছেন। স্বাভাবিক সব জিনিস তার কাছে অস্বাভাবিক হয়ে ধরা দিচ্ছে। বিশেষ করে পত্র-পত্রিকার নেতিবাচক খবরগুলো তার কাছে ইদানিং মূর্তিমান আতংক। দিন দিন মানুষের মন এত কুন্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছে কেন? সামান্য কারণে মারামারি হানাহানি করছে। কোমলমতি শিশু-কিশোরদের বিকৃত উপায়ে হত্যা করছে। স্কুল-কলেজে মেয়েদের উত্যক্ত করছে বখাটেরা। কেউ প্রতিবাদ করতে এলে তাকে খুন পর্যন্ত করতে দ্বিধাবোধ করছে না তারা। না! মানবিক মূল্যবোধ বলতে আর কিছু রইল না মানুষের!
জাহান সাহেব ভাবেন, সারা বিশ্বে জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে এত হৈচৈ হচ্ছে। এজন্য বাহারী নামের কত সম্মেলন হচ্ছে দেশ বিদেশে। অথচ মানুষের যে-টা সবচেয়ে জরুরী-তার মন দিন দিন বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে কারো কোন চিন্তা নেই। আচ্ছা! মানুষের মনকে সংশোধনের জন্য যদি কোন সম্মেলনের ব্যবস্থা করা যেত! শিরোনাম কি হতো, “বিশ্বে বিকারগ্রস্থ মন ও আমাদের করনীয়” অথবা “ বিশ্ব মন সরলায়ণ সম্মেলন”!
জাহান সাহেব ভাবেন, এভাবে তো চলতে পারে না। তিনি সিদ্ধান্ত নেন ঢাকা শহরের কোলাহল ছেড়ে গ্রামে গিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে আসবেন। ঢাকা শহরের সবকিছু বিবর্ণ ঠেকলেও গ্রাম নিশ্চয় তার চির চেনা সবুজ-শ্যামল রূপ ধরে রেখেছে। এখন ফাল্গুন মাস। ঋতুরাজ বসন্তের আগমনের সময়। প্রত্যেক জিনিসের একটা মৌসুম থাকে। বসন্ত হলো কবি-সাহিত্যিকদের লেখা-লেখির মৌসুম। জাহান সাহেবের মতে, যারা লেখা-লেখি করেন তাদের প্রত্যেকের উচিত এ-সময়টা গ্রামে গিয়ে প্রকৃতির মাঝে কাটান। তিনি নিজে প্রতিবছর এ-সময় ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যান।
ফাল্গুন মাস এলে সিরাজুদ্দি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে বাড়ী ঘরদোর ঝেড়ে মুছে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখে। জাহান সাহেবের পরিবারের আসার প্রতীক্ষায় থাকে। সে জাহান সাহেবের জ্ঞাতি ভাই। গ্রামে জাহান সাহেবের সহায়-সম্পত্তি ও বাড়িঘর দেখাগুনা করে। ফাল্গুন মাসটা সিরাজুদ্দির খুবই আনন্দে কাটে। শহর থেকে আসা জাহান সাহেবের বদৌলতে বাড়ী সরগরম থাকে। এ-সময়ে বাড়ীতে কত লোকের আনাগোনা হয়। দিন রাত অদ্ভূত সব কান্ডকারখানা চলতে থাকে। গানের আসর বসানো, পুকুরে বড়শি বাওয়া, চাঁদনী রাতে ফাঁকা বিলের মাঝে শুয়ে ফাল্গুনের জ্যোৎ¯œা দেখা-কত বিচিত্র শখই না আছে লোকটির। সিরাজুদ্দি ভেবে পায় না, এই অদ্ভূত লোকটিকে নিয়ে মানুষ এত মাতামাতি করে কেন? এই পাগলাটে লোকটি কী করে একজন মস্ত লেখক হতে পারে! তবে যত অদ্ভূত কান্ডকারখানা ঘটাক না কেন, জাহান সাহেব সিরাজুদ্দি’র কাছে পীর-পয়গম্বর সমতুল্য। তার দয়ায়ই তো সে টিকে আছে।
জাহান সাহেব গ্রামের বাড়ীতে এসেছেন সপ্তাহ খানেক হলো। রোজ বিকালে তিনি সিরাজুদ্দিকে নিয়ে ঘুরতে বের হন। রাস্তায় বের হয়ে তিনি অদ্ভূত সব কথা বার্তা বলতে থাকেন। সিরাজুদ্দি আগ্রহ সহকারে তার কথা শুনে। যদিও সে প্রায় সময়ই তার কথার আগা-মাথা কিছুই বোঝে না। আর কোন শ্রোতা না থাকায় এবং সিরাজুদ্দির আগ্রহ দেখে জাহান সাহেব তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতায় কখনও বিরক্ত হন না।
আচ্ছা সিরাজুদ্দি, বলতে পার ফাল্গুন যে এসেছে তা কিভাবে জানা যায়?
আপনে গ্রামের বাড়ী আসলে! কারণ প্রতিবছর ফাল্গুন মাসে আপনে গ্রামে আসেন!
আহা! আমি প্রকৃতির কথা বলছি, প্রকৃতিতে কী পরিবর্তন হয় জানো?
সিরাজুদ্দি চেনা ভঙ্গিতে মাথা চুলকাতে থাকে। তার এ-রকম মাথা চুলকানোর অর্থ জাহান সাহেব বুঝেন-আপনের প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই!
তিনি বলতে থাকেন, শোন! ফাল্গুন এলে ভ্রমর গুনগুনিয়ে গান গায়। কবি বলেছেন, ফাল্গুনে শুরু হয় গুনগুনানি, ভোমরাটা গায় গান ঘুম ভাঙ্গানি। শীতে প্রকৃতি ঘুমিয়ে থাকে। ভ্রমর গুনগুনিয়ে গান গেয়ে তার ঘুম ভাঙ্গায়।
সিরাজুদ্দি বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ে, যেন এইমাত্র সে কোন মহা গুরুত্বপূর্ন কোন রহস্যের সমাধান জেনে ফেলেছে।
জাহান সাহেব কিছুক্ষণ কথা বলেন না। তাকে কেমন উদাস উদাস লাগছে। সিরাজুদ্দির মনে হয় জাহান সাহেবের ভিতর আগের সেই ফূর্তি ফূর্তি ভাবটা নেই।
সিরাজুদ্দি!
জি ভাইজান!
আমি ভাবছি দু’এক দিনের মধ্যে শহরে ফিরে যাব।
ক্যান ভাইজান, গ্রাম ভাল লাগছে না?
না! যে প্রাণের টানে গ্রামে আসি, প্রকৃতিতে সে প্রাণ কোথায়? তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না এই ভরা ফাল্গুনেও কোথাও বসন্তের ছিটে ফোঁটা নেই। কোথায় ফুলের সমারোহ! কোথায় ভ্রমরের গুঞ্জণ, কোথায় সেই আমের বনের পাগল করা ঘ্রাণ? শিমুল-পলাশের রক্ত-রাঙ্গা সৌন্দর্য! এ-সব কি দেখতে পাচ্ছ? কিচ্ছু নেই। সব আমরা-এই মানুষরূপী দানবেরা নষ্ট করে ফেলেছি।
সিরাজুদ্দি ফ্যাল ফ্যাল করে জাহান সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার কথা ভাল বুঝতে না পারলেও তার ব্যাকুলতা দেখে সে ধরে নিয়েছে, নিশ্চয় গ্রামে বড় ধরণের কোন ক্ষতির কারণ ঘটে গেছে!
জাহান সাহেব বলতেই থাকেন। সিরাজুদ্দি, তুমি কি সেই হিংসুটে দৈত্যের গল্পটা জানো?
সিরাজুদ্দি পূর্বের সেই চেনা ভঙ্গিতে মাথা চুলকায়-অর্থ হিংসুটে দৈত্যের গল্প তার জানা নেই!
জাহান সাহেব বলেন, শোন! এক হিংসুটে দৈত্য তার বাগানে ছোট ছোট কোমল-মতি বাচ্চাদের ঢুকতে দিত না। খেলতে দিত না। ফলে দৈত্যের বাগানে ফুল ফোটা বন্ধ হয়ে গেল, পাখির গান বন্ধ হয়ে গেল। সেখানে নেমে এলো মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতা। আমাদের অবস্থাটা আজ হয়েছে সেই হিংসুটে দৈত্যের মতো। আমরা আমাদের চারপাশটাকে দৈত্যের আবাসভূমি করে ফেলেছি। সিরাজুদ্দি, বলতে পারো যে দেশে সুস্থ মস্তিষ্কে মানুষ কম্পেসার মেশিনের হাওয়া দিয়ে কিংবা জনসন্মূখে নির্মমভাবে পিটিয়ে শিশুদের বিনা কারণে হত্যা করতে পারে সেই দেশে বসন্ত আসবে কী করে! রাকিব-রাজনদের আর্তনাদ বাতাসকে ভারী করে রেখেছে বলেই তো ফাল্গুন এলেও ভ্রমরের গুঞ্জণ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না! ফুলের মত কোমল-মতি কিশোরীরা বখাটের অত্যাচার সইতে না পেরে ঝরে গিয়েছে বলেই তো এই ভরা বসন্তেও ফুল ফুটছে না!
সিরাজুদ্দি অসহায় দৃষ্টিতে জাহান সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকে-দৃষ্টির অর্থ এর থেকে পরিত্রাণ কি হবে না!
জাহান সাহেব বিস্তীর্ণ ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে আছেন। পরিত্রাণের উপায় তারও জানা নেই। তবে তিনি আশাবাদী মানুষ। তার মনে হয়, এই উন্মত্ততা একসময় কেটেই যাবে। যে-দেশের অধিকাংশ লোকই সরলপ্রাণ, সেই দেশের বসন্তকে মুষ্টিমেয় দানব কিছুতেই আটকে রাখতে পারে না। তিনি যেন তার দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন, ফাল্গুনে ঋতুরাজ বসন্ত তার স্ব-মহিমায় আত্মপ্রকাশ করেছে। তিনি মুকলিত আম-বাগানের মাঝে বসে লেখা-লেখি করছেন। চারিদিকে মৌমাছির গুঞ্জন, মৌ মৌ ঘ্রাণ। কৃষ্ণচূড়া, শিমুল, পলাশ আরো লাল হয়ে ফুটেছে। যেন রাকিব-রাজনদের রক্তের রঙ্গ তার সাথে মিশে এত বেশি লাল হয়েছে! তিনি অনাগত সেই ফাল্গুনের প্রতীক্ষায় দূরে তাকিয়ে আছেন, বহুদূর- যেখানে দিগন্ত মাটিতে এসে মিশেছে বলে ভ্রম হয়।
১২ ডিসেম্বর - ২০১৫
গল্প/কবিতা:
১৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪