দুই দুইটা সরকারী হাসপাতালে গিয়েও কোন লাভ হলো না। এত করে রতনের বাবা বোঝাতে চাইলো যে এটা তার ছেলের পুরনো রোগ। করোনার উপসর্গ হলেও করোনা না। কষ্ট হলেও রতন নিজে কথা বলে বোঝাতে চেয়েছে তার এটা অন্য রোগ। এমনকি পূর্বের চিকিৎসার কাগজ পত্র দেখানোর চেষ্টা করেছে। তবুও কোন ডাক্তার বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেউই তাকে চিকিৎসা দিতে চাইলো না। এমন কি হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখলো না পূর্বের পেসক্রিপশন আর রিপোর্ট গুলো। তাছাড়া ওর করোনা হবেই বা কোথাত থেকে? ভার্সিটি বন্ধ ঘোষনা দেয়ার পরদিনই চলে এসেছে বাড়িতে। এসেই আর বাড়ির বাইরে যায় নি ও।
গত একবছরে ভালোই তো ছিল। ফুসফুসের টিস্যুগুলিতে অনিয়ন্ত্রিত কোষগুলো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার আর সময় পেল না। এই অসময়েই কী তাকে আবার অসুস্থ হতে হবে। ও তো ভেবেছিল রোগটা সেরেই গেছে। দুই বছর আগে তার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর দেশে চিকিৎসা করে কোন ভাবেই কোন উন্নতি হচ্ছিল না। পরে ভারতে গিয়ে কয়েক মাস চিকিৎসা করে সুস্থও হয়ে ওঠে। ডাক্তার বলেছিল নিয়ম করে চললে তেমন কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। এরপর থেকে রতন ভালোই ছিল। ভালো থাকা অবস্থায় ছয় মাস আগে নিজেকে চেকআপ করাতে আবার ভারত গিয়েছিল। ডাক্তাররা ওকে দেখে বলেছিল সে সুস্থই আছে। কোন সমস্যা নাই। সেই সমস্যা বেড়ে যাওয়ার আর সময় পেল না। বাড়িতে নিয়ে এসে বাবা অবশ্য হোমিও ডাক্তারের কাছে বলে কয়ে কিছু ওষুধ নিয়ে এসেছিল। সেগুলো খেয়েও উন্নতির কিছুই হচ্ছে না। রতন কী করবে কোন কুল-কিনার খুঁজে পায় না। তার দিন কী আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছে। নিজেকে নিয়ে যতটুকু চিন্তা করে তারচে দশ গুন বেশি চিন্তা করে তার পরিবারকে নিয়ে।
বাবা’র মুখটার দিকে তাকানো যায় না। হাসপাতালে হাসপাতালে যখন যাচ্ছিল তখন পৃথিবীর সবচে বেশি অসহায় ব্যক্তিটাকে সে দেখেছে। ছেলের জন্য এমন অসহায় হতে আর কাউকেই দেখেনি। ব্যর্থ হয়ে যখন তাকে নিয়ে ফিরছিল পুরো পথ নীরবে কেঁদেছেন তিনি। বাড়িতে এসে পুরো এক অসহায় পরিবারকে আবিস্কার করলো ও। মায়ের মুখের দিকে তাকানো যায় না। ছোট বোনটাও লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। শ^াস কষ্ট বেশি হলেও খুব বেশি বুঝতে না দেয়ার চেষ্টা করে রতন। কষ্ট লুকাতে ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকে। ফেসবুকে ঢুকে আর এক ধরনের বিষন্নতায় কেঁপে ওঠে বুক। করোনায় আক্রান্ত পুরো পৃথিবী। কী হবে এই পৃথিবীর। বাংলাদেশেও করোনা সনাক্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে করোনা মুক্ত একটা পৃথিবীর। প্রার্থনা করে ওর পাশের পৃথিবীটার জন্যেও। ওর পরিবার হচ্ছে আর একটা পৃথিবী। এই পৃথিবীটার কী হবে। ফেসবুকে ইদানিং যা দেখতেছে। তাতে অন্যরকম এক ভয় কাজ করে। করোনার জন্য মানুষকে নতুন করে চেনা যাচ্ছে। নিজের মাকে কেউ জঙ্গলে ফেলে আসতেছে। ভাইরা ভাইয়ের লাশ দাফনের জন্য খাটলি পাচ্ছে না। করোনা হোক আর না হোক শুধু করোনার উপসর্গগুলো দেখা দিলেই মানুষ মানুষের ধারে কাছে যাচ্ছে না। এক ঘরে করে দিচ্ছে তাদের পরিবারকে।
করোনা’র ছোবল কতটা ভায়বহ তা হয়তো রতন জানে না। তবে সে জানে তার যেসব সমস্যা বর্তমানে তা তার অতীতেও ছিল এক সময়। উপসর্গ গুলো হয়তো করোনার সাথে মিলে যায় কিন্তু করোনা না। এতই মন্দ ভাগ্য যে, বিষযটা হাসপাতালেও ও বোঝাতে অক্ষম হয়েছে। ফেসবুকে রতন একটা স্ট্যাটাস লিখলো “করোনা নিয়ে দেশের হাসপাতাল গুলোর যে অবস্থা তা দুঃখজনক। আমি জানি আমার করোনা হয় নাই। কিন্তু এটা কাউকে বোঝাতে পারলাম না। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে করোনার জন্যেই আমাকে মারা যেতে হবে।” স্ট্যাটাসটা দেয়ার পর মনে হলো রিমুভ করবে নাকি। দেশের যা অবস্থা কেউ হয়তো এই স্ট্যাটাস দেখে সকাল না হতেই ছুটে আসবে তাদের বাড়িতে লাল নিশানা লাগাতে। করে দিবে লকডাউন। কি ভেবে আবার রিমুভ করলো না। সে রাতে ভালোই ঘুম হলো রতনের। পরের দিন সকাল হতেই ভয় হচ্ছিল কেউ কি আবার লকডাউন করতে আসবে নাকি তাদের বাড়ি। কিন্তু না কেউ আসেনি সারাদিন। ভযটা কেটে গেছে। পুরোপুরি কাটেনি। এখন ভয়টা আবার অন্যরকম। সে যদি মারা যায় পাড়া পড়শি কি বিশ^াস করবে তার করোনা ছিল না! তারা তো পূর্ববর্তী চিকিৎসার পেসক্রিপশন, রিপোর্ট দেখে বিশ^াস করে নিতে পারবে। নাকি তারাও আবার হাসপাতাল গুলোর মতো পেসক্রিপশন, রিপোর্ট গুলো ছুঁয়েও দেখবে না। তার লাশের জানাজা হবে তো? এই রকম ভয় গুলো প্রতিনিয়ত খেলা করতে থাকলো মাথার মধ্যে।
পরের দিন শ^াস কষ্টটা খুব বেড়ে গেল রতনের। কথা বলাই বন্ধ করে দিলো। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো অসহায় এক বাবার মুখের দিকে। তাকিয়ে থাকলো অসহায় এক মায়ের মুখের দিকে। অসহায় বোনের দিকে। তারা কিছুই করতে পারতেছে না তাদের রতনের জন্য। এখন একটি ভয়ই বার বার দোলা দিচ্ছে ওর মনে। না, মৃত্যু ভয় না। সে যদি মারা যায় তাঁর লাশের জানাজা হবে তো! দাফন সঠিক ভাবে হবে তো?