করিডোরের রেলিং ঘেষে এক প্রান্তে ঠাইঁ দাঁড়িয়ে আছে। তখন মাঝরাত । শহরের বাতিগুলো এক এক করে নিবতে লাগলো । অসহায় দৃষ্টিতে তাকিঁয়ে বাহিরপানে। শীতের আকাশ কুয়াশায় আচ্ছন্ন। হালকা কুয়াশাবৃষ্টির প্রচন্ড ঠান্ডা। শেফালির গায়ে জড়িয়ে আছে শুধুমাত্র একটি বাসন্তি রংয়ের শাড়ী। টানটান দেহ । লাবন্যের ছড়াছড়ি এই দেহটিকে এক সময় শেফালির কাছে মনে হতো প্রশান্ত নিষ্পাপ দেহ। কিন্তু আজ শুধুই ঘৃনা আর ঘৃনা । শেফালির মনের অবস্থা আজ বিধ্বস্ত । কিছুক্ষন পরপরই ওয়াসরুমের দিকে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে পাচঁ থেকে সাতবার নিজের অজান্তে শরীরে ইচ্ছেমতো পানি ঢেলেছে । তবুও কুকুরের চেটে খাওয়া শরীর থেকে বিষ কোনভাবেই সরাতে পারছে না। ফুলে উঠা স্তন দুটিওতে ব্যাথা করছে। হারকাপাঁনো শীতের ঠান্ডা, শেফালির কাছে আজ চৈাত্রের গরম মনে হচ্ছে। স্ব^যতেœ যেভাবে নিজের শাড়ীর আচল আর ওরনা দিয়ে যৌবনকে লুকিয়ে রাখতো । আজ সেদিকটার কোন খেয়াল পর্যন্ত নেই।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে শেফালির মা- রোগে সুখে-দুঃখে জর্জরিত। অসুস্থ বিছানায় কাতরাচ্ছে। জরুরী ভিত্তিতে অপারেশন করাতে হবে। নয়ত মৃত্যুর পথ যাত্রী।
যে কোন কিছুর বিনীময়ে মা‘কে বাচাঁতে চায়, শেফালি। সকাল হলেই সফদর সাহেব ব্যাংক থেকে তুলে এক লক্ষ টাকা দিবেন । সেই টাকা দিয়ে মায়ের অপারেশন হবে। সে অধির আগ্রহে প্রতিক্ষার প্রহর গুনছে। মা, সুস্থ হবে, সে প্রত্যাশায় শেফালি স্বপ্নে বিভোর। সে কারণে শরীরের ধর্ষীত হওয়ার বিষ-ব্যথা গুলোকে খানিকটা কমিয়ে দিচ্ছে।
শেফালি বয়স যখন এক দের বছর তখন শেফালি বাবা হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। পরের ঘঁটনাক্রমে জানতে পারে শেফালির বাবা তাদের গ্রামের জমিলা সুন্দরিকে বিয়ে করে বিলেত পারি দিয়েছে। শেফালির মা সেই থেকে প্রতিটি সময়ের সাথে যুদ্ধ করতে থাকে। শেফালিকে লালন পালন করে । কামায় রোজগার এর জন্য পথে-ঘাটে শাড়ী কাপড় বিক্রি করে। কখনো সবজি বিক্রি করে। রাতে কাপড় শেলাই করে । এই আয় রোজগার করতে যেয়ে কখনো পায়ের আর হাতের ব্যাথায় শরীরে জর আসে। ব্যথার পরাসিটামল ঔষুধ খেয়ে সে জর নিবারণ করতো । সকালে সূর্য্য ওঠার আগেই কাজে বেরিয়ে পড়তো। উচ্চস্বরে সবাইকে জানান দিতো ‘‘কাপড় নিবেন.. নিবেন কাপড়, শাড়ী কাপড়, ওরনা ব্লাউজ, শাড়ী কাপড় নিবেন !’’ এ বাড়ী ও-বাড়ী দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতো । বিক্রি করতে কাপড় । শেফালি রোজ একা একাই স্কুলে যায়। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে । রাতে শেফালির মা কাপড় সেলাই করে পাশে বসে ছোট্ট শেফালি পড়াশুনা করে । সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকে। রাতের খাবার একসাথে খায়। শেফালি আবার, তার মায়ের হাতে খাবার তুলে না দিলে খেতে চায় না। শেফালির মা হাতের মুঠোয় খাবার তুলে শেফালিকে খাইয়ে দেয়। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মা-মেয়ে ঘুমিয়ে পরে। মাঝে মাঝে খুব মজার মজার গল্প বলে শেফালির মা । গল্প শুনতে শুনতে কখনো শেফালি রাজকুমারী সেজে ঘুমের দেশে চলে যায়। কখনো দুঃখের গল্পও বলে । একদিন একটা দুঃখের গল্প বলেছিলো শেফালিকে । গল্পটি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া । শেফালি সেদিন কেদেঁছিলো গল্পটি শুনে। গল্পটি মনে গেঁথে রেখেছে । ব্যাস এইটুকুই্র।
নদীর ¯্রােতের মাতো বয়ে চলা সময়ে সাথে পাল্লা দিতে দিতে শেফালিও বড় হতে থাকে। শেফালির সকল চাহিদা পুরন করাই শেফালির মায়ের কাজ। তাই দিবারাত্রী পরিশ্রম করা । এবং শেফালিকে একটি ভালো স্কুলে পড়াশুনা করানো । শেফালি বড় হওয়ার সাথে সাথে পড়াশুনার খরচও বাড়তে থাকে । শেফালির মায়ের পরিশ্রমও বাড়তে থাকে ।
প্রতিদিনের মাতো সেদিনও রাতে ভাত খেতে খেতে হঠাৎ প্রশ্ন করলো মা‘কে ।
ঃ আচ্ছা মা, আমার বাবা দেখতে কেমন ছিলো ? বাবার কোন ছবি আছে তোমার কাছে ?
ঃ শেফালি মা হঠাৎ যেন বিদ্যুৎচমকানোর মতো খানিকটা জ্বলসে উঠে, ফ্রিজ হয়ে আসে তার শরীর । মেয়ের এমন প্রশ্নের উত্তর তার জানা নাই । তবুও বললো “ না, তোমার বাপের কোন ছবি আমার কাছে নেই। তুমি কেন এই প্রশ্ন করছো আমাকে।”
শেফালি তবুও কৌতুহল তার বাবা দেখতে কেমন ছিলো। সে তার মাকে জড়িয়ে বললো মা ‘‘ এমনেই । বাবা, কি মারা গিয়েছিলো। না হারিয়ে গিয়েছিলো । আজ বিশ্ব বাবা দিবস । স্কুলের সবাই তাদের বাবাকে নিয়ে বাহিরে ঘুরতে গিয়েছে। স্কুলের অন্য বন্ধুদের বাবা যখন তাদের নিতে আসে আমি তখন দূর থেকে তাকিঁয়ে থাকি। আমার বাবা নেই কেন মা ? বলো না বলো . . .””
ঃ শেফালির মায়ের মুখে কোন জবাব নেই। কি বলবে মেয়েকে। তবে শেফালির মায়ের মনের ভেতরে বয়ে যাচ্ছে অগ্নিঝর। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে শেফালির গালে চর বসিয়ে দিয়ে বলে’’ খবরদার আমার সামনে বাপ, বাপ করবি না। ”
ঃ এই প্রথম মায়ের হাতে চরের আঘাত পেয়ে শেফালি ঠুকরে ঠুকরে কাদঁছে আর বলছে ‘‘ স্কুলের সবার বাবা আছে । আমার বাবা নেই কেন ?” আমারওতো ইচ্ছে করে বাবার হাত ধরে স্কুলে যেতে । ”
মেয়ের এমন ঠুকরে ঠুকরে কান্না সহ্য করতে পারছে না শেফালির মা । তাই তড়িঘরি করে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে ‘‘মা, কাদিঁস মা, আমার লক্ষ্মি মেয়ে, সোনামানিক , তুই আমার জীবন , তুই কাদঁলে আমি মরে যাবো । মা, আর কাদিস না।
এভাবে খনিকটা বুকে জড়িয়ে রাখার পর শেফালির মা গভীর ভাবে চিন্তা করলো। সত্যিকারের কথাগুলো মেয়েকে বলতে হবে। তাই আর দেরি নয় এখনই বলতে হবে । যেই ভাবা সেই বলা । সেফালির মা তার চোখের পানি মুছতে থাকে । দীর্ঘ যুগের কষ্টগুলো একসাথে আঘাত হানছে তার মনের মাঝে । তবুও তাকে বলতে হবে । কাপাঁ কাপাঁ ঠোঁেট কান্নাবিজরীতে কন্ঠে বলতে থাকে, শেফালিকে । “তোর বয়স যখন এক থেকে দের বছর তখন তোর বাবা আমাকে ছেরে চলে যায়। আমাদের গ্রামে জমিলা সুন্দরিকে বিয়ে করে সে ডুবাই চলে যায়। ” বলেই চুপ করে থাকে ।
শেফালি মায়ের এইটুকু উত্তরে মন ভরে নাই । জানার আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দেয় । তাই মাকে আবারও প্রশ্ন করে ‘‘ তোমাকে কেন ছেড়ে চলে যায় বাবা ? তোমার আপরাধ কি ? বলো না, মা বলো আমাকে ?
শেফালির মা কিছুতেই বলতে রাজি না তবুও আজ সত্যি কথাটা বলতে হবে। তাই বলেই ফেলে ‘‘ আমি যে ‘‘বিরাঙ্গনা’’। ৭১- এ যুদ্ধের বছর আমি ধর্ষিত হই” সেই কথাটা তোর বাবাকে বলেছিলাম । তার পরের দিনই সে আমাকে ছেরে চলে যায়। তোকে একদিন একটি মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলেছিলাম। তুই সারারাত কেদেঁ চোখ ফুলিয়েছিলি। গল্পের ধর্ষিতা খুদিজার জন্য। আমি সেই খুদিজা আজও বেচেঁ আছি ।
বলতে দেরি হলো না । শেফালি তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে ‘‘ মা আমাকে মাফ করে দাও, আমি আর কখনো বাবার কথা জানতে চাইবো না, কখখনো না। তুমিই আমার বাবা ।
শেফালির মা একটি অনুরোধ করে শেফালিকে , সে যে বিরাঙ্গনা এই পরিচয়টা কাউকে না দেওয়ার জন্য। হাত জোর করে এই অনুরোধ করে।
সেদিন থেকে শেফালি তার বাবাকে ঘৃণা করে ।
শেফালি এখন অনেক বড়। একটি আধা সরকারি প্রাইভেট ফার্মে চাকুরী করে। যা টাকা রোজগার করে । মায়ের ঔষুধ কেনা, থাকা-খাওয়া সবকিছু মিলো ভালেই চলতে থাকে সময়টা। হঠাৎ শেফালির মায়ের অসুখটা বড় আকারে দেখা দেওয়ায় তাকে অপারেশন করাতে হবে। ব্যয়বহুল অপারেশন। লাখ তিনেক টাকা লাগবে। তবেই শেফালির বৃদ্ধ মাতাকে সুস্থ করতে পারবে। শেফালি খানিকটা তার মায়ের কাছে আবার ছুটে গেলো। মায়ের পায়ে খানিকটা তেল মালিশ করলো । চোখের পানি ঝরঝর করে বিছানায় পরতে থাকে। যেই মা জীবনের শেষ পর্যন্ত কষ্ট করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মেয়ের পড়াশুনা শিখিয়ে বড় করে তুলেছে। জীবনে সামন্যটুকু অভাব কষ্ট বুঝতে দেয়নি । সেই মানুষটি অসহায় বিছানায় শুয়ে আছে। কোন সারাশব্দটিও পর্যন্ত নেই । গতকাল পর্যন্তও কথা বলেছিলো । শেফালি খানিকটা তার মায়ের সেবা করে আবারও বারান্দায় ছুটে যায়। আসমানের দিকে তাকাঁয়। ডাগর ডাগর চোখ দু‘টি নামিয়ে নিজের দিকে তাকায় । নিজের শরীরকে মনে হচ্ছে একটি ডাষ্টবিন। শফদর আলীর চেটে খেয়েছে সমস্ত শরীর, কুকুরের মাতে কামড়িয়েছে শরীরের আনাচে কানাচে। শেফালি আবার দৌড়ে ছুটে যায় গোসলখানায় । শরীরের সমস্ত কাপড় খুলে ফেলে । কামড়ের লালচে দাগগুলো মুছে ফেলার জন্য পানি ঢালে। দাগগুলোর দিকে তাকাতেই মনের মাঝে জ্বালা দিয়ে উঠে। অসহ্য বেদনায় কাঁদতে কাঁদতে সমস্ত শরীর মুছে নেই শুকনো কাপড় দিয়ে। তারপর কোন রকমভাবে ব্লাউজ আর শাড়ী পরে। আবার বারান্দার দিকে ছুটে যায়। টাকার বিনিময়ে মায়ের চিকিৎসা হবে । মা সুস্থ হবে । আবার সে মায়ের হাতে ভাত খাবে। মা‘কে নিয়ে ঘুরতে যাবে। মা‘কে নিয়ে এটা করবে ওঁটা করবে । অনেক প্লান । সকাল হলেই সফদর সাহেব ১ লক্ষ টাকা তুলে দিবেন ব্যাংক থেকে । তবে শর্ত আছে টাকাগুলো যে শেফালির ইজ্জতের বিনিময়ে দেওয়া সেটা কাউকে বলতে পারবে না। সময়টা মাঝ রাত পেরিয়ে ভোরের দিকে । আজকে রাত্রী যেনে বিস্তৃর্ণ রাত। কিছুতেই ফুড়োচ্ছে না । শেফালির ছঁটফট এদিকে সেদিন যাওয়া আসা চলছেই । কখন ভোর হবে । সকাল হবে । তার মায়ের আপারেশন হবে। ভোরের পূর্ব মুহুর্ত । আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। শেফালির কাছে মনে হলো আকাশটাও আজ প্রতিবাদি হয়ে উঠেছে। লাল হয়ে জ্বলে উঠেছে বাস্তবতার নিমর্মতাকে ধিক্কার জানাচ্ছে। ইত্যাদি ভাবতে ভাবতেই কানে ভেসে এলে ভোরের আযান। মসজিদের মুয়াজ্জিন আযান দিচ্ছে। প্রতিদিন এই আযান শুনেই শেফালি মা জেগে উঠতো। ফজরের নামাজ পড়তো । নামাজ শেষ করে পবিত্র কুরআন পাঠ করতো । তারপর শেফালির জন্য নাস্তা বানাতো । নিজে নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়তো কাজে। অথচ আজ নিরব মূর্তির মতো শুয়ে আছে। হঠাৎ এই আযানের পরপরই শেফালি মা শেষবারের মতো শেফালিকে ডাকলো ’’ শেফালি. ও শেফালি . মা তুই কই . .. এদিকে আয় মা । ্ শেফালি দ্রুত চোখ মুছে ছুটে যায় মায়ের দিকে। মায়ের ডাক শুনে শেফালি মুখে হাসি ফুটে ওঠে । মাকে জড়িয়ে ধারে । শেফালি খুশি তার মা সুস্থ হয়ে উঠেছে । মা কথা বলেছে । শেফালি তার মাকে জড়িয়ে রাখে। কিন্তু ততক্ষনে ‘মা’ এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে । . . .. . . .. .....
১৮ নভেম্বর - ২০১৫
গল্প/কবিতা:
২৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪