১.
ছমির শেখের ছেলেটা ছোট বেলা থেকেই একটু পাগলাটে। ভোর বেলায় সূর্য ওঠার আগে সবাই যখন দল করে আল্লাহ আল্লাহ যিকির তুলে মসজিদে যায় কায়দা পড়তে, তখন হামিদ হাতে একটা বড় ঝিনুক নিয়ে বেরোয় চারা গাছের খোঁজে। ইমাম সাহেবের নিজের ছেলে বলে কথা, লজ্জায় ছমির শেখের আর মুখ রক্ষা হয় না।
বাড়ির দক্ষিণ পাশে উচু একটা পরিত্যক্ত জমিতে নাম জানা না জানা হাজারো পদের গাছ বুনে বুনে একটা জঙ্গল বানিয়ে ফেলেছে। আর সাহস কত! দিনের উজ্জল আলোতেও সেখানে কেউ যেতে চায় না, আর ছেলেটা দিব্যি সাঝ সন্ধেয় সেখানে চড়ে বেড়ায়। ইমাম সাহেব এর কোন উপায় করতে পারেন না।
হামিদের মা নুরজাহান বেগম অবশ্য ছেলের আচরণে কোন ভুল দেখেন না। তার কথা হলো ছেলেতো কারো বাড়া ভাতে ছাই দিচ্ছে না, সেতো কটা গাছই বুনছে। তাহলে এত শাসনের কি হলো। এমনিতেও ছমির শেখের সাথে নুরজাহান বেগমের খুব হৃদ্যতার সম্পর্ক নেই। কথাটা এভাবে না বলে বলা ভাল ছমির শেখ দিন বললে নুরজাহান রাত বলেন। দুজনের এই উল্টো পথে হাটায় কে সঠিক আর কে ভুল তার বিচার কারো করতে হয় না। ঘর পর্যন্তই তা জমে যায়, বাইরে যাওয়ার কোন উপায় নেই। ছমির শেখের সব আগুন নিভিয়ে দেয়ার একটা মোক্ষম অস্ত্র আছে নুরজাহান বেগমের হাতে। চরম অবস্থায় উনি এটা ব্যবহার করেন। আর ছমির শেখও তার পরে কেমন মিইয়ে যান।
হামিদ বাবার মার খেয়ে খেয়ে বড় হচ্ছে। গ্রামের আর দশটা ছেলের সাথে ওর ভালো বন্ধুত্বও নেই। অনেকটা ইচ্ছা অথবা উপায় না পেয়ে সে মজে আছে বাগান করার কাজে। যে গাছটার পাতা দেখে মনে হয় এটা আগে দেখেনি সেটাই সে এনে পুতে দেয়। আর জমিটাও অনেক উর্বর, কোন গাছই মরে না। তবে মাঝে মাঝে ও যখন বড় গাছ বুনতে বড় গর্ত করে তখন ওর মনটা খারাপ হয়। বড় গর্ত খুড়লেই কিছু না কিছু উঠে আসে। সেগুলো বাড়ির পিছনে একটা জায়গায় জমা করে রাখে। মাঝে মাঝে যখন উত্তর দিকে রেল লাইন ধরে ট্রেনটা ছুটে যায়, সব কাজ ফেলে ওটা দেখে আর ভাবে ‘‘এটা কোথা থেকে আসছে? কোথায় যাচ্ছে? কেউ একজন আসবে তাকে নিয়ে যেতে, যেখানে ছমির শেখের শাসন থাকবে না’’। গাড়িটা চলে গেলেই ফিরে আসে নিজের বাগানে।
হামিদের বয়স দশ পেরিয়ে গেছে। ছমির অনেক চেষ্টা চরিত করেও আরেকটা সন্তান লাভ করতে পারেন নাই। স্ত্রীকে ও কিছু বলতে পারেন না এ নিয়ে, নুরজাহানের উত্তর যে রয়েছে হামিদ।
২.
ঊর্মি আজকের এই বিকেলটাই আমাদের জন্য ভাল। আকাশটাও মেঘে ঢেকে আছে আর এই বনটাও একেবারে পারফেক্ট। কি বলো! একটু কষ্ট হবে হয়তো...
রণি ভাই এই মাত্র এত পথ জার্নি করে এলাম, এখনই মেক আপ, গেট আপ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ব? আর্টিফিসিয়াল একটা ভাব চলে আসবে না! তখন তো আবার বলবেন আমি অভিনয় জানি না। আজ দিনটা একটু স্পট ঘুরে দেখি। আর এখন তো বর্ষাকাল, আকাশে সব সময়ই মেঘ পাবেন নো চিন্তা।
যুক্তিগুলো অকাট্য আর এত কম পারিশ্রমিকে কাজ করতে ঊর্মির চেয়ে যোগ্য কাউকে পাওয়া ও যাবে না। তাই ঊর্মির কথার উপর আর জোর খাটান না রণি।
বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি কাজ পেয়েছেন একালের জাদরেল ডাইরেক্টর রণি খাঁন। রেলযোগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে কুমিল্লায় এ স্পটটা দেখে তার মনে ধরে যায়। ফলজ, ভেষজ আর নানা পদের ফুলের একটা তৈরি বাগান যেন, পাশ দিয়ে ছুটে যাবে দূরন্ত ট্রেন, পাশে উপাসনালয়। একেবারে স্বপ্নের মতো সব কিছু ’’প্রকৃতি ধর্ম আর মানুষের সহাবস্থান’’।
রণিকে বলে ঊর্মি একাই ঘুরতে বের হয়। আশে পাশে লোক বসতি তেমন নেই, একেবারে অজ পাড়া গাঁ যাকে বলে তেমন। আধুনিকতা বলতে শুধুমাত্র উত্তর দক্ষিণে দৌড়ে চলা রেল পথটুকুই। শহুরে ভয়ের কোন লক্ষণ নেই। ভালই লাগছে ঊর্মির।
বেগুনি জারুল আর রক্ত রংয়ের কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো যৌবনের প্রায় শেষ প্রান্তে। কিছু ফুল এখনো এলো মেলো ফুটে আছে যদিও, তবু বর্ষার আগমনে তাতে ভাটা পড়েছে বেশ। পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যের আলো যদিও নিচে পৌছাতে পারছে না, মেঘের আড়ালে সে আলো পূব আকাশটার রংই বদলে দিয়েছে। আকাশটা এখন আগুন রং ধরেছে।
অত মুগ্ধ হয়ে কি দেখছেন?
হঠাৎ পুরষ কন্ঠের এমন প্রশ্ন শুনে অপ্রস্ত্তত হয় ঊর্মি। এ নির্জন বনে তাকে হঠাৎ করে কে এভাবে জিজ্ঞেস করতে পারে!
না মানে একটা সুটিংয়ে এসেছি, এখানটাতেই হবে দৃশ্যায়ন, তাই একটু ঘুরে দেখছিলাম।
গাছগুলো অনেক সুন্দর তাই না!
ঊর্মির ভেতরটা কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে কোথাকার কে তাকে প্রশ্ন করছে। ওর বিরক্ত হওয়ার কথা কিন্তু সে তা হচ্ছে না। কি এক মায়াবী যাদুতে প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।
ওটা হরতকি, আর ঐযে ঐ গাছটা হ্যা ওটা অর্জূন, দুটোই ঔষধী গাছ। ঐযে বড় বড় গোল পাতার গাছটা দেখছেন ওটার পাতার একটা ম্যাজিক আছে জানেন...
ঊর্মি মোহান্বিতের ন্যায় কথা শুনে যায়।
এটার একটা পাতা ছিড়ুন, হ্যা এটা হলেও চলবে। হাতের তালুতে নিয়ে মুচড়ে দেখুন...
কিছুক্ষন হাতের তালুতে ঘষায় সবুজ পাতাটা লাল হয়ে যায়। নতুন কিছু দেখার আনন্দ ঊর্মি ভালই উপভোগ করে।
এটা কী গাছ?
আরে আপনিতো দেখি কিছুই জানেন না। হা হা হা এটা সেগুন গাছ।
তারপর দুজনেই চুপচাপ হেটে চলে।
জানেন গাছেদের ও কষ্ট আছে, অনেক কিছুর সাক্ষী হয়ে আছে ওরা তবে রক্ষে ওরা বলতে পারে না। ধরুন গাছগুলো যদি সব এক সাথে তাদের কষ্টের কথা বলা শুরু করে আমাদের কানের অবস্থাটা কেমন হবে?
ছেলেটাকে ঊর্মির খুব ভয়ের মনে হচ্ছে না, বরং বেশ বন্ধু বৎসল বলেই মনে হচ্ছে। আর ওর কথার মায়াবী জাদুতে কেমন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। যেন কতদিনের চেনা!
চলুন আপনাকে পুরো বনটা ঘুরিয়ে দেখাই। আপনি আমাকে ভয় পাচ্ছেন নাতো আবার?
উত্তরে ঊর্মি একটু হাসে শুধু।
ছেলেটার পাশে হাটে আর মুগ্ধ হয়ে ওর মুখে গাছেদের কথা শোনে। সময় এগিয়ে চলে তার আবহমান ধারায়। হঠাৎ করেই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে। হাটতে হাটতে অনেকটা পথ চলে এসেছে ঊর্মি। না ভিজে ফিরে যাবার উপায় নেই। ছেলেটা বলে
চলুন সামনের বাড়িটায় একটু বসবেন, বৃষ্টি শেষ হলে ফিরে যাবেন।
ঊর্মি আকাশের দিকে তাকায়, হাতদুটো দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে ঘুরতে থাকে। নৃত্যের আবেশে বৃষ্টিটা উপভোগ করে। ওর হঠাৎ ই খেয়াল হয় এখনো ছেলেটার নামটাই জানা হয়নি। দৃষ্টি নামিয়ে আনে
আপনার নাম...
ওর মুখ দিয়ে কথা বের হয় না আর, সামনে পিছনে ডানে বামে কোথাও ছেলেটাকে দেখতে পায় না। বৃষ্টিতে ভিজে হোক আর ভয়েই হোক ওর কাপুনি শুরু হয়। নিচে মাটির দিকে তাকিয়ে দেখে লাল একটা জামার কিছু অংশ মাটির বাইরে বেরিয়ে আছে। আর বাকিটুকু মাটির নিচে। এই জামাটাই তো ছেলেটার গায়ে ছিল। ঊর্মি আর কিছুই ভাবতে পারে না। ঢলে পড়ে নিচের কাদা মাটিতে।
৩.
জ্ঞান ফিরতেই ঊর্মি নিজেকে আবিস্কার করল এক বৃদ্ধার ঘরে। টিমটিমে কেরোসিনের সলতে পোড়া আগুনে অভ্যস্ত নয় সে, তাই ঘরের পরিবেশটা খুব ভাল ভাবে নজরে এলো না।
একপ্রস্থ হাসিমাখা মুখে বৃদ্ধা বললেন-
তুমি কেডা গো মা এই হাইঞ্জা বেলা কবরস্থানে ঘুরতে আইছ?
ঊর্মির শরীরটা আরেকবার কাঁটা দিয়ে ওঠে। এমন চমৎকার একটা বন কবরস্থান হয় কি করে! এর মধ্যেই সন্ধ্যে পেরিয়ে বৃষ্টি হওয়ায় ঊর্মিকে খুজতে খুজতে সুটিং ইউনিটের সবাই হাজির হয় এই বৃদ্ধার বাড়িতে।
ঊর্মি স্থির হয়ে বসে তার ঘুরতে ঘুরতে এখানে আসার এবং ছেলেটার বর্ণনা দেয়। বৃদ্ধা তার জীর্ণ শাড়ির আঁচলে চোখ মুছেন। অনেক বছর আগের কথা মনে পড়ে যায়। যেদিন থেকে হামিদকে আর দেখা যায়নি সেদিনতো হামিদ নতুন লাল জামাটাই পড়েছিল। বৃদ্ধা উঠে বাইরে চলে যায় সাথে অন্যরাও। ডাইরেক্টর রণির ইশারায় ক্যামেরা চলতে থাকে। আষাঢ়ে বৃষ্টি থেমে গেছে একটু আগে, আর আকাশ জুড়ে চাঁদটাও ছড়িয়েছে তুমুল জোছনা। ক্যামেরাটা একবার চাঁদের দিকে ঘুরে এসে দলটার দিকে স্থায়ী হয়।
লাল জামাটার কাছে এসে হাটু গেড়ে বসেন, দু হাতে খাবলে মাটি সরাতে থাকে থাকেন সেটা উঠিয়ে আনার প্রয়াসে। এক সময় বছর দশেকের একটা কঙ্কাল সহ জামাটা উঠে আসে। বৃদ্ধা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। একটা হারাবার ব্যথা ইউনিটের সবাইকে ব্যাথাতুর করে তোলে।
নুরজাহানের বয়স এখন পঞ্চাশের কাছাকাছি। গায়ের রং দেখে কারোই বুঝতে অসুবিধে হয় না যৌবনে উনি কতটা সুন্দরী আর লাবণ্যময়ী ছিলেন। একাত্তরের মাঝামাঝি বাসেত মাঝির ঘরে আসেন নতুন বউ হয়ে। পুরো দেশে তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে। মাত্রতো কয়টা দিন এরই মাঝে একদিন বাসেত উধাও হয়ে গেলেন। লোকমুখে শুনতে পেলেন তার স্বামীকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছেন। গ্রামের কত কিশোরী আর যুবতী মেয়েকে রাজাকার, মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেল।
নুরজাহান বেঁচে গেলেন ছমির শেখের কারনে। ছমির শেখের সঙ্গী রাজাকাররা যখন ওকে নিয়ে যাবার জন্য গেল ছমির হঠাৎ করেই বলল ইনি আমার বিবি হন। অন্যরা হাসাহাসি করে চলে গেলেন। অনেকের কাছে সম্ভ্রম হারানোর চেয়ে নুরজাহান নিজেকে সপে দেন ছমির শেখের হাতে। সেই থেকে ছমির শেখই নুরজাহানের স্বামী।
সেদিন ছমির শেখ যখন হামিদকে আচ্ছা রকম মেরে কাবু করে ফেলেছিলেন, অসহায় নুরজাহান বলেছিলেন-
ওরে তুমি মাইর না, ওতো তোমার পোলা না। ও আমার পোলা। মুরুদ থাকলে নিজে বাপ অইয়া দেহাও।
হামিদ যে ছমির শেখের সন্তান নয় এটাই ছিল নুরজাহানের সেই অস্ত্র। অক্ষম ছমির শেখের চোখে রাক্ষুসী আগুন দেখেছিলেন নুরজাহান। যে আগুনে জ্বলেছিল হাজার হাজার তাজা প্রাণ। তারপর দীর্ঘ বছর গুলো একাকী শুধুই হামিদের অপেক্ষা...
ছোট্ট হামিদের হাতে গড়া আজকের এই বিশাল বনেই পাওয়া গেল তার কঙ্কাল। ক্যামেরাটা চালু থেকে সব ঘটনার স্বাক্ষী হয়। একবার হামিদের জমানো হাড়গোড় আর মাথার খুলিগুলোও ক্যামেরা বন্দি হয়। হাজার প্রাণের বিনিময়ে গড়ে উঠা এ সবুজ দেশের গাছগুলো যদি কথা বলতে পারতো!
ঊর্মির ভাবুক দৃষ্টি আকাশ থেকে পৃথিবীটাকে দেখে। একখন্ড সবুজ চাদরে ঢাকা নয়ানাভিরাম একটা দেশ। সেখানে রক্তের কোন চিহ্ন দেখা যায় না। হাতের মুঠোতে শুধু লেগে আছে সেগুন গাছের পাতা ঘষা লাল রং। হয়তো এটা হাজার মানুষের রক্তেরই রং।
১৯ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৩৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪