স্বপ্নের অপরাহ্নে
জ.ই. আকাশ
এক.
দিবা গোমড়া মুখে ক্যা¤পাসের এক কোণে বারান্দার সিঁড়িতে বসে আছে। এক হাতের উপর মুখটা ভর করে ক্যা¤পাসের সামনে সবুজ ঘাসের দিক অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে ঘড়ির দিকে চোখ ফেরায় দিবা। যত বারই ঘড়ির দিকে চোখ পড়ে, তত বারই গেটের বাইরের দিকেও চোখ দুটি একবারের জন্য হলেও উঁকি মারে। ফোনটা হাতে নিয়ে বার বার ডায়াল করছে সূর্যের নাম্বারে। একের পর এক ডায়াল করেও ফোনটা খোলা পায় না। এই মুহূর্তে পুরোপুরি বিরক্তের ছাপ ফুঁটে উঠেছে দিবার চোখে মুখে। ফাগুনের আকাশের সূর্যের প্রখরতা আর রাগে যেন ওর ফর্সা মুখটিও লাল হয়ে উঠেছে। আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকালো দিবা। এবার উঠে কলেজ ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে বাইরে বারান্দায় এসে একটা পিলারের সাথে গা-টা পুরোপুরি হেলিয়ে দিয়ে হাত দুটো বুকের উপর পেঁচিয়ে একটু আরামের সাথে দাঁড়িয়ে একবার নীল আকাশটাকে দেখল। আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে রৌদ্রের প্রখরতা যেন একটু মাত্রাতিরিক্ত বেশিই মনে হলো দিবার কাছে। সূর্যটা সরাসরি দিবার চোখে পড়ার সাথে সাথেই চোখটা মুহূর্তেই নামিয়ে নিয়ে টিএসসি’র আঙ্গিনাটা দেখার চেষ্টা করল। টিএসসি’র বিভিন্ন জায়গায় জোড়ায় জোড়ায় ছেলে মেয়েরা পাশাপাশি বসে আড্ডা দিচ্ছে। কেউ কেউ আনন্দের জোয়াড়ে মিলিয়ে গিয়ে গার্ল ফেন্ড’র কাধে মাথা রেখে ওই নীল দিগন্তের আভা উপভোগ করছে। দিবা আবার ঘড়ির দিকে তাকালো। রাগে ক্ষোভে দিবার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মনে মনে ভাবছে, শয়তানটা আজ আসুক, দেখাবো মজা। একটা মেয়ে তাঁর জন্য এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্যাম্পাসে অপেক্ষার প্রহর গুণছে। আর সে কিনা দিব্বি বাতাসে গাঁ ভাসিয়ে আছে। ফোনটা খোলা পেলে হয়তো ফোনেই ওর চৌদ্দগোষ্ঠীর পিন্ডি দিত। কিন্তু সেটাও হচ্ছে না। আনমনেই একবার সোহওয়ার্দী উদ্যানের দিকে চোখ পড়তেই দেখল, সূর্যটা খুব তাড়াহুড়ো করে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। সূর্যকে দেখেই দিবা অভিমানে উল্টো ঘুরে ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। সূর্য দূর থেকে দেখেই হাঁটার গতিটা পূর্বের চেয়ে আরেকটু বাড়িয়ে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ডাকতে লাগল,
দিবা, এই দিবা, এই কোথায় যাচ্ছো তুমি? দাঁড়াও বলছি...
দিবার ভাব দেখে মনে হচ্ছে সূর্যের ডাক যেন ওর কান পর্যন্তই পৌঁছায়নি। দিবা সূর্যের ডাককে ভ্রুক্ষেপই করল না। সূর্যও যেন নাছোর বান্দা। সূর্য এক পর্যায়ে দৌড়ে এসে দিবার সামনে দু’হাত বাড়িয়ে পথ আগলে দাঁড়ালো। দিবা থমকে দাঁড়ালো। সূর্যের দিকে বড় বড় চোখে তাকালো। রাগে অভিমানে যেন ওর চোখ দিয়ে আগুনের কুণ্ডু বের হচ্ছে। দিবার ভাব বুঝেই সূর্য একটু নরম সুরে বলল,
কি ব্যাপার, তোমাকে ডাকছি শুনতে পাও নি?
আমাকে দিয়ে তোমার কি দরকার? রাস্তা ছাড় সূর্য। আমাকে যেতে দাও।
রাস্তা ছাড়বো মানে? আমি সব কাজ ফেলে তোমার জন্য ক্যাম্পাসে আসলাম। আর তুমি নাকি বলছ রাস্তা ছাড়তে?
কার জন্য থাকবো?
সূর্য আলতো করে বলল,
কেন? আমার জন্য।
যার সময় সম্পর্কে ন্যূনতম কোনো রেসপন্সিব্লিটি নেই, অন্তত আমি তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে পারি না।
স্যরি! আসলে হয়েছে কি......
এক্সকিউজমি, আমি তো তোমার কাছ থেকে কোনো অজুহাত শুনতে চাইনি। তাহলে কেন অজুহাত দেয়ার পায়তারা করছ? পথ
ছাড়ো, আমি বাসায় যাব। তোমার সাথে কোনো প্রকার কথা বলার মতো মন বা মানসিকতা কোনোটাই এখন অন্তত আমার নেই। পথ ছাড়ো।
সূর্য দু’হাতে কান ধরে আলতো করে বলল,
স্যরি সোনা, প্লিজ এবারের মতো মাপ করে দাও। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ...
দিবা সূর্যের হাত জোড় করে মাপ চাওয়ার ভঙ্গি দেখে মুখটা আলতো করে অন্য দিকে ঘুরিয়ে মুখে মুচকি হাসির রেখা টানলো। কিন্তু সূর্যকে তা বুঝতে দিলো না। সূর্য কান ছেড়ে দিয়ে এবার একটু মুড নিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে ওই আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
ঠিক আছে, মানুষ থাকুক তার মুড নিয়ে। আমাকে তো আর কেউ ভালবাসে না। আমাকে কেউ ভালবাসুক আর নাই বাসুক, আমি কিন্তু মানুষকে ভালবেসেই যাব। তাই তো কাল রাতেও একটা কবিতা লিখলাম। ভাবছিলাম ক্যাম্পাসে গিয়ে কবিতাটি পড়ে শুনাবো। না শুনলো কেউ আমার কবিতা। আমার কবিতা আমিই পড়ব, আমিই শুনবো। বলতে বলতে সুর্য সিড়ির উপর বসে পড়ল। ওই নীল দিগন্তে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কবিতাটি আবৃত্তি শুরু করল সূর্য,
আমি খুঁজে পাই তোমাকে
ওই সুনীল আকাশে।
পুঞ্জু পুঞ্জু সাদা মেঘের চিত্রকল্পে,
শারদ প্রভাতের স্নিগ্ধতা, প্রসন্নতা ও উৎফুল্লতায়
যেন তুমি স্পর্শ করে যাও আমাকে ॥
আমি... ... ... ... ... ... ... ... ... ...।
সূর্যের মুখে কবিতা আবৃত্তি শুরু হতে না হতেই দিবার রাগ যেন মুর্হূতের মধ্যেই মিলিয়ে গেল ওই আকাশ নীলিমায়। আস্তে আস্তে দিবা সূর্যের পাশে এসে বসে পড়ল। সূর্য আড় চোখে একবার দিবাকে দেখে নিল। দিবা তা বুঝতে পারল না। দিবা গভীরভাবে হারিয়ে গেল সূর্যের কবিতার মাঝে। একসময় ওর মাথাটা নুইয়ে দিল সূর্যের কাঁধে। দিবার মাথাটা যখন সূর্যের কাঁধে ভর করল, মুর্হূতের মধ্যেই সূর্য কবিতা আবৃত্তি বন্ধ করে দিবার মুখের দিকে তাকাল। দিবার মুখের ডান পাশটায় একগুচ্ছ চুল এসে পরায় এই মুর্হূতে দিবাকে বেশ সুন্দর লাগছে। সূর্য অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দিবার মায়াবী মুখের দিকে। কিছুকক্ষণ তাকিয়ে মনে মনে ভাবল, এ যেন জীবনানন্দের সেই হারিয়ে যাওয়া জীবন্ত বনলতা সেন। বেতের ফুলের মতো নীলাভ মমতা ভরা মায়াবী মুখটি যেন ভালবাসার গভীর নীল সমুদ্র।
সূর্যকে চুপচাপ থাকতে দেখে মাথাটা তুলে সূর্যের দিকে তাকিয়ে দিবা বলে,
কি ব্যাপার সূর্য, থামলে কেন? তোমার কবিতাটা কি শেষ?
সূর্য এবার দু’হাতে দিবার মুখটি সামনে এনে ওর চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে বলে,
না। আমার কবিতা শেষ হওয়ার নয়। তুমিই যে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা।
দিবা একটু আহ্লাদের সুর এনে বলে,
তাহলে তুমি আমাকে কষ্ট দাও কেন?
স্যরি সোনা। আর এমন হবে না। প্লিজ..
এ রকম কথাতো তুমি কত বারই বললে? কিন্তু আমার কাছ থেকে বিদায় নিলেই তো আমার কথা তোমার মনে থাকে না।
তুমি কি শুধু এই দুঃখের বেহালাই বাজাবে? কোথায় আমার পেট ছটফট করছে?
তো?
তো কি আবার? আমার প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে।
ও তাই! এখন ক্ষুধা লেগেছে তাই না? এই ক্ষুধাটা আগে কোথায় ছিল? ঠিক আছে চলো।
সূর্য মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,
কোথায়?
দিবা একটু ঠোঁট ভেংচিয়ে বলল,
জাহান্নামে। চলো, তোমাকে খাইয়ে নিয়ে আসি।
উঠতে উঠতে সূর্য বলল,
মানে, তুমি আমাকে খাওয়াবে?
দুজনই হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে সূর্যের হাতটা হাতের মুঠোই নাড়তে নাড়তে দিবা বলল,
হুম, ভাবলাম আজ তোমাকে স্পেশাল একটা খাবার খাওয়াবো।
মানে কি?
দিবা সূর্যের শরীরের সাথে একেবারে নিজেকে মিলিয়ে দিয়ে সূর্যের চোখে চোখ রেখে বলে,
মানে তেমন কিছু না। তোমার সব কবিতাই আমার ভাললাগে। তার মধ্যে আজকের কবিতাটা একেবারে ভিন্নতর মনে হয়েছে। আমার মনের গভীরে তোমার কবিতার কথাগুলো পৌঁছে গেছে। আই লাভ সূর্য। আই লাভ ইউ। ইচ্ছে করছে তোমাকে...
কি? থামলে কেন?
দিবা সূর্যের দিকে তাকিয়ে একটু মুসকি হেসে বলে,
যা এখন সম্ভব নয়, তা বলে আর লাভ নাই।
সূর্য নাছোর বান্দার মতো আঁকড়ে ধরে বলল,
বল না প্লিজ, শুনি কি?
দিবা বাম হাত দিয়ে সূর্যের নাক ধরে আলতো ঝাঁকুনি দিয়ে বলে,
এতো ন্যাকা ভাব ধরছো যেন তুমি কিছুই বুঝ না?
না। আমি বুঝতে পারছি না। আমি কি জ্যোতিষি? তোমার কি কখন কি ইচ্ছে করে আমি বুঝবো? বল না প্লিজ..
তাহলে তো তুমি আমাকে ভালইবাসো না।
সূর্য যেন থমকে দাঁড়ালো। দিবার মুখোমুখি হয়ে বলল,
কি বললে তুমি? আমি তোমাকে ভালবাসি না?
তাহলে আমার মন কি চায়, তুমি কেন বুঝতে পার না?
আমি বুঝতে পারি না ঠিক তা নয়, আসলে তোমার মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিলাম।
দিবা মুখটা আলতো ঘুরিয়ে বলে,
তুমি জানো না, মেয়েদের বুক ফাঁটে তো মুখ ফোঁটে না।
জানি কিন্তু তুমি তো আমাকে ভালবাসো। আমার কাছে তোমার এত সংকোচের কি আছে? আমাকে তোমার আদর করতে মন চায়, এই সামান্য কথাটা তুমি মুখে বলতে পারছো না।
দিবা মুসকি হেসে মুখটায় একটু ভেংচি কেটে বলে,
না, পারছি না।
ঠিক আছে, আগে পারনি এখন তো পারছো? এখন একটু কর।
দিবা সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলে,
সূ-র্য তুমি না একটা...
কি?
পাগল।
সূর্য দিবার মুখটি দু’হাতের মুঠোই নিয়ে বলে,
হ্যাঁ আমি পাগল। শুধু তোমার জন্য, তোমার ভালবাসার জন্য। এই হৃদয় গভীরের সবটুকুই যে তোমার জন্য।
বলেই মুখটি দিবার মুখের দিকে বাড়িয়ে দিতেই দিবা সূর্যের মুখটিতে হাত চেপে বলে,
সূ-র্য, এ কি করছো? লোকজন তাকিয়ে আছে তো? অসভ্য, চল।
দুই.
সূর্য আর দিবা হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে আজিজ সুপার মাকেটের নিচ তলায় একটা হোটেলে। মহিলা কেবিনে ঢুকে সামনা সামনি বসে পড়ে দু’জন। বেয়ারা কাছে আসতেই দিবাই অর্ডার দেয় গ্রিল আর স্পেশাল নান। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবারগুলো ওদের টেবিলে আসে। দু’জন খেতে শুরু করে। খেতে খেতে দিবা জিজ্ঞেস করে,
ও ভাল কথা, তোমার যে চাকরিটার কথা বলছিলে সেটার খবর কি?
সূর্য ছোট করে জবাব দেয়,
ভাল।
দিবা সূর্যের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে সূর্য মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে। সূর্যের খাওয়া দেখে দিবা ভাবে, সত্যিই তো ও খুব ক্ষুধার্ত। তাই আর কথা বাড়ায় না দিবা। নিরবতা এনে দু’জনই খেতে থাকে। ওদের খাওয়া শেষে বেয়ারা দু’জনের জন্য দুটো স্প্রাইট এনে সামনে দিল। টিস্যু দিয়ে হাত মুছে স্প্রাইটে একটা চুমুক দিয়ে সূর্যের দিকে সরাসরি তাকিয়ে দিবা বলল,
চাকরির খবর ভাল বলতে কি?
সূর্য টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বলল,
ভাল বলতে ভাল। দেশের যে অবস্থা হরতাল আর অবরোধে অস্থির। এর ভেতর আর চাকরির খবর নেব কখন? তাই খারাপ তো বলা যায় না। জানতে চাইছো তাই বললাম ভাল।
অবরোধ আর হরতাল তো তোমার দলই দিচ্ছে। তাহলে হরতাল অবরোধের দোহাই কেন দিচ্ছ?
তা দিচ্ছে। কিন্তু বিরোধী দলের কোনো দাবীই তো সরকার মানছে না।
দিবা একটু রাগান্বিত হয়ে বলল,
সে যাই হোক, তোমার পলিটিক্যাল ব্যাপারটা কিন্তু আমার একদম ভাললাগে না সূর্য। এখন রাজনীতির যে পরিস্থিতি, তাতে কখন কি হয় বলা যায় না। তোমাকে আজ কিছু কথা বলি সূর্য, তুমি রাগ করবে না তো?
সূর্য দিবার দিকে তাকিয়ে বলল,
ঠিক আছে বল, মহারানীকে অনুমতি দেয়া হলো। রাগ করবো না।
ফাজলামু করো না। আইএম সিরিয়াস।
ওকে, ফাইন। ডু নট জোক। আই এম সিরিয়াস টুও।
তোমার এই সব রাজনীতি আমার ভাললাগে না। তুমি এসব বাদ দিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনাটা শেষ কর। সূর্য তুমি গ্রামের ছেলে। অনেক ভাল স্টুডেন্ড। ভাল মতো মাস্টার্সটা কমপ্লিট করতে পারলে তোমার আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। ভাল একটা জবও পেয়ে যাবে। অন্য কোথাও না হলে, আমি অন্তত বাবাকে বলে একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারব। তাছাড়া, অনেক কষ্টে তোমার বাবা-মা তোমার লেখাপড়ার খরচ চালায়। নিজেও টিউশনি কর। তাই বলছি, তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও প্লিজ। তোমার একটা কিছু হয়ে গেলে তোমার পরিবারের কি হবে একবার ভেবে দেখেছ? তোমাকে নিয়েও যে তাদের অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা। আর আমিও যে তোমাকে আমার স্বত্তার সাথে মিশিয়ে ফেলেছি। যেখান থেকে কেউ তোমাকে আলাদা করতে পারবে না। বাবা আমার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলছিল। আমি বলছি পড়াশুনাটা আগে শেষ হোক, তারপর দেখা যাবে। সূর্য প্লিজ, এখনও সময় আছে। তুমি রাজনীতির পথ ছেড়ে মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনাটা শেষ করে একটা কিছু কর। যাতে আমিও তোমাকে আমার বাবার সামনে মাথা উচু করে দাঁড় করাতে পারি। প্লিজ সূর্য, প্লিজ, প্লিজ..
সূর্যের হাতে হাত রেখে কথাগুলো বলতে বলতে যেন দিবা আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। সূর্যও মাথা নিচু করে মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শুনছিল। দিবার কথা যখন শেষ হয়, সূর্য আস্তে আস্তে দিবার মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়। চোখের কোণ দিয়ে ফোটা ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ছে দিবার নাকের ডগায়। সূর্য দু’হাতে দিবার মুখটিকে আগলে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে দিবার কপালে ছোট্ট একটা চুমু এঁেক দেয়। দিবাও সূর্যের হাত দুটোকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। সূর্যের চোখেও এরই মধ্যে পানি টলমল করে ক’ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল সামনের টেবিলের ওপর। সূর্য দিবার হাতের মুঠোই থেকে একটা হাত ছাড়িয়ে দিবার চোখটা কোনোরকমে মুছে বলল,
দিবা, আমি সত্যি খুব সৌভাগ্যবান তোমার মত এতো সুন্দর মনের একটা মানুষ পেয়ে। তুমি আমাকে ভালবাস তা জানি, কিন্তু সে ভালবাসাটা যে এতটা গভীর, তা কখনও ভাবিনি। তুমি এতটা যে আমাকে এতোটা ভালবাস, আমাকে আর আমার পরিবার নিয়ে এতোটা ভাব, তা কখনও বুঝিনি। রিয়েলি ইউ আর গ্রেট। তুমি এতক্ষণ যা বলছো, আসলেই তা সত্য। রাজনীতি করে কি লাভ? আমার মতো ছেলে রাজনীতি থেকে কিই বা আসা করে? আমার বাবা দেশের জন্য আজ পঙ্গুবরণ করে ঘরে বসে আছে। পায়নি মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট কিংবা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। গ্রামের বাজারে একটা ভাঙা ঘরে দর্জির কাজ করে অর্ধাহারে, অনাহারে থেকে আমাকে পড়াশুনা করিয়ে এ পর্যন্ত এনেছে। শুধু আমার বাবা নয়, এদেশে এখনো হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আছে, যারা দেশের জন্য জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের খবর কেউ রাখেনি। কোনো সরকারই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মূলায়ন করতে পারেনি। এ রকম একটা ভাঙ্গা, জোড়াতালি পরিবারের ছেলে হয়ে তোমার কাছ থেকে ভালবাসা তো দূরের কথা, তোমার দিকে তাকানোর মত সাহসও আমার হওয়ার কথা না। তারপরেও তুমি আমাকে তোমার জীবনের সাথে জড়িয়ে নিয়েছো। এ যে আমার মত একটা হতভাগার জন্য কত বড় পাওয়া, তা আমি আজই প্রথম বুঝতে পারলাম।
এভাবে বলছো কেন সূর্য? তোমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। এদেশে গর্ব। হয়তো সরকারি কোনো সহযোগিতা সে পাইনি। তাতে কি? একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তো তাকে ছোট করে দেখার নেই। আমি অন্তত গর্ববোধ করি তোমাকে নিয়ে। একজন মুক্তিযোদ্ধার ছেলেকে আমি ভালবাসতে পেরেছি। তুমি একজন দেশমাতৃকা রক্ষার সৈনিকের সন্তান, এটাই তোমার বড় পরিচয়।
সূর্য এবার দিবার হাতে হাত রেখে বলে,
আমি আর রাজনীতির পথে হাঁটবো না। আজ, এখন থেকে তোমাকে আমি কথা দিলাম। আমি কালই হল ছেড়ে দেব। রুবেলের সাথে আমি আজই যোগাযোগ করে আমি ওর মেসে উঠে যাবো। হলে থাকলে রাজনীতির পথ আমার পরিহার করা খুব কষ্টকর হয়ে যাবে। তার চেয়ে ভাল, আমি হলই ছেড়ে দিবো।
দিবা মুখে রৌদ্রজ্জ্বল হাসির রেখা টেনে বলল,
রিয়েলি?
ইয়েস, রিয়েলি অ্যান্ড ইট ইজ ট্রু।
থ্যা্কংস্ সূর্য। ভ্যালেনটাইন ডে’র আর মাত্র ২ দিন। এবার ভ্যালেনটাইন ডে-তে আমি কিন্তু ফাটাফাঁটি একটা কবিতা চাই।
সূর্য একটু মুসকি হেসে বলল,
শুধুই কি কবিতা? আর কিছু...
দিবা চোখটা একটু বড়সড়ো করে সূর্যের দিকে বলল,
এই, তোমার কথা কিন্তু আবার লাইন বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে।
ওকে ডিয়ার, স্যরি। তবে ভ্যালেনটাইন ডে-তে আমি যেমন একটা স্পেশাল কবিতা দিব, তেমনি আমিও কিন্তু স্পেশাল কিছু আশা করি।
দিবা মুসকি হেসে সূর্যের পিঠের একটা কিল বসিয়ে বলল,
টাইম উইল ছে।
ওকে। কি আর করা, চলো। তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আমি হলে ফিরবো।
দু’জন বেরিয়ে গেল। একটা রিক্সা ডেকে তাতে চেপে বসল দু’জন। রিক্সাওয়ালা এলিফেন্ট রোডের দিকে চলতে থাকল।
তিন.
আজ ভ্যালেনটাইন ডে। দিবা সকালে ঘুম থেকে উঠেই গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে নাস্তার পর্ব শেষ করে। দিবা খুব সিম্পল সাজতে ভালবাসে। তেমন উগ্রপন্থি’ সাজ তার ভাললাগে না। এমনিতেও সে খুব শান্ত শিষ্ট এবং ভদ্র টাইপের। বাসন্তী রঙের একটি শাড়ী বের করে তাতে ম্যাচিং করা একটা ব্লাউজ পড়ে, একটু সাধারণ সাজেই আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে মেলে ধরে দিবা। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজের কাছেই খুব অবাক লাগল দিবার। নিজেকে কেন জানি নিজের কাছেই খুব অপরূপ মনে হলো। হালকা সাজেই দিবাকে আজ খুব চমৎকার লাগছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই দিবা মনে মনে ভাবনার বেড়াজালে আটকে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগল, আজ আর নিজেকে সূর্যের কাছ থেকে রক্ষা করা যাবে না। মনের মাঝে এক অদৃশ্য কামনা বাসনার জন্ম নিল দিবার। দিবা ভাবছে, আমিও তো চাই, সূর্য আমাকে পাগলের মতো ভালবাসবে, আদর করবে। ওর ভালবাসা তো শুধু আমার জন্যই। মন প্রাণ উজাড় করে আমিও সূর্যকে ভালবাসতে চাই। কাছে পেতে চাই নিজের মতো করে। ভাবতে ভাবতে আয়নার সামনেই এক ঝিলিক হাসির রেখা টেনে হঠাৎ দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই বিস্মিত হলো দিবা। একটু মুসকি হাসি দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল দিবা।
দিবা টিএসসি-তে ক্যান্টিন চত্ত্বরে যখন পৌঁছালো তখন সাড়ে দশটা বাজে। চার পাশে চোখটা ঘুরিয়ে সূর্যকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু সূর্যকে না দেখে একটু মুখে একটু বিরক্তের ছাপ এনে ফোনটা খুলেছে কিনা একটু ট্রাই করতে লাগল। ফোনটা এতোক্ষণে খোলা পেয়ে হাসির রেখা ফুটে উঠলো দিবার মুখোমণ্ডলে। ফোনটা রিসিভ করতেই দিবা বলল,
কি ব্যাপার সূর্য কোথায় তুমি?
আমি বাংলা একাডেমির সামনে। তুমি কোথায়?
আমি ক্যান্টিন চত্ত্বরে আছি। তাড়াতাড়ি আসো।
ঠিক আছে। দুমিনিটওয়েট কর আমি আসছি।
বলেই লাইনটা কেটে দিবার চোখটা চলে গেল অপাজয় চত্ত্বরভেদ করে বাংলা একাডেমির দিকে।
হঠাৎ দিবার চোখ আটকে গেল সূর্যের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই। মুহূর্তের মধ্যেই দিবার মুখটায় শরতের দানাবাঁধা মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়া স্বচ্ছ ঝলমল রোদের আলোর মতো হাসির রেখা ফুঁটে উঠলো। দিবা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সূর্যের আসার পথে। অপাজয়ের কাছে আসতেই দু’দিক থেকে দুটি মোটরসাইকেল এসে রিক্সার গতি রোধ করে সরাসরি সূর্যের বুকে তিন রাউন্ড গুলি ছুড়ে মোটরসাইকেল দুটি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সূর্য রিক্স্রা থেকে ঢলে পড়ে গেল রাস্তার উপরে। সূর্যের পড়ে যাওয়া দেখে দিবাও চিৎকার দিযে সূর্যের দিকে ছুটতে থাকে। গুলির শব্দে মুর্হূতের মধ্যেই টিএসসি-তে যে যার মতো দৌড় ঝাপ শুরু করে দেয়। রক্তের বন্যা বইয়ে যায় অপরাজয় চত্ত্বরে। কিছুক্ষণের মধ্যে পথচারীরা আস্তে আস্তে এসে ভিড় জমায় সূর্যের চারপাশে। দিবা দৌড়ে এসে চিৎকার দিয়ে লুটিয়ে পড়ে সূর্যের বুকের ওপর। দিবার চিৎকারে যেন টিএসসি চত্ত্বরের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে। সূর্যের বুকের ওপরেই দিবা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। দিবা চিরদিনের জন্য অচেতন হয়ে যায়। প্রকৃতির নীল আকাশের সূর্যটা ডোবার সাথে সাথে যেমন দিনের আলোটা চলে যায় পৃথিবীকে অন্ধাকারাচ্ছন্ন করে দিয়ে; ঠিক তেমনি প্রকৃতির এই নিয়মের সাথে রাজনৈতিক ক্রোন্দলের শিকার হয়ে দুটি মানব মানবী সূর্য আর দিবাও যেন মিলিয়ে যায় পৃথিবী নামক গ্রহ থেকে।
সমাপ্ত