বেনাপোল সীমান্তে পৌঁছেছে গত রাতে।
মোমেন তালুকদার একটি সস্তা হোটেলে রাত কাটিয়েছে । খুজে পেতে রাতের বেলা মোমেন আলাপ সেরেছে ধুড় দালাল ইব্রাহিমের সাথে। ইব্রাহিম খুব ভাল করে পর্যবেক্ষণ করল মোমেনকে । বলেছে বাড়ি মিরপুর, প্রথম যাচ্ছি ,ঈদের আগে কিছু মালামাল আনব। আরও বলল তার আত্মীয় এখন কোলকাতায় ।সেও মালামাল পাচারের কাজ করে । মোমেনের কাছে দু’হাজার টাকা দিয়ে জরুরি পাসপোর্ট আর ভিসার ফাঁদ বড্ড বেশি লাগছিল। এরকমটাই সে ইব্রাহিমকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল। যাহোক তার মত ধুড় অনেক- অনেক । সমস্যা হল তার ভদ্রলোকি চেহারা সুরত সময় সময় বিপদ ডেকে আনে। হয়ত মার্ডার ফার্ডার বা ডাকাতি করে ভাগছে । এজন্য ইব্রাহিমদের কড়ি গুনতে হয়। ধুড় যায় চিকিৎসা , মালামাল , বেড়ানো , সোনার বিস্কিট পাচার আরও কত কি । বিস্কিটের রেট আলাদা ।সোনা বলে কথা।
সকাল ১১টায় সবাই জড়ো হল সীমান্তের কাছে।
এখান থেকে হরিদাসপুরের পেট্রাপোল আর বেনাপোল সীমান্ত গেট দেখা যায়। বরিশাল, পিরোজপুর , বাগেরহাট আর খুলনা যশোরের ধুড়ই বেশি । এরা ভোরের বাসে এসেছে বলে বর্ডার পার হওয়ার দেরির কারন। সবার কাছ থেকে বিশ, আর পঁচিশ করে পঞ্চাশ টাকা নিলো ইব্রাহিম । বিশ ইব্রাহিমের বাকিটা দুই বাহিনীর ।তারা বিল এলাকা পার হচ্ছে বিডি আর আর বি এস এফের নাকের ডগা দিয়ে।তবে কোমর তল্লাশি থেকে কেউ বাচেনি । মোমেন তার স্পঞ্জ খুলে হাতে নিয়েছে আর চারিদিক ঘুরে ফিরে দেখছে। মাঝ পথে থামতে হল । মোমেনের মনে হল তারা হাত বদল হয়ে ওপারের কারো হাতে পড়ল। মাথা ফাটা রোদ্দুর। একজন বৃদ্ধা অসুস্থ হয়ে পড়লে তার জোয়ান ছেলে হবে মনে হয় পাঁজাকোলা করে এগুতে লাগলো । আধা ঘণ্টা হেটে তারা বড় বড় গাছের নিচে কিছু ভ্যান দেখতে পেল। তারা কোমরে গামছা বেধে রেডি । কোন কথা নেই কারো সাথে মায় কি ভ্যানওয়ালা পর্যন্ত চুপ। গ্রামের রাস্তা দিয়ে ভ্যান চলতে শুরু করল।
গন্তব্য বনগাঁ রেল স্টেশন । ভ্যান ভাড়া জানা নেই, হবে কিছু একটা। ভ্যান চলছে আর মোমেনের স্বস্তির পরিমান বাড়ছে। চল্লিশ মিনিট পরে সবাই পৌঁছে গেল। বারো রুপী দিয়ে বিদ্যুৎচালিত ট্রেনের টিকেট কাটল। স্টেশনের পিনে কা পানি আজল ভরে খেল। মুড়ি কিনতে কিনতে ট্রেন চলে এলো । এখন প্রতি ঘণ্টায় , ভোরে পাচ মিনিট অন্তর। ওদেরকে নিয়েই হুশ করে ট্রেন চলতে শুরু করল।
গরম আর অনিশ্চিত জীবনযাত্রার ক্লান্তিতে গ্রাম , শহর , ধানক্ষেত দেখতে দেখতে মোমেন ঘুমিয়ে গেল ।
বেশ হৈ চৈ আর কোলাহলে মোমেনের ঘুম ভেঙ্গে গেল । এবার ট্রেনে উঠে আসতে শুরু করা উন্মত্ত জনতাকে ঠেলে প্রানপনে প্লাটফর্মে পা রাখল। এই বিব্রত পরিস্থিতির কথা সে শোনেওনি , দেখেওনি যদিনা তার শরীরে এসে পড়া লোকটি জবাব দিত হ্যা দাদা এটাই শেয়ালদা।
সন্ধ্যা তখন ।
অফিস ফেরতা মানুষের সেকি ভিড়। মোমেন পকেট হাতড়ে কটা কাগজের টুকরো বের করে তা থেকে রবীন হালদারের টেলিফোন নাম্বার বের করে স্টেশনের কোনে ফোনের লাইনে দাঁড়ালো। এটা আবার কয়েন মেশিন । কে তাকে কয়েন দেবে এখন !
পানের দোকানদার সরাসরি না করলে বাদামওয়ালাকে ধরল। বিশ পয়সার বাদাম কিনে দশ পয়সার খুচরো পাওয়া গেল । রবীনবাবুকে একবারেই ধরা গেল। তিনি মোমেনকে কখনো দেখেননি বা চেনেনও না। রবীনবাবু তার ঢাকার স্বজনদের কথা শুনে বললেন ‘ তুমি কি সেই মোমেন যার ফাঁসির আদেশ হয়েছে’?
হ্যা , আমিই সেই ! গলাটা কেঁপে গেল একটু ।
একটা বাস নাম্বার দিয়ে বললেন ’২১ টা স্টপেজ গুনে গুনে তারপর বেলগাছি নাববে, তারপর আমিই তোমায় নিয়ে আসব, ওখানে ফোন আছে’।
কত বাস এখানে কত তার নাম্বার।আসছে ঠেসেঠুসে কিন্তু যাচ্ছে প্রায় খালি । ভালই হল। কন্ডাক্টরকে বলল ‘আমায় বেলগাছি নামিয়ে দেবেন দয়া করে’। প্রত্যুত্তরে জবাব এলো ‘ ওপারের মাল বুঝি’ ! মাথা নাড়িয়ে হ্যা সুচক জবাব দিল মোমেন ।
রবীনবাবু এলেন ও তাকে নিয়ে গেলেন তার আস্তানায় । পুরাতন বাড়ীর নিচতলায় ছোট ছোট তিন রুম । খুব সাধারন মানের একটা চেয়ার আর টেবিল আর শোয়ার আয়োজন মাদুরে , মেঝেতে । একটা ধোয়া লুঙ্গি মিলল । ভিতরে উঠোনের কোনে বস্তায় ঘেরা কুয়ো আর দড়ি বাধা বালতিতে জল । শেষ হয়ে আসাএক টুকরো সাবান পাওয়া গেল ভাগ্যের জোরে তাই দিয়েই ঘসে মেজে ঝরঝরে হল মোমেন।
ভাত আলু চটকানো , ডিম ভাজি আর ডাল। বেশ পরিতৃপ্তির সাথে আজকের দিনের প্রথম ভাত খেল । রান্না দারুন , বাঙ্গালী হিন্দুদের রান্নার খুব নামডাক আছে।
‘কি পরিকল্পনা তোমার , কি করতে চাও?’
‘হ্যা , জী , কিছু একটা ধরিয়ে দেবেন -----।’
‘কোলকাতায় টিকে থাকা কঠিন হবে কারন তোমার কোন কর্ম অভিজ্ঞতা নেই আর তুমি ব্যাবসাপাতিও বুঝবে না।’
একটু চুপ থেকে বললেন ‘কাকদ্বীপ চলে যাও ওখানে নতুন আইটেম চিংড়ির পোনা।তোমার মত নতুন অতিথিরা ইদানিং ওখানে যাচ্ছে এবং ভালই করছে।তুমি শুধু কিনবে আর খদ্দেরদের কাছে বেচবে। তবে তোমায় দাদন দিতে হবে জেলেদের। একটু মাথা খাটিয়ে করতে পারলে জমিয়ে ফেলতে পারবে, দেখো।’
‘তাহলে দাদা আমি আগে যাই একটু ঘুরে ফিরে দেখি বুঝি।আবার আসতে হবে আপনার কাছে টাকা নিতে, একসাথে নেবনা , এই ধরেন দশ হাজার করে নেব।’
পরদিন সকালে নাস্তা সেরে ওরা গেল বেশ একটা ঘিঞ্জি এলাকায় । এরই তিনতালায় ছোট একটা রুম হাজতখানার মত লোহার গরাদে ভিতর থেকে তালা দেওয়া , একজন বুড়ো নাকের ডগায় চশমা, খাচা খুলে দিল আর হাত জোড় করে অভ্যর্থনা করল নিঃশব্দে। ভিতরে সিন্ধুক বড় একটা , বসার ব্যাবস্থা মাদুরে , মাটিতে। বাবু অবশ্য গদিতে বসেন সামনে বড় কারবারি বাক্স , নকশা করা , পুরাতন। দেয়ালে কালী মূর্তি তাতে ধুপ কাঠি জ্বলছে । রবীন বাবু দাড়িয়ে পুজো সারলেন এবং বসলেন ।পাশের টেলিফোনে ডায়াল করে কথা বললেন, মনে হল তিনি ঢাকায় কথা বলছেন, মোমেনের দিকে এগিয়ে দিলেন। মোমেন তার ভালভাবে পৌঁছানোর খবরটা আব্বা – আম্মাকে দিতে বলল । টেলিফোনের ওদিকে মামা, উপদেশ দিলেন এবং দুদিকেই ফোনে যোগাযোগ রাখতে বললেন।
একজন লোক এলো ময়লা গা গতর ধুতি পরা ।লোহার গেট খুলে গেল । সামনে দাড়িয়ে একটা স্লিপ তুলে দিল। শব্দহীন লেনা দেনা কোন কথা নেই কারো মুখে। একটা জীর্ণ খেরো খাতায় রবীন বাবু কিছু একটা দেখলেন তারপর আদেশ প্রাপ্তির অপেক্ষায় পলকহীন রবীন বাবুর দিকে তাকিয়ে থাকা বুড়োকে হাতের পাঁচটা আঙ্গুল উচিয়ে দেখালেন । কোনের সিন্ধুক খুলে পাঁচটি সোনার বিস্কিট আগত লোকটির হাতে তুলে দিলে সে কোমর থেকে কালো পাথর বের করে তাতে প্রতিটি বার যাচাই করল এবং একটি ছোট থলিতে ঢুকিয়ে আবার চলে গেল।
মোমেন চুপচাপ বসে সব নিষ্ঠার সাথে দেখছে।
একটি জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের আলো আর পুরাতন দালান দেখা যাচ্ছে। বুড়ো লোকটি ঐ জানালা দিয়ে নিচে ঝুকে হাক দিল’সুখিন্দর, বড়া চা’য়ে লাও’। খানিক বাদে হাতে কেটলি আর মাটির পাত্র নিয়ে একজন এলো। লোহার রডের ফাকা দিয়ে সে চা’য়ে ঢেলে দিল তিনটি পাত্রে । ওর ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই।
বেশ আয়েশ করে চা খাচ্ছে মোমেন তালুকদার এমন সময় তিন জন ছেলে এলো । তারা রবীন বাবুকে চাইলে বুড়ো তাদের পাসপোর্ট আর স্লিপ চাইল। ওরা তালাবদ্ধ লোহার গরাদের বাইরে দাড়িয়ে রইল।
রবীন বাবু স্লিপ আর পাসপোর্ট চেক করলেন এবং আরেকটি খাতায় লেখা কিছু নাম্বারের সাথে মিলিয়ে দেখলেন । বৃদ্ধকে বললেন ‘লোকনাথ ,ওদের পয়ত্রিশ হাজার গুনে দাও।’ ওরা যারা বাংলাদেশী পাসপোর্ট বহন করছিল তারা গেটে দাড়িয়ে গুনে টাকা পকেটে ভরল।
মোমেন পুরো বিষয়টি খুব সহনশীল আর নিবিষ্ট মনে পর্যবেক্ষণ করছিল।
দুপুরে রবীন বাবু তার হাতে পাচ হাজার রুপী তুলে দিয়ে বললেন প্রয়োজনীয় জামা- কাপড় ,জুতো সব কিনে নাও। ছোট্ট একটা খাতায় টাকার অঙ্ক টুকে রাখলেন । সেখানে ইন্ডিয়ান রুপী পচাত্তর হাজার লেখা আছে।
মোমেন বেরিয়ে রবীন বাবুর দেয়া তথ্যে বাসে চড়ে এসপ্ল্যানেড এলো তারপর পথচারীদের জিজ্ঞাসা করে নিউমার্কেটের সামনে হাজির। এক কাপড়ে চলে আসা মোমেন শার্ট , টি শার্ট , লুঙ্গি, প্যান্ট, জুতা, কেডস, টুথব্রাশ, রেজর সব কিনল।
পড়ন্ত দুপুরে একটি সস্তা দেখতে রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেল। আধা কাটা ড্রাম থেকে পানি উঠিয়ে হাত মুখ ধুয়ে তেল চিটচিটে টেবিলে। ভেতরের অনেকেই ঢাকার বাংলায় কথা বলছে। মোমেন কারো দিকে দেখছেনা আর তার শেভহীন নোংরা কাপড় কারো দৃষ্টি কাড়ছে না । বিল দিয়ে হাতের ব্যাগগুলো নিয়ে বাইরে নামতেই কাধে হাত , ‘দোস্ত কই যাও’ ? চমকে ওঠার পালা। চঞ্চল , তার বন্ধু , অনেকদিন দেখা হয়না, একেবারে বোকা বনে গেল। আমি সব জানি বইলাই রেস্টুরেন্টের মধ্যে আওয়াজ দেইনাই । মোমেন শুকনো গলায় বলল দোস , অন্য আলাপ পাড়ার আগে কাপড় পাল্টানো জরুরি। হেব্বি ময়লা। নিউমার্কেটের পিছনে বড় মসজিদ আর লাগোয়া টয়লেট, গোসলখানা সবই আছে। খুব ফ্রেশ হয়ে গোসল সেরে নতুন কাপড়ে, জুতায় বেরিয়ে এলো মোমেন। পুরাতন সব সাথের ডাস্টবিনে ফেলে দিল।
চঞ্চল তাকে অভয় দিল এখানে এক্সপোজ হলে কোন সমস্যা নেই। তোমার মত আরও অনেকে এখানে আছে আর কেউ কেউ চুটিয়ে ব্যাবসা করছে। চল আমাদের ওখানে যাই। রবীন হালদারকে ফোনে বন্ধু প্রাপ্তির কথা বললে তিনি রাজি হলেন এবং বললেন আজকে আমিই তোমার জন্য জায়গা খুজছিলাম ।
ওরা গড়িয়া চলে এলো। এক বাড়িতে অনেক বাঙ্গালী । তাকে কেউই চেনেনা কারন সে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা পাড়ের ছেলে আর এরা প্রায় সবাই ঢাকার। ওর নাম বদলে মোহন ডাকার অনুরোধ করল মোমেন । রাতে বাথরুমে সময় নিয়ে দাড়ি গোঁফ কেটে সাফসুতর এক যুবক বেরিয়ে এলো। দীর্ঘক্ষণ দাত ব্রাশ করল যা গত তিনদিনে হয়নি । এক কাপড়ে , পায়ে স্পঞ্জ , পকেটে মামার দেয়া দুহাজার টাকা , কয়েক টুকরো কাগজ আর রবীনবাবুর ফোন নাম্বার সম্বল করে ঢাকা ছেড়েছে। ওইদিন সকাল ১১টায় কোর্টে তার ফাঁসির হুকুম হয়। ভাগ্নের কারখানায় সাথে সাথেই জেনেছে। মামা বললেন বাকি টাকা এই ঠিকানায় পাবে কোলকাতায় । দুপুরের প্রথম বাসে যশোর তারপর আরেকটি বাসে বেনাপোল।
মোমেন অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরের জানালায় দাড়িয়ে শরীর বাকিয়ে আকাশ আর তারা দেখছে । মা ,বাবা সবার কথা মনে পড়ল , চোখের কোনে পানি। জিজ্ঞাসা করল নিজেকে এই একজন পলাতক খুনি , ফাঁসির দড়ি হাতে ছুটছে ,এই জীবন কি তোমার কাম্য ছিল? মাথা নাড়ল অস্ফুট চিৎকারে না , না ,না । পেছনে চঞ্চলের হাত ‘আয় খায়া দায়া ঘুম দে একখান , টেনশন লইছ না।