উৎসর্গ

লাজ (জুন ২০১৮)

পারভেজ রাকসান্দ কামাল
  • ১০
১)
উনিশ নম্বর চৌধুরী লেনের গলির মুখে ঢুকতেই একটা বোঁটকা গন্ধ নাকে লাগে সবার। বেশ ছোট খাট একটা গলি। একবার একমাথা থেকে ঢুকলে আর আরেক মাথা দিয়ে বের হবার কোন পথ নেই। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ডেড এন্ড’। গলির একপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটি কালো রঙের কংক্রিটের নালা। মূলত গন্ধটি ঐ নালা থেকেই আসে। মাঝে মাঝে পৌরসভার পরিচ্ছন্নকর্মীরা নালা পরিষ্কার করে নালার কালো কালো ময়লা রাস্তার উপরেই ফেলে রাখে। যেকোনো পথিক এই গলিতে ঢুকলেই প্রথমেই নাকে রুমাল চাপা দেয়। তবে এ পাড়ার বাসিন্দাদের অবশ্য ওসব নাকে হাত দেয়া লাগে না। সবই আসলে অভ্যাসের ব্যাপার। ইদানিংকালে গলির দুপাশে বেশ কিছু নতুন বাড়ি ঘর উঠছে। অনেকে আবার পুরোনো বাড়ি মেরামত করে একটু আধুনিকিকরণ করেছে এই আরকি।
এই গলিরই শেষের মাথায় রয়েছে একটি আগেকার আমলের লাল ইটের দোতলা বাড়ি। নীচতলাটা নানা গাছপালা, শ্যাওলা ও বুনো বন জংগলে ভরে গেছে। ঠিক বসবাসের উপযুক্ত নেই। আর কেই বা বসবাস করবে। উপরতলায় মাত্র কয়েকটি প্রাণী থাকে। দু’তিনটি ধাড়ি ইঁদুর, কিছু আরশোলা, কয়েকটি টিকটিকি আর মনুষ্যকুলের মধ্যে রমেন মাষ্টার।
রমেন মাষ্টার সারাজীবন বকুলতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাষ্টারী করে গেলেন। নিজের আইবুড়ো নাম ঘুচিয়ে পরবর্তি জীবনে পা রাখার সাহস বা সঙ্কল্প কোনটিই করেন নি। স্কুলের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের মানুষ করবার মহান দ্বায়িত্ব পালন করে গেছেন। তাঁর ধারণা নিজের বংশ বৃদ্ধির থেকে নিজের আদর্শ কে প্রতি বছর সব ছাত্র ছাত্রীর মাঝে বিলিয়ে দিতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া এই দেশ একদিন সুখী সমৃদ্ধিতে ভরে উঠবে। হীনতা-দীনতা, নীচতা-শঠতা সব বইয়ের পাতাতে থাকবে, বাস্তবে আর দেখা দিবে না।
আসলে সমাজে একধরণের মানুষ থাকেন যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ান। রমেন মাষ্টার অনেকটা সেরকম একজন মানুষ। তবে বনের মোষ তাঁর কপালে না জুটলেও দুষ্টু কিছু বাঁদর জুটেছে। মহল্লার সব ছোট ছেলেমায়েদের বাবা মায়েরা রমেন মাষ্টারের কাছে নিজেদের কচি কাঁচাদের পাঠিয়ে এক প্রকার নিশ্চিন্তে থাকেন। শুধু অক্ষরজ্ঞানই নয় রমেন মাষ্টার ও বকুলতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকেরা তাঁদেরকে আদর্শ মানুষ হিসাবে সমাজের সুকঠিন পথে ছেড়ে দিতে পারবেন এই বিশ্বাস তাঁদের মধ্যে আছে। মাঝে মধ্যে রমেন মাষ্টার গত ত্রিশ-পয়ত্রিশ বছর ধরে কত ছাত্র ছাত্রী পার করছেন তার হিসাব করতে থাকেন। আর মনে মনে বেশ পুলকিত বোধ করেন। নিজের যক্ষা রোগীর ফুসফুসের মত ধুঁকে ধুঁকে চলা পোড়ো বাড়ি, বোঁটকা গন্ধযুক্ত এঁদো গলি বা কালো রঙের অগভীর নালা সব কিছু ভুলে যান ওই নিষ্পাপ সরলমতি শিশুদের দিকে তাকিয়ে। সারাজীবন এমনিভাবেই পার করে দিলেন রমেন মাষ্টার।
আজ রবিবার। বেশ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে পরিষ্কার ইস্ত্রী করা কাপড় চোপড় পরে স্কুলের দিকে রওয়ানা হলেন। স্কুলে পৌছাতেই গণিত শিক্ষক রহমত স্যার এসে রমেন মাষ্টার কে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “স্যার, আপনি যে আবার স্কুলে আসবেন ভাবতেই পারিনি”।
রমেন মাষ্টার একটু হেসে জবাব দিলেন, “গত বৃহঃপতিবার আমাকে অবসরে যাবার বিদায়ের আয়োজন করেও আমাকে বিদায় করতে পারলেন না তো? পারবেন না। বিদায় নেবো আমি একেবারে আখেরী বিদায়ের কালে।” মজা করে কথা বলা রমেন মাষ্টারের একটি বৈশিষ্ট্য। তারপর আবার মুচকি হেসে বললেন, “ওই যে কথায় আছে না,
‘ম্যায় গুস্তাফি করেগা ইকবার
য্যব সব বান্ধু লোক প্যায় দল চলেঙ্গা
ম্যায় উসকো কান্ধ পার সওয়ার।’”
গত সপ্তাহে রমেন মাষ্টার বকুলতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। স্কুলের সব সহকর্মীরা ও ছাত্রছাত্রীরা মিলে তাঁকে বিদায়ও দিয়েছেন। এখন রমেন বাবুর অখন্ড অবসর জীবন পালন করার কথা। কিন্তু যেহেতু বাড়িতে কয়েকটি ইঁদুর, আরশোলা, টিকটিকি ছাড়া আর কেউ নেই, তাই তিনি আর বাড়িতে থাকতে পারলেন না। চলে এসেছেন তাঁর প্রিয় কর্মক্ষেত্র বকুলতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। গণিত শিক্ষক রহমত স্যার এখন প্রধান শিক্ষকের দ্বায়িত্ব পালন করছেন।
এভাবেই একেকটি দিন একেকটি মাস পার হতে থাকে। আগের মতই প্রতিদিন নিয়ম করে রমেন মাষ্টার স্কুলে আসতে থাকেন। তাঁর প্রিয় বাঁদরের দলের সাথে সময় কাটান, স্কুলের বিভিন্ন বিষয়ের তদারকি করেন, বর্তমান প্রধান শিক্ষককে তাঁর বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজে সাহায্য করেন। যদিও নিয়ম বহির্ভুত তারপরও রমেন মাষ্টার পুরোদমে নিয়মকরে অফিস করতে লাগলেন। শুধু পার্থক্য একটাই। সবাই মাস গেলে বেতন পাচ্ছেন। কিন্তু রমেন মাষ্টার এখনও অবধি পেনশন আর প্রভিডেন্ট ফান্ডের এককালীন জমানো টাকা পাচ্ছেন না। মুখ ফুটে রমেন মাষ্টার কিছু বলেন না। ভেতরে ভেতরে তিনি একটু লাজুক স্বভাবের মানুষ। নিজের ঘরের মাটির ব্যাঙ্কে যে কয়েকটি টাকা জমানো আছে তাই দিয়ে এই কয়েক মাস চলছে। এছাড়া তাঁর সঞ্চয় আর কিছু নেই।
সঞ্চয়ের কথা বললেই তিনি বলতেন, “অবসরের পর তো প্রভিডেন্টের টাকা পাবই। তাই এখন সঞ্চয় করে বর্তমান জীবনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবার কোন মানেই হয় না।” সারাজীবন নিজে যা কিছু উপার্জন করেছেন তারমধ্যে নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত অংশটুকু গরীব ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। মানুষের বিপদ আপদে পাশে এসে দাড়িয়েছেন।
বেশ কিছুদিন পর স্কুলের সহকর্মীরা লক্ষ্য করেন রমেন বাবুর শরীর ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে, বয়সজনিত নানান রোগ শোকে ভুগছেন কিন্তু ওষুধ পথ্য ঠিকমত কেনা হচ্ছে না। এমনকি রান্নার এতদিনের কাজের বুয়াকে ছাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সবসময় রমেন মাষ্টার কালো প্যান্টের উপর হাফহাতা হাওয়াই শার্ট পরেন। খুব যত্ন করে পরিষ্কার করা ও ইস্ত্রী করা থাকত তাঁর কাপড় চোপড়। কিন্তু এই পড়ন্ত বেলায় তাঁর শার্ট প্যান্টের অবস্থা অনেকটা তাঁর বাড়ির মতই তথৈবচ হয়ে উঠেছে। সহকর্মীরা বেশ বুঝতে পারছেন রমেন বাবুর অর্থকড়ির টানাটানি চলছে। সবাই মিলে টিফিন পিরিয়ডে রমেন মাষ্টার কে জিজ্ঞেসা করলেন তাঁর প্রভিডেন্ট ফান্ড ও পেনশনের কী অবস্থা। তিনি খুব একটা সদুত্তর দিতে পারলেন না। লাজে একেবারে রাঙ্গা হয়ে গেলেন, নিজের অর্থকষ্ট সহকর্মীদের মাঝে ধরা পড়ে যাবার জন্য।
বর্তমান প্রধান শিক্ষক রহমত স্যার বললেন, ‘আমি বেশ কয়েকবার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি স্যারের পেনশনের ব্যাপারে। কিন্তু কোন খবর পাই নি। মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তা বলেছেন যে, স্যার কে নিজে গিয়ে তদবির করতে হবে। তাহলে কাজটি সহজে হয়ে যাবে।’
কথাটি শুনতেই রমেন মাষ্টারের মুখ রৌদ্রে শুকাতে দেয়া কাঁচা আমের মত এতটুকু হয়ে গেল। লাজ ও ভয়ে রমেন বাবু যেন কুকড়ে গেলেন। যিনি নিজে জীবনে কারোর কাছে নিজের জন্য কোন অভাব-অভিযোগ-অনুযোগ করেন নি, তিনি যাবেন পেনশনের টাকার তদবির করতে! ছি ছি ! একই লজ্জা!! আর তাছাড়া ঢাকা শহরে চলতে তাঁর ভীষন ভয় করে। সহকর্মীরা রমেন মাষ্টার কে অনেক দিন ধরেই চিনে। তাই রহমত স্যার তাঁর আরেক জুনিয়র সহকর্মী ইয়াকুবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইয়াকুব, রমেন বাবু তো তোমারও শিক্ষক ছিলেন পরে সহকর্মী হয়েছেন। তাই স্যারের জন্য তুমিই স্যারের সাথে যাবে ঢাকা শহরে সচিবালয়ে। তুমি চালাক চতুর এ যুগের ছেলে। স্যারের পেনশন আর প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুরাহা করে তবে ফিরবে।’ রমেন মাষ্টার যদিও না না করতে লাগলেন। কিন্তু পেটের দায় বড় দায়। তাই তিনি অবশেষে রাজি হলেন ঢাকায় মন্ত্রণালয়ের সচিবালয়ে যাবার জন্য। তদবির টদবির যা হবে সব করবেন ইয়াকুব, তিনি শুধু সাইনবোর্ডের মত দাড়িয়ে থাকবেন।
২)
যথাসময়ে রমেন বাবু ও ইয়াকুব ঢাকায় আসলেন এবং যোগাযোগ করে সচিবালয়ের গেটে উপস্থিত হলেন। কোথা থেকে যেন ইয়াকুব সচিবালয়ে ঢোকার পাশ জোগাড় করে নিয়ে আসলেন। স্কুল থেকে আসবার সময় রহমত স্যার বলে দিয়েছিলেন, “মাহফুজুর রহমান নামে আমাদের স্কুলের এক ছাত্র এখন মন্ত্রণালয়ের বেশ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। তিনি রমেন স্যারের প্রথম জীবনের ছাত্র। ইয়াকুব, তুমি স্যার কে নিয়ে সেই লোকের সাথে দেখা করবে। দেখবে সেই সব ব্যবস্থা করে দিবে।”
ইয়াকুব অক্ষরে অক্ষরে রহমত স্যারের কথা মেনে পথ চলতে লাগল। মিশন ‘রমেন মাষ্টারের পেনশন ও প্রভিডেণ্ট ফান্ড’।
গেট থেকে পাশ জোগাড় করে তাঁরা সচিবালয়ে ঢুকল। একে ওকে জিজ্ঞেস করে মাহফুজুর রহমানের কক্ষের সামনে উপস্থিত হল। মাহফুজুর রহমানের সাথে মোবাইল ফোনে আগেই কথা হয়েছিল ইয়াকুবের। কক্ষের সামনে টুলে বসে আছে একটি পিয়ন। দরজার উপর বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘ডঃ মাহফুজুর রহমান, সহকারী সচিব...’ রমেন মাষ্টার নাম ফলকটি পড়লেন। গর্বে তাঁর বুক ৪২ ইঞ্চি থেকে ফুলে ৪৬ ইঞ্চি হয়ে গেল। ইয়াকুবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেখো ইয়াকুব, আমার ছাত্র। আজ ডক্টোরেট।” রমেন মাষ্টারের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। অনেকক্ষণ পর এই প্রথম রমেন মাষ্টার কথা বললেন। এইবার ইয়াকুবেরও বেশ খুশি লাগছে- স্যারের আনন্দ দেখে।
যাইহোক, পিয়ন কে পরিচয় দিতেই সে ভিতরে ঢুকলো অনুমতি নিতে। অনুমতি নিয়ে রমেন মাষ্টার ও ইয়াকুব প্রবেশ করল ডঃ মাহফুজুর রহমানের কক্ষে। রমেন মাষ্টার কে দেখে চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালেন মাহফুজুর রহমান। স্যার কে খুব খাতির যত্ন করে বসালেন। তারপর শুনলেন সব কথা। স্যারের পেনশনের কথার থেকেও বেশি আলোচনা করলেন, স্কুলের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীটির কথা, ছেলেবেলার কথা, বন্ধুদের কথা ইত্যাদি।
সব শুনে মাহফুজুর রহমান বললেন, “সব হয়ে যাবে স্যার। কোন চিন্তা করবেন না। দু’দিন পর আবার আসুন।”
এভাবে দু’দিন পর পর রমেন মাষ্টার ও ইয়াকুব আসতে লাগলেন। ইতিমধ্যে প্রায় তিন চারবার দেখা করেছেন ডঃ মাহফুজুর রহমানের সাথে। এদিকে ঢাকায় থাকার খরচ অনেক। সব খরচ সামাল দিতে পারছেন না রমেন মাষ্টার। ইয়াকুব রমেন মাষ্টার কে বলল, “স্যার আপনার ছাত্র তো মনে হচ্ছে আমাদের ঘোরাচ্ছে। আপনি আজ একটু কড়া ভাষায় বলবেন।”
এ কথা শুনে রমেন মাষ্টার একচোট হেসে নিলেন। তারপর বললেন, “শোন ইয়াকুব, ও কত বড় পদে চাকরী করে। কত দ্বায়িত্ব তাঁর। আসলে কী জানো ইয়াকুব মানুষ সবসময় দৌড়ে প্রথম হতে চায়। কিন্তু সে মাত্র দুই জায়গায় হেরে গেলেও জিতে যায়। একটি হল তাঁর সন্তান ও আরেকটি হল তাঁর ছাত্রের কাছে। আমি ডক্টোরেট করতে পারিনি। আমার ছাত্র পেরেছে। এই দৌড়ে আমি পিছিয়ে। তাতেও আমি জিতে গেছি। তারপরও তুমি যখন বলছ তখন না হয় ডক্টোরেট ছাত্র কে একটু বকেই দেব। হা হা হা...”
ইয়াকুব ও রমেন মাষ্টার আবারও দেখা করলেন ডঃ মাহফুজুর রহমানের সাথে। কিন্তু পেনশন বিষয়ক কোন কথা আগালো না। মাহফুজুরের ওই ‘হয়ে যাবে’, ‘চিন্তা করবেন না স্যার’, ‘কত টেবিল ঘোরে স্যার ফাইল’, ‘সবই তো বোঝেন স্যার’ ইত্যাদি কথা ছাড়া আর কোন কথা নেই। এই কয়েকদিন ওই এক কথা শুনতে শুনতে ইয়াকুবও ক্লান্ত। ইয়াকুব রমেন মাষ্টার কে নিয়ে বেরিয়ে এল ডঃ মাহফুজুর রহমানের কক্ষ থেকে। আসার সময় ইয়াকুব দেখল যে রমেন মাষ্টার কিছুই বললেন না মাহফুজুর রহমান কে। তাই নিজেই উদ্যোগ নিয়ে বলে এসেছে, ‘স্যার আমরা আগামী কাল গ্রামের বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। যদি কিছু ব্যবস্থা হয় আমাকে ফোন করবেন। সেই মত আমরা আসবো।’
মাহফুজুর রহমান বলল, ‘তোমাদের আর আসতে হবে না। আমি তোমার সাথে পরে কথা বলব। সব কথা স্যারের সামনে বলা যায় না। তুমি স্যার কে নিয়ে বাড়ি চলে যাও। খুব সাবধানে যাবে। স্যারের পথে যেন কোন কষ্ট না হয়।’
ইয়াকুব ও রমেন মাষ্টার ডঃ মাহফুজুর রহমানের কথায় কিছুটা ভরসা পেয়ে বেরিয়ে এল তাঁর কক্ষ থেকে। সচিবালয়ের গেটে আসতেই রমেন মাষ্টারের মনে হল তাঁর চশমার খাপের কথা। তিনি ভুলে চশমার খাপ ফেলে এসেছেন মাহফুজের টেবিলে। ইয়াকুব ও রমেন মাষ্টার সেটি আনতে ছুটল মাহফুজুর রহমানের কক্ষের দিকে। কক্ষের সামনে টুলে বসে থাকা পিয়নটি নেই। আছে ভিতরে। কক্ষের ভিতর থেকে মাহফুজ ও পিয়নের কথোপকথন শোনা যাচ্ছে।
মাহফুজুর রহমান বলছে, “কী যে করো না তুমি রশিদ। ওই বুড়ো লোক আর ওই ছোকরা কে আমার রুমে যখন তখন ঢুকতে দিতে তোমাকে কে বলেছে? ”
পিয়ন জবাব দিল আমতা আমতা স্বরে, “কয়েকদিন ধরেই তো ওনারা আসছেন আপনার কাছে। আর উনি শুনলাম আপনার শিক্ষক। গ্রামে স্কুলে উনার কাছে নাকি আপনার হাতে খড়ি হয়েছিল। আর তাছাড়া এই কয়েকদিন তো আপনার অনুমতি নিয়েই ঢুকছিল। আজ আমি মনে করলাম...”
রশিদ কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই মাহফুজুর রহমান বলে উঠল, “শোন শিক্ষক না ছাই। কবে কোন কালে কী পড়িয়েছেন না পড়িয়েছেন। সামান্য প্রাইমারী স্কুলের হেড মাষ্টার। কোন কালে কী অক্ষরজ্ঞান দিয়েছেন তার দাবি নিয়ে এসেছেন পেনশনের তদবির করতে। যত্তসব। এই কয়েকদিন ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বোঝাতে পারলাম না যে টাকা না ঢাললে ফাইল আগায় না সচিবালয়ে।
-“স্যার একটা কথা বলব, কিছু মনে করবেন না তো স্যার?”
-“বলো”
-“স্যার আপনি খোলসা করে বললেই পারতেন। তাহলে উনারা বোধহয় বুঝতে পারতেন।”
-“আরে থামো তো। আমি খোলসা করে বলি আর এটা নিয়ে নাটক শুরু হোক বাইরে। উনি আর ওই ছোকরা শিক্ষক সারা দুনিয়ায় বলে বেড়াক যে আমি ঘুষ চেয়েছি। আমার রেপুটেশনের কী হবে তখন, ভেবে দেখেছ?”
-“তাহলে স্যার আমি বলে দেখব এবার আসলে?”
-“বলে দেখতে পারো। তবে খুব সাবধানে। ওই ছোকরাকে বলো তাহলে সে বুঝবে। বুড়ো শিক্ষকেরা এসব বোঝে না। ওনারা আদর্শের বুলি কপচান।”
বাইরে দাড়িয়ে রমেন মাষ্টার ও ইয়াকুব সব শুনতে পারলেন। ইয়াকুব চোখ তুলে রমেন মাষ্টারের দিকে তাকাতে পারছে না। তারপরও রমেন মাষ্টারের দিকে তাকিয়ে দেখল। ততক্ষণে রমেন মাষ্টারের মুখ তীব্র ঘৃণায়, লজ্জায় বিকৃত হয়ে গেছে।
দরজা ঠেলে হঠাৎ রমেন মাষ্টার ডঃ মাহফুজুর রহমানের কক্ষে ঢুকলেন। হাত-পা কাঁপছে তাঁর থর থর করে। শান্ত ভাবে মাহফুজুর রহমানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “তুমি আজ ডক্টোরেট ডিগ্রীধারী। তোমার ডক্টোরেট ডিগ্রী বা সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদের রেপুটেশন তোমার থাক বাবা। আমার পেনশন আর প্রভিডেন্ট ফান্ড তোমাদের মত দরিদ্র মানুষ কে আমি উৎসর্গ করলাম। তুমি শুধু আমার শেখানো বর্ণমালা আর অক্ষরজ্ঞানটুকু ফেরত দাও।”
এই টুকু বলে টলতে টলতে রমেন মাষ্টার ইয়াকুবের হাত ধরে বেরিয়ে এলেন মাহফুজুর রহমানের কক্ষ থেকে। ফিরে চললেন বাড়ির পানে।
ঘটনার আকষ্মিকতায় মাহফুজুর রহমান নির্বাক হয়ে গেছেন। হা করে তাকিয়ে আছেন দরজার দিকে। টেবিলে থাকা রমেন মাষ্টারের চশমার খাপের দিকে নজর পড়ল তাঁর। চশমার খাপটি যেন বিদ্রুপ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে রমেন মাষ্টারের শেখানো বর্ণমালা ও অক্ষরজ্ঞান ফেরত চাইছে আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। দুই হাত দিয়ে কান-মুখ ঢেকে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল ডঃ মাহফুজুর রহমান। তাঁর মনে হতে লাগল, আসলেই রমেন মাষ্টার ঠিক কথা বলেছেন। রমেন মাষ্টারের শেখানো অক্ষর, বর্ণমালা ছাড়া তো তাঁর ডক্টোরেট ডিগ্রী, অর্থ-বিত্ত, সম্মান, পদমর্যাদা সবই অর্থহীন। মুখের উপর থেকে দুই হাত সরাতে পারল না মাহফুজুর রহমান লজ্জায়। এই পোড়ামুখ সে কাকে দেখাতে পারবে। ধীরে ধীরে তাঁর কক্ষ থেকে রমেন মাষ্টারের শেখানো অক্ষর, বর্ণমালা, আদর্শলিপি শুন্যে মিলিয়ে যেতে লাগল আর নাকে এসে লাগতে লাগল রমেন মাষ্টারের বাড়ির সামনের গলির সেই বোটকা গন্ধ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নুরুন নাহার লিলিয়ান সাবলীল উপস্থাপন । তবে মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় খাপ ছাড়া মনে হয়েছে। শুভ কামনা রইল।
মাইনুল ইসলাম আলিফ সুন্দর গল্প।শুভ কামনা আর ভোট রইল।আসবেন আমার গল্প আর কবিতার পাতায়।
পারভেজ রাকসান্দ কামাল বিশ্বরঞ্জন দা আপনার কমেন্ট পড়ে উৎসাহ পেলাম। ভাল থাকবেন। আমি সাধারণত প্রান্তিক মানুষদের দু:খ কষ্ট নিয়ে লিখে থাকি। কারণ ওই দু:খ কষ্ট আমার নিজের চোখে দেখা।
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত ভাল লাগল আজকের সমাজের এক বাস্তব চিত্র । গল্পেতে এই লাইনটি খুব সুন্দর লাগল - " তুমি শুধু আমার শেখানো বর্ণমালা আর অক্ষরজ্ঞানটুকু ফেরত দাও ।” -- ভাল থাকবেন । ভোট সহ শুভকামনা রইল ।
পারভেজ রাকসান্দ কামাল অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
মৌরি হক দোলা শেষে এসে মাহফুজুর রহমানের উপলব্ধি বেশ ভালো লেগেছে....চমৎকার লেখা! ভালোলাগা ও শুভকামনা রইল....
পারভেজ রাকসান্দ কামাল অনেক ধন্যবাদ লেখাটি পড়বার জন্য। আমিও পড়েছি আপনার লেখা। ভোট রেখে এসেছি। ভাল থাকবেন।
%3C%21-- %3C%21-- ভালই লাগল। ভোট রেখে গেলাম। সময় পেলে আমার লেখাটি পড়ে দেখবেন। শুভকামনা রইল।
পারভেজ রাকসান্দ কামাল একটু চমকের চেষ্টা আর কি আপু। ওই সুররিয়ালিজমের চেষ্টা। ধন্যবাদ গঠনমুলক সমালোচনার জন্য আপু
ফাহমিদা বারী গল্পটা ভালোই লাগছিল। শেষে কাহিনী ছকে বাঁধা হয়ে গেল মনে হচ্ছে। আর একটু নাটকীয়তা বেশি ছিল। লেখনী ভালো লেগেছে। গতবারের চেয়ে এবারে আরেকটু পোক্ত মনে হয়েছে।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

সমাজে কিছু মানুষ থাকে যারা লাজুক প্রকৃতির। নিজের অভাব অভিযোগ কাউকে বলতে পারেন না। নিজের আদর্শ নিয়ে চলেন। রমেন মাষ্টার সেরকম একজন মানুষ। নিজের পেনশনের তদবির করতে গিয়ে তাঁরই পুরোনো ছাত্রের নির্লজ্জ চেহারা পরিষ্কার হয়ে যায় তাঁর সামনে। ছাত্রটি অবশ্য চক্ষুলজ্জা বা পদমর্যাদার ভয়ে কিছু বলতে পারে নি। কিন্তু আকারে ইংগিতে ঘুষের টাকা দাবি করতে চায়। রমেন মাষ্টার নিজের আদর্শের এই অপমৃত্যু দেখে লজ্জায় মরে যান। আর ওদিকে ছাত্রটিও ধরা পড়ে যাবার কারণে বিবেকের দংশনে লজ্জিত হয়। এভাবেই এগিয়ে চলে লাজে রাঙ্গা ছাত্র শিক্ষকের গল্প।

১৩ এপ্রিল - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ১৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“ ” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ , থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী