এক.
কোন কারণে সবাই আজকে একত্রিত হয়েছে। চারিদিকে হাসি-তামাশা, হই-হুল্লোড় চলছে। এর মাঝেই কেউ একজন পেছন থেকে জামিল এর কাঁধে হাত রাখল। জামিল পেছনে ফিরতেই এক নারীকে দেখা গেলো,খুব দ্রুতই দূরে সরে যাচ্ছে। তার মুখ দেখা না গেলেও , মেহেদী রাঙ্গা হাত দেখা যায়। গত কয়েকদিন ধরেই খুব বিরক্ত করছে ওই হাত,আজ দেখতেই হবে সে কে। জামিল পা চালাতেই কে যেন আলোটা কমিয়ে দিলো,রুমটা কাঁপতে শুরু করলো................ ‘Sir, we are about to land, please fasten your seat belt’ হাস্যোজ্জ্বল বিমানবালার ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো জামিল আহমেদের। সিট বেল্ট বেঁধে নিয়ে প্লেনের জানালা দিয়ে তাকাতেই নিচে দেখা গেলো ঢাকা নগরী। জীবনে প্রথমবার বাংলাদেশে আসা। ‘কেন যাচ্ছো?’ জার্মানি থেকে রওনা হবার আগে অনেকের করা এই প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারেনি, উত্তরটা যে নিজেরই জানা নেই।
দুই.
বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত মাত্রই দিন পনের আগে নেওয়া। তার বাবা আসিফ আহমেদ এর প্রায় শেষ অবস্থা। ক্যানসারটা ধরা পড়েছিলো টার্মিনাল স্টেজে,ডাক্তাররা বেশ কিছুদিন আগেই হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ব্যাপারটা অনেকটা মৃত্যুকালীন প্রায়শ্চিত্ত করার মতোই। মারা যাওয়ার দিন দুয়েক আগে জামিলকে ডেকে বাবা একটা ডায়েরী আর একটা খাম দিলেন। সে সময় কথা বলতেও আসিফ সাহবের কষ্ট হচ্ছিলো। খুব কষ্ট করে বললেন তার মৃত্যুর পর জামিল যেন ডায়েরীটা পড়ে। বাবার মৃত্যুর পর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ডায়েরীটা খোলার সময় পেলো জামিল।তখনই জানতে পারলো তারা দেশ ছেড়ে আসার সময় তার মা মারা যাননি, হয়তো এখনও বেঁচে আছেন।বাকরুদ্ধ শব্দটাকে সেদিনই উপলব্ধি করতে পারলো জামিল। তারপর থেকে ডায়েরীটা তার সাথেই আছে। শীতের শেষ বিকেলে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে গাড়িতে বসে আবার খুললো ডায়েরীটা।
“ জামিল,
কিছু না জানা কথা আজ বলবো। মরার আগে না বলে গেলে তোর প্রতি অন্যায় করা হবে। তোকে নিয়ে যখন জার্মানি চলে আসি তখন ১৯৭২ সাল। এখানে আসার কিছুদিন পর মারগারিটা কে বিয়ে করি, আর তুই ছোটবেলা থেকেই জানতি যে তোর মা দেশে থাকতেই মারা গিয়েছিলেন। আজ আমি যা বলবো তার জন্য মনকে শক্ত কর। আমরা যখন চলে আসি তখন তোর মা বেঁচে ছিলেন। মনে আছে, বছর পাঁচেক আমি একবার দেশে গিয়েছিলাম; তখনও তার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। জানি, মনে অনেক প্রশ্ন, হয়তো আমার ছবির উপর ডায়েরীটা ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। তারপরও তোকে অনুরোধ করব লেখাটা পড়ে শেষ করতে।
১৯৭১ সাল, তোর বয়স তখন দুই বছর। আমি ব্যবসা করি, তোর মা গার্লস স্কুল এর এ্যাসিসট্যান্ট হেডমিস্ট্রেস। সে বরাবরই খুব রাজনীতি সচেতন ছিলো, আমার এসব বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ ছিলোনা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই স্কুল বন্ধ। হঠাৎ করেই তোর মায়ের মাথায় কি ভূত চাপলো- স্কুল খুলতে হবে, এ সময় বাড়িতে বসে থাকলে পাকিস্তানিরা ধরে নেবে যে বাঙ্গালিরা ভীতু। আমি অনেক করে নিষেধ করলাম, আমার কথা সে কানেই নিলোনা। অন্য কোন শিক্ষকও তার সাথে আসলোনা। সে একাই নেমে পড়লো, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রীদের অভিভাবকদের সাথে কথা বললো, শেষ পর্যন্ত যেদিন স্কুল খুললো সেদিন সর্বসাকুল্যে বিশ জন ছাত্রী উপস্থিত। ক্লাসে পড়ালেখার বদলে রাজনৈতিক আলোচনাই বেশী। এক সপ্তাহ পরেই আর্মি ক্যাম্প থেকে স্কুল বন্ধের আদেশ এলো। তোর মা তাতেও স্কুল বন্ধ করলোনা। চিন্তা করে দেখ, লম্পট পাকিস্তানীদের ভয়ে যখন বাড়ির মেয়েদেরকে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে, তখন তোর মা আর্মি ক্যাম্পের আদেশের পরেও স্কুল চালু রাখল। এই একগুঁয়েমির জন্যই সর্বনাশটা হল। স্কুলের ছাত্রীসংখ্যা তখন দশএ নেমে এসেছে। একদিন সকালে কিছু সৈন্য নিয়ে এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আসলো। মেজর সাহেবের অর্ডার, স্কুলের ছাত্রী-শিক্ষক সবাইকে আর্মি ক্যাম্পে যেতে হবে। উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। তোর মা স্কুলের সব দরজা-জানালা বন্ধ করলো। ছাত্রীদের মানসিকভাবে তৈরি হতে বলল, তারপর একটা জানালা খুলে বলল ছাত্রীদের নিয়ে সে আত্মহত্যা করবে। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন কিছুটা সময় নিলো। ক্যাম্প থেকে ফিরে এসে বললো যদি ম্যাডাম তার সাথে ক্যাম্পে যায়, তাহলে ছাত্রীদেরকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তোর মা রাজী হলো,ছাত্রীদের নিরাপদে স্কুল থেকে বের করে দিয়ে জানালো সে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আমি পাগলের মতো তাকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করলাম। কোন লাভ হলোনা।
তোর মা বাড়ি ফিরলো যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর,গালভরা এক খেতাব নিয়ে- বীরাঙ্গনা। বাড়িতে তার উপস্থিতি অসহ্য ঠেকত। আশেপাশের লোকজন যেন কেমন করে তাকাত, আত্মীয়-স্বজনেরও একই অবস্থা। সবাই যেন আমদেরকে এক ঘরে করলো। মনে হতে লাগলো - সে যদি আমার কথা শুনতো,তোর আর আমার কথা যদি একটুও চিন্তা করতো,তাহলেই আজ এই অবস্থা হয়না। কিছুদিন পর আমি তাকে বললাম আমাদের পক্ষে আর একসাথে থাকা সম্ভব না। তোর মা কোন প্রতিবাদ করলোনা,যেন সে এটার জন্য প্রস্তুত ছিল। দিন দুয়েক পর তোর মা বাড়ি ছাড়লো। যাবার আগে তোকে একটু আদর করে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো-ভাল থেকো। জানতে চাইলাম সে কোথায় যাচ্ছে, বললো না জানলে আমাদের সবার জন্যই মঙ্গল।
তোর মা চলে যাওয়ার পরও আমার মনে হলো,দেশে থাকলে তোকে আর আমাকে নানারকম ঝামেলা পোহাতে হবে। তাই প্রথম সুযোগেই দেশ ছাড়লাম। জার্মানি এসে নতুন করে জীবন শুরু করলাম, তোর মায়ের কথা ভুলে যেতে চেষ্টা করলাম,পারিনি। সবসময়ই মনে হতো তার সাথে অন্যায় করেছি,জীবন সায়াহ্নে এসে মনে হলো ক্ষমা চাওয়ার সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই বছর পাঁচেক আগে দেশে গিয়ে অনেক কষ্টে তাকে খুঁজে বের করেছিলাম। ক্ষমা চাইলাম, বলল আমাকে কখনই অপরাধীর চোখে দেখেনি। তোর কথা বললাম, বললো আমাদের সাজানো জীবনে আর ব্যাঘাত ঘটাতে চায়না।
জানিস, তোর মায়ের বীরত্ব,দেশপ্রেমের গল্প এখনও এলাকার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তোর মা আমার চাইতে অনেক উঁচু মনের মানুষ। তাকে আমি কখন ছুঁতে পারিনি,পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। খামটার ভেতর তোর মায়ের ঠিকানা আর অনেক পুরনো একটা ছবি আছে । ওহহো, তার নামই তো বলিনি-নীলা,তোর মায়ের নাম নীলা। গায়ের রঙ খুব ফরসা,তুই তোর মায়ের রঙ পেয়েছিস। আর তোর মা হাতে মেহেদী দিতে খুব পছন্দ করতো।
চিঠি পড়ার পর কি করবি তা ঠিক করে দেবার কোন অধিকার আমার নেই। এটা পুরোপুরি তোর সিদ্ধান্ত। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিস।
ইতি
বাবা
তিন.
এরপরের কয়েকটা দিন যেন ঘোরের মধ্যে কাটল। স্ত্রী ফ্রিদা আর সৎ বোন সোফিয়া ছাড়া আর কারও সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করেনি জামিল। তারপরই দেশে আসার সিদ্ধান্ত নিলো। বাবার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী এখন সে কক্সবাজার। আজ দ্বিতীয় দিনের মতো একই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। গতকাল চোখ ভরে প্রথমবারের মতো নিজের মাকে দেখল,কাছে যাওয়ার সাহস হয়নি। নীলা আহমেদ এখানে একটা এন জি ও পরিচালিত স্কুল এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের সাথে জড়িত। এলাকার মানুষের মাঝেও তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়।
ঐ যে দূরে তাকে দেখা যাচ্ছে, শীতের শেষ বিকেলে হেঁটে আসছে মা। হাতের মুঠোয় মায়ের ছবিটা নিয়ে অস্থির হয়ে উঠলো জামিল। কি যে করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। কি বলবে মায়ের সামনে,কোন পরিচয়ে গিয়ে দাঁড়াবে? মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করলো জামিল। তারপরই শান্ত হয়ে গেলো। বেঞ্চ থেকে উঠে মায়ের দিকে হাঁটতে লাগলো।
মায়ের দিকে হেঁটে চলেছে পুত্র। শেষ বিকেলের আলোয় যে রঙ্গমঞ্চের সৃষ্টি তার আশেপাশের গাছগুলোতে নতুন পাতা আসছে,সবুজ রঙের পাতা।
ঝরা পাতার দিনগুলো শেষ হয়ে এলো প্রায়।