সে কে ?

প্রশ্ন (ডিসেম্বর ২০১৭)

সাদিক ইসলাম
ফাতিহুল সাহেব এই কলেজটিতে নতুন এসেছেন কয়েকমাস হলো; মফস্বলের কলেজ চারদিকে নানা রকমের গাছগাছালিপূর্ণ আর সবুজে সবুজে ছাওয়া টিলাময় এই ছোট্ট উপজেলা শহরে যেখানে বিকলের পরই সন্ধ্যা আর রাত একসাথে নামে। গাছের ফাঁকে বাড়িঘরগুলোকে সাগরের মাঝে দ্বীপের মতো মনে হয়। রাত হলে আঁধার এতো ঘন হয় যে ঘর থেকে বাইরে তাকালে কেমন একটা গা ছমছমে ভাব হয়। ফাতিহুল সাহেব ঢাকা মহানগর থেকে এই কলেজে প্রথমে এসে মনে করেছিলেন মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে কিন্তু সরকারি চাকুরী তাই করার কিছুই নেই আর প্রমোশনের কারণে বদলী মেনেই নিতে হবে। কলেজটি অনেক পুরানা আর ঐতিহ্যবাহী আর ছেলেমেয়রাও অনেক মেধাবী তাই এদের পড়িয়ে বেশ ভালোই লাগে তাই মানিয়ে নেবার শঙ্কা কেটে গেছে খুব তাড়াতাড়ি। শিক্ষার্থীরা বেশ জ্ঞান পিপাসী তাই ফাতিহুল সাহেবের এই ব্যাপারটা ভালো লেগেছে খুব। আর কলেজটির রেজাল্টও ভালো। ভালো শিক্ষকের সাথে ভালো শিক্ষার্থীর মেলবন্ধন না হলে মেলে না; যখন দু’টো দু’য়ে দুয়ে চার হয়ে গেল ফাতিহুল সাহেবের দিনগুলো কাটতে লাগলো অর্থপূর্ণভাবে আর আনন্দে ।
ফাতিহুল সাহেবের সন্তানসন্ততি সব ঢাকায় পড়ালেখা করে তাই পুরো পরিবার নিয়ে আসতে পারেননি। কলেজের পূর্ব পাশে একটি টিচার ডরমিটরি আছে সেখানে যারা ব্যচেলর টিচার তাদের থাকার ব্যবস্থা আছে; তিনি সেখানেই থাকেন। আর ছেলেদের একটা হোস্টেল আছে সেখান থেকে তার সকাল, দুপুর আর রাতের খাবার আসে। সাধারণত দিনে অফিস পিয়ন আর রাতে নাইটগার্ড খাবার নেয়া আসা করে। তবে ফাতিহুল সাহেবের একটা শারীরিক সমস্যা আছে তিনি হাইপারটেনশানের রোগী মাঝে মাঝেই রাতে প্রেশার খুব হাই হয়ে গেলে হাসপাতালেও নিতে হয়। কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার এই ব্যাপারে বেশ সাহায্য করেন। মাঝে মাঝে ছাত্ররা এসেও স্যারের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নেন। একবার ফাতিহুল সাহেব ঢাকা থেকে ফিরে হঠাৎ বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন । কলেজ কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে অধ্যক্ষ মহোদয়ের সহায়তায় তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন দুই দিন হাসপাতালে থেকে আবার ডরমিটরিতে এসে ওঠেন। অধ্যক্ষ স্যার বলেন ফাতিহুল সাহেব আপনি যেহেতু অসুস্থ আর এই শরীর নিয়ে ঢাকায়ও যেতে পারছেননা আপনি আপাতত এখানেই থাকুন আর আপনার রাতে একা থাকা ঠিক হবেনা আমি একজন ছাত্রকে বলছি সে এসে আপনার সাথে থাকবে যদি হঠাৎ আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন তাছাড়া একজন থাকলে একাকী বোধ করবেননা। ফাতিহুল সাহেব এমনিতে খুব সাহসী লোক যতো অসুস্থই হন খুব বেশি ভয় করেননা তবু প্রিন্সিপাল সাহেব যখন খুব করে বললেন তাঁর কথা ফেলতে পারলেননা। ঠিক হলো শাহীন নামে একাদশ শ্রেণীর এক ছাত্র ফাতিহুল সাহেবের সাথে থাকবেন। আর শাহীনের সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক আছে বাংলা সাহিত্যের স্যারের কাছে শেখাও যাবে অনেক তাই যখন হোস্টেলে বলা হলো কে থাকবে স্যারের সাথে রাতে শাহীন নিজেই প্রস্তাবটা সানন্দে গ্রহণ করলো।
সন্ধ্যাবেলাটা ফাতিহুল সাহেবের খুব ভালো কাটে তিনি বাংলার অধ্যাপক আর চমৎকার করে সাহিত্য আর ব্যাকরণ বুঝান তাই ছাত্ররা প্রতি সন্ধ্যায় নিয়ম করে তাঁর কাছে আসে সাহিত্যের একটা আড্ডাই বসে যায়। আসলে উপজেলায় এতো ভালো মানের শিক্ষক আগে কখনো আসেননি আর ফাতিহুল সাহেব যেমন সাহিত্য পড়াতে এর প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন ছাত্ররাও ক্লাসের বাইরে এই আড্ডা থেকে অনেক জানতে পারে তাদের জানাও হয় এই শিক্ষা তাদের পরীক্ষার জন্যও কাজে লাগে। একদিন সন্ধ্যাবেলা জুয়েল নামে সায়েন্সের এক ছাত্র হঠাৎ বললো আচ্ছা স্যার আপনি কি ভূতে বিশ্বাস করেন? ফাতিহুল সাহেব এই প্রশ্ন শুনে বললেন হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? জুয়েল বললো না স্যার এমনি বললাম। কিন্তু কথাটার প্রসঙ্গ নিজের দিকে টেনে নিয়ে মামুন বললো জানেন স্যার এখানে গণিতের সামসুল স্যার না ভূত দেখেছিলেন! ফাতিহুল সাহেব হাসতে হাসতে বললেন তাই নাকি তা সেই ভূত দেখতে কেমন? মামুন বললো তা জানিনা স্যার তবে স্যার বলতেন প্রায়ই রাতে ওনার ঘরে কী কী নাকি ঘটতো। তাই ফাতিহুল সাহেব বললেন কী ঘটতো জানো তোমরা ? শ্যামল বললো , স্যার সামসুল স্যারের মনে হতো কিসের যেন আওয়াজ হচ্ছে, কে যে ফিসফিস করে কী বলছে আর উনি নাকি এই বারান্দায় কিসের ছায়া দেখতেন মানুষের মতো কিন্তু আশেপাশে কোনো মানুষ থাকতো না; আগেও নাকি অন্য স্যাররাও এমন দেখেছেন তাই অনেকেই এখানে থাকতে চাননা। ফাতিহুল সাহেব আবার হাসলেন বললেন এটা কবেকার ঘটনা। জুয়েল জবাব দিলো স্যার আমরা আমাদের কলেজের স্যার আর বড়ভাইদের কাছে শুনেছি এই চার-পাঁচ বছর আগে হবে সামসুল স্যারের এই ঘটনা ঘটেছিলো তারপর থেকে কেউ আর এই ডরমিটরিতে থাকেননা। ফাতিহুল সাহেব উত্তরে বললেন শুনো এগুলোকে বলে হ্যালুসিনেশান তোমরা কি জানো হ্যালুসিনেশান মানে কী? সবাই বললো হ্যা স্যার জানি- কল্পনা, মায়া , ঘোর এই ধরনের । ফাতিহুল সাহেব বললেন হ্যা এটা দৃষ্টিভ্রম ছাড়া কিছুই নয়। আর এই এলাকার নির্জনতা, এই ঘন গাছপালা, কম মানুষের আনাগোনা এগুলো কারণে এধরনের হ্যালুসিনেশান হতেই পারে আর যারা একটু দুর্বলচিত্তের লোক তাদের ক্ষেত্রে এটা ঘঠতেই পারে। অর্ণব বললো স্যার তাহলে আপনি ভূতে বিশ্বাস করেননা? স্যার জবাব দিলেন মোটেই না। অর্ণব বললো স্যার ভূত বলে কিছুই নেই ? ফাতিহুল সাহেব জবাব দিলেন উহু নেই। আর এই মোবাইল, কম্পিউটারের যুগে ভূতরা সব মনুষ্য লোকালয় ছেড়ে তাদের নিজের দেশে গিয়ে আস্তানা গেড়েছে। ফাতিহুল সাহেব হাসতে হাসতে আরো বললেন ; আর তোমরা সবাই শোনো যদি ভূত বলে কিছু থেকেও থাকে তবে এখন মানুষ এতো বেশি ভয়ংকর হয়ে গেছে যে ভূত মানুষের ভয়ে তার আশেপাশেই আসবেনা। ছাত্ররা সবাই হেসে উঠলো। সেদিনের মতো সবাই চলে গেল শাহীন রাতে আসলো নিজেই স্যারের জন্য খাবার নিয়ে আসলো। শাহীন পাশের বেডে শোবার জন্য প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছিল ফাতিহুল সাহেব বললেন শাহীন আমার খুব ঘুম পাচ্ছে আমি খেয়েই শুয়ে পড়বো তোমার আজ এখানে থাকার দরকার নেই আমি এখন অনেক সুস্থ এখানে থেকে তোমার পড়ার ক্ষতি হবে তুমি বরং হোস্টেলে গিয়ে পড়ালেখা করে শুয়ে পড়ো। শাহীন চলে গেল ফাতিহুল সাহেব খেয়েদেয়ে তাড়াতড়ি শুয়ে পড়লেন কিন্তু ভোরের দিকে একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলেন। জেগে উঠার পর শরীরটা কেমন ছমছম করতে থাকলো। মনে হচ্ছিল দরজার ঐ পাশে কেউ দাঁড়িয়ে থেকে তাঁকে দেখছেন। দু’একবার কেমন খুটখাট শব্দ শুনতে পেলেন মনে হলো আস্তে আস্তে কেউ দরজায় কড়া নাড়ছে। ফাতিহুল সাহেব সাহসী লোক তাই লাইটটা জ্বালিয়ে দরজাটা খুললেন ; না কেউ নেই, কিছু নেই ঘুটঘুটে অন্ধকার আর বৈশাখের টানা বাতাসে আবছা অলোয় গাছগুলো কেমন দুলছে মনে হচ্ছে মাথা নাড়িয়ে হেলেদুলে কাউকে ডাকছে । কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন এতো অন্ধকার কলেজে মূল ভবনটাকে দেখাই যাচ্ছেনা মনে হচ্ছে শুধু ঘরের আলোটুকু ছাড়া বাইরের পৃথিবীটাকে কেউ কালো কালি দিয়ে লেপে দিয়েছে আর অন্ধকার কেমন একটা চেহারা নিয়ে মুখ থমথম করে আছে। ফাতিহুল সাহেব দরজা বন্ধ করে ঘরে আসলেন আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। আর স্বপ্নের ব্যাপরটাকে পাত্তা দিলেননা তিনি যুক্তিপূর্ণ মানুষ তাই ভাবলেন এইসব গতরাতে তাঁর ছাত্রদের সাথে আজগুবি গল্পের ফল; ভয়ের স্বপ্নটাও তাই। কিছুক্ষণ পরে বুঝলেন প্রেশারটা একটু হাই হয়ে গিয়েছে বুকটা একটু ধড়ফড় করছে তাই একটা ইনডিভার ট্যাবলেট খেয়ে নিলেন। তিনি ঘুমাতে চাইলেন কিন্তু অস্থিরতা কেটে গেলেও প্রায় এক ঘন্টা কেমন এক শরীর হিম করা অনুভূতি তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখলো। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়লেন আর জানেননা।
পরের দিন কলেজে গিয়ে ফিজিক্সেরর টিচার নাহিদ কামালকে ঘটনাক্রমে ডরমিটরিতে অস্বাভাবিক কিছু ঘটে কি না বললেন নাহিদ সাহেব স্পষ্ট করে কিছু বললেন না শুধু বললেন স্যার যতদিন পরিবার না নিয়ে আসেন কাউকে নিয়ে থাকাই ভালো হবে । ফাতিহুল সাহেব আর বেশিদূর এগোলেননা বললেন দেখা যাক।
ফাতিহুল সাহেবের ডরমিটরিটা কলেজের মূল ভবন থেকে একটু দূরে যদিও চারদিকে দেয়াল দেয়া ক্যাম্পাস তবু বিকালবেলা যখন ক্লাস নেই ছাত্রছাত্রীরা সব চলে যায় ; সব টিচাররা যার যার বাসায় চলে যান একাডেমিক ভবনে তালা পড়ে কেমন এক অদ্ভুত নির্জনতা নেমে আসে কলেজটাতে। একটা খেলার মাঠ অবশ্য আছে কলেজটাতে তবে তা ঢাকা পড়েছে মূল ভবনের পশ্চিপাশে তাই বিকেলে ছেলেদের খেলা হলেও তার মৃদু কোলাহল মাত্র কানে আসে। কলেজের একেবারে পূর্ব পাশে ডরমিটরি এর সামেনে ছোট খোলা স্থান আর পুরো পূর্ব পাশটা শাল, তমাল হিজল, মেহগনি গাছে ভরপুর। ডরমিটরির পিছনের জানালার খাটো দেয়ালের ওপর দিয়ে দেখলে চোখে পড়ে ঘন গাছগাছালিতে ভরা একটা সীমাহীন শাল বন ; দিনের বেলা এই বনকে সুন্দর লাগে কিন্তু রাত নেমে আসলে বনটা কোনো এক অব্যক্তভাব নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে থাকে এর মর্ম উদ্ধার করা দুর্ভেদ্য । আর তাই বিকেল শেষে ফাতিহুল সাহেব পিছনের জানালা বন্ধ করে দেন কোনো ভয়ের জন্য নয় বরং বিষাক্ত কীটপতঙ্গ আর ম্যালেরিয়া মশা থেকে সতর্ক থাকার জন্যে।
বিকালে সুনীলের দোকানের গরম চা, সন্ধ্যায় ছাত্রদের সাথে আড্ডা তারপরে রাতে দুই ঘন্টা সাহিত্যের বই নিয়ে ডুবে থাকা এভাবে ফাতিহুল সাহেবের দিনগুলো মন্দ যাচ্ছিলনা। গ্রীষ্মকাল শেষে বর্ষাকাল চলে আসলো সেকি বৃষ্টি! রাতে বৃষ্টি নামলে মনে হয় এই ডরমিটরি পুরো বিশ্ব চরাচর থেকে বিচ্ছিন্ন ; প্রলয়ের এই বৃষ্টিকে ফাতিহুল সাহেবের শিল্পিত মনে, মনে হয় মনোরম সংগীত। এরকম বর্ষা সেই ছোটকালে দেখেছিলেন তারপরে কোথায় হারিয়ে গেছে বর্ষার সেই মোহনিয়া রূপ। ঢাকায়তো বর্ষাকাল ভোগান্তির নামান্তর ছাড়া কিছুইনা। তাই তিনি এই নতুন জায়গায় এসে বর্ষাকে উপভোগ করতে লাগলেন মধুর মনে হলো বর্ষার দিন আর অঝর ধারার রাতগুলোকে। একদিন ফাতিহুল সাহেব বিকেলে চা খেতে যথারীতি বের হয়েছেন। চা খেতে গেলে দোকানের লোকরা তার সুষমাম-িত চেহারা, চমৎকার বাচন আর অমায়িক ব্যবহার পেয়ে খুব আনন্দিত বোধ করেন তাই তিনি একটু যতœ-আত্মি পান বেশি তাছাড়া সরকারি কলেজের প্রফেসর হিসেবে আলাদা একটা সম্মানতো আছেই। সেদিন চা নাস্তা শেষ করে গল্প করে একটু বেশি সময় ব্যয় করে ফেললেন ঘড়িতে দেখলেন রাত সাড়ে আটটা ; আহা তাঁর ছাত্ররা এসে তাঁকে না পেয়ে ফিরে গেছে বোধহয়। এর মাঝে হঠাৎ কখন যে আকাশটা নিকশ কালো হয়ে এসেছে টেরই পাননি। দোকান থেকে বের হতে না হতেই হালকা একটা বৃষ্টি শুরু হলো দোকানের একটা ছেলে বললো স্যার কি ছাতা নিয়ে আসছেন ফাতিহুল সাহেব বললেন না আনিনি। সে প্রস্তাব করলো স্যার আপনাকে আমি এই ছাতা দিয়ে কলেজ পর্যন্ত পৌঁছে দেই? ফাতিহুল সাহেব জবাব দিলেন আরেনা বৃষ্টির দিনে একটু না ভিজলে কি বর্ষাকালকে বোঝা যায়? বর্ষাকালে একটু-আধটু না ভিজলে বর্ষাকাল যে বৃথাই চলে যাবে। ছেলেটা কিছু না বুঝে হা করে তাকিয়ে থাকলো আর ভাবলো জ্ঞানী লোকরাও মাঝেমাঝে কতো বোকার মতো কাজ করে। ফাতিহুল সাহেব হোটেল থেকে আসার পথেই ইলেকট্রিসিটি চলে গেল, যখন ডরমিটরির কাছে আসলেন বেশ ভিজে গেলেন। বৃষ্টির গতি বেড়ে গেল সাথে বাতাসও শুরু হলো ; বাতাসে অদ্ভুত এক আওয়াজ শুনতে পেলেন মনে হলো যেন কেউ কাঁদছে। ফাতিহুল সাহেব কোনো রকমে বারান্দায় এসে হাতড়ে দরজা পেলেন কিন্তু চাবি মেলাতে পারছিলেননা ঠিক এমন সময় মনে হলো কালো রাত ভেদ করে আরো নিকষকালো এক ছায়া এসে বারান্দার ওপাশে দাঁড়ালো ফাতিহুল সাহেব হকচকিয়ে গেলেন তবু ভয় পেলেননা বরং কেউ একজন মনে করে বললেন কে , কে ওখানে ? তারঁ মনে হলো ছায়াটা আস্তে আস্তে লম্বা হতে লাগলো তারপর আঁধারের মাঝখানে মিলিয়ে গেল; আর এরপরেই দমকা একটা বাতাস এসে ফাতিহুল সাহেবকে ধাক্কা দিয়ে গেল; তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন বাইরের বহমান বাতাসের চেয়ে এ বাতাস আলাদা ; মনে হচ্ছে অপার্থিব এক শক্তি তাঁকে তার খেলা দেখাচ্ছে ফাতিহুল সাহেব বাতাসের ধাক্কায় পড়ে যেতে পারতেন কিন্তু দরজার তালা ধরে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। এভাবে নিসাড় হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন জানেন না আর কখনবা কিভাকে তালা খুলে ঘরে এসেছেন তাও জানেন না। যখন তাঁর পুরো চেতনা কাজ করলো তিনি দেখলেন তাঁর পুরো শরীর কাঁপছে সাথে একটা ঠা-া শিহরণ দেহ বেয়ে মাথা থেকে পা অবধি বয়ে যাচ্ছে এই ঠা-াতেও তিনি ঘেমে গেলেন। তবু মনে সাহস নিয়ে হাতড়ে হাতড়ে চার্জার বাতিটা বেড় করলেন। দেখলেন তাঁর দরজায় সিটকিনি দেয়া কখন যে তিনি নিজেই সিটকিনি দিয়েছেন তা জানেন না। হাত দিয়ে পালস মেপে দেখলেন পালস রেট বেড়ে গেছে তাই ওষুধ খেয়ে কাপড় বদল করলেন। বাইরে তখনও বৃষ্টির অবিরাম ধারা যেন ক্ষণে ক্ষণে বেড়ে চলছে। সাঁ সাঁ বাতাসের শব্দ এতো বেশি জোর নিয়ে বয়ে যাচ্ছে যে তিনি যদি সব শক্তি নিয়েও চিৎকার দেন তবুও প্রকৃতির এই রুদ্রমূর্তি ভেদ করে তা দশফুট দূরের মানুষের কানে যাবেনা। ফাতিহুল সাহেব পুরো ব্যাপারটিকে যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করলেন ; তিনি ভাবলেন যেটাকে ছায়া ভেবেছেন হতে পারে তা গাছের ফাঁক দিয়ে কোনো আলো যা আঁধারের সাথে খেলা করে কখনো ছোট আর কখনো বড় হয়েছে আর তিনি যেহেতু কিছুটা হলেও ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন তাই বাতাসের ধাক্কাটাকে বেশি মনে হয়েছে তাঁর সেই মুহূর্তের দুর্বল চিন্তায় আর প্রেশার বেড়ে যাবার কারণে বাকি কাজগুলো এতো তাড়াতাড়ি করে ফেলেছেন যে তা তাঁর মনে নেই আর হোটেল থেকে বের হবার পরই তাঁর মন তাঁর মস্তিষ্ককে সিগনাল দিয়ে রেখেছিলো কী কী করতে হবে তিনি যেহেতু ঐ ছায়ার কথা আগেও ছাত্রদের মুখে শুনেছেন তাই ছায়ার মতো কিছু দেখে এতাটাই মানসিকভাবে বিচলিত ছিলেন যে এরপর তালা খোলা, দরজা খোলা, বন্ধ করা সব অটো-সাজেশনে ঘটে গেছে; তার মন ব্রেনকে যে সাজেশন দিয়ে রেখেছিলোই সেভাবেই। তিনি ভাবলেন চিন্তাকে বেশি প্রশ্রয় দেয়া যাবেনা তাই বিছানায় শুয়ে টেবিলের ওপর চার্জার বাতিটা রেখে একটা উপন্যাস নিয়ে বসলেন। ঘন্টাখানেক পরে ইলেকট্রিসিটি আাসলো, বৃষ্টিটাও কিছুটা কমে এসেছে। ফাতিহুল সাহেব বই রেখে দেখলেন রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে কিন্তু শাহীন আসছেনা । শাহীন দুপুরে বলেছিলো রাতে ও খাবার নিয়ে আসবে আর থাকবে। তিনি মোবাইলটা তুলে নিয়ে শাহীনকে একটা কল দিলেন। শাহীন ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো সরি স্যার পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছিলাম আমি আপনার জন্যে খাবার নিয়ে আসছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহীন চলে আসলো বাইরে বৃষ্টি কিন্তু কোনো ছাতা ছাড়া আর আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে ওর চুল একদম ভিজেনি। ফাতিহুল সাহেব বললেন শাহীন তুমি ছাতা ছাড়া আসলে চুল ভিজেনি যে? শাহীন উত্তরে বললো স্যার গাছের নিচ দিয়ে এমনভাবে এসেছি যেন গায়ে বৃষ্টি না পড়ে ফাতিহুল সাহেব জবাব দিলেন ও আচ্ছা। শাহীন প্রতি রাতে খাবার এনে টেবিলটার ওপর রাখে কিন্তু আজ রাখলো পাশের খাটটার পাশে। ফাতিহুল সাহেব ভাবলেন ছেলেটার শরীর বোধহয় খারাপ করেছে ফাতিহুল সাহেব তাই বললেন শাহীন তোমার কি শরীর খারাপ? শাহীন জবাব দিলো না স্যার আমি ভালো আছি। ফাতিহুল সাহেব উত্তরে বললেন ও অচ্ছা। শাহীন হঠাৎ বললো স্যার আমি কি একটু বাথরুমে যেতে পারি? ফাতিহুল সাহেব হেসে জবাব দিলেন হ্যা অবশ্যই। ফাতিহুল সাহেব মনে মনে ভাবলেন আজই প্রথম শাহীন বাথরুমে যেতে চাইলো এর আগে কোনোদিন সে বাথরুমে যায়নি। শাহীন বাথরুমে যাবার অনেকক্ষণ হয়ে গেল কিন্তু বের হবার নাম নেই ফাতিহুল সাহেব কিছুটা অবাক হলেন। আরো দু’চার মিনিট কেটে গেল তিনি একটু অবাকই হলেন তাই ভাবলেন তিনি শাহীনকে ডাকবেন কিনা। যখন সময় অনেক পাড় হয়ে যাচ্ছে ফাতিহুল সাহেব শাহীনকে ডাকতে যাবেন এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলেন। ফাতিহুল সাহেব দরজার সামনে গিয়ে বললেন কে ? ওদিক থেকে শোনা গেল স্যার আমি আপনার খাবার নিয়ে এসেছি। ফাতিহুল সাহেব সম্মোহিতের মতো দরজা খুলে দিলেন। দেখলেন এক হাতে টিফিন কেরিয়ার এক হাতে ছাতা নিয়ে হাসিমুখে শাহীন দাঁড়িয়ে আছে। ফাতিহুল সাহেবকে দেখেই বললেন স্যার অনেক দুঃখিত বাইরে বৃষ্টি আর আমার ছাতাটাও খুঁজে পাচ্ছিলামনা তাই অনেক দেরী হয়ে গেল। ফাতিহুল সাহেব বিস্ময়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন। শাহীন বললো প্লিজ স্যার একটু সড়ে দাঁড়ান আমি ভিতরে যাবো। এই সময় জুয়েলের কল আসলো স্যার শাহীন গিয়েছে ? ওর একটু দেরী হলো সরি স্যার। ফাতিহুল সাহেব জবাব দিলেন হ্যা এসেছে বলে কল কেটে দিলেন। তিনি ঘরে ঢুকলেন দেখলেন শাহীন ঠিকি টেবিলে খাবার রাখলো। তারপর ফাতিহুল সাহেবের প্লেট পরিস্কার করে আনলো। কিন্তু ফাতিহুল সাহেব বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে সব দেখছিলেন। তিনি অনেকক্ষণ বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন। শাহীন স্যারকে আগে কোনোদিন এভাবে দেখেনি তাই কিছুটা অবাক হলো স্যার শাহীনকে কেন এভাবে দেখছেন আর কেনই বা তাঁর এরকম আচরণ সে বুঝতে পারলোনা। ফাতিহুল সাহেবের বিস্ময়ের ঘোর খানিকটা কাটতেই তিনি যেন পরাবাস্তব থেকে চেতনালোকে ফিরে আসলেন। এতক্ষণ কী দেখেছেন যা দেখেছেন তা সত্যি কিনা তা ভাবতে শুরু করলেন। তিনি নির্বাক হয়ে ছিলেন শাহীন তাই বললো স্যার খাবার খাবেননা অনেক রাত হয়ে গেছে। ফাতিহুল সাহেব হু বলে জবাব দিলেন আর পরক্ষণেই ভাবলেন এ যদি শাহীন হয় তবে বাথরুমে যে আছে সে কে? তাঁর শরীর হিম হয়ে গেল। চোখের সামনে যা ঘটছে তা অস্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। একটু ভাবতেই মনে পড়ে গেল আগের শাহীন যেভাবে এসেছিলো এভাবে আসল শাহীন আসেনা। এ যদি আসল শাহীন হয় তবে আগের শাহীন কে? নাকি তাঁর শুধুই কল্পনা, হ্যালুসিনেশন? তিনি যখন আরো বাস্তবে ফিরে আসলেন তাঁর মনে পড়ে গেল সেই শাহীনও তো খাবার নিয়ে এসেছিলো তাই তিনি স্বাভাবিক হতেই সেই টিফিন বক্সের খোঁজ করলেন মনে আছে তিনি ওটাকে পাশের খাটের পাশে রাখতে দেখেছিলেন তাই সামনে এগিয়ে গিয়ে ওটাকে খুঁজলেন কী আশ্চর্য সেই টিফিন কেরিয়ার নেই! তিনি যখন সম্মোহিতের মতো এদিকওদিক ঘুরছেন শাহীন ভাবলো স্যারের মনে হয় শরীর ভালোনা তাই বললেন স্যার আপনি খেয়ে শুয়ে পড়–ন। ফাতিহুল সাহেব বললেন হ্যা ঠিক আছে । শাহীন আবার বললো স্যার সব কি ঠিকঠাক আছে তো? ফাতিহুল সাহেব জবাব দিলেন হ্যা সব ঠিক আছে। ফাতিহুল সাহেব এবার আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলেননা তিনি বাথরুমের কাছে গেলেন দুইবার বাথরুমে কড়া নাড়লেন কোনো আওয়াজ নেই এবার ধাক্কা দিয়ে বাথরুম খুললেন। কী দেখবেন তা ভেবে শরীরর হিম শীতল হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু সাহস করে পুরো দরজা খুলে দেখলেন ; লাইট জ্বালানো ; মনে আছে শাহীন এসে লাইট জ্বালিয়ে বাথরুমে গেছে ; কিন্তু ভিতরটা একদম ফাঁকা কেউ নেই ফাতিহুল সাহেবের মাথাটা মনে হলো কেমন ঘুরে উঠলো তিনি স্বপ্ন আর ঘোরের মধ্যে আটকা পড়েছেন মনে হচ্ছে; সারাজীবন অপ্রাকৃতকে তিনি আমল দেননি কিন্তু যে অবা¯তব ঘটনা আজ তাঁর সামনে ঘটলো তার ব্যবাখ্যা কী? এই শাহীন সত্য কিন্তু এর আগে যে শাহীন এসেছিলো কেন এসেছিলো; একি মিথ্যা ফাতিহুল সাহেবের ঘোর শুধুই ? কিন্তু বাথরুমের লাইটটা তো অন করাই আছে ! তবে কেন সে এসেছিলো ঐ শাহীন ? আসলে সে কে?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ওয়াহিদ মামুন লাভলু গল্পে রহস্যের গন্ধ আছে। ফাতিহুল সাহেবের মাথা ঘুরে উঠারই কথা। একই লোক যদি ওভাবে দুইবার তার সামনে আসে তবে তার মনে প্রশ্ন তো জাগবেই। অনেক ভাল গল্প। শ্রদ্ধা জানবেন। শুভকামনা রইলো। ভাল থাকবেন।
ভালো লাগেনি ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৭
অনেক অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন। শুভ কামনা।
ভালো লাগেনি ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৭
Sanchita Saha golpoti pore valo laglo...ami golpo kobitay notun...sobar lekhai sundor.
ভালো লাগেনি ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৭
অনেক ধন্যবাদ...।
ভালো লাগেনি ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৭
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী দারুণ একটি গল্প। ভূত বিভ্রাট। গল্পটি সহজে একটানে পড়তে পেরেছি.... খুউব ভালো লেগেছে ভাই, শুভকামনা রইল
ভালো লাগেনি ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭
অনেক ধন্যবাদ। আপনার প্রতি শুভ কামনা থাকলো
ভালো লাগেনি ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৭
Farhana Shormin বেশ ভাল
ভালো লাগেনি ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭
অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
ভালো লাগেনি ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৭
মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া বেশ ভালো...
ভালো লাগেনি ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭
অনেক ধন্যবাদ । ভালো থাকবেন।
ভালো লাগেনি ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৭
Tanvir Ishraq Utsho অসাধারণ লেখা! জাস্ট লাভড ইট!
ভালো লাগেনি ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৭
অনেক ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৭
Muhin Roy মুহিন রায় মনে হচ্ছে অপার্থিব এক শক্তি তাঁকে তার খেলা দেখাচ্ছে ফাতিহুল সাহেব বাতাসের ধাক্কায় পড়ে যেতে পারতেন কিন্তু দরজার তালা ধরে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। গল্পটির উৎকণ্ঠা শেষ পর্যন্ত গল্পটি পড়তে টেনে নিয়ে যায়। ভৌতিক হলেও গল্পের প্রশ্ন থেকে যাওয়াটি ভাল লেগেছে। লেখকের জন্য শুভ কামনা রইল
সাদিক ইসলাম Thank u very much for reading my story and voting me. best of luck
মনজুরুল ইসলাম Very nice story. A suspense has been observed from starting to finishing.Feeling awesome after reading the story. Stay fine.
Thank u very much for reading my story and voting me. best of luck

০৮ ফেব্রুয়ারী - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ১৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪