ঘটনাটা বাংলাদশেরই যে কোন একটা গ্রামের। খুব সুন্দর গ্রামটা। চারিদিকে প্রচুর সবুজ গাছ-পালা। দেখলে মনে হয় যেনো পুরো বাংলাদেশের প্রতচ্ছবি গ্রামটাতে ফুটে উঠেছে। ঘন সবুজ গাছপালা, ফাকে ফাকে সোনালি ধানক্ষেত। মনে হয় যেনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা। এই গ্রামটা দেখলেই বোঝা যায়, কেনো বাংলাদেশকে সবুজের দেশ বলা হয়। সেই গ্রামেরই এক ছেলে, যাকে নিয়ে এই ঘটনা।
ছেলেটা মা’র খুব আদরের। বাবা তাকে তেমন একটা আদর দেয় না। সবসময় বকা-ঝকা করে। তাই বাবার সাথে তার তেমন একটা মিলে না। ২০০৯- এর জানুয়ারি মাসে তার বয়স ১০ বছর পূর্ণ হয়েছে। এখন সে মোটামুটি অনেক কিছুই বোঝে। চটপটে আর দুরন্ত এই ছেলেটা সবকিছুই করে নিজের খেয়াল-খুশি মতো। তবে বড়দের সে যথেষ্ট সম্মান করে। কখনো কারো সাথে বেয়াদবি করে না। সারাদিন ঘুড়ি উড়ানো আর সাইকেল নিয়ে থাকে। মা এজন্য তাকে বকাও দেয় খুব। মানুষকে সাহায্য করার ব্যাপারটা তার মধ্যে প্রবল। নিজের ক্ষতি করে করে হলেও সে মানুষকে যথাসাধ্য সাহায্য করে। পড়ালেখায় তেমন একটা ভালো না তবে, বাস্তব জ্ঞান তার মধ্যে অনেক।
সেই বছরের ডিসেম্বর মাস। প্রচণ্ড শীত পড়েছে। গ্রামের লোকেরা বলাবলি করছে, এবারের শীতে বুড়োরা নির্ঘাত মারা পড়বে। গত কয়েক বছরেও নাকি এমন শীত পরেনি। যাই হোক, সে মাসের প্রথম দিনটি থেকে সেই ছেলেটার মধ্যে দেখা গেলো একটা বিশেষ পরিবর্তন। তাদের বাড়ির পাশে অনেকগুলো বড় বড় গাছ আছে। সেগুলোর মধ্যে মাঝখানের একটা গাছ সবচেয়ে উঁচু, এবং খাঁড়া। আশে-পাশের সবগুলো গাছের মধ্যে এই গাছটা সবচেয়ে উঁচু। দেখে মনে হয় যেনো বাকি গাছগুলোর নেতা, মাঝখানে থেকে সবগুলো গাছকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ডালপালাও তেমন একটা নেই। তারপরও বিশেষ কি যেন একটা আছে গাছটার মধ্যে যা তাকে সবগুলো গাছের চেয়ে আলাদা করে রেখেছে। এই গাছটায় চড়ার জন্য হঠাৎ করেই ছেলেটা দিনরাত ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। অনেকেরই চোখে পড়লো ব্যাপারটা।
ঘুড়ি উড়ানো আর সাইকেল চালানোর পিছনে যে সময়টা ব্যায় করতো এখন সে ওই সময়টা ব্যায় করে এই গাছের পিছনে। আর কোন কাজ নেই। দিনরাত সে পরে থাকে গাছটার সামনে। বিকেলে বন্ধুরা খেলতে ডাকলে খেলতেও যায় না। স্কুল বন্ধ, তাই পুরো সময়টাই এখন সে গাছে উঠার চেষ্টায় ব্যায় করে। বন্ধুরা অনেকেই হাসাহাসি করে তার পড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে। এত লম্বা আর খাঁড়া গাছ বেয়ে উপরে ওঠা কি মুখের কথা? তারপরও হাল ছাড়তে রাজি নয় ছেলেটা। যতবার সে পড়ে যায় ততবারই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাড়িয়ে আবার চেষ্টা করে। পিছন থেকে বন্ধুদের হাঁসি-ঠাট্টা কানে আসে ঠিকই কিন্তু সেগুলো সে গায়ে মাখেনা। নিজের মতো গাছে উঠার চেষ্টা করতে থাকে। এভাবেই চললো কয়েকদিন।
একদিন সন্ধ্যায় দুজন বুড়ো লোক গাছটার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো। হঠাৎ করেই তাদের সামনে ধপ্ করে ছেলেটা গাছের উপর থেকে পড়লো। লোকদুটো প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলো। এর মধ্যে একজন ছিলো ছেলেটার দাদা। উনি সামনে এসে ছেলেটার কান ধরে ইচ্ছামত মুচরে দিলো। দুটা চড়ও দিলো। ছেলেটার চোখ ফেটে বেড়িয়ে এলো পানি। পাশের বুড়ো লোকটা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘থাক, থাক। মাইরা আর কি হবে? ওরে ভালো করে বুঝাও এইরকম সন্ধ্যায়ে এসব গাছপালার সামনে থাকা ঠিক না। অনেকরকম খারাপ বাতাস লাগতে পারে’। ছেলেটার দাদা তখন বললো, ‘সাধে কি আর মারি? ওরে কয়দিন কইসি এই গাছটার সামনে আইতে না। এই গাছে আমি খারাপ জিনিষ দেখসি। ওইদিন দুপুরেও ওরে দেখলাম গাছটার সামনে দাড়ায়া আসে। তুমিই কও ফজল মিয়া, যদি খারাপ কিসু হয়া যায় তখন আমি ওর বাপরে কি জবাব দিমু? বাপে সারাদিন বাসায় থাকেনা তাই আমারই তো দেইখা রাখতে হয়। ওর মা তো কিছুই কয়না। আরেকদিন দেইখা লই, তর বাপের কাছে নালিশ দিমু। আমি আর পারিনা, আমার বয়স হইসে’।
ছেলেটা মাথা নিচু করে দাড়িয়ে তাদের চলে যাওয়ার অপেক্ষা করতে থাকে। পাশের বুড়ো লোকটা যেতে যেতে বলে, ‘দোষ আসলে ওর না। দোষ হইলো আমাগো। পুরা বাঙালি জাতিগো দোষ। পারবিনা উপরে উঠতে, কেন উঠবি? শেষে হাত-পা ভেঙ্গে লুলা হয়ে ঘরে পড়ে থাকবি। বাঙ্গালীরা তো এজন্যই মরে। যেটা পারবো না সেটাও করতে চায়। আর যেটা না করবেন, ওইটা আরও বেশি কইরা করবে’...... আস্তে আস্তে কথাগুলো দূরে মিলিয়ে যেতে থাকে। লোকটার শেষ কথাগুলো ছেলেটার মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কাটে। ‘পারবিনা উপরে উঠতে, কেন উঠবি’? সেদিন সারাটা রাত ওর মাথায় এই একটা কথাই ঘুরতে থাকে। রাতে আর ঘুমাতে পারেনা।
পরদিন রাতে সে আবার চেষ্টা চালায়। যেভাবেই হোক, গাছটার মাথায় তাকে পৌঁছাতেই হবে। অর্ধেকও উঠতে পারেনি হঠাৎ ঘরের ভিতর থেকে মায়ের ডাক শুনতে পায় ছেলেটা। সাথে সাথে লাফিয়ে নেমে ঘরে ঢুকে যায়।
১১ তারিখ, শুক্রবার। দোকান-পাট সব বন্ধ, তাই ছেলেটার বাবা বাসায়। ছেলেটাও আজ তাই একটু ভয়ে ভয়ে আছে। গাছে উঠতে গেলে যদি বাবা দেখে ফেলে তাহলে আজই ওকে মেরেই ফেলবে। কারন, ওর বাবা সবসময় ওকে মারার অজুহাত খুজতে থাকে। সামান্য কোন অজুহাত পেলেই বেচারাকে পিটিয়ে আধমরা করা ফেলে। ওর মা’ও তখন থামাতে পারেনা। যাই হোক, ছেলেটা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে কখন ওর বাবা বাইরে যাবে। সারাটা দিন সুযোগের অপেক্ষায় কেটে যায় কিন্তু বাবা বাইরে যায় না। অবশেষে সন্ধ্যার দিকে একটা সুযোগ আসে। কি কাজে যেন ওর বাবা একটু বাইরে যায়। ছেলেটা তখন এক মুহূর্তও দেরি না করে দৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গাছটার সামনে আসে এবং দ্রুত ওঠা শুরু করে। বেশ কিছুক্ষন চেষ্টা করার পর এবার সে অর্ধেকেরও বেশি উপরে উঠে যায়। খুশির সীমা থাকেনা তার। মনে হয় এবার সে গাছটার মাথায় যেভাবেই হোক পৌঁছে যাবে।
ঠিক সেই মুহূর্তে ছেলেটা দূর থেকে তার বাবার গলার আওয়াজ শুনতে পায়। কিছু একটা বলতে বলতে গাছটার দিকে দৌড়ে আসছেন তিনি। ছেলেটা এই দৃশ্য দেখে ওইটুকু উচ্চতা থেকেই হাত ছেড়ে লাফিয়ে পড়ে। সাথে সাথে পা’টা মচকে যায়। প্রচণ্ডরকম ব্যাথায় মাটিতে পড়ে কাতরাতে থাকে ছেলেটা, কিন্তু ওর বাবার সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। দৌড়ে এসে ওকে টেনে-হিঁচড়ে ঘরে নিয়ে যায়। তারপর দরজা বন্ধ করে শুরু করে মার। প্রচণ্ডরকম মার খাওয়া সত্ত্বেও ছেলেটার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয়না। কারণটা...যাই হোক, ছেলেটার মা ঘরের পাশে দাড়িয়ে নীরবে অস্রু-বিসর্জন দিতে থাকে।
পা ব্যাথা এবং প্রচণ্ড মারের কারনে তিনদিন ছেলেটাকে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়।
চতুর্থদিন রাতে- ব্যাথা পা নিয়ে শেষ চেষ্টা চালায় ছেলেটা। সে সময় পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে ছিলো। কেউ জানলো না ছেলেটা তার লক্ষে পৌঁছাতে সফল হলো কিনা...
পরদিন, অর্থাৎ ১৬-ই ডিসেম্বর। দিনটা ছিল বুধবার। সকাল ৭টার দিকে বেশ কয়েকটা বাচ্ছা ছেলেকে দেখা গেলো গাছটার সামনে দাড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে সবাই তাকিয়ে আছে গাছটার একেবারে উপরের দিকে।
দেখা গেলো...বেশ বড় সাইজের একটা বাংলাদেশের পতাকা সেখানে ঝুলছে। কারও বুঝতে বাকি রইলো না, এটা কার কাজ। কি উদ্দেশ্য কাজ করছিলো ছেলেটার গাছে উঠার পিছনে।
অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর, ছেলেটার জয় হলো। শত বাঁধা-নিষেধ অতিক্রম করে সে পৌছালো তার কাঙ্খিত লক্ষে। কোন কিছুই তাকে দমিয়ে রাখতে পারলো না। সবাই বুঝতে পারলো তার গাছে ওঠার কারন।
এরই নাম- ‘বাংলাদেশ’। এরাই সেই বাঙালি জাতি যারা হার মানতে জানেনা। যারা হার মানেনি ‘একাত্তরেও’। শত বাঁধা অতিক্রম করে অর্জন করেছে তাদের কাঙ্খিত লক্ষ্য। ছিনিয়ে এনেছে বিজয় পতাকা, যা আজ স্থান পেয়েছে সবচেয়ে উঁচু জায়গায় এবং সগর্বে উড়ছে। যেনো ছেলেটার বিজয়কে অভিবাদন জানাচ্ছে। এই বিজয়, শুধু এই ছেলেটার একা নয়। এই বিজয়, পুরো বাঙালি জাতির বিজয়। কারন, এই ছেলেটার মধ্য দিয়েই অঙ্কিত হয়েছে পুরো বাঙালি জাতির সাহসিকতার কথা, একাগ্রতার কথা, বিজয়ের কথা। আজ বহুদিন পর যেনো আরও একবার বাঙালি জাতি নতুন করে কিছু একটা জয় করলো। স্বাদ পেলো নতুন কিছু বিজয়ের।
কিছুক্ষন পর সেই ছেলেটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে বাচ্ছাদের দলটার সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর সবাই একসাথে পতাকাটাকে স্যালুট করলো। ছেলেটার মা’ও তখন বেড়িয়ে এসে তাদের সাথে দাঁড়ালো। ছেলেটা তখন পতাকাটা দেখিয়ে হাতের ইশারায় তার মা’কে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করলো কারন, কথা বলার ক্ষমতা তার নেই। সে বাক-প্রতিবন্ধী, তবে কানে শুনতে পায়। মাত্র দেড় মাস বয়সে ছোট্ট একটা দুর্ঘটনায় ছেলেটা তার বাক্-শক্তি হারায়। যাই হোক, ছেলেটার মা বুঝতে পারলো সে কি বলতে চাইছে। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সাথে সাথে সে তার ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তার প্রতিবন্ধী ছেলের উপর তার গর্ব বেড়ে গেলো। সেই গর্ব, অশ্রু হয়ে ঝরে পরতে লাগলো। গর্বের হাঁসি ফুটে উঠলো তার মুখে। সত্যিই এমন সন্তানের জন্ম দিয়ে সে গর্ব বোধ করে। গর্ব বোধ করি আমরাও। এমন সন্তানের জন্ম দেয়া, শুধু আমাদের মায়ের পক্ষেই সম্ভব। পৃথিবীর বুকে আমরাই একমাত্র জাতি যারা মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পরেছি শুন্য হাতে, হারিয়েছি সবকিছু, হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছি, তবু শেষ পর্যন্ত মায়ের মুখে ঠিকই হাঁসি ফোঁটাতে পেরেছি। এমন সন্তানের জন্ম দিয়েছো তাই...সালাম তোমায় মা, সালাম দেশের মাটি, সালাম বাংলাদেশ। তোমায় সালাম......
০৪ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪