“কালো চুলের রূপাঞ্জেল”

দুঃখ (অক্টোবর ২০১৫)

মুহম্মদ ফজলুল করিম
মোট ভোট প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.২৭
(১)
আচ্ছা , আম্মু তুমি কেমন আছো? জানো আমার বয়স না , এখন মাত্র তিন মাস হল। কথা বার্তা বলতে শিখি নাই , তবে আমি না পুরোপুরিই হয়ে গেছি। এখন খালি একটু বড় হবার পালা। আরে , আসল কথাইতো বলা হয়নি। আমি তো একটা মেয়ে। তুমি যেরকম ফরসা , আমি সেইরকম। যাক , তোমার অনেক কষ্ট বেঁচে গেছে। ছেলেরা না যা দুষ্ট হয়। আমি কিন্তু , একদম লক্ষ্মীটি হয়ে থাকবো। তোমাকে একটুও জ্বালাবো না , চুল এলোমেলো রাখবো না , খালি খালি ভেউ ভেউ করে কাঁদবোও না। আচ্ছা , আম্মু তোমাকে না একটা কথা বলি , তোমার পেটের ভেতর না কুসুম কুসুম গরম ভাব। ভালই লাগছে। আচ্ছা আম্মু তুমি আমার বকবক শুনে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছ নাতো। অবশ্য বিরক্ত হলেই কি , আমার তো কোন খেলার সাথীই নেই। খালি তুমি আছো। তাও সারাদিন গোমড়া মুখে বসে থাকো। তোমার বিরক্ত লাগলে , আমারও বিরক্ত লাগে। আচ্ছা , আম্মু তুমি না আগের মত হাসোও না। তুমি হাসলে কিন্তু আমি টের পাই। আচ্ছা তুমি কি এখনো প্লান কর নাই , আমি আসলে তুমি আমার জন্যে কি রঙের চাদর কিনবে। আমার কিন্তু লাল খুব প্রিয়। কেন জানো আম্মু , কারণ আমি ঐ একটা রঙই সারাদিন দেখি – লাল।

আমি সারাদিন বকবক করেই যাই। তুমি তো একটা কথাও বল না, বয়স তো প্রায় চার মাস হয়ে গেল। এতদিন আম্মু বিরাট যন্ত্রণায় ছিলাম। ঠিকঠাক মত হাত-পাও নাড়তে পারতাম না। এখন কিন্তু একটু একটু পারি। অনেক ভাল লাগে। আমি যদি বেরিয়ে আসি, তাহলে আমি কিন্তু সারাদিন হাত পা ছুঁড়বো। বড় হলে , সারাদিন খেলবো। আর একটু আধটু মারামারিও করবো। দুষ্টু ছেলেপেলে আমি দেখতেই পারি না। আচ্ছা, আম্মু তোমাকে একটা গুড নিউজ দেই। কি আন্দাজ করতে পারছো ? না পারলে আমিই বলে দি – আমার মাথায় না একটু আধটু চুল গজাতে শুরু করেছে। বলেছিলাম না, আমি আর কয়েকমাসের মধ্যেই চলে আসবো। আমি কিন্তু আসার জন্যে রেডি। আচ্ছা আম্মু আমার চুল কিরকম হবে। কাকের চোখের মত কালো নাকি সোনালি রঙের। আমার না স্বর্ণকেশী হওয়ার বড় শখ। কেন জানো আম্মু? তুমি না কয়েকদিন আগে রূপাঞ্জেলের গল্প পড়ছিলে। রূপাঞ্জেলের ইয়া লম্বা লম্বা স্বর্ণকেশী চুল। রাজপুত্র রূপাঞ্জেলের চুল দুর্গ বেয়ে বেয়ে নামে। রূপাঞ্জেলের জাদুর চুল। আচ্ছা মা , রূপাঞ্জেলের চুল যদি কাল হত , তাহলে কেমন হত ? ইয়ে মানে, আমার চুলতো স্বর্ণকেশী না কালো বুঝতে পারছি না। দেখতেও পারছি না। আমি যখন বেরিয়ে আসবো, তখন কিন্তু আমার চুলগুলি দেখে আমার কানে কানে বলবে , আমার চুলের রং কি? নাহ , আসলেই দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ইসস, রূপাঞ্জেলের মত যদি স্বর্ণকেশী চুল হত?

আচ্ছা আম্মু তুমি ইদানীং খাওয়া-দাওয়াতো একদমই ছেড়ে দিয়েছো। খালি সারাদিন ভেউ ভেউ করে কাঁদো। দাঁড়াও , খালি আমাকে আসতে দাও। আমি এমন জোরে জোরে কাঁদবো যে তুমি নিজেই কান্না কি জিনিস ভুলে যাবা। তখন চোখ মুছে আমাকে কোলে নিয়ে, উলে উলে বাবু করবা। আগেই বলে দিচ্ছি – কোন প্রকার ন্যাকামি আমি কিন্তু সহ্য করবো না। আমার বাবুটা , উলে উলে , কিগু কিগু এইসব ন্যাকামো আমার সাথে কিন্তু ভুলেও করবা না। করলেই কিন্তু বিপদ আছে , নতুন জামাকাপড় দেখলেই পি করে দেবো। এমনেই মেজাজ গরম , পাঁচ পাঁচটা মাস এই বদ্ধ জায়গায় আটকে আছি। আর কয়দিন আম্মু ? আমার আর এখানে জানো ভালই লাগছে না। মনে হচ্ছে , বাইরে গিয়ে একটু নিঃশ্বাস নেই। চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখি। তুমি তো আবার ভাববে , কি বোকার মত চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছে। আসলে কিন্তু , আমি একদমই বোকা না। চেহারাটাই খালি বোকা বোকা , অন্য কিছু কিন্তু আমি সব বুঝতে পারি। এই যে , আব্বুতো আমার সাথে কথাই বলে না। আমার কিন্তু খুব খারাপ লাগে। তুমি আব্বুকে বলে দিবা , আব্বু যেন আমার সাথে কথাবার্তা বলে। তুমিও তো আমার সাথে কথা বল না। আমাকে খালি আসতে দাও , আমি যে কত্ত কথা বলতে পারি, তোমার সে সম্পর্কে ধারণাই নাই। দেখবা , সারাদিন কথা বলতে বলতে , চিৎকার করতে করতে বাড়িঘর মাথায় তুলে ফেলবো। প্রশ্ন করতে করতে এমন অবস্থা করবো যে তুমি বলবা, “ইস , “এই দস্যি মেয়েটার মুখ কি বন্ধ হবে না, সারাদিন ভাঙ্গা ক্যাসেটের মত চলছেই চলছে। আল্লাহর ওয়াস্তে , একটু চুপ কর।” আমি তখনও কিন্তু চুপ করবো না , বলেই যাবো বলেই যাবো। আমার সাথে এখন কথা না বলার জন্যে , তোমার তখন কঠিন শাস্তি হবে।

আচ্ছা আম্মু তুমি না আজ ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে। ডাক্তার মহিলাটাকে না আমা একদমই পছন্দ হয় নি। কই খুশি হয়ে হেসে হেসে কথা বলবে , আমার সাথে। তা না , খালি চুপচাপ বসেই আছে। আমি না এখন একটু-আধটু শব্দ করতে পারি। তুমি আগে স্কুলে যেতে , তখন বাচ্চা ছেলে মেয়েরা খালি চিৎকার করতো। তুমি যখনই মিষ্টি গলায় পড়ানো শুরু করতে সবাই চুপ করে যেত। আচ্ছা , আম্মু তোমার গলা এতো মিষ্টি কেন। যখন গুনগুন করে গাও , শুনতে এতো মিষ্টি লাগে কল্পনাও করতে পারবে না। ঐদিনই তো ক্লাসে সবাইকে রূপাঞ্জেলের গল্প শোনাচ্ছিলে। রূপাঞ্জেল মিনারে বসে বসে বিষণ্ণ সুরে গাইতো ,
“আমি রূপাঞ্জেল একাকী কাটাই বনে,
কেউ জানে না একাকী কাটাই সময় কেমন?”
ঐভাবে এখন আমারও গাইতে ইচ্ছে করে , আমিও ঐভাবে গাইবো। শুধু কথা বলাটা শিখে নেই , তখন দেখবে। আচ্ছা আম্মু , রূপাঞ্জলেকে আটকে রাখা সেই দুষ্টু ডাইনী বুড়িটা এতো খারাপ কেন? মানুষ কি এত খারাপ হয় , রূপাঞ্জলেকে আটকে রাখবে কেন। আমি জানি , আমার আম্মু কখনই আমাকে ঐ দুষ্টু ডাইনী বুড়ির খপ্পরে পড়তে দেবে না। বুকে আগলে ধরে রাখবে আমাকে। আচ্ছা তুমি আবার কাঁদছো কেন , তাও আবার এই দুষ্টু ডাক্তারের সামনে। কিছুক্ষণ আগে খুব জোরে চাপ দিয়েছে , তোমার পেটে। আমার না খুব ব্যথা লেগেছে। তুমি আর কক্ষনো এই দুষ্টু ডাক্তারের কাছে আসবে না।



(২)
ডায়রিটা বন্ধ করল শাহেদ। সিগারেটটাতে লম্বা একটা টান দিল , শাহেদ। আগুনের আঁচ ঠোঁটে এসে লাগলো। কখন সিগারেট ফিল্টারের দিকে এসে গিয়েছিল খেয়ালই করেনি। সামনে একটা মধ্যবয়স্ক মানুষ মোটামুটি বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে বসে আছে। দাঁড়িতে পাক ধরেছে কিছুদিন আগে বোঝাই যাচ্ছে। পাশে একটা মহিলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। থানার তেল চিটচিটে ফ্যানের তলায় এরকম সুদর্শন মধ্যবয়স্ক দম্পতিকে মানায় না। তবুও ভাগ্যের ফেরে আজকে তাঁদের এখানে এসে বসতেই হচ্ছে। প্লেটে সিঙ্গারা আর সমুচা পড়ে আছে। চা’য়েও চুমুক দেয়নি দুইজন। শাহেদ নতুন জয়েন করেছে , ডিবি পুলিশের কর্মকর্তা হিসেবে। চাকরি মাত্র কয়েক মাস হল। উপন্যাসের নতুন জয়েন করা সুদর্শন এবং অবশ্যম্ভাবী ভাবে সৎ গোয়েন্দা পুলিশ অফিসারের মত না শাহেদ। নিয়ম করে সবার কাছে থেকেই ঘুষ খায়। স্থানীয় সন্ত্রাসীদের কাছে থেকে মাসহারা নেয়। মোটের উপর সুদর্শন-সৎ এ দুটোর কোনটাই না। একজন সাধারণ অফিসারের স্কেচ , আর শাহেদকে আলাদা করা কঠিন।

আজকে সকালে সেগুনবাগিচার অফিসে এসেই এই সুইসাইড কেসটা হাতে পায়। পুলিশি জীবনে তাঁর হাতে পড়া প্রথম সুইসাইড কেস। উত্তরায় এক মেয়ে সুইসাইড করেছে। সুইসাইড হলেই , কারণ হিসেবে অনেক সাদামাটা মোটিভ বের হয়ে আসে। প্রেম , দাম্পত্য সমস্যা, খুন করে সুইসাইড বলে চালিয়ে দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানে আপাতত ডায়রিটা পড়ে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। চিরচেনা সুইসাইডাল রিজনের কোনটাই মিলছে না। শাহেদ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ডায়রিটা পড়ছে। কোন ক্লু পাওয়া যায় কিনা। প্রথম পৃষ্ঠায় একটা হাতে আঁকা অসাধারণ সুন্দর স্কেচ পাওয়া গেল। একটা ছোট্ট মেয়ে কোলে নিয়ে মা আর বাবা দাঁড়িয়ে আছে। পেনসিলের আঁকা এতো সুন্দর ছবি আর কখনই দেখেনি। বোঝাই যাচ্ছে ,মেয়েটার হাত খুব ভাল ছিল।

লতা নামের মেয়েটা কালকে রাতে সুইসাইড করেছে। আজকে সকালে বাবা-মা দরজা ভেঙ্গে ঢুকে দেখে এ অবস্থা। সেজে-গুজে নীল শাড়ি পরে , চোখে কাজল দিয়ে , হাতে নীল কাচের চুড়ি পড়ে , বিছানায় মেয়েটি শুয়ে আছে। কয়েক পাতা সিডাইল ৫ মিলিগ্রাম ডেস্কের উপর পড়ে আছে। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে , মেয়েটি মারা যায়নি। শাহেদ স্পটে দেখেই অবাক হয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল সুইসাইড করে মৃত মানুষের দৃশ্য দেখতে খুব ভয়ঙ্কর হবে। কিন্তু আজকে তা মোটেই মনে হয়নি। মনে হচ্ছে গ্রিক দেবী আফ্রোদিতি শুয়ে আছে। একটু শব্দ করলেই আফ্রোদিতি জেগে উঠবে ।

শাহেদ আরো একটা সিগারেট ধরালো। সামনে বসে থাকা জাফর সাহেবের দিকে সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিল। তিনি আস্তে করে না বলে মাথা নাড়লেন। শাহেদ মাঝে মাঝেই অবাক হয় নিজের পুলিশি আচরণে। মানুষটা তার বাবার বয়সী। তবুও সে কিভাবে সিগারেট সাধলো ভেবেই পেল না। ইউনিফর্ম যে কতটা মানসিকতা পরিবর্তন করে দিতে পারে , সেটা যে ব্যবহার করেনি , সে কখনই কল্পনা করতে পারবে না। আবার চায়ে চুমুক আর সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে জাফর সাহেবকে জিগ্যেস করল , “আপনার মেয়ে কি করত? মানে পড়ালেখা না চাকরিবাকরি।”
জাফর সাহেব উত্তর দিল , “পড়ালেখা করত , জগন্নাথে। ফাইনাল ইয়ার চলছিল।”
“কি সাবজেক্ট?”
“চারুকলা।”
“আর কিছু করত না ?”
“এমনি , অবসর সময়ে একটা এনজিও’র হয়ে কাজ করত।”
“কি করত ? ঐখানে।”
“টিচার। বিকেলে রাস্তার বাচ্চাদের পড়াতে যেত।”
শাহেদ মনে মনে ভাবল , আচ্ছা রূপাঞ্জেলের গল্পটা কি ঐখান থেকেই আসল নাকি। এতক্ষণ তো মনে হচ্ছিল , ডায়রিটা শুধু গল্প লেখার জন্যে। এখন মনে হচ্ছে কিছুটা বাস্তবতাও আছে। শাহেদ আবার মহিলার দিকে তাকাল। মহিলাকে জিগ্যেস করল , “আপনার মেয়ের কোন প্রেম জাতীয় সম্পর্ক ছিল।” এইসব প্রশ্ন মা’দেরই করতে হয়। কারণ , বাবাদের চেয়ে মা’রাই ভাল জানে এইসব প্রশ্নের উত্তর।
মধ্যবয়সী মহিলা এতক্ষণ ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। কোনমতে ধাতস্থ হয়ে উত্তর দিল , “আমি জানি না। আমাকে কখনও কিছু বলে নি। তাও ওর আচার আচরণে , আমার মনে হয়েছিল ওর এই ধরনের কিছু ছিল।”
“ ও , আই সি। ছেলেটার নাম-ধাম জানেন? মানে আইডিয়া আর কি।”
“না...”






(৩)
যাই হোক , ডায়রিটা আবার খুলল শাহেদ। নতুন কেনা ডায়রি। শেষের দিকের সামান্য কয়েকটা পৃষ্ঠায় এই লেখাগুলি লেখা। খুব যত্ন করে লেখা। ছোট ছোট অক্ষরের ছাপা অক্ষরের মত সুন্দর করে লিখা। কোন কারণে মনে হচ্ছে ডায়রিটা থেকে অনেক ক্লু উদ্ধার করা যাবে।

“আচ্ছা আম্মু , তোমাকে না মানা করেছিলাম ডাক্তারের কাছে না আসতে। তাও তুমি আসছো। তুমি আসলেই দুষ্টু। আচ্ছা , চেম্বারে তো ডাক্তার মহিলাটা নেই , তুমি বরং আমাকে রূপাঞ্জেলের গল্প শোনাও। আম্মু , আমার না খুব চিন্তা হচ্ছে রূপাঞ্জেলের তো সব জাদুর চুল কেটে ফেলা হয়েছিল। তারপর কি রূপাঞ্জেল একবারও আফসোস করেনি। ঐ চুল দিয়ে কত রোগ-শোক সারাতে পারতো রূপাঞ্জল। আমার তো এইখানে বসেই আফসোস হচ্ছে। আচ্ছা , আম্মু তোমার চুলতো কালো। তাহলে তো আমার চুলও কালো হবে। আচ্ছা , আম্মু আমি না ভেবে ভেবে বের করেছি। সোনালী চুলের রূপাঞ্জেলের চেয়ে কালো চুলের রূপাঞ্জলেকে দেখতে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগবে। শ্বেত-শুভ্র মুখের পিছনে লম্বা লম্বা কালো চুল – কি সুন্দর যে ফুটে উঠবে তা কল্পনাই করতে পারবে না। আচ্ছা আমি এতো কথা বলে যাচ্ছি , আর তুমি কোন কথা না বলে চিৎকার করে কেঁদেই যাচ্ছো। খুব বিরক্তি লাগছে। আচ্ছা ডাক্তার এখন তোমাকে বিছানায় শোয়ালো কেন? এই দুষ্টু ডাক্তারটাই তো সেই ডাক্তার। আমি তো কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝে গিয়েছি। আচ্ছা ঐটা কিসের শব্দ। মনে হচ্ছে সব কিছু টেনে নিচ্ছে। আম্মু আমার না খুব ব্যথা হচ্ছে। মনে হচ্ছে সব কেটেকুটে যাচ্ছে। আম্মু , রূপাঞ্জলের ডাইনী বুড়ির মত ডাক্তারটাকে থামাও। আমার খুব ব্যথা লাগছে। থামাও না , থামতে বল না। আম্মু ... আম্মু ... আম্মু।”

শাহেদ ঠাস করে ডায়রি বন্ধ করে ফেলল। এই মেয়ে যা লিখেছে , তা যদি সত্যি হয়। সেটা হচ্ছে এবরশন। পরের পৃষ্ঠা গুলো না উল্টিয়েই বুঝে গেল ঘটনাটা কি ছিল। এই মেয়ে এবরশন করেছে। কাউকে না জানিয়েই। নিজের কল্পনায় বিবেকের তাড়না থেকে লিখেছে এই ডায়রি। এইসব গল্পগুলি। কল্পনায় দেখেছে , তার মেয়ে তার সাথে কথা বলছে। সেই কথাগুলো এইখানে লিখে ফেলেছে।
শাহেদ চেইন স্মোকার। সিগারেটের প্যাকেট হাতড়ে দেখে , একটাও নেই। এই রফিক , বলে মানিব্যাগ খুলে টাকা পেপারওয়েটের নিচে রেখে দিল। অফিসের পিয়ন রফিক , শাহেদের এই আচরণের সাথে পরিচিত। দিনে দুইবার যাওয়া লাগে সিগারেটের প্যাকেট আনতে। আজকেও যাওয়া লাগছে , তবে প্রতিদিন সকালে-বিকেলে প্যাকেট আনতে যাওয়া লাগে , আজকে সকালেই দুবার আনা লাগলো। জাফর সাহেব আর ভদ্রমহিলা চুপ করে বসে আছে। মহিলা এতক্ষণ কাঁদা বন্ধ করেছিল। আবার কি মনে হয়ে , ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদা শুরু করেছে। মেয়ে মানুষরা মায়া দিয়ে গড়া। মায়া-মেয়ে এই দুই শব্দের মধ্যে পার্থক্যটা এজন্যেই হয়ত খুবই কম। অসম্ভব মায়া নিয়ে তারা পৃথিবীতে আসে। জন্ম থেকে মৃত্যু , জীবনের প্রতিটা পর্যায়ে অসম্ভব মায়াবতীর ভূমিকা নিয়েই পার করে।

“আপনার মেয়ে যে এবরশন করিয়েছিল , আপনি তা জানেন।” , মহিলার দিকে তাকিয়ে শাহেদ বলল।
মহিলা আরো জোরে কেঁদে উঠলো। কোনরকমে বলল , “ না , জানি না। ও আমাকে কিছুই বলেনি।”
বাবার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো , শাহেদ। মুখটা এতক্ষণ অন্ধকার ছিল , এখন আর অন্ধকার হল। সেবার ছিল নিখাদ দুঃখ , এবার এর মধ্যে যোগ হয়েছে অপমান। ঘটনা জানাজানি হলে সমাজের চোখে কতটা অপমানিত হবেন , এই ভেবে। তিনি চুপ করেই থাকলেন। শাহেদ সিগারেটটা মুখে নিয়ে টেবিলের ফাইল-পত্র ঠিক করতে করতে বলল , “বুঝতেই পারছেন , আত্মহত্যাটা কেন ঘটেছে। কেস খুব সোজা। আপনার মেয়ে এবরশন করেছে। বিবেকের দংশন সইতে না পেরে সুইসাইড। কেস ডিসমিস।”
জাফর সাহেব ভাঙ্গা গলায় বলল , “ছেলেটা কে? চিনতে পেরেছেন।”
“না আপাতত চিনতে পারিনি। তবে চেনাটাও কঠিন হবে না। ফেসবুক আইডি ঘাটাঘাটি করলে , ঘরের এলবাম কল-লিস্ট চেক করলে খুব সহজেই পাওয়া যাবে। আপনারা যখন আইডিয়া করতে পারেন নি , আমরা বের করবো। ছেলেকে ধরা খুব কঠিন হবে না , যদি না...”
“যদি কি ?”
“যদি না প্রভাবশালী কিংবা উঁচু মহলের কেউ হয়। তাহলে ধরা আসলেই কঠিন হয়ে যাবে। বোঝেনইতো , আমাদেরও তো উপরের নির্দেশ মেনে চলতে হয়।”
উনি চুপ করে রইলেন। আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন , চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
শাহেদের দেখে মায়াই হল , তাই বলল , “আচ্ছা আমি ফোনে বলে দিচ্ছি , আপনার মেয়ের ল্যাপটপটা আর ফোনটা যেন এখানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমি দেখছি , ছেলেটা কে ?”
ডিবি পুলিশদের যারা ঐ স্পটে , তাদের একজনকে কল করল শাহেদ। শাহেদ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হওয়ায় , তারা দ্রুত ল্যাপটপ আর ফোন পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলে। শাহেদ আরো একটা সিগারেট ধরায়। টেবিলের উপরে থাকা ডায়রিটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে। সকালে স্পট থেকে এটা নিয়ে এসেছে। বাকি অফিসারের এখনো আলামত নিচ্ছে। সুইসাইড কেস খুব জটিল কিছু হয়না। এতো আলামতের কিছুও লাগে না। খুব সহজেই কারণটা বের করে ফেলা যায়। তাও , রুটিন ওয়ার্ক করতেই হয়। এখানেতো ডায়রিই অর্ধেক ঘটনা বলে দিলো। এখন খালি কালপ্রিটটাকে বের করে জিজ্ঞাসাবাদ করাটাই বাকি। সিম্পল কাজ।

(৪)
আধাঘণ্টার মধ্যে ল্যাপটপ-ফোন চলে আসল। ল্যাপটপ ওপেন করে , ফেসবুক চালু করল। লগ আউট করে দেয়া। কিছুক্ষণ লাগলো রিকভারি করে ফোন দিয়ে আইডিতে ঢুকতে। মজার ব্যাপার , কোন মেসেজ নেই । মানে সব মুছে দেয়া হয়েছে , আইডি থেকে। ফোন বের করল। ফোনের মেসেজ আদান-প্রদানেও কোন মেসেজ নেই। মানে সব মুছে দেয়া হয়েছে। শাহেদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। এই মেয়ে আসলে এই মোছামুছি করেছে কেন? কারণটা কি ?
আইটি শাখার জাহিদকে ডেকে পাঠাল , সিম দিয়ে বলল এর মেসেজ আর কল লিস্ট এনে হাজির কর। অপারেটরের সাথে যোগাযোগ করে কিছুক্ষণের মধ্যেই , প্রিন্টেড মেসেজ আর রেকর্ডেড ফাইলের কপি এনে দিল শাহেদের হাতে। উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই। শুধু একটা ছেলের সাথে কয়েকবার কথা হয়েছে। নাম বোঝা যাচ্ছে না। তাকে লতা বলছে ,
“চল দুইজন মিলে , গাজীপুর বেড়িয়ে আসি। আমার না নিজেকে সব ঝামেলা থেকে মুক্ত মনে হচ্ছে।”
উত্তর আসলো – “কখন ? বলেছিলাম না , সবকিছু আগের মত হয়ে যাবে...”
“বিকাল তিনটায় রওয়ানা হব আমরা।”
মেসেজ লিস্ট পড়ে বোঝাই যাচ্ছে , ছেলেটাই সেই কালপ্রিট। সিমটার বয়স মাত্র একদিন। বোঝাই যাচ্ছে , সিমটা নতুন কিনেছে। আগের কনভারসেশনটা মেয়ে লুকাতে চাচ্ছে। সন্দেহ আর বাড়ছে। মেয়েটার কি প্রয়োজন ছেলেটার পরিচয় লুকিয়ে রাখার। আত্মহত্যাটা পূর্বপরিকল্পিত বোঝাই যাচ্ছে। যাই হোক , এরা পেশাদার কোন অপরাধী না। তাই , এইসব করেছে। এভাবে কি পরিচয় লুকিয়ে রাখা যায় না। ছেলেটার কল লিস্ট চেক করলেই , সব বেরিয়ে আসবে। জাহিদকে ডেকে বলল ,
“ জাহিদ , এই ছেলেটার কল লিস্ট বের করার ব্যবস্থা কর।”
উত্তর আসলো – “আচ্ছা স্যার।”
শাহেদ চুপ করে চেয়ারে বসে বসে ভাবছে। কেসটা যতটা সহজ ভেবেছিল , ততটা মনে হচ্ছে না। আরেকটা সিগারেট ধরালো। ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা এখনো বসে আছে। সব দেখছে। কিন্তু কিছু বলছে না। চুপ করে বসে আছে। মহিলা মাঝে মাঝে কাঁদছিল। এখন চুপ করে বসে আছে। ভদ্রলোকের দিকে খেয়াল করল শাহেদ। আঙ্গুলে কড়ার দাগ , ঠোঁটে চির-চেনা ডার্কস্পট। বোঝাই যাচ্ছে , ভদ্রলোক অনেক দিনের স্মোকার। আবারো , শাহেদ সিগারেটের প্যাকেটটা টেবিলের উপরে একটু বাড়িয়ে দিল। ভদ্রলোক এবার না করলেন না। প্যাকেট টেনে নিয়ে মুখে সিগারেট গুঁজলেন। লাইটার পকেট হাতড়ে বের করলো। বোঝাই যাচ্ছে , ভদ্রলোকও চিন্তিত মুখে বসে বসে ভাবছে আসলে ঘটনাটা কি। তার মেয়ে কি কোনদিক দিয়ে দোষী?

জাহিদ কিছুক্ষণ পরে ল্যাপটপ নিয়ে আসলো। রেকর্ড আর কল লিস্ট দেখিয়ে বলল , “স্যার ছেলেটির নাম রাসেল।”
“আচ্ছা আমি দেখছি।”
ল্যাপটপে মুখ গুজে মেসেজগুলি দেখতে লাগলো। জাহিদ আবারো বলল , “স্যার কালকে ছেলেটি মার্ডার হয়েছে। আজকে সকালে জব্বার সাহেবও কল লিস্ট তলব করেছিল।”
“মানে ... কখন?”, শাহেদ কোনমতে উত্তেজনা চেপে বলল।
“আজকে একেবারে সকাল বেলা। ছেলেটার লাশ আজকে ভোরে গাজীপুর থেকে পাওয়া গেছে। বুকে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন। মুখ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছিল। সিরিয়াস কোন ঘুমের ওষুধ টাইপের কিছু ছেলেটাকে খাওয়ানো হয়েছিল। তারপর...”
“লাশটা কোথায় ?”
“স্যার , মর্গে।”

শাহেদের মুখে ঘাম জমলো। রাসেলের মেসেজ ইনবক্সে অনেকগুলো মেসেজের মধ্যে লতারগুলো পাওয়া গেল। শাহেদই লতাকে এবরশন করতে বলেছে। সবশেষে গতকালে বিকালে লতা , রাসেলকে লং-ড্রাইভে যাওয়ার কথা বলে। রাসেল রাজি হয়। অবশেষে , ভোরে রাসেলের লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরে। গাড়ীর ভেতরে। বোঝা যাচ্ছে , খুনটা হয়েছিল সন্ধ্যার দিকে। হিসেবমতে খুনের সময় লতা , রাসেলের সাথেই ছিল। কে খুন করলো , রাসেলকে ? সেটা আর কেউ না , লতাই ভাল বলতে পারবে।
“আপনার মেয়ে কালকে বাসায় ফিরেছিল কয়টায় ?”
ভদ্রমহিলা উত্তর দিল , “ঠিক মনে নাই , তবে সম্ভবত রাত সাড়ে দশটার দিকে ? বলেছিল , বান্ধবীর জন্মদিনের পার্টি করতে গিয়ে দেরী হয়ে গিয়েছে।”

শাহেদ আবারো সিগারেট ধরালো। নিকোটিন দিয়ে মাথা ব্যথা দূর করার চেষ্টা চালালো। ঘটনা খুবই জটিল। রাসেলের লাশ পাওয়া গেছে , মুখে ফেনা ছিল। তার মানে রাসেলকে অজ্ঞান হবার জন্যে কিছু খাইয়ে দেয়া হয়েছিল। এরপর , বুকে ছুরি ঢুকিয়ে খুন করা হয়েছে। লতা ছাড়া আর কেউ থাকার কথা না , সেখানে। তাহলে কে খুন করলো?

শাহেদ ডায়রিটা আবার তুলে নীল। এতক্ষণ টেবিলের এককোণায় ছিল। ডায়রি তুলে নিয়ে আবার পাতাগুলি এলোমেলোভাবে উল্টাতে লাগলো। কিছুই লেখা নেই। যা লেখা ছিল , সবই পড়ে ফেলেছে। ডায়রিটা রাখতে গিয়ে আবার প্রথম পৃষ্ঠার সেই ছবির দিকে চোখ পড়লো। মা-বাবা একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। ডায়রি বন্ধ করে আবার রাখার সময় খেয়াল হল , স্কেচটার নিচে গুটি গুটি করে কি যেন লেখা। ভাল করে তাকিয়ে দেখলো , তারিখ লেখা। কালকের তারিখ। তারিখের নিচে খুব ছোট করে লেখা , “আব্বু আর আম্মু আসছি , রূপা...”
শাহেদ ধপ করে ডায়রিটা বন্ধ করল। যা বোঝার বুঝে গেল। সিগারেটটা এশট্রেতে গুজে চেয়ার ছেড়ে উঠলো। বেসিনের দিকে এগিয়ে গেল। ট্যাপ ছেড়ে মুখে পানি দিল। চোখের কোণায় পানি জমেছিল। পুরুষ মানুষের চোখের পানি কাউকে দেখাতে নেই। তাই , মুখটা হালকা ধুয়ে নিল। কেউ কিচ্ছু টের পাবে না। কালো চুলের রাজকন্যা রূপাঞ্জেল , রূপাও টের পাবে না।




আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এশরার লতিফ অনেক অভিনন্দন.
রেজওয়ানা আলী তনিমা বেশ চমৎকার লাগলো। গতানুগতিক থেকে ভিন্ন স্বাদের আপনার বর্ননা। ভালো থাকবেন।
আপনাকেও ধন্যবাদ। উৎসাহ দিয়ে সহযোগীতা করবার জন্যে ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্ গল্পটা অনেকটা সময় নিয়ে পড়লাম কিন্তু দুঃখের বিষয় শেষটা বুঝতে পারলাম না ! বুঝলেন শুধু আপনি আর শাহেদ সাহেব ! পরিশ্রম টা বেকার গেল না ? যদিও মনে হয়েছে আপনার লেখার হাতটা বেশ ভাল ।
শেষটা , হল রূপাঞ্জেল মারা গিয়েছে। এই দুঃখটাই শাহেদকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে।
এফ, আই , জুয়েল # বেশ ভালো---, অনেক সুন্দর গল্প ।।
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,ভোট রেখে গেলাম।পাতায় আমন্ত্রন রইল।
অবশ্যই। আপনার আমন্ত্রণ নিলাম।
সুগত সরকার খুব ভাল লাগলো। শুভেচ্ছা রইল। আমার গল্পে সাদর আমন্ত্রন।
এস আই গগণ ভাল লিখেছেন
অনেক ধন্যবাদ ভাই।

৩০ জানুয়ারী - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ৫ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.২৭

বিচারক স্কোরঃ ২.৮৭ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৪ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪