গত পহেলা ফাল্গুন আমি মরে গিয়েছি।
আমার কথা শুনে কি হাসছেন? ভাবছেন মজা করছি আপনাদের সাথে? মরে গিয়ে নিজের কথা বলছি কীভাবে?
সত্যি কথা বলতে কী, সেটা আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার ধারণা ছিল, ভেতরের যত জ্বালা যন্ত্রণা ক্ষোভ রাগ সবকিছুকেই আমি ঐ ইহজগতেই জলাঞ্জলি দিয়ে এসেছি। এই জগতে এসে সেসব নিয়ে আর পড়ে না থাকলেও চলবে।
কিন্তু কী হচ্ছে এসব? আমি তো এখনো ঐ জগতেই ঘুরে বেড়াচ্ছি!
ঘটনাটা যেদিন ঘটলো, সেদিনের কথা একটু খুলে বলি। আগেই বলেছি,দিনটা ছিল পহেলা ফাল্গুন। দু’দিন আগেই ফয়সল আমাকে খুব সুন্দর একটা হলুদ শাড়ি গিফট করেছিল। রঙটা ঠিক বাসন্তী হলুদও না, আবার কটকটে হলুদও না। দুটোর মাঝামাঝি কিছু একটা। কেউ যেন হলুদ রঙে খুব হাল্কাভাবে কচি কলাপাতা সবুজের ছোপ মিশিয়ে দিয়েছে। ফয়সলের পছন্দ দেখে আমি সবসময়ই মুগ্ধতায় হাবুডুবু খেতাম। এবারেও ব্যতিক্রম হলো না। গলায় উচ্ছ্বাসের বাড়াবাড়ি ঝড় তুলে বললাম,
‘মাই গড! কোথায় পেলে এই শাড়ি তুমি?’
শাড়িটা কিন্তু মোটেও তেমন আহামরি কিছুই ছিল না। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সেটা চুপিচুপি জানিয়েও দিয়েছিল আমাকে। সাদামাটা জমিনের ওপরে একেবারেই অনাড়ম্বর জরির পাড়। টাঙ্গাইলের তাঁতে বোনা। ফয়সলের বাড়ি টাঙ্গাইল। পাতরাইলে গেলে সে সস্তায় অনেকগুলো শাড়ি একবারে কিনে আনতো। বেশিরভাগই আমার জন্য। তবে নববিবাহিত বন্ধুদের বউদেরও দিত কিছু। বন্ধুর বউরা এসব ফাউ উপহার পেয়ে খুশিতে আটখানা হয়ে যেত। ফয়সলকে বাসায় ডেকে খাতির করে দাওয়াত খাইয়ে দিত। এসব কথাও ফয়সল নিজেই আমাকে বলেছে। কাজেই সেইসব শাড়ি খুব যে আহামরি কিছু হবে তেমন ভাবাটা বোকামী।
কিন্তু তাতে কী? ফয়সল আমাকে যেটাই দিত, আমার কাছে মনে হতো সেটাই বুঝি জগতের সেরা। সারা পৃথিবীতে ঐ একটি আইটেমই শুধু তৈরি হয়েছিল। আর সেটাও আমারই জন্য!
বান্ধবীরা ফয়সলের প্রতি আমার এই বাড়াবাড়ি আদিখ্যেতায় আড়ালে মুখ টিপে হাসতো। বিশেষ করে সোমাটা উঠতে বসতে জ্ঞান দিত,
‘তুই একদিন পস্তাবি দেখিস!’
আমি গায়ে মাখতাম না। জীবনটা আমার। আমি যাকে নিয়ে পুরো জীবনটা কাটাবো, তাকে যদি পাগলের মতো ভালোই না বাসলাম...তাহলে এত ভালোবাসা জমিয়ে রেখে আমার কোন কাজে আসবে?
অবশ্য এখন তো সব শেষই হয়ে গেল! ফয়সলের প্রতি আমার সুতীব্র ভালোবাসা আর কোনো কাজেই আসবে না। কে জানে, হয়ত সারাজীবন ভালোবাসার কাঙ্গাল হয়েই বেঁচে থাকতে হবে ওকে! অথবা যদি আরেকটু সাহসী হয়... তাহলে হয়ত আমারই মতো...
ভেতরটা কষ্টে ভেসে যেতে লাগলো আমার। ইস! আমি এভাবে ফয়সলকে নিঃস্ব করে চলে এলাম! এতটা সার্থপর আমি কীভাবে হলাম?
সেই বাসন্তী রঙা শাড়ি পরে সেদিন আমি খুব সেজেছিলাম। মাথায় ফুলের ঝাঁপি আর কানে গলায় ফুলের গয়না। মা আমাকে দেখে চোখমুখ সরু করে জিজ্ঞেস করেছিল,
‘কোথায় যাচ্ছিস?’
‘কোথায় আবার! বান্ধবীদের সাথে ঘুরে বেড়াবো!’ আমার কণ্ঠে অকপট মিথ্যে কথা। অথচ বলতে গিয়ে এতটুকুও গলা কাঁপলো না আমার!
‘বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যাচ্ছিস নাকি ঐ লাফাঙ্গাটার সাথে বেলেল্লাপনা করতে যাচ্ছিস? বেহায়া মেয়ে! লেখাপড়ার নাম নেই! আজ বাদে কাল পরীক্ষা...আর উনি প্রেম করে বেড়াচ্ছেন!’
পরীক্ষার বেশ ভালোই দেরি আছে এখনো। মোটেও আজ বাদে কাল নয়। মায়ের সব কথাতেই বাড়াবাড়ি! আর তাছাড়া আমি তো মন দিয়েই পড়ছিলাম! মা ই তো আমার কোচিংটা বন্ধ করে দিলো!
একদিন থমথমে মুখে এসে বললো,
‘এই শোন! তোর আর কাল থেকে কোচিং এ যেতে হবে না। এখন থেকে বাসাতেই পড়াশুনা করবি!’
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। কী বলছে মা এসব? কোচিং এ না গেলে ফয়সলের সাথে আমার দেখা হবে কীভাবে? ওকে প্রতিদিন দেখতে না পেলে আমি তো দম আটকে মরেই যাবো!
ক্লাসের শুরুতে ফয়সল যখন লেকচার শিট বিলি করার নামে আলতো করে আমার আঙুলগুলোকে ছুঁয়ে যায়...অথবা পরিসংখ্যান বোঝাতে বোঝাতে চশমার ফাঁক দিয়ে যখন আমার দিকে তাকায়...! আমার নিশ্বাসটা তখন বুকের কোথায় যেন আটকে যায়। কিছুক্ষণের জন্য স্থবির হয়ে যায় আশেপাশের সবকিছু। অথচ ঠিক সেই সময়ই মনের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কী যে প্রচণ্ড এক ঝড় ওঠে!
কিন্তু সেসব কথা তো আর মাকে বলা যাবে না! আমি আমার মনের ভাবনাকে একশো আশি ডিগ্রীতে ঘুরিয়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,
‘আর মাত্র ক’দিন পরেই আমার পরীক্ষা। আর তুমি আমার কোচিং এ যাওয়া বন্ধ করে দিতে চাও? আমি যদি ফেল করি!’
মা নিষ্ঠুর পাষাণের মতো গলায় বললো,
‘ফেল করলে করবি! তবু তুই ঐ কোচিং এ যেতে পারবি না! তোদের কলেজের সব মেয়ে কি পরীক্ষার প্রিপারেশনের জন্য কোচিং এ ভর্তি হয়েছে? তোকে ভর্তি করিয়েছিলাম...ভেবেছিলাম ভালো রেজাল্ট করবি। তুই তো সেখানে গিয়ে প্রেমকানন রচনা করে বসে আছিস!’
মা সত্যি সত্যি আমার কোচিং এ যাওয়া বন্ধ করে দিলো।
রাগে দুঃখে আমি খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিলাম। একটা দিন পুরোপুরি কিছু খেলাম না। বাসার কেউ আমার দিকে ফিরেও দেখলো না। আমি মানুষটা যে সারাদিন কিছু খাইনি, সে ব্যাপারে কারো যেন কোনো চিন্তাভাবনাই নেই! সবাই দিব্যি যার যার মতো খেয়ে দেয়ে প্রত্যেকের নিজের কাজে চলে গেল। রাতের বেলাও রাগ না ভেঙে শুয়ে থাকলাম। মনে মনে ঠিক জানতাম, এবার বাবা অন্ততঃ উঠে এসে আমার রাগ ভাঙাবে। চাইলে মুখে তুলে খাইয়েও দিতে পারে। ছোটবেলায় যেমন দিত।
কিন্তু কীসের কী! আমার সেই ভাবনাই সার! কেউ এসে আমার মানও ভাঙ্গালো না...খাবারও নিয়ে এলো না!
একজনকে একটু পছন্দ করেছি দেখে এত রাগ সবার! আমার বাবা-মা, ভাই এদের কাছে আমার আর কোনো মূল্যই নেই! আমি মানুষটা কোনো গুরুত্বই রাখি না কারো কাছে? এই তাহলে পরিবারের অবদান!
আমাদের ক্লাসের শম্পার কয়েকমাস পরেই বিয়ে হবে। ওর হবু স্বামী ইঞ্জিনিয়ার, দেশের বাইরে থাকে। বিয়ের পরে শম্পাকে নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাবে। শুনে আমাদের মন খারাপের শেষ নেই। অথচ শম্পাটা বেহায়ার মতো দাঁত কেলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটুও মন খারাপের চিহ্ন নেই। আমরা বান্ধবীরা শম্পাকে সমানে এটা সেটা জিজ্ঞেস করছি।
‘কী রে, তোর মন খারাপ হচ্ছে না বাবা-মার জন্য?’
শম্পার গলায় ফুরফুরে সুর। হাসতে হাসতে বলে,
‘কীসের মন খারাপ? সব মেয়েরই তো একদিন বিয়ে হয়ে যায়। আমারও হচ্ছে...তোদেরও হবে। স্বামীর সাথেই তো থাকতে হবে সারাজীবন। মন খারাপ করবো কেন?’
বাবা-মা’র এই ব্যবহারে আমিও বুঝে গেলাম, স্বামীর কাছে যাওয়ার জন্য মেয়েরা কেন এত উতলা হয়! আসলে একটা সময় পরে বাবা-মা বুঝি এভাবেই পর হয়ে যায়। স্বামীই হয়ে ওঠে সবকিছু।
কিন্তু আমার তো এখনো বিয়ে হয়নি। তবে হবে তো একদিন! আর ফয়সল ছাড়া অন্য কাউকেই আমি বিয়ে করবো না। ফয়সলও আমাকে ছাড়া আর কোনো মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না। আমাকে নিয়েই ফয়সলের দিনরাত্রি।
কোচিং শেষে প্রতিদিন আমাদের কথা হয়। রাত জেগে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে চ্যাটিং করি আমরা। বেশ অনেক রাতে যখন বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তখন মাঝে মাঝে ভিডিও কল দেয় ফয়সল। মাঝে মাঝে একটু আধটু অসভ্যতাও যে করে না তা নয়! কিন্তু আর তো মোটে কয়েকটা দিন! ফয়সল ভালো একটা চাকরি পেয়ে গেলেই আমরা বিয়ে করে ফেলবো। কোচিং এর টাকা দিয়ে তো আর সংসার চলবে না! অদেখা সংসারের কত রঙিন স্বপ্ন বুনি দু’জন!
যখনই নক করি, সাথে সাথে ফয়সলের সাড়া পাই। এমনভাবে কেউ আমার জন্য দিনরাত বসে থাকে না। আমি লিখি,
‘এ্যাই কী কর?’
‘তোমার সাথে চ্যাট করি।’
‘আর কী কর?’
‘তোমার কথা ভাবি?’
‘আহা! আর কী কর এসব ছাড়া?’
‘তোমাকে আদর করি...’
আমি লজ্জায় লাল হই। এমনভাবে বললে আর কি কিছু বলা যায়? আমি কপট রাগ দেখাই,
‘ধ্যাৎ! এরকম করলে আর কথাই বলবো না তোমার সাথে!
‘আচ্ছা যাও আর কিছু বলবো না। শুধু একটিবার...সেদিনের মতো...প্লিজ প্লিজ প্লিজ...’
আমি শিহরিত হই। ফয়সল কী যে পাগলামি করে মাঝে মাঝে! অথচ এমনভাবে আমাকে পাগল করে ওর কথা দিয়ে...যে আমি না বলতে পারি না। নিজের অজান্তেই সাড়া দিই।
সেদিন অবশ্য একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছিলাম।
খুব গরম পড়লে রাতে গোসল না করলে ঘুম আসে না আমার। ভেজা শরীরে ভেজা চুল বালিশে ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ি আমি। দ্গদগে গরম ছুটে পালায় সেই সিক্ততার কাছে হার মেনে।
সেই রাতেও গোসল সেরে এসে বসেছিলাম চ্যাটিং এ। একটু পরেই ভিডিও কল করেছিল ফয়সল। কানে হেডফোন গুঁজে এলিয়ে ছিলাম বালিশের তাকিয়ায় হেলান দিয়ে। রাতের থমথমে নিস্তব্ধতা তখন সেঁটে বসেছে পুরো প্রকৃতিতে। বাসার সবাই ঘুমে অচেতন। আকাশে ফুটফুটে জ্যোৎস্নার মাখামাখি। প্রচণ্ড গরমের উন্মত্ততায় অধীর হয়ে প্রকৃতিও দিনশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
সদ্যস্নাতা আমার লম্বা চুলের কোল বেয়ে টুপটাপ জলকণা ঝরে পড়ছে...কীসের যেন ব্যকুল অধীরতায়। বিন্দু বিন্দু ধারায় আমার গায়ে জড়ানো পাতলা নাইটিটাও সিক্ত হয়ে উঠেছে। সেই সিক্ততায় আমি কেমন যেন উন্মত্ত তখন। ফয়সলের কথাবার্তাও সেদিন যেন একটু বেশিই অসংলগ্ন। চোখে অদেখা মাতাল আহ্বান। ওর সেই আহ্বান আজো কানে ভাসে... ‘বেশি না একবার...কিছুক্ষণের জন্য...প্লিজ...প্লিজ...’
আমার চারপাশে তখন অজস্র জোনাকির কাঁপাকাঁপি। বাতাসে ভেসে বেড়ানো তীব্র মাদক ছড়ানো বুনো সুবাস। নিজেকে ভুলে আমিও ভেসে গিয়েছিলাম বুনো ফুলের সেই পাগল করা গন্ধে...
পহেলা ফাল্গুনের ঘোরলাগা সন্ধ্যা কাটিয়ে বাসায় ফিরে এসেই অন্য এক ঝড়ের মুখোমুখি হলাম সেদিন।
বাসায় পা দিয়েই টের পেলাম কোনোকিছু ঠিক নেই। কিছু একটা ঝামেলা বেঁধেছে। মা’র চোখেমুখে দগদগে আগুন যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে। বাবা শীতল অনুভূতিহীন মুখে বসে আছে চেয়ারে...মাথাটা যেন ভীষণ ক্লান্তিতে ঝুঁকে পড়েছে পেছনে। ছোটভাইটির চোখে কীসের যেন জিঘাংসা! আমাকে আসতে দেখেই সবক’টি চোখ থেকে ছুঁড়ে দেওয়া বাণ একযোগে ছুটে এলো আমার দিকে। মা হিসহিসে গলায় বললো,
‘ভেতরে চল!’
বাবা টেনে টেনে বললো,
‘রুমু...বাড়াবাড়ি কর না!’
মা’র গলায় রাগ আর ক্ষোভের জ্বালা যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বাবার কথা শুনে মা তীব্র সেই আগুনের শিখায় একেবারে দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো।
‘বাড়াবাড়ির আর কি কিছু বাকি আছে? তোমার মেয়ের নির্লজ্জতার বাড়াবাড়ি চোখে দেখ না তুমি? আরো কিছু দেখতে বাকি আছে?’
বাবা হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকলো আমাদের দুজনের দিকে। আমি তখনও অথৈ জলে। কীসের বাড়াবাড়ির কথা বলছে মা? কী করেছি আমি?
টানতে টানতে আমাকে ঘরে ঢোকালো মা। নিজেও ঢুকে টেনে দিলো দরজার ছিটকিনি। তারপরে হাতে ধরা আমার ভাইয়ের মোবাইল খুলে দেখালো একটা ভিডিও। আমি কৌতুহলী চোখে সেই ভিডিওর দিকে তাকিয়ে একেবারে জমে গেলাম। ফয়সলকে পাঠানো আমার সেই ভিডিও। ভাইয়ের কাছে গেল কী করে?
তারপরেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো মনে পড়লো, ভিডিওটা আমার ফোনে সেইভ করে রেখেছিলাম। গতকাল দুপুরে যখন গোসল করছিলাম, আমার বান্ধবী সোমা আমার ঘরে ঢুকেছিল। আমি জানি, সোমাটা আমাকে ঈর্ষা করে। এই ভিডিও ঐ তাহলে সরিয়েছে কোনোভাবে! আর একেবারে পৌঁছে দিয়েছে আমার ভাইয়ের হাতে! কত বড় শয়তান!
আমি কী বলবো মনে মনে সাজাতে লাগলাম। মা আমার অযুহাতের ধারও ধারলো না। স্পষ্ট গলায় বললো,
‘তুই মরতে পারিস না? বেঁচে থেকে কী করবি তুই? আরো নতুন নতুন ভিডিও বানাবি? তারপরে সেসব ভিডিও বাজারে বিক্রি করবি?’
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কী বলছে মা এসব! নিজের মেয়েকে কেউ এমনভাবে বলতে পারে? আমি ভিডিও বাজারে বিক্রি করার জন্য ছেড়েছি? আমি ভালোবাসি ফয়সলকে। ফয়সলও আমাকে ভালোবাসে। খুব শীঘ্রি আমরা বিয়ে করে ফেলবো। আর তাছাড়া এসব সোমার কারসাজি। সে আমাকে সবার চোখে নীচু দেখাতে যায়। আর কে জানে! মনে মনে ফয়সলকে পছন্দ করে বসে আছে কী না। সেই জেরেই হয়ত এতকিছু করছে!
আমি অকপট গলায় বললাম,
‘এসব সোমার চাল! আমি এমন ভিডিও বানাইনি। সোমা আমাকে দেখতে পারে না। ঐ এসব ভিডিও কারসাজি করে বানিয়ে তোমাদের বোকা বানাচ্ছে!’
মা বাঘের মতো গর্জে উঠলো,
‘চুপ কর বেহায়া মেয়ে! তুই এমন কী রসগোল্লা যে তোকে কেউ দেখতে পারবে না? আরে ঈর্ষা তাকেই করতে হয়, যার মধ্যে কিছু আছে। তোর মধ্যে আছেটা কী যে ঈর্ষা করবে? তোর এই ভিডিও সবার হাতে হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে!’
আমার ভেতরে এতক্ষণে একটা ভয়ের স্রোত বয়ে গেল। সবার হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে! আমি ফয়সলকে ফোন করতে চাইলাম। মা এক ঝটকায় আমার মোবাইল টান মেরে ফেলে দিলো। চোখের সামনেই সেটা দু’টুকরো হয়ে দু’দিকে ছড়িয়ে গেল।
মা চাপা গলায় গর্জন করলো,
‘কাউকে ফোন করার দরকার নেই। খবরদার বলে দিলাম! এই মুহূর্তেই নিজের বাক্স পেটরা সব গুছিয়ে নে। আজই তোকে নিয়ে আমি গ্রামে চলে যাবো। সেখানেই থাকবি তুই। আর পড়ালেখার দরকার নেই। যে কেচ্ছা করেছিস বিয়ে দিতে পারবো কী না তারও ঠিক নাই। শুধু তোরই না, তোর ভাইয়ের জীবনটাও অনিশ্চিত করে দিলি তুই। যার বোন এমন বেহায়া, নষ্টা...তাকে আর কে বিশ্বাস করবে? সবাইকে সারাজীবনের জন্য লটকে দিলি! আর নিজে গলা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছিস এখনো!
একটা দড়ি নিয়ে এসে একেবারে লটকে যেতে পারছিস না মুখপুড়ি!’
মা ঘরের মধ্যে আমাকে বন্দি করে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। যাওয়ার আগে বলে গেল,
‘আজ থেকে তুই আমাদের জন্য মরে গেছিস।’
সারারাত সেই বন্ধ দরজা ধরে বসে থাকলাম আমি। কোনো চেঁচামেচি করলাম না। কাউকে ডাকলাম না। মাঝরাতের দিকে মনে হলো, আচ্ছা...আমার জন্য সবার জীবন এভাবে নষ্ট হয়ে গেল! মা’র কাছে তাই মনে হচ্ছে? নিশ্চয়ই আমি মরে গেলেই বাবা-মা ভাই সবাই প্রাণ খুলে বাঁচবে। নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াবে। বেশ! তাহলে সত্যি সত্যিই তাদের বাঁচার ব্যবস্থা করে দিয়ে যাই!
কেউ না মানলেও আমি জানি, ঐ সোমাটাই আমাকে ফাঁসিয়েছে! আমার ভিডিওটা নিজের মোবাইলে নিয়ে সে ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছে। আজকাল কারো ওপরে ক্ষোভ থাকলে কত কী করে মানুষ!
আমার মৃত্যুর পরে সবাই টের পাবে আমি সত্যি বলেছি নাকি মিথ্যে।
বেশি কিছু ভেবে আর সময় নষ্ট করতে গেলাম না। ফয়সলের দেওয়া শাড়িটা খুলে যত্ন নিয়ে ভাঁজ করে রেখে দিলাম। তারপর বিছানার চাদরটাকেই পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে দড়ি বানালাম। একেবারে শেষ মুহূর্তে ফয়সলের মুখটা একবার মনে পড়েছিল। ইস! আমি মরে গেলে বেচারা খুব কষ্ট পাবে! আমিই তো ওর সবকিছু ছিলাম!
নয়টার দিকে দরজা ভেঙ্গে আমাকে বের করলো সবাই। অবিশ্বাসীর ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ সবাই তাকিয়ে ছিল আমার ঝুলে থাকা লাশটার দিকে। তারপরেই শুরু করলো মহা নাটক। বাবা এবার আর শান্ত ছিল না। হাউমাউ করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতে লাগলো। মা ও অনেক বিলাপ বকতে শুরু করলো। এমনকি আমার ভাইটাও ‘বুবুরে’ বলে আছাড়িবিছাড়ি দিতে লাগলো।
এমন মেজাজ খারাপ হলো আমার! এই ঢং দেখানোর কোনো দরকার আছে? এখন তো তোমরা মুক্ত। যাও আমাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে এসে আনন্দ ফূর্তি কর!
আমি সবার চোখ বাঁচিয়ে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। আসলে চোখ বাঁচিয়ে বলাটা ঠিক হচ্ছে না। আমাকে এখন কেউ আর দেখতেই পাচ্ছে না। এটা একদিক দিয়ে খুব ভালো হয়েছে। নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম আমি।
প্রথমেই গেলাম সোমার বাসায়। ঐ ছেমড়িটাকে একটা শাস্তি আমার দিতেই হবে। সেদিন আমার ঘরে ঢুকে ঐ আমার মোবাইলে হাত দিয়েছিল। জানি তো আমি!
সোমার ঘরের দরজা খোলা ছিল। দরজা খোলা রেখেই মন দিয়ে পড়ছে ছেমড়ি! ইঃ! আমার সাড়ে সর্বনাশ ঘটিয়ে সে পড়তে বসেছে! তোকে শান্তি পেতে দিব আমি? সারাজীবন তোর ঘাড়ে চেপে বসে থাকবো! সত্যি সত্যিই ওর ঘাড়টাকে লক্ষ্য করেই এগুচ্ছিলাম। এমন সময়ে ওর ছোটভাই দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসে আমার মৃত্যু সংবাদ দিলো।
চোখমুখে ভয়াবহ অবস্থা ফুটিয়ে তুলে সে এমন একটা দৌঁড় দিল আমাদের বাসার দিকে! মনে মনে ভাবলাম, সবাই এত সুন্দর অভিনয় করতে জানে কীভাবে? এই দুইদিন আগেও ফয়সলকে নিয়ে ওর সাথে আমার ঝগড়া হয়েছে। ফয়সলকে পছন্দ করতো বলে আমাকেই সরে আসতে বলেছিল ফয়সলের কাছ থেকে। আর এখন কী অভিনয়টাই না করছে!
ছুড়ি আমার মায়ের কাছে গিয়ে ব্যাপক কান্নাকাটি জুড়ে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
‘আমি কত বলেছিলাম...তুই সরে যা...সরে যা ওর কাছ থেকে...’
অসহ্য! আর দেখতে পারলাম না এই মিথ্যে শোকের মাতম। এদের সবার চেহারা খুলে যাবে আমার চোখের সামনে। শুধুমাত্র কয়েকটি দিনের অপেক্ষা।
আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমাদের বাসার সামনের দিকের ছোট্ট একটা ঘুলঘুলিতে একেবারে সেঁটে বসে রইলাম আমি। কাউকে চোখের আড়াল করবো না। দেখি এরা কতদিন অভিনয় করে যেতে পারে!
দিনের পরে দিন যেতে লাগলো। কেউ ক্লান্ত হলো না। এরা লাগাতার অভিনয় চালিয়ে যেতে লাগলো। মা রান্না করতে ভুলে যেতে লাগলো... বাবা অসুস্থ হয়ে বিছানায় গেল। আমার চেয়ে দুইবছরের ছোট আমার ভাই স্কুলে না গিয়ে সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগলো। মাঝেমাঝে সোমার বাসার ভেতরেও উঁকি দিয়ে আসতে লাগলাম। সেই ছুঁড়িও দেখি কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। আহা! কী পাকা অভিনেত্রী! কে বলবে দেখে যে, এই মেয়েই আমার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছে!
আমি বিরক্ত হয়ে এদের ছেড়ে অন্যজায়গায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বহুদিন ফয়সলকে দেখি না। একবার ঘুরে আসি...আহা! এরা এত কান্নাকাটি করছে! ফয়সল না জানি কী করছে আমার বিরহে!
মনে মনে তিরস্কার করলাম নিজেকে। এদের এই সস্তা ধাঁচের অভিনয়ের সাথে আমি ফয়সলের গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক খুঁজতে চাইছি! আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? ফয়সল ভালোবাসতো আমাকে। সেই ভালোবাসায় কোনো খাঁদ ছিল না। আমার মায়ের জেদের কারণে তাকে বলে আসা হলো না। আমি চলে গেলেও সে সোমাকে কিছুতেই ছাড়তো না। অথচ বলেই আসা হলো না কিছু!
অনেক রাত। বাইরে ঝি ঝি ডাকছে একটানা। ফয়সলের ঘরে আলো জ্বলছে। রাত জেগে পড়ার অভ্যেস ফয়সলের। আমি নির্বিঘ্নে ঢুকে গেলাম ঘরে। কতদিন ভিডিও চ্যাটে এই ঘরের ছবি দেখতে দেখতে মনে মনে কল্পনা করেছি...আমি একদিন এই ঘরের মালকিন হব! আয়োজন করে এই ঘরে আমাকে স্বাগত জানানো হবে। আজ সত্যিই এই ঘরে এলাম। অথচ এইভাবে!
ফয়সল জেগেই ছিল। কানে ইয়ারফোন গুঁজে খুব নীচু স্বরে কারো সাথে কথা বলছিল। আমি আস্তে আস্তে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। পরম মমতায় আমার হাতটাকে ওর কাঁধে রাখলাম। ইস! আমার এই স্পর্শ একদিন কত আরাধ্য ছিল ওর কাছে! সব শেষ হয়ে গেল!
ফয়সলের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। কত সাধনার...কত কামনার এই কণ্ঠস্বর! আমার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করলো হাত দিয়ে। আজ তো আমি বহুদূরেই চলে গেছি! আগের মতো ডাকলেই তো আর সাড়া দিবে না ফয়সল! হাত বাড়ালাম ওর গলার কাছটাতে। আর ঠিক তখনই...চমকে সরে এলাম দু’ধাপ। ফয়সল কাকে যেন বলছে,
‘প্লিজ লক্ষী সোনা একবার দেখাবে? প্লিজ...আর কখনো দেখাতে বলবো না...প্রমিজ!’
ওপারে কেউ হয়ত সম্মতিসূচক কিছু বললো। তা শুনেই হাসি ফুটে উঠলো ফয়সলের মুখে। অসভ্য জানোয়ারের হাসি! সে হাসিতে কোনো আওয়াজ নেই। শুধু কদর্য নোংরা নৃশংসতা মিশে আছে। আমি অবাক হয়ে দেখতে থাকলাম সেই হাসি। ফয়সল ফোন বন্ধ করে বসে রইলো। মুখে মিশে রইলো সেই বিভৎস হাসি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মেসেজ ভেসে এলো। আনরিড এমএমএস। ফয়সল ক্ষীপ্র হাতে অন করলো সেই এমএমএস। মুখের হাসিটা আরেকটু ক্রুর হয়ে উঠলো। একটু পরেই...আমার চোখের সামনেই সেই ভিডিওটাকে ইন্টারনেটে আপ্লোড করলো ফয়সল।
আমি দেখতে থাকলাম। কত সহজে একটা সাদামাটা সহজ সরল মেয়ে পুরো সমাজের কাছে খোলামেলা বেশ্যা হয়ে গেল! প্রতিদিন হাজার হাজার পুরুষ তাকে দেখবে...চেটে চেটে খাবে। আর যত তাকে সবাই আয়েশ করে খাবে তত পকেট ভারী হবে ফয়সলদের!
অচেনা অদেখা ফয়সলকে আমি অবাক হয়ে দেখতেই থাকলাম। একসময় সম্বিত ফিরলো। আমি হাতটাকে আবার সামনে বাড়ালাম। ঠিক ফয়সলের গলা বরাবর! আমার পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ কেটে বসে গেল ফয়সলের গলায়।
তীব্র গোঙ্গানির আওয়াজে আমি আত্মতৃপ্তিতে ভেসে গেলাম। মরেছে ব্যাটা! বেশ হয়েছে!
হাত সরিয়ে নিলাম পরম উল্লাসে।
কী আশ্চর্য! আমার সারা হাত কুৎসিত কালিতে একাকার হয়ে গেছে। কিন্তু...ফয়সলের কিচ্ছু হয়নি! সে মহা আনন্দে মোবাইলের বাটন টিপে চলেছে। আমার মাথায় ঘুরতে লাগলো... কিচ্ছু হয়নি ফয়সলের! কিচ্ছু হয়নি!
তাহলে এই তীব্র গোঙ্গানির আওয়াজ কোথা থেকে ভেসে এলো!
আমি ভয়ে ভয়ে আবার তাকালাম আমার হাতের দিকে। আমার হাতের কালি ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেহে। আমার কনুই, বাহু, গলা, মুখ...না দেখেও বুঝতে পারছি ধীরে ধীরে সেই কালি আমার শরীরের আসল রঙটাকে মুছে ফেলছে। সমস্ত শরীরে কালি মেখে আমি উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
আমার সামনে জান্তব কিছু একটা গুঙিয়ে চলেছে। ঘোৎ ঘোৎ...
অথচ সেই আওয়াজ কেউ শুনতে পাচ্ছে না...
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
অলিক কিছু স্বপ্নে মানুষ প্রায়ই নিজেকে হারিয়ে ফেলে। বিভ্রান্তির জালে জড়িয়ে গিয়ে জীবনের অর্থটাকেই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে।
অনেক বিভ্রান্তিকে সংশোধনের আলোকে পরিশুদ্ধ করা গেলেও, কিছু ভুল আর কখনো ফুল হয়ে ফুটতে পারে না।
অলিক ছন্নছাড়া মোহের তাড়নায় অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায় অনেক কুঁড়ি...
০১ ডিসেম্বর - ২০১৪
গল্প/কবিতা:
৬৭ টি
সমন্বিত স্কোর
৬.৮৪
বিচারক স্কোরঃ ৪.২ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.৬৪ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪