এক
একটানা কান্নার গুনগুন আওয়াজে মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে রুবিনা বেগমের।
সম্মিলিত কান্নার আওয়াজটা ভেসে আসছে বাইরের চুলার পাড়ের ওদিকটা থেকেই। গ্রামদেশে এই চল অনেকদিনের। পাড়া প্রতিবেশি কেউ মারা গেলে সবাই দল বেঁধে তার বাড়িতে গিয়ে শোক জানিয়ে আসে। সেই শোকের তীব্র প্রকাশ এই সম্মিলিত কান্না।
অনেকক্ষণ থেকেই রুবিনা ভাবছিলেন উঠে গিয়ে একটু ধমক দিয়ে আসবেন। কিন্তু সঙ্কোচ আর দ্বিধায় উঠতে পারছিলেন না। সদ্য স্বামীহারা হয়েছেন তিনি। এ সময় চিৎকার করে তো তারই কাঁদবার কথা! সেই কান্না তার পরিবর্তে গাঁয়ের অন্যরা এসে কেঁদে যাচ্ছে। অথচ তাতেও বিরক্তি লাগছে তার!
মাঝে মাঝে ভাবতে গিয়ে অবাক হন রুবিনা বেগম। এত কঠোর তিনি কীভাবে হলেন ?
তার বাবা-মা আজ এই তাকে দেখলে বুঝি অবাকই হয়ে যেত। তাদের সেই অতি চেনা নরম মনের রুবিনা এত শক্ত জগদ্দল পাথরের মতো হয়ে গেল কীভাবে? এত শক্ত যে, স্বামীর মৃত্যুতেও তার চোখে পানি আসে না!
চোখের পানি শুকিয়ে গেছে রুবিনা বেগমের। আর কান্না আসে না সহজে।
একসময় অনেক কেঁদেছেন গোপনে। অনেক অভিসম্পাত করেছেন নিজের ভাগ্যকে। আর কত?
জগ সংসারে তিনিই বুঝি একমাত্র মানুষ অবশিষ্ট ছিলেন, যার ভাগ্যে এমন একজন স্বামী জুটতে হবে! মনের কত আশা, কত আকাঙ্ক্ষা অবোধ অব্যক্ত কথা হয়ে ঝরে পড়ে গেছে! কাউকে বলতে পারেননি। অনুযোগ করা তো দূরের কথা!
বাইরে কে একজন যেন ডাকছে তাকে,
‘ও মা, এনা ইদিক আসো দিকিন। দ্যাখো দিকিন মা, এই ছোলডাক এনা কিছু খাবার দিবার পারবিন?’
ক্লান্ত শরীর মন নিয়ে বাইরে এলেন রুবিনা। চুলার পাড়ে একপাশে বসে কেউ কেউ থালা বাটি নিয়ে খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত। কেউ বা বিলাপের মতো করে মাঝে মাঝে কান্নার একটা সুর তোলার চেষ্টা করছে।
ঘরভর্তি মানুষের দেখভাল করতে হচ্ছে তাকে। আশেপাশের গ্রাম থেকে আত্মীয় স্বজনরা এসেছেন শেষ বিদায় জানাতে। তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও একা হাতে তাকেই সামলাতে হচ্ছে।
ছেলে সৈকত শুকনো মুখে লাশ দাফনের আয়োজন করছে পরিবারের অন্য পুরুষদের সাথে। আত্মীয় স্বজনদের দেখভাল করার কথা মেয়ে রানুকে বলতেই মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছে,
‘আমি পারবো না কিছু করতে। তুমি করছো, কর।’
রুবিনা বেগম চকিতে এদিক সেদিক চেয়ে চাপা গলায় বলেছেন,
‘ছিঃ! মা! এখন এভাবে বলতে আছে? তোর বাবা মারা গেছে!’
রানু ততোধিক চাপা স্বরে হিসহিসিয়ে বলেছে,
‘মারা গেছে তো কী করবো? আমাদের কপাল কি আর নতুন করে পুড়েছে যে, আজ কাঁদতে বসবো?’
রুবিনা বেগম ভয়ে ভয়ে এদিক সেদিকে তাকাতে থাকেন।
গাঁয়ের মানুষের মন মানসিকতা, লোক লৌকিকতা অন্যরকম। সবকিছুতেই মাখো মাখো একটা ভাব না থাকলে কারো মন ভরে না।
তারা যে নিতান্ত দায়সারা ভাবে সবকিছু স্রেফ করার জন্যই করে যাচ্ছেন, এটা সবার নজরে আসতে বেশি সময় লাগবে না। তাহলে পরিস্থিতি কী হবে কে জানে!
এমনিতেই খুব বেশিদিন হয়নি তারা গাঁয়ে এসেছেন।
শহরের বেশ বাস রকম সকম এখনো গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। সৈকত এখনো হোস্টেলে থেকেই ভার্সিটিতে পড়ছে। আর রানুকে পড়াশুনার মাঝপথেই গাঁয়ে নিয়ে এসেছেন।
রানুর বাবা তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাকে তিনি আর পড়াতে পারবেন না। এই সাধ্য তার আর নেই। গাঁয়ে গিয়ে তাদের সাথেই রানুকে থাকতে হবে। বিয়ে শাদী ঠিক হলে বাদ বাকি দায়িত্ব তার স্বামীর। স্বামী চাইলে রানু পড়বে।
এজন্যই বুঝি বাপের ওপরে রাগটা রানুরই বেশি।
তবু শত হোক, এখন তো বেচারা চলেই গেছে! আর রাগ জেদ পুষে রেখে কী হবে? এই আস্ফালনই বা আর কাকে দেখানো!
দাফনের আয়োজন প্রায় শেষের পথে। বাদ আসর দাফন হবে।
রুবিনার বড় ভাসুর ঢাকা থেকে এখনো এসে পৌঁছতে পারেননি। তার জন্যই এত দেরি করা হচ্ছে। নইলে সকাল সকালই মাটি হয়ে যেত।
গতকাল রাত সোয়া বারোটার দিকে মারা গেছেন রুবিনার স্বামী। দাফন করতে এত দেরি করায় গাঁয়ের মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যেই একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে।
‘এই লাশ এত বেলা অব্দি ফ্যালা থুবিন? ক্যাঙ্কা করি হবে? লাশ পচি উঠবি না?’
তাদের অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করতে হয়েছে। শীতের দিন। ভালো করে চায়ের পাতা দিয়ে রেখে দিতে পারলে কিছুই হবে না। মাত্র তো আধাবেলার ব্যাপার!
গাঁয়ের লোক অনেকটা নিমরাজি হয়ে মেনে নিয়েছে।
গতকাল রাতের খাবার খেয়ে শোয়ার পর থেকেই কেমন যেন ছটফট করছিল মানুষটা। সাড়ে এগারোটার দিকে একবার শুধু বুকে হাত দিয়ে বলেছিল,
‘গ্রামের ডিস্পেন্সারি তো এত রাতে খোলা থাকবে না, তাই না?’
রুবিনা বেগম পাশ ফিরে ঘুমিয়েই পড়েছিলেন। গলার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। এমনিতেই খুব পাতলা ঘুম তার। খানিক বিরক্ত হয়েই বলেছিলেন,
‘কী হয়েছে, বুক ব্যথা করছে? এণ্টাসিড তো আছেই বাসায়। দিব?’
তিনি ভেবেছিলেন, অন্যদিনের মতো কাল রাতেও বুঝি তার গ্যাস্টিকের ব্যথাটাই উঠেছিল। খাওয়া দাওয়ায় একটু এদিক সেদিক হলেই ইদানীং ব্যথাটা ওঠে।
এন্টাসিড এনে দিয়েছিলেন তিনি। তার স্বামী খেয়েও নিয়েছিলেন কোন প্রতিবাদ না করে।
কিন্তু মুখের ভাবটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। একদম চুপচাপ হয়ে বসেছিলেন। করুণ একটা অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিল সমস্ত অবয়বে।
রুবিনা বেগম একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলেন। মেয়েকেও ডেকে তুলেছিলেন ঘুম থেকে। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে বিরক্ত মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল রানু। বাবাকে অসহায় মুখে বসে থাকতে দেখেও দয়ার্দ্র হয়ে ওঠেনি সে।
রুবিনা বেগম একটু বিস্মিতভরা চোখে তাকিয়ে ছিলেন। এমন নরম ভাব তো অনেকদিন দেখেননি তিনি সৈকতের বাবার মধ্যে! কী হলো আজ হঠাৎ?
খুব বেশি ভাবনা চিন্তা করার আর সুযোগ পাননি অবশ্য। বুকে হাত দিয়ে ছটফট করতে করতেই মানুষটা আচমকাই কেমন চিরবিদায় জানিয়ে ফেললো পৃথিবীকে।
মৃত্যুর আগের মূহুর্তে শুধু কী যেন বলার এক আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তিনি।
মুখটাকে হাঁ করে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলেন আর কিছু একটা শোনানোর আশায় ব্যাকুল চোখে রুবিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
সেটাকে অবশ্য খুব বেশি পাত্তা দেননি তারা। মৃত্যুর আগে মানুষ হয়ত বুঝতে পারে, তার সময় শেষ হয়ে এসেছে। তাই না বলা অনেক কথা একসাথে বলে ফেলতে ইচ্ছে করে সেই সময়।
একটি জীবনে জমে যাওয়া কত না বলা কথা!
আত্মীয় স্বজনদের ফোন করে রাতেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সৈকত রওয়ানা দিয়েছে রাতের বাসেই ।
সারারাত লাশ নিয়ে বসে ছিলেন মা-মেয়ে, স্তব্ধ বিমূঢ় হয়ে।
সারাজীবন এত শক্ত নিয়ম নীতি আর কার্পণ্যের জালে তাদেরকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখে মানুষটা এমন শান্ত নির্ঝঞ্ছাটভাবে বিদায় নিল! কেমন যেন বিশ্বাস হতে চায় না। এত সহজেই মুক্তি দিয়ে গেল তাদের!
যেন এটাই বলতে চেয়েছিল মৃত্যুর আগে,
‘আমি চললাম। এবার যত পারো হাত খুলে খরচ কর। মনের সাধ মিটিয়ে। আর বাধা দেওয়ার কেউ রইলো না।’
দুপুরের পরে পরে হঠাৎ লাশের কাছে একটা শোরগোল শোনা গেল।
সবাই অবাক হয়ে দেখতে পায়, পনেরো ষোল বছরের একটা কিশোর ছেলে উপুড় হয়ে লাশের গায়ে ঝুঁকে পড়ে আকুল হয়ে কেঁদে চলেছে। আশেপাশের হতচকিত লোকজন তাকে থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। কিছুতেই থামছে না ছেলেটার কান্না।
রুবিনা বেগম অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকলেন। আর সবার মতো তার মনেও প্রশ্ন খেলে গেল,
‘কে ছেলেটা? লাশটার কাছে গিয়ে এভাবে কাঁদছে কেন?’
দুই
রুবিনার স্বামী সিরাজুল ইসলাম সাহেব রেলওয়েতে টিটিই হিসেবে চাকরি করতেন। মাত্র দুই বছর আগেই চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন তিনি।
কঠিন নিয়ম শৃঙ্খলার মাঝে তিনি কাটিয়ে গেছেন তার সারাটা জীবন।
তার জীবদ্দশায় অনর্থক একটা টাকাও এদিক সেদিকে খরচ করার জো ছিল না। প্রতিটি পয়সার পাঁই পাঁই হিসাব তাকে কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়ে দিয়ে তবেই মুক্তি মিলতো সবার।
প্রথমদিকে এতটা বাড়াবাড়ি না করলেও, যত দিন গেছে তার কার্পণ্যের মাত্রা তত যেন আকাশ ছুঁয়েছে।
ছেলে মেয়েদের জন্য একটা জামা জুতা অথবা শখের একটা কোন জিনিস কোনদিন নিজের হাতে কিনে দিয়েছেন কী না সন্দেহ। ছেলেমেয়েরা নিজেরা কখনো সখনো কিনে আনলেও অজস্র বাক্যবাণে জর্জরিত করেছেন তাদেরকে। চোখ মুখের ভীষণ ভঙ্গিমা করে বলেছেন,
‘তোমাদের বাপ কি জাহাজের ব্যবসা করে নাকি যে, চাইলেই দুইজনে গিয়া যা খুশি তাই কিনে আনবা?
বেশি আজেবাজে খরচ করার ইচ্ছা থাকলে নিজেরা রোজগারপাতি শুরু কর। তারপরে শখ মিটিয়ে যত ইচ্ছা খরচ কর। খবরদার আমার টাকার অপব্যয় করবা না কেউ! আমি কিছুতেই এটা মানবো না... বলে দিলাম!’
রুবিনা বেগম ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করেছেন স্বামীকে।
‘ওদের বয়স কম। একটু আধটু তো সাধ আহ্লাদ করবেই!’
‘সাধ আহ্লাদ বেশি করতে ইচ্ছে করলে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাক। বাইরে গিয়া মনের সুখে আহ্লাদ করে বেড়াক! আমি দেখতেও যাবো না। এই বাসায় বসে ওসব চলবে না।’
‘তুমি ওদের বাবা না? তোমার কাছে চেয়েও তো পায় না কিছু। নিজেরা একটু কেনে মাঝে সাঝে, তাতেও এত কথা বল!’
তপ্ত কড়াইয়ে পানি পড়লে যেমন ছ্যাঁত শব্দে আঁতকে ওঠে, সিরাজ সাহেবও তেমন ছ্যাঁত করে ফুসে উঠেছেন।
‘দেখ রুবিনা, তোমাদের যদি না পোষায়... তাহলে তোমরা গিয়া অন্য কোথাও থাকো গা। তোমাদের সাধ আহ্লাদের এসব নিত্য নতুন জোগান আমি দিতে পারবো না।’
এই কথার ওপরে আর কথা চলে না। এমন শক্ত কথা তার স্বামী কথায় কথায় উচ্চারণ করতেন। দুটো টাকা এদিক ওদিক করলেই বলতেন,
‘তোমাদের চাহিদা দেখে ইচ্ছা হয়, ট্রেনের নীচে গিয়া ঝাঁপ দিই। মানুষ না, যেন কতগুলান হাতি পুষি আমি! এত খাই কেন তোমাদের?’
আরো সব কুৎসিত কথাবার্তা।
রানু কতদিন কলেজ থেকে কাঁদো কাঁদো মুখে বাড়ি ফিরেছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলেছে,
‘শুনে কী করবা? কিছু করতে পারবা যে শুনতে চাও?’
রুবিনা বেগম তবু গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছেন,
‘কী হয়েছে মা, আমাকে বল। মাকে বললে মন হাল্কা হয়।’
‘হুম, হাল্কা হয়! কিছু তো করতে পারবা না, হাল্কাই কর খালি!
জানো, কলেজের ছেলেমেয়েরা আমার জামা কাপড় নিয়ে হাসাহাসি করে। বলে, আমি নাকি প্রতিদিন গোসল করি না। সেজন্য একই জামা রোজ রোজ পরে কলেজে যাই। আমার জামা দিয়ে নাকি ঘামের গন্ধ বেরোয়!’
বলতে বলতে চোখের পানিতে আকুল হয়েছে রানু। অসহায়ের মতো তাকিয়ে থেকেছেন রুবিনা বেগম। সত্যিই তো! কিছুই করার সাধ্যি নেই তার।
সৈকতের ক্রিকেট খেলার নেশা ছিল। ছোট শহরের ক্লাব মাঠে কয়েকমাস পর পরই ম্যাচ থাকতো ওদের। সৈকত ছিল ওদের দলের প্রধান ব্যাটসম্যান। ওর ব্যাটিং এর হাত নাকি দূর্দান্ত।
একজোড়া প্যাড আর গ্লাভস কিনে দেওয়ার জন্য বেচারা কতবার যে করুণ মুখে গিয়ে দাঁড়িয়েছে বাবার সামনে! সেই করুণ মুখ দেখেও একটুও কাতর হয়নি সিরাজ সাহেবের মন। অজস্র টিটকারি মেশানো শ্লেষ মিশিয়ে ছেলেকে বলেছেন,
‘ঠিকমত খেতে পরতে দিতে পারলেই বলে বর্তে যাই! আবার ক্রিকেট! এরেই বলে গরীবের ঘোড়া রোগ! ওসব ক্রিকেট ফ্রিকেট খেলার জিনিসপাতি কিনে দেওয়ার ক্ষমতা আমার বাপেরও নাই। খেলতে মন চায় ওসব ছাড়াই খেলবা, বুঝছো?’
আত্মাভিমানী সৈকত সেদিনের পরে থেকে আর কিছু চাওয়ার জন্যই বাবার সামনে দাঁড়ায়নি।
ক্লাবের ছেলেপুলেরা চাঁদা তুলে ওর জন্য গ্লাভস প্যাড কিনে দিয়েছে।
নিতে চায়নি সৈকত। খেলাই ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। তাইতো! যার বাপের এসব কিনে দেওয়ার সাধ্য নাই, তার এমন শখ থাকা কীসের জন্য?
সবাই জোর করে নিতে বাধ্য করেছে তাকে। সৈকত না খেললে ওদের দলের বিরাট ক্ষতি। সেটা কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না।
ভার্সিটিতে চান্স পাবার পরে আর কোন ব্যাপারেই বাবার মুখাপেক্ষী থাকেনি সৈকত। কয়েকটা টিউশনী জুটিয়ে নিজের খরচ সে নিজেই চালিয়ে নিয়ে আসছে।
ছেলেমেয়েদের সামান্য কিছু আবদারকে এমন ভয়ানক পরিনতির মুখে পড়তে দেখে রুবিনা বেগম তার সব শখ আহ্লাদের গলা চেপে ধরেছেন। জীবনের আর কয়টা দিনই বা বাকি আছে! সাধের মুখে কুলুপ এঁটে দিব্যি পার করে দিতে পারবেন।
রুবিনা বেগম কিছুতেই ভেবে পেতেন না, কী এমন বেশি খরচ করে তার ছেলেমেয়েরা!
ছোটবেলা থেকেই কৃচ্ছতা মেনে চলতে চলতে দুজনের কেউই সহজে মুখ ফুটে কিছু চাইতো না কখনো। নিতান্তই প্রয়োজন না পড়লে জামা জুতা থেকে শুরু করে স্কুল কলেজের প্রয়োজনীয় কোনকিছুও কখনো চাইতো না তারা।
গ্রামে তাদের নিজেদের কিছু জমি জিরাত ছিল। পৈতৃক সুত্রে পেয়েছিলেন। সেখান থেকে বছরের চালডালের জোগানটা ভালো ভাবেই হয়ে যেত। আলাদা করে চাল ডাল কিনতে হতো না কখনো।
তারা থাকতেন ছোট মফঃস্বল শহরে। জীবনযাত্রার ব্যয় একেবারে হাতের নাগালে ছিল না সেকথা ঠিক। তবে স্বচ্ছল্ভাবে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার মতো সংস্থানটুকু তাদের ভালমতই ছিল।
অথচ সবকিছুতেই কার্পণ্য করে চলতে চলতে মনের দিক দিয়েও একেবারে কুঁজো হয়ে বেঁচে ছিলেন তারা সবাই। যাদের সাথে বাস করতেন, ওঠাবসা করতেন... তাদের জীবনযাত্রার অনেক নীচে ছিল রুবিনা বেগমদের অবস্থান।
এই দৈন্য কতটা বাস্তবের, আর কতটা মনগড়া... বুঝে উঠতে পারতেন না কিছুতেই।
রুক্ষ্ণতা আর দৈন্যের সাথে বাস করতে করতে ছেলেমেয়েরা চিরতরে বাবার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। রুবিনা বেগম নিজেও একসময় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, হয়ত তাদের ভাগের অংশটুকুতে একাই ভোগ দখল করে চলেছেন সিরাজুল ইসলাম।
কতরকম আজেবাজে নেশা থাকে পুরুষ মানুষের! কে জানে, তেমন কিছু নেশার খোরাক জুটে গেছে নাকি জীবনে! হয়ত সে কারণেই এই কৃচ্ছতার মুখোশ।
সবকিছু তবুও দাঁতে দাঁত চেপে মেনে নিয়েছিলেন একরকম। অবসর গ্রহণের পরে গ্রামে এসে থাকার সিদ্ধান্তেও না করেননি। ভোগবিলাসের আশায় তো আর শহরে পড়ে ছিলেন না!
কিন্তু থার্ড ইয়ারে থাকা রানুর পড়া যখন হুট করে বন্ধ করে দিলেন, তখন কিছুতেই মানতে পারেননি রুবিনা বেগম। স্বামীকে শক্ত মুখে কিছু বলে আটকাবেন, এত জোর তার ছিল না কোনদিন। চোখের পানিতে ভেসেই কাতর অনুনয় করেছিলেন,
‘মেয়েটার পড়া এভাবে মাঝপথে থামিয়ে দিও না। গ্রামে তো যাবোই, দুইটা বছর পরে গ্রামে যাই। আর নইলে মেয়েটাকেও হোস্টেলে রাখার ব্যবস্থা কর। মেয়েদের পড়া একবার থেমে গেলে ভবিষ্যতে আর হওয়া কঠিন।’
গলেনি পাথরের মন। ইস্পাত কঠিন গলায় সিরাজ সাহেব বলেছেন,
‘মেয়ের রোজগার খাওয়ার কোন শখ নাই আমার যে, মেয়েকে পড়ায়ে জজ ব্যারিষ্টার বানাতে হবে! যতদূর পড়েছে, অনেক পড়েছে। আর পড়ে কাজ নাই!’
খবরটা শুনে অবিশ্বাসীর চোখে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে ছিল রানু। তবে প্রতিবাদ করেনি কোন। জানতো সে, করলেও সব আবেদনই নিষ্ফল হবে।
কিন্তু সেদিনের পরে থেকে ‘বাবা’ নামের মানুষটার সাথে অন্তরের সব লেনাদেনাই একরকম চুকিয়ে ফেলেছে সে।
তিন
ছেলেটার বুকফাটা কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। কেউ থামাতে পারছে না তাকে।
সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বুকের ভেতরে কেমন যেন খোঁচা খেলেন রুবিনা বেগম। মনের মধ্যে কীসের যেন ‘কু’ডাক শুনতে পেলেন।
কে এই ছেলে? সিরাজুল ইসলাম কি ভেতরে ভেতরে আরেকটা সংসার...!
যদি তেমন কিছু হয়ে থাকে, তাহলে এই মৃত মানুষের দাফন কাফনের সব ব্যবস্থা বন্ধ করে তিনি চলে যাবেন এখান থেকে। কঠিন মনে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললেন রুবিনা বেগম।
অনেক কটুক্তি, নীচুতা আর শ্লেষ সয়ে বেঁচেছেন তারা। কিন্তু কোন প্রতারণাকে কিছুতেই সহ্য করবেন না।
এই দ্বিতীয় সংসারে টাকা ঢালতে গিয়েই তাহলে হাড়ি উপুড় হয়ে যেত!
কান্নার শব্দে ঘর থেকে রানুও এসে দাঁড়িয়েছে মায়ের পাশে। তার মুখে চোখেও জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা। রুবিনা বেগম বুঝতে পারলেন, শুধু তিনি নন। রানুর মনের মধ্যেও একই ঝড় বইছে।
হাত ইশারায় ছেলে সৈকতকে ডাকলেন রুবিনা বেগম। সৈকত শুকনো মুখে কাছে এসে দাঁড়াতে বললেন,
‘ছেলেটাকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে আয়।’
সৈকতের সাথে ধীর পায়ে রুবিনা বেগমের কাছে এসে দাঁড়ালো ছেলেটি। নত মুখে সালাম করলো।
রুবিনা বেগম দেখলেন, ছেলেটির পরনে পাজামা পাঞ্জাবী। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলে গেছে একেবারে। মুখটা ভারী শুকনো। দেখে মনে হয়, যেন সকাল থেকে খাওয়া হয়ে ওঠেনি।
কিন্তু সেই মুখ কোন ছায়াপাত করলো না রুবিনার মনে। রুক্ষ্ণ সুরে তিনি বললেন,
‘কোথা থেকে এসেছো তুমি? সাথে কে এসেছে?’
একজন চল্লিশ বিয়াল্লিশ বছরের মাওলানা গোছের ভদ্রলোক পেছনেই দাঁড়িয়েছিলেন। ছেলেটা কিছু বলার আগেই তিনি সসম্ভ্রমে সালাম দিয়ে নীচু মুখে বললেন,
‘ও আমার সাথেই আসছে খালাম্মা। আমাদের মাদ্রাসার ছেলে।’
‘মাদ্রাসার ছেলে? এখানে কেন এসেছে? আমার স্বামীকে কি ও চিনতো? এভাবে কাঁদছে কেন?’
‘খালুজানরে না চিনলে ও আর কারে চিনবো গো খালাম্মা? এই দুনিয়ায় ওর আর কে ছিল? ও যে বিশ্ব এতিম!’
চমকে উঠলেন রুবিনা বেগম। ছেলেটা এতিম! এই এতিম ছেলের সাথে সিরাজুল ইসলামের কী সম্পর্ক?
প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে হলো না। মুখ তুলে একবার রুবিনা বেগমের দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা বুঝে ফেললেন সেই ভদ্রলোক। বললেন,
‘ট্রেন এক্সিডেণ্টে ওর বাবা-মা মারা গিয়েছিল। আজ থেকে বারো তের বছর আগে। এই ছেলের বয়স তখন তিন চার বছর। একেবারে দুধের শিশু। বাবা-মা’র লাশের পাশে বসে কাঁদছিল।
স্টেশন থেকে একটু দূরেই লাইনচ্যূত হয়ে কয়েকটা বগি পড়ে গেছিলো। সেদিন ট্রেন এক্সিডেন্টে অনেক লোকের মৃত্যু হয়েছিল। কারো কারো লাশ চেনারও উপায় ছিল না। আত্মীয় স্বজনের কাছে সবার লাশ ফিরায়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না।
খালুজান স্টেশনেই ছিলেন। সেই স্টেশন থেকেই তার ঐ ট্রেনে ওঠার কথা ছিল।
বাচ্চাটারে কাঁদতে দেখে খালুজান কোলে উঠায়ে নেন। বাচ্চাটার আত্মীয় স্বজনের খোঁজ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাও খালুজান পুলিশের কাছে বাচ্চাটারে দেননি। নিজে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন স্টেশনে।
সেদিন বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন বাচ্চাটার কোন আত্মীয় স্বজনের খোঁজ জোগাড় করতে পারলেন না, তখন বাধ্য হয়ে আমাদের এতিম খানায় নিয়ে আসেন বাচ্চাটারে।
আমরা এতিম বাচ্চাদের জন্য একটা ছোটখাট মাদ্রাসা চালাই। আর তাদের দেখাশোনাও করি। কোমল মনের মানুষজন অল্প যেটুকু সাহায্য সহযোগিতা করেন, তাতেই আল্লাহর রহমে কোনরকমে বাচ্চাগুলো খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারে।
খালুজান আগে যেখানে চাকরি করতেন, আমাদের এতিমখানাটা সেই জায়গাতেই।
এত ছোট বাচ্চা দেখে আমরা এরে রাখতে চাইনি। ভাবছিলাম...কে দেখবে এই বাচ্চাকে? খালুজান জোর করে অনেক অনুরোধ করে বাচ্চাটারে আমাদের কাছে দিয়ে যান। বাচ্চাটার খাওয়া দাওয়া বাবদ কয়েক হাজার টাকাও দিয়ে যান আমাদের।
এরপর থেকে প্রায় প্রতি সপ্তাহে খালুজান এসে বাচ্চাটার খোঁজ খবর নিতেন। টাকা পয়সা যখন যা লাগে দিতেন।
আপনারা গ্রামে চলে আসার পরেও উনি টেলিফোনে খোঁজ রাখতেন। মাসে একবার গিয়া দেখে আসতেন।
বাচ্চাটাকে অনেক আদর করতেন খালুজান। আমার কাছে কতদিন বলেছেন,
‘‘বুঝলে মিয়া, আমি নিজেও এমনই এক অভাগা ছিলাম। আমার বাপ মাও জন্মের পরে বাস দূর্ঘটনায় মারা গেছিলো।
আমার তবু এক বড় ভাই ছিল। এই হতভাগার তো কেউ নাই দুনিয়ায়। এ তো জন্মের এতিম! এরে দুইটা আদর দেওয়ারও তো কেউ থাকলো না!’’
খালাম্মা, আমরা তো এতিমখানাতেই পড়ে থাকি দিনরাত। এতিম পোলাপান দেখতে দেখতে চোখ সয়ে গেছে আমাদের। এই ছেলে তো আর তাদের থেকে আলাদা কিছু ছিল না আমাদের কাছে।
কিন্তু খালুজান এরে খুব মায়া করতেন।
এর জন্য খেলনা কিনে আনতেন। কিছু খেতে ইচ্ছা করে নাকি জিজ্ঞেস করতেন। এতিমখানার অন্য বাচ্চাদের দেখেও খুব কষ্ট পাইতেন খালুজান। কিন্তু সবার জন্য তো আর একজনের করার সাধ্যি থাকে না! দেখে দেখে তাই শুধু দীর্ঘশ্বাসই ফেলতেন। খালাম্মা, অনেক বড় মন ছিল খালুজানের। আল্লাহ যেন তারে জান্নাতবাসি করেন। এই এতিমের চোখের পানি মিথ্যা হইতে পারে না!’
ছেলেটা কেঁদেই চলেছে হু হু করে ।
বিমূঢ় হয়ে কথাগুলো শুনতে শুনতে কখন যে চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি গড়াতে শুরু করেছে, বুঝতে পারেননি রুবিনা।
পাশ থেকে কান্নার আওয়াজ শুনে মুখ ফিরিয়ে দেখতে পেলেন, ওড়নায় মুখ লুকিয়ে অঝোরে কাঁদছে রানু।
হঠাৎ ভারী এক অভিমান হয় রুবিনা বেগমের। এতই কি পর ছিলেন তিনি? কিছুই কি বলা যেত না তাকে?
কিন্তু পরমূহুর্তেই মনে হলো, তিনিই কি কখনো স্বামীর পাশে বসে জিজ্ঞেস করেছেন,
‘আজ তোমার শরীরটা কেমন? চুপ করে আছো কেন? মন খারাপ? কী হয়েছে?’
যখনই মুখ খুলেছেন, কিছু না কিছু অভাব আর চাহিদার কথাই তো শুধু শুনিয়েছেন। স্বামীর মনের খবর নেওয়ার কি তারই কোনদিন সময় হয়েছে?
তার স্বামী হয়ত মানুষ হিসেবে পূর্ণ ছিলেন না। অনেক অপূর্ণতা ছিল তার। তাই তার আসল করণীয় কাজটুকুতে তিনি অনেক ভুলত্রুটি করে গিয়েছেন।
কিন্তু অনেক দোষে মেশানো মানুষটার মাঝেও কোমলতার একটা আধার ছিল।
কুড়িয়ে পাওয়া দায়িত্বটাকে তাই তিনি অস্বীকার করতে পারেননি। সেখানে তিনি তার আপোষহীন মমতা দেখিয়ে গেছেন।
হয়ত সঙ্কোচে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি অন্যদের কাছে। হয়ত ভেবেছেন, যদি তারা কেউ এটাকে মেনে না নেন! তাহলে এই অনাথ বাচ্চাটার কী হবে?
রুবিনা বেগমের মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, হঠাৎ কখনো তার স্বামী কী যেন বলতে গিয়েও চেপে যেতেন শেষ মূহুর্তে। দিনরাত ব্যগ্র হয়ে টাকা পয়সার হিসাব করতেন। সেই সময় গুলোতে চুপ করে কী যেন ভাবতেন। মুখ ফুটে বলতেন না কখনো।
তাই দেখে তিনি মনে মনে বিষোদগার করতেন,
‘যখের ধন আগলায়ে রাখছে। মরার পরে কবরে নিয়ে বসে থাকবে!’
ভারাক্রান্ত হওয়ার কথা, তবু কেন যেন রুবিনা বেগমের খুব হাল্কা লাগছে নিজেকে। চোখ ফেটে অঝোরে নেমে আসছে অশ্রুধারা।
তিনি রুখছেন না। নামুক...আজ প্লাবন হোক। সেই প্লাবনে তিনি গলা অব্দি ডুবিয়ে বসে থাকবেন।
হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন ছেলেটিকে। সস্নেহে জানতে চাইলেন,
‘কী বলে ডাকতা উনারে?’
ছেলেটি অশ্রুসজল কণ্ঠে বললো,
‘বাবা!’
রুবিনা বেগম আপ্লুত হয়ে বলেন,
‘আমাকে মা বলে ডেকো। আমি তোমাকে দেখতে যাবো, তোমার বাবা যেমন যেত...আমিও যাবো। কিছু খাবে বাবা?’
আসর নামাজের ওয়াক্ত শেষে চিরবিদায় দেওয়ার সময়ও এসে গেল।
কিছু মুরুব্বী রুবিনা বেগমকে লাশের কাছে যেতে নিষেধ করলেন। কেউ কেউ বললেন, দূর থেকে এক ঝলক দেখা যেতে পারে।
রুবিনা বেগম দূর থেকেই দেখলেন।
নীরব নিথর একটা মুখ। সব অনুযোগ অভিযোগের উর্ধে চলে যাওয়া তার সারা জীবনের সঙ্গী।
একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এলো অনেক গভীর থেকে।
পাথরের শক্ত খোলসটাকে দেখে কখনো কাছে গিয়ে দু’দণ্ড বসতে চাননি। কতদিন কায়মনোবাক্যে কামনা করেছেন, সেই পাথরের বুক চিরে ঝর্ণাধারা নেমে আসুক। স্নাত হবেন সেই শীতল ধারায়।
আজ দেখেছেন সেই ঝর্ণাকে প্রবাহিত হতে। শীতল স্পর্শে দূর থেকেই জুড়িয়েছেন তপ্ত শরীর।
দুঃখ রয়ে গেল, কাছে গিয়ে অবগাহন করা হলো না সেই ঝর্ণাধারায়!