এক
খুব ভোরে বেরিয়ে পড়লো শাওন। অনেকটা দূর যেতে হবে। ঢাকা থেকে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের একটা গ্রাম, কুসুমপুরে। রাস্তার জ্যামের অবস্থা কেমন কে জানে! ঝোলাটা কাঁধে নিতেই মনে পড়লো, ইমন আজ আসতে পারবে না। বাসার পেয়ারা গাছ থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে বসে আছে। এই বয়সে পেয়ারা গাছে উঠে পেয়ারা খাওয়ার কী সাধ জাগলো মনে কে জানে! হাতের কাছে কি লাঠি টাঠি কিছু ছিল না?
ইমন ওর ক্যামেরাম্যান। ক্যামেরাম্যান না থাকলে রিপোর্টিং ঠিক অচল নয়, তবে খানিকটা খোঁড়া তো বটেই! কিন্তু বিকেল বেলা কোঁকাতে কোঁকাতে ফোন দিলো ইমন। অগত্যা একাই বের হওয়া। বসে থাকার সময় নেই মোটেও। একটি ডকুমেন্টারি রিপোর্টিংএ হাত দিয়েছে। চ্যানেল সেভেনে সাত দিনের ধারাবাহিক রিপোর্টিং হিসেবে যাবে এটা।
চাকরীতে শাওন একেবারে নতুন নয়। ঢাকা ভার্সিটিতে যখন সে অনার্স সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ে মাত্র, ওদের ডিপার্টমেন্টেরই এক বড় ভাই ওকে অফারটা দেন। চ্যানেল সেভেন তখন সবেমাত্র হাঁটি হাঁটি পা পা করে যাত্রা শুরু করেছে। সেই ভাইয়াও ছিলেন এখানকার এক রিপোর্টার। সাংবাদিকতা বিভাগে পড়তে এসে এতো তাড়াতাড়িই এরকম একটা অফার পেয়ে যাওয়া অনেকটা আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ারই সামিল ছিল ওর কাছে। ভেবেছিলো, কিছুদিন কাজ করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নেবে। তারপর এখানে থাকা না থাকা পরের ব্যাপার। কিন্তু কাজ করতে এসে এখানেই একরকম বসতি গেঁড়ে ফেলেছে সে। জড়িয়ে গেছে মায়ার বন্ধনে। এখানকার কাজের পরিবেশ, বসদের বন্ধুত্তসুলভ উদার আচরণ, সহকর্মীদের ঈর্ষাহীন মমতাভরা সাহচর্য...এসব ওকে একেবারে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে। গতবছরেই সে মাস্টার্স শেষ করেছে। কিন্তু এখনো এখান থেকে পাততাড়ি গোটানোর কোনো লক্ষণ ওর মধ্যে নেই। সিনিয়রদের কাছেও ওর অন্যরকম একটা চাহিদা আছে। শাওনের মানবিক দিকটি ভীষণ উজ্জ্বল। অন্য অনেকেই একটা ঘটনা থেকে স্রেফ সংবাদ টুকু বের করে আনে। কিন্তু শাওন একটা ঘটনা থেকে ভেতরের গল্পটাকে তুলে নিয়ে আসে। তাই ওর রিপোর্টিংগুলো একেবারেই অন্যরকম হয়। শাওনের প্রতিটি অনুষ্ঠানের টিআরপি সবসময়ই অনেক বেশি থাকে।
গতমাসের শুরুতেই ওর বস সেজান ভাই ওকে এই এসাইনমেন্টটা দেন। এসাইনমেন্টটা পেয়ে তেমন খুশি ছিল না সে। একেবারে সাদামাটা খবর মনে হয়েছে। এটা নিয়ে ডকুমেন্টারি! করা যাবে; যাবে না তা নয়। কিন্তু পাবলিক কী আর সব কিছু খায়! ব্যাতিক্রমী কিছু দেখাতে না পারলে লোকে মারতে আসে।
কিন্তু সেজান ভাই ওকে এসাইনমেন্টটার ব্যাপারে বেশ খানিকটা ইঙ্গিত দেন।
‘হতাশ হয়ো না। একটু ঘেঁটেঘুঁটে দেখো...পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন!’
শাওন ঠিক হতাশ হয়নি। তবে অমূল্য রতন পেয়ে যাবে এমনটাও আশা করেনি।
আজকে নিয়ে প্রায় দশদিন যাবত সে কুসুমপুর গ্রামের এই বাড়িতে চক্কর কাটছে। সুবিধাজনক কোন কিছুর সাথে এখনো সাক্ষাৎ ঘটেনি। শাওনের টার্গেট একজন বৃদ্ধ, বয়স কম করে হলেও আশি বছর। মুখের রেখাগুলো গুনতে বসলে প্রায় দিন পেরিয়ে যাবে। ঢলঢলে ঝুলে পড়া চামড়ার মাঝে জরাজীর্ণ ভগ্নপ্রায় একটা শরীর। প্রথমদিন লোকটিকে দেখে শাওন কী করবে ভেবে পাচ্ছিলো না। সেজান ভাইএর মাথাটাথা ঠিক আছে তো! এই বুড়োর কাছে তিনি কী মনে করে পাঠালেন? তাও আবার অমূল্য রতন পাবার আশায়।
কিন্তু সাংবাদিকতা পেশায় ‘হতাশা’ শব্দটির কোনো স্থান নেই। শাওন তাই প্রথমদিন থেকেই বিপুল উৎসাহে কাজে নেমে পড়ে। একজন অতিশয় বৃদ্ধ মানুষের কাছে মাইক ক্যামেরা ঝুলিয়ে স্টাইল মেরে দুটো প্রশ্ন করলেই আর দেখতে হবে না। গড়গড়িয়ে পেটের কথা বের করে দেবে। এই আত্মবিশ্বাসের জোরেই শাওন শুরু হয়ে যায়। আর তখনই সে বুঝতে পারে ওর হিসাবে কতোটা গড়মিল। অবাক হয়ে দেখে, কুঁচকে পড়া চামড়ার মাঝে কী ব্যাপক ঋজুতা! ঘোলাটে হয়ে আসা চোখের তারায় কী আশ্চর্য অন্তর্দৃষ্টি! একটা দুটো প্রশ্ন শুনেই শাওনের উদ্দেশ্য বুঝতে বাকী থাকে না বৃদ্ধের। হাত জোড় করে ঠাণ্ডাসুরে নিজের অনাগ্রহের কথা জানিয়ে দেয়। শাওন খুবই অবাক হয়। কী এমন গল্প থাকতে পারে এই বৃদ্ধের, যেটাতে সেজান ভাইএর মতো কাজের মানুষ পর্যন্ত আকৃষ্ট হন! আর সেই গল্প বলাতে এই বৃদ্ধেরই বা কীসের এত অনীহা!
সেজান ভাই ওর কাছে ছোট্ট একটা ঘটনা উল্লেখ করেছেন মাত্র। এই বৃদ্ধ ভদ্রলোক প্রত্যন্ত এক গ্রামে সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে এবং ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিন যাবত একটি স্কুল চালান। স্কুলটিতে প্রায় দুইশোর মতো ছাত্রছাত্রী। বলাইবাহুল্য প্রত্যেকেই সুবিধাবঞ্চিত। সারা দেশে খুঁজে পেতে এরকম আরো অনেক স্কুলের সন্ধানই পাওয়া যাবে। তাই শাওন সেজান ভাইকে বেমক্কা প্রশ্নটা করেই বসলো,
‘নিজের ব্যবস্থাপনায় স্কুল চালান এরকম মানুষ তো খুব বেশি বিরল হওয়ার কথা নয়। আমাদের সমাজে এখনো এমন অনেক ভালোমানুষই আছেন যারা নিঃসার্থভাবে এসব কাজে হরহামেশাই এগিয়ে আসছেন। শুধুমাত্র এই একটা নিউজকে কেন আমরা এতোটা প্রাধান্য দিতে যাচ্ছি?’
সেজান ভাই ধীরস্থিরভাবে বেশ খানিকক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে জবাব দেন,
‘গুরুত্ব দেবার মতো কিছু মনে না হলে দিও না। ডেইলি নিউজে ছোট করে কাভার করো। কিন্তু জানি না কেন, আমার মনে হয় ভদ্রলোকের এই কমিটমেন্টের জায়গাটা খুব হালকা না। বেশ অনেকদিন যাবত এই পেশায় আছি। গন্ধ শুঁকে অনেক কিছুই এখন বুঝতে পারি। ভদ্রলোকের সাথে আমার ঘটনাচক্রে একদিন দেখা হয়েছিল, কিছুটা কথাও হয়েছিলো। আমার খুব তীব্রভাবেই মনে হচ্ছে এখানে কিছু একটা আছে। তুমি একটা ধারাবাহিক ডকুমেণ্টারীতে হাত দিতে চাচ্ছিলে না? দেখোই না গিয়ে!’
অতএব সেজান ভাইএর সেই গন্ধের উৎস খুঁজতেই এখানে আসা। কিন্তু ভদ্রলোক যেনো ধনুকভাঙ্গা পণ করেছেন যে কিছুতেই মুখ খুলবেন না। একটা স্কুল সম্পর্কে বলার জন্য এতো কেন সাধতে হবে কে জানে! কিন্তু শাওনও নাছোড়বান্দা। বুড়োর মুখ সে খুলিয়েই ছাড়বে।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক দরজা খুলে শাওনকে দেখেই মুখ অন্ধকার করলেন।
‘তুমি আবার এসেছো? আচ্ছা, আমার এই স্কুলের পিছনে কেন লাগলে বলো তো! নিজের উদ্যোগে স্কুল চালানো কি অন্যায়?’
‘না, চাচা। অন্যায় হতে যাবে কেন? আমি শুধু আপনার এই মহৎ উদ্যোগের ব্যাপারে সবাইকে জানাতে চাই। আরো দশজন মানুষ যেনো আপনার মত করে এগিয়ে আসে। সামান্য সাংবাদিক আমরা; আমাদের আর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলুন! চাচা, আপনি কেন বলতে চাচ্ছেন না, বলুন তো?’ শাওন মুখে দশকেজি মধু ভরে জবাব দেয়।
শাওনের মুখের মধুর গুণেই হোক, কিংবা এতোদিনের চেষ্টার সার্থকতা হিসেবেই হোক বৃদ্ধ হেসে ফেললেন।
ভেতরে ডাকলেন শাওনকে। এদিক ওদিক চেয়ে বললেন,
‘তোমার সেই ক্যামেরাম্যান কই? আজকে একা এসেছো যে!
ভদ্রলোক সহজ হতে শুরু করলেন...। শাওন তার অনুমতি নিয়েই টেপরেকর্ডার অন করলো।
দুই
‘চাচা, প্রথম থেকে বলেন। এই স্কুল চালানোর ব্যাপারে অনুপ্রেরণা পেলেন কোথা থেকে?’
‘আরে আগে আমার স্কুলটাতো দেখো! এমন কিছু আহামরি জিনিস নয় মোটেও। কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষিকা আছেন, যাদের বেতনটাও ঠিকমতো দিতে পারি না।’
ভদ্রলোক বাড়ির ভেতর দিয়েই শাওনকে নিয়ে আসলেন। বাড়ির অবস্থাও এই বৃদ্ধের মতো একেবারেই ভগ্নপ্রায়। ছোটো ছোটো তিনটা কক্ষ। তাদের একটাতেই আবার রান্না এবং খাওয়ার ব্যবস্থা। আলাদা কোনো রান্নাঘর চোখে পড়লো না। একটি কক্ষে বিছানাতে এখনো মশারী ঝুলছে। মশারীর রঙ এবং দেয়ালের পলেস্তরা সবকিছুর মাঝেই ঘুনে ধরা বার্ধক্যের প্রকট রূপ ফুটে উঠেছে। ঘরে কোনো দ্বিতীয় ব্যাক্তির দেখা মিললো না। বাড়ির পেছন দিকের একটা দরজা দিয়ে বের হয়ে ওরা একটা খোলা জায়গায় প্রবেশ করলো। উঠানের মতো বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে স্কুলটির অবস্থান। উপরে টিনের শেড। বসার জন্য বেঞ্চের ব্যবস্থাও আছে। শিশুদের হট্টগোল আর পাঠগ্রহণের মাঝে মুখরিত পরিবেশ। ছাত্রছাত্রীরা চারটা আলাদা দলে বিভক্ত হয়ে বসেছে। তাতে বোঝা যাচ্ছে প্রতিটি দল একেকটি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি। প্রতিটি শ্রেণিতেই একজন করে শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান করছেন। দুইশো জন না হলেও ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। এতো জন ছাত্রছাত্রীর পড়ানোর আয়োজন করাও চাট্টিখানি কথা না। শাওন শিক্ষকদের সাথে কথা বলতে চাইলো। ভদ্রলোক বোধহয় তার মনের কথা বুঝতে পেরেই ওকে ঘরের ভেতর নিয়ে এলো। শাওনের বেশ খানিকটা বিস্ময় জাগলো। ভদ্রলোকের ভাবসাব কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বাসায় নিয়ে এসে শাওনকে একটা চেয়ারে বসতে দিলেন। নিজে পা তুলে আরাম করে বিছানায় বসলেন। তারপর শাওনের দিকে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘কেমন দেখলে আমার স্কুল?’
‘ভালোই তো! কিন্তু...।’ মনের মধ্যে যে প্রশ্নটা উশখুশ করছে, সেটা জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে কিনা ভাবতে লাগলো। বৃদ্ধের শারীরিক এবং আর্থিক এমন ভঙ্গুর দশায় কীভাবে তিনি এই বিপুল আয়োজন করে চলেছেন এটা শাওনের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো।
‘কিন্তু আপনার মানে...আপনার একার পক্ষে তো এতোটা ব্যবস্থা করা খুবই কঠিন! কবে থেকে এই স্কুল চালাচ্ছেন আপনি? এই বাচ্চারা কোথা থেকে আসে?’
বৃদ্ধ খানিকটা আনমনা হলেন। বেশ বড় করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। মনে হলো যেন ভেতর থেকে শক্তি সঞ্চয় করে নিলেন।
‘ভেবেছিলাম, এই গল্প কারো কাছে কোনোদিন বলবো না। অথচ দেখো, ভাগ্যের কী পরিহাস! একজন সাংবাদিকের কাছেই এই গল্প বলতে রাজী হয়ে গেলাম! তুমি এই গল্প নিয়ে যা করতে চাইছো, এর পরে হয়তো আরো অনেকেই আসবে। কে জানে, এবার হয়তো সময় হয়েছে এই গল্পকে আলোর মুখ দেখানোর।’ এটুকু বলে বৃদ্ধ একটু দম নিলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন,
‘এখানে যেসব বাচ্চারা পড়তে আসে তারা সবাই যুদ্ধশিশুদের সন্তান। একসময় এদের বাবা-মায়েরা এই স্কুলে পড়েছে। কোনো ভালো স্কুলে পড়ার সামর্থ্য তো দূরের কথা, সমাজে তখন তাদের কোনো অবস্থানই ছিলো না। ভাগ্যবিড়ম্বিত জারজ সন্তান, শিক্ষার সাথে যাদের কোনোরকম যোগাযোগ ঘটারই সম্ভাবনা ছিল না। আমার এই স্কুলটার বয়স প্রায় চল্লিশ বছর। তখন এখানে যারা পড়েছে, তাদের কেউ কেউ আজ সমাজে স্বীকৃতি পেয়েছে। নিজেদের সন্তানদের অপেক্ষাকৃত ভালো স্কুলে দেওয়ার সামর্থ্য তাদের ভালোভাবেই হয়েছে। কিন্তু হয়তো মায়ার টানেই তারা এই স্কুলটাকে মনে রেখেছে। নিজেদের বাচ্চাদের এখানে ভর্তি করিয়েছে।’
শাওন হাঁ হয়ে গেলো শুনে। মনে মনে সেজান ভাইএর অভিজ্ঞতার তারিফ না করে পারলো না। তিনি কীভাবে বুঝতে পারলেন যে, এই স্কুলের পেছনে এমন গল্প আছে! বৃদ্ধ বলতে লাগলেন,
‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন সারাদেশে হত্যা আর লুণ্ঠনের মাতম চলছে, তখনো আমাদের এই কুসুমপুর গ্রামটা ছিলো শত্রুমুক্ত। আমরা প্রতিদিন সকালবেলায় নজরুল হুদা স্যারের কাছে যুদ্ধের খবর শুনতাম। নজরুল স্যার ছিলেন কুসুমপুর প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার। আমাদের এই কুসুমপুর গ্রামের এক রাজাকার ভেতরে ভেতরে মিলিটারীদের সাথে যোগাযোগ রাখতো। এই গ্রাম এবং আশেপাশের কোনো গ্রামের কেউ মুক্তি হলে খবর পাচার করতো। এই খবর পাচারের বিনিময়ে সে কুসুমপুর গ্রামকে মিলিটারী আসার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলো। গ্রামের কেউ তাকে চিনতে পারেনি। মিলিটারীরা তাকে শহরের ক্যাম্পে কিছু মেয়ে পাচার করতে বলে। এই কাজে সে হাত দিতে চায়নি। তাই অনেকদিন ধরেই গাঁইগুঁই করছিলো। কিন্তু মিলিটারীর খায়েশ বলে কথা! একসময়ে তারা বেশ কড়াভাবে মেয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। অগত্যা গ্রামের কিছু বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা মেয়েকে সে বাছাই করে। যেদিন তাদের পাচার করার দিন ঠিক করে, তার আগেরদিন হঠাৎ করেই সে মিলিটারীদের গ্রামে আসার খবর পায়। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না! হয়তো মিলিটারীরা বুঝতে পেরেছিলো যে, সে তাদের ঠকাচ্ছে। উপায়ন্তর না দেখে সেই রাজাকার, নজরুল মাস্টারের কাছে সব কিছু খুলে বলে। নিজের সম্মানের কথা তখন চিন্তা করার সময় নাই। তার গ্রামকে সে নিজেও ভালোবাসতো। কিন্তু হেরে গেয়েছিলো নিজের কাপুরুষতা আর লোভের কাছে।
ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন নজরুল মাস্টার। কিন্তু তখন বেশি সময় হাতে নেই। গ্রামকে বাঁচাতে হলে আগে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সেই রাজাকারের শাস্তি তিনি সময়ের হাতেই ছেড়ে দিলেন। গ্রামের জোয়ান ছেলেদের তিনি আশেপাশে সরিয়ে দিলেন। যুবতী মেয়েদের নিজে এবং আরো কয়েকজন মিলে নৌকা চালিয়ে অন্য গ্রামে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। এই গ্রাম থেকে মিলিটারীরা সরে গেলেই আবার তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হবে। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। যুবকদের আগে সরিয়ে দেওয়া গেলেও যুবতী মেয়েদের পাঠাতে একটু দেরি হয়ে গেলো। নৌকার চালকদের গুলি করে যুবতী মেয়েগুলোকে শহরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে সেই রাজাকারের স্ত্রী আর বোনও ছিলো। নজরুল মাস্টার এবং আরো যে ক’জন নৌকা চালাচ্ছিলো তাদের হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সেই সাথে ভেসে যায় সেই রাজাকারের পরিচয়।’
তিন
‘মিলিটারীরা পুরো গ্রামে তছনছ চালায়। গ্রামে তখন একজন যুবক ছেলেও নাই। ক্রোধান্বিত মিলিটারীরা নির্বিচারে গুলি করে গ্রামের বৃদ্ধ ও শিশুদের। পুড়িয়ে দেয় ঘরবাড়ি। বেয়নেটের আঘাতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে হতভাগ্য মানুষগুলোকে।
গ্রামের সেই রাজাকার তখন পালিয়েছে। মিলিটারীরা যে তাকেই সবার আগে খুঁজবে এটা সে ভালোমতোই জানতো। আর তাকে খুঁজে পেলে যোগ্য হিসাব চুকাতেও ছাড়বে না তারা। ততোদিনে হুঁশ ফিরেছে রাজাকারের। নিজ দেশ, নিজ মাটি আর নিজের মানুষের সাথে গাদ্দারীর সমুচিত জবাব সে পেয়ে গেছে।
প্রায় চার মাস পরে দেশ স্বাধীন হয়। মিলিটারীদের সীমাহীন লালসার চিহ্ন শরীরে বহন করে গ্রামের মেয়েগুলি শহরের মিলিটারী ক্যাম্প থেকে গ্রামে ফিরে আসে। বিদেশী স্বেচ্ছাসেবী নানা সংগঠন তাদের ফিরে আসতে সাহায্য করে। পুরো গ্রামে তখন কেবল হতাশা আর লাঞ্ছনার হাহাকার। প্রতিটি ঘরে ঘরে লুণ্ঠনের চিহ্ন। মেয়েগুলো তো গ্রামে ফিরে আসে, কিন্তু তাদের পরিবার তাদেরকে মেনে নিতে পারে না। প্রায় প্রতিটি মেয়েই তাদের গর্ভে ধারণ করছে যুদ্ধের বীজ। সেই বীজ থেকে জন্ম হয় নতুন তরতাজা চারাগাছের। কোনো পরিবারই সেই চারাগাছের যত্ন করে না, তবু সেগুলো বেড়ে ওঠে...অনাদরে, অবহেলায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেকদিন পরে একদিন সেই রাজাকারও ভয়ে ভয়ে ফিরে আসে গ্রামে। যুদ্ধের শেষ সময়টুকু সে ব্যয় করেছে তার স্ত্রী আর বোনের সম্ভ্রমের প্রতিশোধ নিতে। নিজের পাপের চিহ্ন ধুয়ে ফেলতে। গ্রামে ফিরে সে দেখে, তার বোন এক রুগ্ন জারজ সন্তানের জন্ম দিয়ে ধুঁক ধুঁক করে বাঁচছে। তার স্ত্রী এই লজ্জা আর অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে।
গ্রামে তখন অনেক ঘরেই এই যুদ্ধশিশু। যুদ্ধের রেখে যাওয়া কদর্য ক্ষত। এই ক্ষতকে কেউ নিজের শরীরের অংশ বলেই মনে করে না, তাকে সারিয়ে তোলা তো দূরের কথা।
রাজাকারের মনে পড়ে যায় নজরুল মাস্টারের বলা সেই কথাগুলো...’যে মাটি তোমাকে বেঁচে থাকার রসদ জুগিয়েছে তারে তুমি অপমান করলা? যদি কোনোদিন নিজের দিকে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করে, তাহলে এই মাটিতে মিশে থাকা রক্তের দাগ তোমাকে মুছতে হবে। এর শরীরের লজ্জা তোমাকে ঢাকতে হবে। তাহলেই নিজেকে মানুষ বলে পরিচয় দিও...’
সে চেষ্টা করে নজরুল মাস্টারের কথামতো নিজেকে মানুষ হিসেবে আবারো পরিচয় দেবার। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া এই শিশুগুলোকে কাছে টেনে নেয় সে। নিজের যৎসামান্য জ্ঞান আর সম্পত্তি দিয়ে সে তাদের বেঁচে থাকার আনন্দটুকু পাইয়ে দিতে চায়। কিন্তু সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষা। সেই শিক্ষা না থাকলে কি নজরুল হুদার মতো মানুষের জন্ম হয়, যারা নিজের জীবন উৎসর্গ করে অন্যের সম্ভ্রম বাঁচাতে চায়?
এই সুন্দর কাজে সে সাদা মনের কিছু মানুষের সন্ধান পায়। যারা নাম পরিচয় গোপন করে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে কিছু দেশী-বিদেশী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও। এভাবেই ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে যায় একটি স্কুল। সেই রাজাকার হয়ে ওঠে কারো মামা, কারো চাচা...পরবর্তীতে সবার প্রিয় দাদুভাই। আর নিজের কাছে একজন মানুষ। অসংখ্য ভুল ত্রুটি আর অল্প কিছু ভালোতে মেশানো স্রেফ একজন রক্ত মাংশের মানুষ............।’
চার
বৃদ্ধ ভদ্রলোক কখন থেমে গিয়েছেন শাওন বুঝতেও পারেনি। গল্পের সাথে মিশে গিয়ে সে চলে গিয়েছিল একাত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলোতে। সামনে বসে থাকা মানুষটার প্রতিবিম্ব কখন যেনো এক রূপ থেকে ধীরে ধীরে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে শাওন।
টেপ রেকর্ডারটা খুলে ভেতর থেকে ক্যাসেটটা বের করে নষ্ট করে ফেলে। তারপরে ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দেয়। কিছু কিছু ডকুমেন্টারী মনের গহীনে তৈরী হয়, সেখানেই তাদের রেখে দিতে হয়।
ঝোলাটা কাঁধে তুলে নেয় শাওন। বৃদ্ধের কুঁচকানো চোখের ঘোলাটে দৃষ্টিতে মিশে থাকা অজস্র প্রশ্নের উত্তর আজ তার কাছে নেই।
আগামী প্রজন্মের কাছেই সেই উত্তর দেবার ভার দিয়ে যায় সে।।
০১ ডিসেম্বর - ২০১৪
গল্প/কবিতা:
৬৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী