এক
চারপাশের হাওয়া টা ভাল করে বুঝে নিয়ে শাহীন ড্রইংরুমে ঢুকে রিমোট হাতে নিয়ে বসল। রান্নাঘর থেকে টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসছে। পৌলমী ফিরে এসেছে। ওর মার বাসায় গেলে এত তাড়াতাড়ি তো ফেরে না সাধারণত! ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে কখন ঘরে ঢুকেছে শাহীন বুঝতে পারেনি। শাহীন বেডরুমে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল। কালকের মধ্যেই প্রপোজালটা জমা দিতে হবে। একদম সময় নেই হাতে। এই প্রজেক্টটা নিয়ে অনেক স্বপ্ন বুনছে সে মনে মনে। খুব খাটাখাটনি যাচ্ছে প্রপোজালটা তৈরি করার পেছনে। ইতিমধ্যেই অনেকবার তাগাদা এসেছে। কিন্তু শাহীন যেনতেনভাবে সাবমিট করতে রাজি হয়নি। সময় কিছুটা বেশি লাগুক ক্ষতি নেই, ডেডলাইন তো আর চলে যাচ্ছে না। তাই দিনরাত এক করে এখন এটা নিয়েই পড়ে আছে।
রিমোট টেপাটেপিতে ব্যস্ত হবার ভান করলেও শাহীনের মন পড়ে রইল রান্নাঘরেই। পৌলমী যদি ডাক দেয় এই আশায়। চোখ টিভির স্ক্রীনে, বাদবাকি সর্ব ইন্দ্রীয় রান্নাঘরের আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে। এই সিংকের কলটা থেকে পানি পড়ে যাচ্ছে...ফ্রিজের পাল্লাটা কয়েকবার খোলা আর বন্ধ করা হল...ফ্রাইপ্যানে কিছু একটা ভাজা হচ্ছে, চমৎকার গন্ধ আসছে।
পৌলমীর রান্নার হাত দারুণ। সামান্য একটা ভাজি কিংবা খুব সাধারণ কোন লাবড়া পৌলমীর হাতের ছোঁয়ায় অসাধারণ হয়ে ওঠে। বিয়ের পাঁচদিন পরে পৌলমী প্রথম রান্নাঘরে ঢোকে। শাহীনের মা’র মোটেও কোন ইচ্ছে ছিল না যে তার ছেলের বৌ এত তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢুকবে। তার বয়স হয়েছে, কিন্তু সনাতনপন্থী নন। ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে চটজলদি ছেলের বৌকে রান্নাঘর বুঝিয়ে দিতে হবে। তার মতে, ঐ খড়ি তো সবাইকেই ঠেলতে হবে...এত তাড়া কিসের! দুটো দিন একটু রয়ে সয়ে নাও বাপু।
কিন্তু পৌলমীর সামনে কিছুই বলা হল না তার। ঐ পাঁচদিনেই তিনি কী বুঝলেন কে জানে! ছেলের বৌকে ঘাঁটাতে গেলেন না। পৌলমী রান্নাঘরে ঢুকল এবং বাড়ির যাবতীয় রান্না একা নিজের হাতে করলো। কাজের মেয়েটা দূরে দাঁড়িয়ে এটা ওটা এগিয়ে দিল শুধু। তিন বছর আগের কথা। পৌলমীর বয়স তখন পঁচিশের বেশি হবে না। সেই দিনের কথা আজো পরিষ্কার মনে আছে শাহীনের। মাছ, মাংস আর শাকসব্জী মিলিয়ে মোট দশরকম রান্না করেছিল পৌলমী। শাহীনের মা রান্নাঘরে ঢুকে কিছু বলতে গিয়েও ফিরে এসেছেন। শাহীনের ছোট দুই বোন একে অন্যের গা টেপাটেপি করেছে। বাবা ঘরে বসে হম্বিতম্বি করেছেন,
‘তোমাদের আক্কেল টা কী শুনি? নতুন বৌকে দিয়ে এত কাজ করাচ্ছো! এই শিমু, শায়লা তোরা রান্নাঘরে গিয়ে একটু সাহায্য করতে পারছিস না? পারে খালি গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করতে।’
পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে। শাহীন প্রমাদ গোনে মনে মনে। একবার রান্নাঘরে ঢুকে দেখতে যায় কী হচ্ছে। পৌলমী ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কিছু চাই তোমার?’
‘না, কী করছো দেখতে এলাম।’
‘রান্নাঘরে রান্না করা ছাড়া আর কী কী করা যায়?’
কাজের মেয়েটা মুখ লুকিয়ে ফিক করে হেসে ওঠে। শাহীন আর দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ বোধ করে না। পৌলমীর ঠোঁটকাটা স্বভাবের সাথে তার বিয়ের দিনই পরিচয় হয়ে গেছে। আর কী বলে বসবে কে জানে!
খাবার টেবিলে বসে কারও মুখে কথা সরে না। কথা বলে কেউ সময়ও নষ্ট করে না। কিছুক্ষণ শুধু খাবার চিবানো আর গলাধঃকরণের আওয়াজই শোনা যায়। খাওয়া শেষে শাহীনের মা পৌলমীকে তার ঘরে ডেকে আনেন।
‘নতুন বৌকে কিছু একটা দিতে হয়। আমারও ইচ্ছা ছিল সোনার কিছু একটা তোমায় বানিয়ে দেব। মা, আমার রান্নাঘরটাই নাও! ওটা তোমাকেই দিলাম।’
শাহীনের বাবা পাশ থেকে ফোড়ন কাটেন,
‘হুম, তা তো দেবেই। ওটা দিলে তো তুমিই বেঁচে যাও।’
পাশের ঘরে বসে শাহীন অপেক্ষা করে থাকে পৌলমীর। মনে মনে অনেক কথা বলে যায় পৌলমীর সাথে। আজ বাবা-মা আর বাড়ির সবার চোখে মুখে পৌলমীর জন্য যে সমীহের ছাপ সে দেখেছে, তাতে সে যেন নিজেই সম্মানিত বোধ করেছে। কিন্তু পৌলমী ঘরে ঢুকে একটা কথাও বলে না। চুপচাপ শুয়ে পড়ে বিছানায়।
পাশে বসে শাহীন খড়িকাঠের সাথে কথা বলে। পৌলমী জানতে পারে না, জানতে চায়ও না।
দুই
একমাত্র ছেলের বিয়ে নিয়ে শাহীনের মার আগ্রহ ছিল দেখার মত। ছেলের বৌএর ডানাকাটা পরী হওয়ার প্রয়োজন নেই, কিন্তু গায়ের রংটা দুধে আলতা হওয়া চাই। লম্বা খুব বেশী না হলেও চলবে, কিন্তু তার ছেলের কাঁধটা যেন ছুঁতে পারে(তার ছেলের উচ্চতা পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি)। খুব বেশি শিক্ষিত হতে হবে না, কিন্তু কলেজের বিএ টিএ পাশ যেন না হয়। একটা ভার্সিটির ডিগ্রী যাতে অন্ততঃ থাকে। এরকম ছোটখাট কিছু ন্যূণতম চাহিদা(!) আর কী!
কেবলমাত্র মেয়ের বাপের আর্থিক সংগতি নিয়ে তার কোন চাহিদা ছিল না। তার ছেলের সুখটাই এখানে মূখ্য বিষয়। আর এটার সাথে মেয়ের বাবার আর্থিক সংগতির কোন যোগাযোগ নেই। এটাই মনে করেন তিনি।
শাহীনের বাবা তার মাকে বাধা দেন না। করুক গে যা খুশি! একমাত্র ছেলেকে নিয়ে একটু আদিখ্যেতা করার শখ হয়েছে কী করা যাবে! দুই মেয়ের বিয়ে দিতে সেই আদিখ্যেতার ঝাল ভালোমতই টের পাবে। মেয়ে দুটো তো হয়েছে একেকটা চীজ। একগ্লাস পানি ঢেলে খেতেও হাত ব্যথা করে। পড়াশুনার নামে লবডঙ্কা; দিনরাত পড়ে আছে ফেসবুক, মোবাইল, ভাইবার আরো কী কী সব নিয়ে যেগুলোর নামও শোনেননি কস্মিনকালে।
শাহীনের মা তার এই পাত্রীবাছাই পর্বে কাউকেই বলতে গেলে সুযোগ দেন না। শিমু,শায়লাকেও না। ওদের অবশ্য বিশেষ মাথা ব্যথা নেই তা নিয়ে। মা যখন প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন, নিট রেজাল্ট দেখার মতই একটা কিছু হবে। একমাত্র চিন্তা কেবল বিয়েতে সাজগোজের জন্য সময়টা উপযোগী হবে কিনা, গরমটা তো যাচ্ছি যাবো করেও বিদায় নিচ্ছে না।
আর শাহীনের এ ব্যাপারে কোন বক্তব্যই নেই। বুয়েটে পড়ার সময়ই মা তাকে বলে রেখেছেন,
‘মেয়ে বন্ধু কর্ আরে যাই কর্ তোর বউ কিন্তু আমি খুঁজবো। এইটা একা একা খুঁজে নিতে পারবি না। যদি নিস, তাহলে সেদিন থেকে বাসার ভাত বন্ধ।’
হুমকির ভয়ে না, খুশিমনেই দায়িত্বটা মার কাঁধেই দিয়ে রেখেছিল শাহীন। মেয়েদের মন বোঝার চেয়ে মেকানিক্সের জটিল তত্ত্ব বোঝা অনেক সহজ মনে হয়েছে ওর কাছে।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, গণ্ডায় গণ্ডায় ছবি সাপ্লাই করে শেষপর্যন্ত পাঁচজন মেয়েকে প্রাথমিকভাবে মনোনীত করলেন শাহীনের মা। এরমধ্যে থেকেই একজন হবে তার পুত্রবধু। এই পাঁচজনের বাসায় তিনি নিজে গিয়ে দেখা করলেন, ঘটক টটকের ধার ধারলেন না। কষ্টিপাথরে অনেক যাচাই বাছাই শেষে পৌলমী’র ঘাটে এসে তরী ভেড়ালেন।
তিন
বিয়ের প্রথম রাতেই শাহীনের মনে হল কিছু একটা ভুল হয়েছে।
শাহীন তার স্ত্রীকে প্রথম দেখে বিয়ের আসরে। মেয়ে দেখার তুমুল যজ্ঞে একবারও সে অংশ নেয় না। বিচার প্রক্রিয়া শেষ হবার পরে মা ছবি নিয়ে এসেছিল ওর ঘরে। শাহীন দেখেনি। মনের আগল টেনে রেখেছিল জোর করে। উহু, এখন খোলা যাবে না সে আগল। চোখ আর মনের সমস্ত অনুভূতি দিয়েই সে প্রথম দেখবে তার রক্তমাংসের মানবীকে। মনের মাঝে সাজিয়ে রাখে কল্পনা আর আকাঙ্ক্ষার সৌধ। কিন্তু ওর জানা ছিল না, ইট পাথরের সৌধেই ফাটল ধরে। এ তো কোন ছার!
বাসর রাতে ওর মনে হয়, ওর ঘরে যেন হাজার আলোর রোশনাই। মার পছন্দে আস্থা ছিল, কিন্তু এতটা আশা করেনি শাহীন। স্বর্গের অপ্সরী যেন ভুল করে নেমে এসেছে ধরাধামে। শাহীন এমনিতেই বরাবরের মুখচোরা। পড়াশুনা কিংবা কর্মক্ষেত্রে সে যতটাই সাবলীল ও তুখোড় ততটাই অনভ্যস্ত আর আনাড়ি মেয়েদের ব্যাপারে। মনে মনে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে সে ঘরে ঢুকেছে, কিন্তু এখন কিছুই মনে পড়ছে না। কোথা দিয়ে কথা শুরু করবে, কী কী বলবে সবকিছুই গুলিয়ে যাচ্ছে। শাহীন কিছু বলার আগেই পৌলমী কথা বলে ওঠে। আজো শাহীনের কানে বাজে কথাগুলো।
‘দেখুন, আমি জানি না আপনাকে কিংবা আপনার পরিবারকে কী জানানো হয়েছে। কিন্তু আমার দিক থেকে আমি কখনোই অন্য কোন অবস্থান নেইনি। আমি বিয়ে করতে চাইনি। আমার বাবা-মাকে পরিষ্কার জানিয়েও দিয়েছিলাম সে কথা। তারা আমার কথা শোনেননি। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। আশাকরি বিষয়টা বুঝবেন। আমি মানসিক কিংবা শারীরিক কোন ভাবেই এই সম্পর্কের জন্য প্রস্তুত নই।’
শাহীন যেন বিদ্যুৎএর শক্ খায়। প্রচণ্ড অপমানে কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে। প্রথমেই মাথায় যা আসে বলে ফেলে,
‘তুমি কি অন্য কাউকে পছন্দ কর?’
‘না, আমার কোন পছন্দ নেই।’
‘তাহলে কি আমাকে তোমার পছন্দ হয়নি?’
‘আপনার কোন ছবি আমি দেখি নাই। পছন্দ-অপছন্দের কোন প্রশ্নই নেই। আর তাছাড়া আমি বিয়ে ব্যাপারটারই বিরোধী।’
‘তাহলে আমাকে জানালে না কেন? কোনভাবে আমার সাথে কি যোগাযোগ করতে পারতে না?’
পৌলমী এবারে বেশ অপ্রস্তুত হয়। অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে মুখে চোখে।
‘আমি চেষ্টা করেছিলাম। বাবা-মা বুঝতে পেরে আমাকে একরকম বন্দি করে রাখেন। বাইরের কারোর সাথেই আমাকে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয় নাই।’
শাহীন কথা খুঁজে পায় না। কী থেকে কী হয়ে গেল! কার ওপরে রাগ করবে বুঝে ওঠে না। মার ওপর, পৌলমীর ওপর, নাকি নিজের ভাগ্যের ওপর?
পৌলমী নিরাসক্তের মত ঘুমিয়ে পড়ে পাশ ফিরে। একবারের জন্যও মুখ ঘুরিয়ে দেখে না পাশের মানুষটিকে।
দিন যেতে থাকে ছন্দহীন গতিতে। কোন রকম পূর্ণতা পায় না তাদের বৈবাহিক বন্ধন। পৌলমী এক দুর্ভেদ্য শৈত্যের চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে রাখে। সেই চাদর ভেদ করে শাহীন পৌঁছতে পারে না তার কাছে। শাহীন কাছে যেতে চায়, পৌলমী তাকে অপমান করে দূরে সরিয়ে দেয়। কথা বলতে চাইলে ব্যস্ততার সূত্র ধরে। শরীরের পথ ধরে যে মনকে চেনা, সেটাও হয়ে ওঠে না। একান্ত ঘনিষ্ট মুহূর্তে পাথরের মত নিশ্চল থেকেছে পৌলমী। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছে শাহীন, ভালোবাসার সেই বিশেষ ক্ষণটুকুতে যেন ভয় গ্রাস করেছে পৌলমীকে। বশ্যতা মানতে নারাজ মন বারবার কাছে আসতে চেয়েছে পৌলমীর। পৌলমী সবসময় নিজেকে সরাতে পারেনি যদিও, কিন্তু অদ্ভূতরকম শীতলতায় আচ্ছন্ন থেকেছে পুরোটা সময়। একপর্যায়ে শাহীন বাধ্য হয়েছে নিজেকে গুটিয়ে নিতে।
শাহীন খুঁজে পায় না এই সম্পর্কের পরিণতি। তবু সরাতে পারে না নিজেকে। প্রত্যাখ্যাত হবে জেনেও বারবার ছুটে যায় পৌলমীর কাছে। একটুখানি দাক্ষিণ্যের আশায় চেয়ে থাকে চাতক পাখির মত।
শাহীন অনেকবার কথা বলতে চায় বিষয়টি নিয়ে। কোন্ কারণে পৌলমীর এই অদ্ভূত প্রত্যাখ্যান, তার উৎস কোথায়...সমাধানই বা কী? কিন্তু পৌলমী এড়িয়ে যায় বারে বারে। কোন একটা ছুতো ধরে চলে যায় অন্য কোথাও।
শাহীন ভয় পেয়েছে ওর পরিবারকে নিয়ে। বিশেষ করে মা’র কাছে থেকে নিজের দৃষ্টি বাঁচিয়ে চলেছে সব সময়। মা’র কাছে ধরা পড়তে চায় না সে। জানে ওর সব প্রতিরোধ ভেঙে যাবে মুহূর্তেই। ঐ একটি জায়গাতে ওর অবস্থান আজো ভীষণ নাজুক।
চার
পৌলমী রান্নাঘরে খুটখাট করছে ঠিকই, কিন্তু মন পড়ে আছে ড্রইংরুমে। শাহীন আজ বাসায় থাকবে ওর জানা ছিল না। তাহলে আরেকটু দেরি করে ফিরতো। বাসার সবাই আজ একটা দাওয়াতে গেছে। পৌলমী যায়নি। মা’র বাসায় যাওয়া হয়নি অনেকদিন। এই সুযোগে সারাদিন ওখানে থেকে এসেছে।
শাহীন কখন উঠে আসে কে জানে! কেন যেন শাহীনকে খুব ভয় লাগে আজকাল। প্রত্যাখ্যানের ভার কতদিন সে বহন করবে? একসময় যদি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে? পারবে কি পৌলমী নিজেকে বার বার রক্ষা করতে? যদি ও নিজেই দূর্বল হয়ে পড়ে?
কার শাস্তি কাকে দিচ্ছে পৌলমী? কেন দিচ্ছে?
ছোটবেলা থেকেই ডানাকাটা রূপসী বলতে যা বোঝায় তাই ছিল পৌলমী। কত যে অত্যাচার হজম করতে হয়েছে ইয়ত্তা নেই তার। পাড়ার ছেলেরা পাড়ার যাবতীয় সভা সংঘ করার জন্য ওদের বাসার সামনের রাস্তাটাকেই উপযুক্ত মনে করতো সবসময়। পাড়ার মোড়ের দেয়ালগুলোর দিকে তাকানো যেত না। পৌলমীকে নিয়ে কাব্য কাহিনীর বণ্যা বয়ে যেত। কিছু কিছু আনাড়ি শিল্পী অদক্ষ হাতে ফুটিয়ে তুলতে চাইতো তার সৌন্দর্য। ওর স্কুল, কলেজ, কোচিং, প্রাইভেট ইত্যাদি যাবতীয় কর্মকাণ্ডের আপডেট থাকত সবার কাছে। পৌলমীর কোন ভাই ছিল না। ওরা দু’বোন। বড় আপা বিয়ের পরে দেশের বাইরে চলে গেছে। সকল ঝুটঝামেলা তাই বাবাকেই পোহাতে হত।
ক্লাস সিক্সে পড়তেই বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হয়ে যায়। স্কুলে শেষের দিকে আসতে আসতে প্রতি দশ-বারো দিনে একটা করে প্রস্তাব আসা শুরু হল। আত্মীয় স্বজনেরাও রেহাই দিত না। কিন্তু বাবা-মা অনড় ছিলেন বলেই পড়াশুনাটা শেষ পর্যন্ত করতে পেরেছে সে।
একদিন কলেজে যাওয়ার পথে প্রিয়বান্ধবী হেনা’র বাড়ি হয়ে যায়। হেনা দু’দিন ধরে কলেজে আসছে না। হেনা ওর ছোট্টবেলার বান্ধবী। ওদের পরিবারের সাথেও পৌলমীদের পরিবারের ভাল সম্পর্ক। হেনার বাড়িতে গিয়ে দেখে ও আজ সুস্থ। কলেজে গেছে। বাড়িতে কেবল খালুজান ছিলেন। খালাম্মা মার্কেটে গেছে। পৌলমী চলে আসতে গিয়ে বাধা পায়। খালুজান ওকে বসতে বলেন। পাশে বসিয়ে ওর বাবা-মা’র কথা জিজ্ঞেস করেন। ফ্রিজ থেকে কোল্ডড্রিংকস বের করে আনেন। অনেকটা জোর করেই খাওয়ান ওকে। তারপরই কেমন যেন মাথা ঘুরতে থাকে পৌলমীর। আধো তন্দ্রা, আধো জাগরণে পৌলমী টের পায়, বাবার মত শ্রদ্ধা করতো যাকে সেই খালুজান ওকে পঙ্কিলতার শেষ ধাপে নিয়ে যাচ্ছে।
পৌলমী কাঁদতে কাঁদতে ফিরে আসে বাসায়। সেদিন আর কলেজে যাওয়া হয় না ওর। খালুজান মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছে,
‘এসব কথা কাউকে বলতে হয় না মেয়ে। মানুষ তোমাকেই দোষ দেবে। তোমার বাবা-মা কত কষ্ট পাবেন ভেবে দেখ।’
পৌলমী বলতে পারেনি। কাউকেই না। হেনা জোর করে একদিন ওকে ওদের বাসায় নিয়ে যায়। খালুজান হেসে হেসে কত কথা বলে। খালাম্মা আদর করে পিঠা বানিয়ে খাওয়ান। সুখি, হাসিখুশি একটি পরিবারের ছবি।
পুরুষ নামটাই চরম ভীতিকর একটা শব্দে পরিণত হয় ওর জীবনে। বিতৃষ্ণা চলে আসে বিয়ে নামক বন্ধনটার ওপর। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় জীবনে কোনদিন বিয়ে করবে না। বাবা-মা বিয়ে নিয়ে ওর এই চরম অনাগ্রহের অন্য অর্থ দাঁড় করান। হয়তো কারও সাথে মন দেয়ানেয়া হয়েছিল, ভেঙে গেছে। বিয়ে হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু ভাগ্য ওকে গাঁটছড়া বেঁধে দেয় এমন একজনের সাথে, যার সরলতা আর নিষ্কলুষতা ওকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। পৌলমী কিভাবে পারবে ওর পঙ্কিল, পোকায় কাটা মন আর আত্মা নিয়ে শাহীনের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে?
পাঁচ
শাহীন উল্টেপাল্টে অনেকক্ষণ ধরে দেখে ওর ডায়েরীটা। মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নেয় সে। অনেক তো হল পাহাড়ের বুকে ঘুষি মারা। ঝরণা তো প্রবাহিত হল না। মুক্তি দিয়ে যাবে সে পৌলমীকে। এই পিঞ্জরে আর নাই বা বাধা রইল। দৃষ্টির মাঝে বন্দি না রেখে এবার উড়িয়ে দেবে খোলা আকাশে। ওর প্রপোজালটা একসেপ্ট করেছে কানাডার ইউনিভার্সিটি। সামনের মাসেই ওর ফ্লাইট। বাসায় এখনো জানায়নি। অনেক প্রশ্নবাণের মুখোমুখি হতে হবে। তা হোক। তবু এই ভাল।
এদিকে মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত বিধ্বস্ত পৌলমী সিদ্ধান্ত নেয়, শাহীনের কাছে সব কথা খুলে বলবে। মুক্তি দেবে ওর মনের মাঝে জমিয়ে রাখা সব অন্ধকারকে। অনেক বড় মন শাহীনের। পৌলমীর তো কোন দোষ ছিল না। সে তো নোংরা একজন মানুষের কদর্য লালসার শিকার মাত্র। নিজের কাছে সে হার মেনেছে সেই কবেই! ওর মনের জমাট বরফ গলে গিয়েছে শাহীনের উষ্ণতার ছোঁয়ায়।
শাহীন ডায়েরীটা খোলা রেখেই ওদের শোবার ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দাটায় আসে। ব্যাগ গোছাতে হবে। গুটিয়ে নিতে হবে পুরাতন জীবন। পৌলমী ঘরে ঢুকে শাহীনকে দেখতে পায় না। ফিরে যাওয়ার পথে চোখ পড়ে যায় ডায়েরীটার খুলে রাখা পাতায়।
‘আমায় তুমি বসিয়ে রাখো কেন?
মিথ্যে হেলার মূল্যে কেন আমায় তুমি কেনো?
দিলাম তুলে তোমার হাতে জীবন তুরুপ তাস,
দৃষ্টিবন্দি বনলতার আমিই ক্রীতদাস।’
ডায়েরীটা রাখতে গিয়ে নিজেকে সম্বরণ করতে পারে না পৌলমী। ডুকরে কেঁদে ওঠে। শাহীন ঘর থেকে একটা আওয়াজ পেয়ে বারান্দা থেকে এসে দেখে, আঁচলে মুখ ঢেকে অঝোরে কাঁদছে পৌলমী। সম্পূর্ণ অচেনা এক রূপে পৌলমীকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে শাহীন।
অচেনা, অদেখা তবু অনেক আকাঙ্ক্ষিত।