এক
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির সোশিওলোজি’র প্রফেসর ডঃ আর্থার মিলার অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। সেই দৃষ্টিতে একই সাথে কৌতুক আর রহস্যের মাখামাখি।
‘সো মিজ মেহরী(আমার নাম আসলে মেহ্রীন), ইউ আর মিসিং ইয়োর হোমল্যান্ড। ইজ ইট? অ্যাম আই বিয়িং ভেরি হার্ড? হা হা হা...’
এই সাদা চামড়ারা না ভিতরে ভিতরে কঠিন জিনিস। উপর থেকে দেখলে মনে হয়, নিপাট ভালমানুষ। কারো সাতে পাঁচে নাই। এই প্রফেসরকে দেখলে কে বলবে, পড়াশুনার বাইরে আর কিছু খেয়াল করে! অথচ ঠিকঠাক আমার মনের কথা বুঝে ফেলেছে।
প্রফেসর আর্থার মিলারের একজন পি,এইচ, ডি স্টুডেন্ট আমি। আমার রিসার্চের টপিক হচ্ছে, ডিফারেন্ট ফেসেস অফ ইনটিমেট ভায়োলেন্সঃ প্রিভেনশন অ্যান্ড ট্রিটমেন্ট।
ডাটা সংগ্রহের জন্য আমি আমার সুবিধাজনক একটা জায়গা বেছে নিতে পারি, প্রফেসরের এই কথায় ভয়ে ভয়ে বলেই ফেললাম যে, আমি বাংলাদেশ যেতে চাই। সুবিধাজনক লোকেশন বেছে নিতে বলেছে। আমি যে সুবিধাজনক দেশই বেছে নেব, এটা নিশ্চয়ই প্রফেসর আশা করেননি। একটা প্রজেক্টের অংশ হিসেবে রিসার্চটা করছি। টাকা-পয়সা ভালোই আছে প্রজেক্টের খাতে। সুতরাং আমার মত সুযোগসন্ধানীদের তো বসে থাকলে চলবে না। রথ দেখা আর কলা বেচা একসাথেই হয়ে যাবে। আহা, কতদিন দেশের আলো-হাওয়া গায়ে মাখিনা! শুনেছি তা নাকি এখন আর গায়ে মাখার পর্যায়ে নেই। বিশ্বের অন্যতম বাস অযোগ্য নগরী হিসেবে প্রথম সারিতে চলে এসেছে।
তবু তো নিজের দেশ! আমার বাবা-মার আবাস সেখানে। বিয়ের পরপরই চলে এসেছি মার্কিন মুলুকে। পাক্কা ছ’বছর হতে চলল। আমার স্বামী আবিদ একটা আই,টি ফার্মে চাকরি করছে। আমাদের একমাত্র সন্তান মিতুলের জন্ম এদেশেই। বাংলাদেশ সে চেনে না। অনেক চেষ্টায় বাংলাদেশকে তার কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করি। বাসায় পারতপক্ষে বাংলায় ছাড়া কথা বলি না। এতে অন্ততঃ আমার মেয়েটার কাছে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব টিকে আছে। আবিদের অবশ্য তেমন মাথা ব্যথা নাই। ওর কোনকিছুতেই মাথা ব্যথা নাই। সময়মত খাওয়া আর ঘুমানোর জায়গা পেলেই হল।
অনেকদিন থেকেই তাই মনে মনে সুযোগ খুঁজছিলাম। এখানে আসার একবছরের মাথায় কনসিভ করে ফেলি। মেয়েটা একটু বড় হতেই নিজের পি,এইচ,ডি শুরু করি। বাবা-মা দেশ থেকে অবিরাম জিজ্ঞাসা করে চলেছেন, কবে আসছি? কেন এত দেরি হচ্ছে? আমার শ্বশুর শাশুড়ি কেউ বেঁচে নেই। একমাত্র ননদ থাকে এদেশেই, ভার্জিনিয়ায়। তাই আমার বরের দেশে যাওয়ার বিশেষ কোন গরজ নাই। যত গরজ আমার একার। আমার দেশে যাওয়ার কথা শুনে আবিদ হ্যাঁ না কিছুই বলল না। জানা কথা। মাঝে মাঝে কেন যেন মনে হয়, আবিদ বোধহয় আমাকে অবহেলা করার চেষ্টা করছে। যদিও এমনটা মনে হওয়ার পেছনে খুব জোরদার কোন যুক্তি আমার নেই, তবু ভাবনাটা এড়াতে পারি না। আমার পড়ালেখা, ক্যারিয়ার ভাবনা সব কিছুতেই সে নিস্পৃহ একটা ভাব দেখায়। নিষেধ নাই কোন, আবার অনাবশ্যক প্রগলভতাও নাই।
আবিদের সব কিছুতেই ব্যাপক পরিমিতি। যে বয়স থেকে মেয়েরা তাদের ভবিষ্যত জীবনসঙ্গির একটা ছবি মনের মধ্যে আঁকে, সেই বয়সে আমার মনের কোথাও আবিদের মত একজন রসকষহীন জীবনসঙ্গির ছবি আঁকা ছিল না। আমি বরাবরই ভীষণ রোমাণ্টিক। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমার এখনো কবিতার সিডি বাজাতে ইচ্ছে করে। ঝুম বৃষ্টিতে খোলা চুলে ভিজতে ইচ্ছে করে। আকাশ ভরা কালো মেঘ দেখলে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ খুলে বসতে ইচ্ছে করে। এই ইচ্ছেগুলোর সাথে যখনই একাত্ম হয়েছি, পাশে একজন জীবনের উচ্ছ্বাসভরা সঙ্গীকে কল্পনা করেছি। যে ভালোবাসার উষ্ণ আবেগ দিয়ে আমার আবেগকে অনুভব করবে, প্রবল ভালোবাসায় আমার হাত ধরবে।
এসব আবিদের কাছে আশা করা বাতুলতা মাত্র। অনেক বড় বড় বিষয়ে তাকে মাথা ঘামাতে হয়। আমার আবেগের পারদ কিংবা চোখের কাজলের ঘনত্ব মাপার মত তুচ্ছ কাজে সময় নষ্ট করার মত সময়ের তার বড়ই অভাব। এসব নিয়ে মাথা ঘামানো এখন আমিও ছেড়ে দিয়েছি। আশার কথা এই যে, আমার মেয়েটা আবিদের মত নীরেট রোবট হয়নি। ভেতরের আবেগ টাবেগ প্রোগ্রাম করা না, সহজাত ভাবে আসে বলেই তো মনে হয়।
বাংলাদেশ যাওয়ার কথা শুনে মিতুল ভীষণ উত্তেজিত। জন্মের পর থেকে যে দেশের নাম সে তার মাকে জপ করতে শুনেছে, সেই দেশকে অবশেষে সচক্ষে দেখতে যাচ্ছে। আমার চেয়ে মেয়ের উত্তেজনাই বেশী।
মনে মনে পরিকল্পনা করেছিলাম, তিনজনে মিলেই যাব। এখানেও বাধ সাধল আবিদের ছুটি। বছরের এই সময়টাতে নাকি ও ছুটি পাবে না। আমি কিছু বললাম না। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর দেশের সাথে আবিদের বন্ধনটাই একরকম ছিঁড়ে গেছে। তাই ছুটি এটা সেটা বলে আমাকে বোঝাচ্ছে।
আমিও বুঝ মানলাম। অনেক গভীরে গিয়ে সব বৃক্ষই কি মাটির স্পর্শ নিতে পারে? পারে না হয়তো। তাই দীর্ঘ ছ’বছর পর আমার সন্তানকে সাথে নিয়ে একাই দেশে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
দুই
বাবা-মা আমাকে আর নাতনীকে পেয়ে ক’দিন আকুল হয়ে কেঁদে ভাসালো। মা তো মনে হয়, পাগলই হয়ে গেল। কি খাওয়াবে, কোথায় নিয়ে যাবে, কি কি বলবে সব তালগোল পাকিয়ে ফেললো। বাবা কিছুক্ষণ পর পর এসে এটা সেটা জিজ্ঞাসা করছে, ‘মা, তোমার কি বেশী গরম লাগছে?...তোমার ঘরের এসি টা ঠিকমত কাজ করছে তো? নতুন লাগানো হয়েছে তো, সমস্যা হতে পারে।...বাথরুমের মেঝে বেশি পিচ্ছিল হয়ে নাই তো?...’
মিতুলকে নিয়ে বাবা-মা’র দুশ্চিন্তার অন্ত নাই। মিতুল ঠিকঠাক মানিয়ে নিতে পারছে কিনা, শরীর খারাপ করছে কিনা এসব নিয়ে তাদের মোটামুটি ঘুম হারাম হয়ে গেল।
আর মিতুলের চিন্তা তো আরেক কাঠি বেশি। তার নানা-নানু তো ইংরেজী বোঝে না। তাদের যাতে বুঝতে কোন সমস্যা না হয়, সেজন্য সে বাংলায় কথোপকথন চালিয়ে যাবার এক প্রানান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছে। সে চেষ্টা আমাদের ভীষণরকম বিনোদনের খোরাক যোগাচ্ছে।
আবিদের না আসার কারণ নিয়ে মা কিছুদিন কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করল। আমার সাড়া শব্দ না পেয়ে অগত্যা হাল ছেড়ে দিল। নিজে নিজে কি বুঝলো কে জানে, মুখ চিমসিয়ে আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। শেষে একদিন মাকে ডেকে কথা বললাম,
‘মা, তুমি আসলে যা ভাবছো তা না। তোমাদের জামাইয়ের সাথে আমার কোন সমস্যা হয় নাই। ও ছুটি পায় নাই, তাই আসে নাই। এতদিন পরে আসলাম, আমাকে একটু আদর আপ্যায়ন কর।’
কিছুদিন মার হাতের চব্য-লেহ্য খেয়ে আর আত্মীয় পরিজনদের সাথে দেখা সাক্ষাত শেষ করে আসল কাজে মনোনিবেশ করলাম। প্রফেসর আমার বাংলাদেশ সফরে খুশিমনে সম্মতি দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এসাইনমেন্ট অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটা নাকি আমার হোমল্যান্ডে যেতে পারার জন্য আমার তরফ থেকে ট্রিট। ট্রিটই হোক আর যাই হোক, আমি অযথা গাঁইগুই করে সময় নষ্ট করিনি। খুশিমনে এসাইনমেন্টের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি। আমার কাজটা যে ক্ষেত্রে তাতে কিছুটা নৈকট্য এবং কথা বলার খোলামেলা পরিবেশ পেলে আমার জন্য ভাল হয়। আমি কয়েকটা সোশ্যাল অরগানাইজেশনের সাথে কথা বললাম। তারা আমাকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিল। ছুটি নিয়েছি মোটে দু’মাস। অতএব বসে থাকলে চলবে না। পুরোদস্তুর কাজে নেমে পড়লাম।
মিতুল তার নানা-নানুর সাথে ভালোই জমিয়ে নিয়েছে। ইতিমধ্যে সে আবিষ্কার করে ফেলেছে যে, নানা-নানু তার হঠাৎ ভুলে বলে ফেলা ইংরেজীর অর্থ বুঝতে পারছে। বিষয়টাতে সে বেশ নিশ্চিন্তবোধ করছে। আমিও নিশ্চিন্ত মনে আমার ডাটা সংগ্রহে মন দিলাম। প্রায় আট-দশ দিন ধরে বিভিন্ন সংস্থার অফিসে গিয়ে ধর্না দিলাম। তারা তাদের মহিলা কর্মীদের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিল। কাজ বেশ জোরেসোরেই এগিয়ে চলল।
এমনি একদিন ঢাকার অদূরে একটি সংস্থার অফিসে গিয়েছি। দুঃস্থ, সুবিধাবঞ্চিত এবং বিধবা কিছু মহিলা এদের সংস্থায় কাজ করে। আমি ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন শাখা দেখে বেড়াচ্ছি। দু’একজনের সাথে কথাও বলছি। হঠাৎ পেছন থেকে রিনরিনে একটা কণ্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকালাম। আমার নাম ধরে কেউ একজন যেন ডাক দিল। খুব আস্তে, যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে।
আমার সামনে আমার সমবয়সী যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে, তাকে আমি চিনি। শুধু চিনি বললে কম বলা হয়। ভার্সিটি জীবনে যে সহপাঠিনীকে তার অন্যরকম ব্যাক্তিত্ব আর মেধার কারণে মনে মনে ঈর্ষা করতে বাধ্য হতাম , সেই মৌটুসি! এখানে?
তিন
আমার বিস্ময়ের ধাক্কা খানিকটা কেটে যাওয়ার পর সম্বিত ফিরে পেলাম। জড়িয়ে ধরলাম পুরনো সহপাঠিনীকে। ফেসবুকের এই জামানায় পুরনো বন্ধুদের সাক্ষাৎ মিলবে না, এটা ভাবাই যায় না। কিন্তু ভার্সিটি শেষে মৌটুসির আর কোন খবরই পাইনি। কারও কাছ থেকেই না। মৌটুসি যেন ভোজবাজির মত হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। আজ এতবছর পর মৌটুসিকে দেখবো, তাও আবার এখানে, এটা ঠিক মেলাতে পারছিলাম না।
আমার চেহারায় ফুটে উঠা একরাশ প্রশ্ন আর কৌতুহল দেখে হেসে ফেলে মৌটুসি।
‘না, তুই যা ভাবছিস তা নয়। আমি এখানকার পরিচালনা গ্রুপের একজন। তবে এটাও ঠিক, নীতিগতভাবে আমিও এদেরই একজন। সুবিধাবঞ্চিত।’
‘তুই কেন সুবিধাবঞ্চিত হতে যাবি? তুই হয়তো জানিস না, ভার্সিটিতে তুই আমাদের অনেকের আদর্শ ছিলি। তোর আত্মবিশ্বাস, ব্যাক্তিত্ব, আশেপাশের সবকিছু ঠিকঠাক বুঝে চলার ক্ষমতা...,’ আমি বলতে থাকি প্রগলভের মত।
‘হুম, সবকিছু বুঝতে পারার ক্ষমতা। ভালোই বলেছিস। সেজন্যই হয়তো সবচেয়ে কাছের মানুষটিকেই ঠিকমত বুঝে উঠতে পারিনি।’
আমি চুপ করে থাকি। মৌটুসিকে দেখে মনে হয়, ওর মনের দ্বার আজ খুলে গেছে। বলতে থাকে,’আমাদের দু’ব্যাচ সিনিয়র আফজালের সাথে যে আমার একটা সম্পর্ক ছিল তোরা জানতিস নিশ্চয়ই। কথা ছিল, পাশ করার পরপরই আমরা বিয়ে করে ফেলবো। আফজাল ততদিনে চাকরিতে ঢুকে পড়বে। আমার রেজাল্ট ভাল ছিল। তাড়াতাড়ি পি,এইচ,ডি শুরু করার চেষ্টা করবো এটা ছিল অনেকটা অলিখিত। আফজালের সাথে আমার এটা নিয়ে অনেকবার কথাও হয়েছে। আমাদের বিয়ে পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক চলতে থাকে। পারিবারিক ভাবেও কোন সমস্যা ছিল না।
কিন্তু বিয়ের পর আফজাল হয়ে যায় সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। আমার ক্যারিয়ার সচেতনতা ও ভালভাবে নিতে পারে না। আমি আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করি, যে আফজাল আমার ছোটখাট বিষয়গুলোর প্রতিও কখনো অবহেলা করতো না, সে আমার অনেক বড় বড় বিষয়েও আর কোন আগ্রহ দেখায় না। পারিবারিক হাজারো ঝামেলার মাঝে আমাকে অনেকটা জোর করে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে। সংসার জীবনে অনেক কিছুর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। প্রথম দিকে ভাবতাম, হয়ত আস্তে আস্তে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমার জীবনটা যে সংসারের চার দেয়ালের মাঝে বন্দি থাকার জন্য নয়, সেটা আফজালের নিশ্চয়ই বুঝতে পারার কথা।
কিন্তু পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপের দিকেই যেতে থাকে। আফজাল শিক্ষিত পরিবারেই ছেলে। আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই আধুনিকমনষ্ক। ওর পরিবার থেকে আমার লেখাপড়ার ব্যাপারে কোন বাধাই ছিল না। কিন্তু যত বাধা সব ছিল আফজালের মনে। কেমন যেন খুঁতখুঁতে সন্দেহপ্রবণ হয়ে যেতে থাকে ও দিনে দিনে। আমার ভাল রেজাল্ট সত্ত্বেও ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে এপ্লাই করতে দেয় না। নানান কথা বলে নিরস্ত করে। ভার্সিটির অধ্যাপনা নাকি মেয়েদের জন্য ঠিক সুবিধার না। অনেক রকম মানুষের সাথে মিশতে হয়। আমি নাকি পেরে উঠবো না। হাস্যকর সব কথাবার্তা।
ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখেছি পি,এইচ,ডি করার। সেটার নামও আর মুখে আনতে পারি না। আমাদের ডিপার্টমেন্টের মতিন স্যার আমাকে উনার সাথে কাজ করতে বলেন। একটা রিসার্চ ওয়ার্ক। কিছু অনারিয়ামও অফার করেন। আমি প্রস্তাবটা পেয়ে বেশ খুশি হলাম। ভাবলাম শুধু শুধু বসে না থেকে কিছু কাজ শেখা যাবে। আফজাল এই প্রস্তাব শুনেই নাকচ করে দিল। উলটা পালটা কথা বলা শুরু করে দিল স্যারের নামে। আমি বুঝতে পারতাম না, আফজালের সমস্যাটা আসলে কোথায়। বাড়ির বউকে কিছু করতে না দেওয়ার পেছনে শুধুই কি পারিবারিক বাধা ছিল, নাকি সমস্যার গভীরে ছিল অন্যকিছু?’
‘অন্যকিছু মানে?’ এতক্ষণে প্রশ্ন করার সুযোগ পাই।
‘হয়তো ঈর্ষা। স্রেফ ঈর্ষা। আমি যদি ওর চেয়ে এগিয়ে যাই। একদিন আর না থাকতে পেরে কথাটা বলেই ফেললাম। ব্যস, সেদিন থেকেই আমার দাম্পত্যজীবনের যেটুকু সম্ভাবনা বাকী ছিল সেটাও ফুরিয়ে গেল। আসল জায়গায় আঘাত করেছি যে! তারপরও চেষ্টা চলতে থাকে মানিয়ে নেবার। কিন্তু পারি না। ইগোতে আঘাত লাগায় আফজাল এতটাই হিংস্র হয়ে ওঠে যে, আমার গায়ে হাত তুলতেও বাধে না ওর। এটা আমি মেনে নিই না। আমার আমিত্বকে বিসর্জন দিতে হবে এমনতো কথা ছিল না। শেষমেষ একদিন চলে আসি বাবার বাসায়। পছন্দটা আমার নিজেরই ছিল, কিন্তু তবু বাবা-মা দোষারোপ করেন না।
ততদিনে অনেকটা সময় চলে গেছে যদিও, কিন্তু আমি থেমে থাকি না। পরিচিত একজনের কাছে এই সংস্থার খবর পাই। কেন যেন মনে হয় এই ক্ষেত্রটাতে আমি ভাল করতে পারবো। হয়ত এদের দুঃখটাকে অনেকটা বুঝতে পারবো। তারপর ইন্টারভিউ...আস্তে আস্তে আজকের জায়গায় আসা।
এখানে এসে জেনেছি কত বিচিত্র জীবন মানুষের, কতই বিচিত্র না তার গতিবিধি। দুঃখের সংজ্ঞা কত আলাদা একেকজনের কাছে।’
আমি অবাক হয়ে শুনে যাই। জীবন মানুষকে কত অভিজ্ঞতার স্বাদই না গ্রহণ করায়!
‘ জানিস মেহরীন, আমি কোনদিন ভাবিনি আফজাল এমনটা করতে পারে। ও না খুব রোমান্টিক ছিল! আমাকে প্রতি দু’দিন পরপর একটা করে কবিতা লিখে পাঠাতো। কবিতার সিডি গিফট করত। একই শহরে থেকে প্রতিদিন দেখা হওয়া সত্ত্বেও প্রতিদিন চিঠি লিখতো। আরো কতরকম পাগলামি করতো।’
আমি চমকে তাকাই মোটুসির দিকে। ও কি এই কথাগুলো বিশেষ কোন কারণে আমাকে বলছে? আমার ভেতরটা দেখতে পাচ্ছে না তো মৌটুসি?
‘তুই পি,এইচ,ডি করছিস, খুব ভাল লাগল দেখে। কোথায় আমিও তোর সাথে ডাটা সংগ্রহ করতে আসবো, সেখানে দ্যাখ আমিই তোর প্রধানতম ডাটা হয়ে গেলাম। হা হা...’
দু’জনে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। পাশের ঘরটা থেকে মহিলাদের টুকটাক কথা ভেসে আসছে। ছেঁড়া ছেঁড়া অর্থহীন কথা। টুকরো হাসি। চাপা কান্না। আমাদের মৌনতা যেন আর সবকিছুকেই ছাপিয়ে গেল।
চার
ডাটা সংগ্রহ প্রায় শেষের দিকে। ইচ্ছে ছিল প্রফেসরকে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে বাংলাদেশ সফর আরো একমাস দীর্ঘ করবো। মন চাইলো না। বাবা-মা’র অনুনয় মাখা চাহনীকে জোর করে পাশে ঠেলে ব্যাগ গুছাতে বসলাম। মিতুলের চোখ-মুখ কাঁদোকাঁদো। সে বাংলাদেশে আরো কিছুদিন থাকতে চায়।
কিন্তু আমার ভীষণ মনে পড়ছে একজনের কথা। এত তীব্রভাবে ওকে কোনদিন অনুভব করেছি কিনা আমি জানি না। হঠাৎ মজা করার জন্য আবিদকে ফোন দিলাম। এখন আমেরিকায় রাত দু’টা তিনটা তো হবেই। ভীষণ ঘুমজড়ানো কণ্ঠে আবিদ ফোন ধরে বললো,
‘ তোমার কি দেশে গিয়ে মাথা নষ্ট হয়ে গেছে? কত রাত এখন বল তো? আমার ঘুম নষ্ট করলা?’
‘ ঘুম ভেঙ্গে গেলে এক কাজ কর। আমার ক্লযেটে একটা ভাল কবিতার সিডি আছে দেখ, শিমুল মোস্তফা’র। দারুণ লাগে রাতের বেলা শুনতে। শুধু শুধু বিছানায় শুয়ে থেকে কি করবা বল, ঘুম না আসলে?’
আমি আর অযথা রিস্ক নিলাম না। কট করে ফোনটা কেটে দিলাম।