বর্ষানুরাগ

বর্ষা (আগষ্ট ২০১১)

তান্নি
  • ৫০
  • 0
  • ৯৬
সিডি প্লেয়ারের সাউন্ডটা ক্রমশ বাড়ছে, বাড়াতে হচ্ছে, না বাড়িয়ে উপায় নেই, বৃষ্টির জোরালো শব্দে কিছু শোনা যাচ্ছেনা। সাউন্ড না বাড়ালে গান শুনে মজা পাওয়া যায় না। কিন্তু সাউন্ডটা যদি মায়ের কানে যায় নির্ঘাত বকুনি খেতে হবে। কিন্তু বৃষ্টির সাথে এ গানটা শোনার মজা মিস করা যাবেনা। এমন মূহূর্তে কোনো কিছুকে পাত্তা দেয়া চলেনা। আর সাত পাঁচ না ভেবে সিডি প্লেয়ারের ভলিউমটা সম্পূর্ণ বাড়িয়ে দেয় মৃত্তিকা। খোলা জানালার গ্রীলে মাথা রেখে পা দুটোর নিচে বালিশ দিয়ে ঝুলিয়ে রাখে। খাটের উপর বিছানো আকাশী এবং সাদা রঙ্গের চাদরটার সাথে মিশে যেতে চাইছে শরীর। প্রচন্ড বৃষ্টির ঝাপটা খানিক পর পর আলিঙ্গন করছে তার সাথে। অন্যরকম শিহরণে আবিষ্ট মৃত্তিকার শরীর। দুচোখ বুজে ঠোট বাকিয়ে একচিলতে হাসি ঝুলিয়ে রাখল মুখে। বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে সিডি প্লেয়ারে বেজে চলছে অতি হালকা সুরের একটি গান - I know your eyes in the morning sun, I feel you touch in the pouring rain......... how deep is your love,I really mean to learn...|। গানটির সাথে সাথে ঠোট মেলায় সে। এই শিল্পীর নাম জানা নেই মৃত্তিকার। এই মূহূর্তে গানটি অসাধারণ লাগছে তার কাছে। গানের অর্থটা সত্যিই অনুভব করার মতো। এমন ভালোলাগাটা মৃন্ময়ের সাথে শেয়ার করা দরকার। গ্রীল থেকে মাথাটা তুলে সোজা হয়ে উঠে বসে সে। চুলগুলো ভিজে স্যাতস্যাতে হয়ে গেছে। চোখের পাপড়িতে গর্জিয়াস করে দেয়া বেগুনী রংয়ের ওয়াটারপ্রুফ মাশকারার রংটা বৃষ্টির পানিতে ভিজে চোখ দুটো আরো চমৎকার লাগছে। ড্রেসিংটেবিলে বসে চুলগুলোতে দ্রুত চিরুনী চালিয়ে নেয় একবার। ড্রয়ারে রাখা মোবাইলটা হাতে নেয় মৃন্ময়কে কল করবে বলে। হাতে নিয়ে নাম্বার ডায়াল করার পূর্বেই বেজে উঠল মোবাইলটা। স্ক্রীনের দিকে তাকাতেই স্যারের নাম ভেসে উঠল। পল্লব স্যার ফোন করেছেন।। মৃত্তিকার গৃহ শিক্ষক। কী ব্যপার এ সময় স্যারের ফোন! এ সময়তো স্যারের ফোন করার কথা নয়! তাছাড়া বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কখনোইতো ফোন করেননা স্যার। নানারকম প্রশ্ন ভীড় করে মৃত্তিকার মনে। তবে কী এমনি কথা বলার জন্য....! এটা ভাবতেই কেমন যেন আনন্দে নেচে উঠে মনটা। দ্রুত রিসিভ করে কোমল স্বরে সালাম দেয় মৃত্তিকা।
ঃ হঁ্যা, ওয়ালাইকুম, হ্যালো মৃত্তি তুমি কী ফ্রি আছ?
ঃ হঁ্যা স্যার, আমি একদম ফ্রি, বলুননা স্যার, ভালো আছেন আপনি? প্রবল উৎসাহে কথাগুলো বলে মৃত্তিকা।
ঃ হুমম আছি ভালো। শোনো, তুমি পারলে খাতাটা আর কলমটা একটু নাওতো। এবার একটু হকচকিয়ে গেল মৃত্তিকা। তার অতি উৎসাহের লাগামটা যেন কেউ সজোরে টেনে ধরেছে। মৃদু স্বরে প্রশ্ন করে, কেন স্যার?
ঃ শোনো, আমি আগামী তিনদিন পর্যন্ত পড়াতে আসতে পারবোনা। স্যারের একটু কাজ আছে। তোমাকে বলে দিই যে তুমি কোন কোন অধ্যায়ের পড়াগুলো দেখবে। এমন একটা মূহুূর্তে এরকম অপ্রত্যাশিত কিছু কথা শুনে কেমন যেন চুপসে গেল মৃত্তিকা। সত্যিই তো স্যার এবার ও বিশেষ প্রয়োজনেই ফোন করেছে। আন্তরিকতা কিংবা কোনরকম মমত্ত্ববোধ থেকে নয়। শুধুমাত্র দায়িত্ববোধের তাগিদে মৃত্তিকাকে ফোন করেছে স্যার। এমন কী একবারও জানতে চাইলনা যে মৃত্তি তুমি কেমন আছ?
ঃ কী হল মৃত্তি, মন খারাপ? চুপ করে আছ কেন?
ঃ না স্যার, বলুন আপনি। নীরস কন্ঠে বলে মৃত্তিকা। দ্রুত হাতে পড়ার টেবিল থেকে খাতা আর কলমটা নিয়ে টুকটাক লিখে নেয় স্যারের দেয়া পড়াগুলো। তারপর ফোন রেখে দেয়। মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল। স্যার কী একবার ও বলতে পারতোনা যে মৃত্তি তুমি কী করছো এখন, কী ভাবছো? সেটা বললেওতো অনেক কিছু পাওয়া হতো তার। এ কথাটা দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা বলে কী বলা যায়না? ইচ্ছা করে না হোক, অন্তত সৌজন্যতার খাতিরে। স্যার কখনো মৃত্তিকাকে 'মৃত্তিকা' বলে ডাকে না। ডাকে মৃত্তি বলে। আর এটা অনেক ভালো লাগে মৃত্তিকার। মৃন্ময়কে ফোন করার ইচ্ছেটা নিভে গেছে। এখন আর কথা বলতে ভালো লাগবেনা তার। তারপর ও অনিচ্ছা সত্ত্বে ফোন দেয় মৃন্ময়কে। রিসিভ করতেই শুধু শোঁ শোঁ একটা শব্দ হচ্ছে। মৃন্ময় নিশ্চয় পথে আছে। কিছু শোনা যাচ্ছেনা। রাগে লাইনটা কেটে দেয়। তখনো বিরামহীন বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে। ছুটে গিয়ে জানালার গ্রীলের ফাকে হাত দুটো বাড়িয়ে দেয়। গুন গুন করে বলে; I wanna feel you in my arms again, and you come to me... On a summer breeze keep me warm in your love, then you softly leave, and its me you need to show................................

দুদিন ধরে টানা বর্ষন, শহরের নীচু নীচু প্রতিটা বিল্ডিংয়ের দেয়াল টপকে প্রায় এক দেড় হাত পানিতে ডুবে গেছে বাসার ভেতরটা। চারদিকে হৈ চৈ। এমন সিটি এলাকায় ও ইলেকট্রিসিটি ঘন ঘন আসা যাওয়া করছে। একেবারে দিচ্ছেনা বললেই চলে। যথোপোযোগী চার্জের অভাবে চার্জলাইটগুলো প্রায় নিভু নিভু। পড়াতে কিছুতেই মনোনিবেশ করতে পারছেনা মৃত্তিকা। মোমবাতির আলো একেবারে অসহ্য লাগে তার। চার্জলাইটের এমন আবছা আলোতেও পড়া সম্ভব নয়। বৃষ্টিটা সত্যিই বেশ উপভোগ্য। ভীষন আরামদায়ক। কিন্তু যাদের ঘরের ভিতর পানি ঢুকে গেছে তারা নিশ্চয় খুব কষ্টে আছে। একা শুধু নিজের ভালোলাগাটা ভাবলে স্বার্থপর বলেই ধরে নিতে হবে। যাক, তারপরও মনটা খুব ফুরফুরে। মৃন্ময় গাধাটা কি বাসায়? নাকি বৃষ্টির মধ্যে টোঁ টোঁ করছে আল্লাই জানেন। একটা খবর নেয়া উচিৎ। এই বলে কল দেয় মৃন্ময়ের নাম্বারে।
ঃ হ্যাঁ, কি খবর মৃত্তিকা, রিসিভ করা মাত্রই অভ্যাসবশত কথাটা বলে মৃন্ময়।
ঃ খুবই ভালোরে, জানিস, বৃষ্টি আমার ভীষন প্রিয়। কিযে ভালো লাগে, বৃষ্টি মানেই আমার কাছে অন্যরকম কিছু ভালোলাগা, অন্য রকম কিছু স্মৃতি। Romance has been elegantly defined as the off spring of fiction and love... চোখ বন্ধ করে কথাগুলো উচ্চারণ করে মৃত্তিকা।
ঃ এসব কিরে মৃত্তিকা?
ঃ বেঞ্জামিন ডিসরাইলির লেখা। সুন্দর না কথাগুলো? উচ্ছাসে ভরপুর কন্ঠে বলে মৃত্তিকা।
ঃ সত্যি কথাগুলো ভীষন সুন্দর, তারচেয়েও সুন্দর তোর বলার ভঙ্গিটা। রিয়েলি সো সুইট ইউর ভয়েস........
ঃ থাক, এভাবে আর বলতে হবে না। সবচেয়ে মূল কথাটা কি জানিস, প্রকৃতিকে ঘিরে তোর প্রত্যেকটি অনুভূতি প্রকৃতির মতোই স্বচ্ছ ও সুন্দর হবে। তোর ভালো লাগবে, আন্ডারস্ট্যান্ড?
ঃ ইয়েস ম্যাম, আচ্ছা তুই বর্ষাকাল খুব ভালোবাসিস তাই না?
ঃ হুমম! আষাঢ়-শ্রাবন বর্ষা, মনে জাগায় হর্ষা...........
ঃ বাহ! চমৎকার বলেছিস, আচ্ছা তোর বর্ষামূখর দিনের মনে দোলা দেয়া অন্যরকম কিছু স্মৃতির গল্প শোনাবি আমাকে?
ঃ কি শুনবি? স্মৃতি মানেই তো উঠোন ভর্তি কাদা, জমে থাকা বৃষ্টির জলে কাগজের নৌকা ভাসানো। টিনের ফুটো ভেদ করে ঘরের ভেতর তীব্র ধারার অবাধ বিচরণ। হারিকেনের মৃদু আলোতে মেঘের তর্জন গর্জনের শঙ্কিত প্রতীক্ষা।
ঃ তারপর...............! অস্ফুট স্বরে বলে মৃন্ময়।
ঃ তারপর ঝুপঝাপ বৃষ্টি ঝরা বিকেল বেলা। ছিপছিপে গড়নের মসৃন লম্বা বড়শীর ছিপ। হাটু অব্দি কাদার ভিতর মাছ ধরার নেশায় ঝপাৎ ঝপাৎ লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে চলা। বাদাম গাছের শুকনো মরা ডাল মাথায় দিয়ে মাছ ধরার নামে ডিগবাজি খেলা আরো কত কি.........!
ঃ সত্যিই অভূতপূর্ব। তুই অনেকটা প্রাপ্ত বয়ষ্কদের মতোই কথা বলছিস। তুই তো বৃষ্টি অনেক পছন্দ করিস । আচ্ছা তুই কি কোনো বৃষ্টির দিনেই জন্ম নিয়েছিলি? হেসে প্রশ্ন করে মৃন্ময়।
ঃ তুই কিভাবে জানলি?
ঃ It must have been a rainy day, when you were born... but it was not really rain. actually the sky was crying, because it lost his most beautiful angel. Understand?
ঃ হুম! ভালোই বলতে শিখেছিস, ছোট্ট করে হেসে উত্তর দেয় মৃত্তিকা।
ঃ তোর মনটা খুব ভালোরে মৃত্তি....
ঃ কী বললি তুই মৃন্ময়? হঠাৎ এবার একটু বিচলিত হয়ে উঠে মৃত্তিকা।
ঃ বললাম তোর মনটা খুব ভালো.....
ঃ না না তুই আমাকে কী বলে যেন ডাকলি?
ঃ মৃত্তি বলে ডাকলাম, কেন কী হয়েছে তাতে?
ঃ নারে কিছু হয়নি। ঐ নামে আমাকে শুধু একজনই ডাকে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মৃত্তিকার।
ঃ কে ডাকে তোকে এ নামে?
ঃ কে ডাকে সেটা জানতে চাসনা, আমি বলতে পারবোনা। শুধু বলবো মৃত্তি নামে শুধু ওই ডাকবে আমাকে, আর কেউনা। আবেগে রূদ্ধ হয়ে আসে মৃত্তিকার বন্ঠস্বর, বুকের ভেতর কষ্ট গুলো গলার কাছে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।
ঃ খুব ভালোবাসিস তাকে তাইনা? বিস্মিত স্বরে জানতে চায় মৃন্ময়।
ঃ জানিনা। বলে থেমে যায় মৃত্তিকা। চোখের সামনে ভেসে উঠে পল্লব স্যারের মুখটা। লুবনা নামের এক কলেজ বান্ধবীকে ভালোবাসে পল্লব স্যার। মৃত্তিকাকে পড়ানোর ফাকে সময় পেলে লুবনার সাথে কথা বলে পল্লব। তাদের মধ্যে ঘনঘন এস এম এস আদান প্রদান হয় মৃত্তিকার চোখের সামনেই। আর কিছু ভাবতে পারেনা মৃত্তিকা। স্বগত স্বরে নিদায় নেয় মৃন্ময়ের কাছ থেকে। বেশ অবাক হয় মৃন্ময়। এতো শক্ত মেয়েটা? কেউ জানেই না যে এতো প্রাণোচ্ছ্বলতার আড়ালে কাওকে অজান্তে ভালোবেসে ফেলেছে? এমন কী মৃন্ময়কে ও জানায়নি যে সে কাকে ভালোবাসে।


সকাল থেকে ল্যান্ড ফোনটা বেজেই চলেছে। মোবাইল সুইচট অফ রেখে ও শান্তি নেই। ভোর থেকেই কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করছে ফোনটা, এবার একটু বিরক্ত হল মৃত্তিকা। টানা তিন চারদিন বৃষ্টি হওয়াতে পরিবেশটা বেশ শীতল। ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজে একটা চাদর গায়ে দিয়ে বেশ আরাম করে ঘুমাচ্ছিল সে। কিন্তু এ বিরক্তিকর জিনিসটা তা আর হতে দিল না। শুধু একটু আরামে ঘুমানোর জন্য মোবাইলটা সুইচট অফ করে রেখেছিল সে। কিন্তু কোনো লাভ হলনা তাতে। বরং সকাল থেকে ফোনটার বিদঘুটে ক্রিং ক্রিং শব্দে রীতিমতো মাথা ব্যথা অনুভূত হচ্ছে হালকা। বাসায় কেউ নেই নাকী? আপু, আম্মু কোথায় গেলে তোমরা? প্রচন্ড বিরক্তিতে জোরে জোরে হাঁক ছাড়ে মৃত্তিকা। রান্না ঘারের কাজ ফেলে দৌড়ে মেয়ের কাছে ছুটে আসেন মৃত্তিকার মা শায়লা।
ঃ কীরে কী হয়েছে? অমন চিৎকার চেচামেচি করে সারা বাড়ি মাথায় তুলছিস কেন? কপালের ঘাম মুছে জানতে চান তিনি।
ঃ সকাল থেকে ফোনটা বাজছে, কেউ রিসিভ করছনা কেন?
ঃ করেছিলাম, তোর ফোন এসেছিল। গ্রামের বাড়ী থেকে মিতু ফোন করেছিল, তোকে আর তোর আপুকে বাড়ীতে পাঠানোর জন্য বার বার অনুরোধ করছিল আমাকে।
ঃ তুমি কী বলেছ? আনন্দে গদ গদ স্বরে বলে মৃত্তিকা।
ঃ কী বলেছি মানে? এমন ঘোর বর্ষায় গ্রামের বাড়ী যাবি? মাথা খারাপ? বিরক্ত কন্ঠে বলেন মৃত্তিকার মা শায়লা।
ঃ কিছু হবেনা মা! তুমি তো জানো কত দিন গ্রামের বর্ষা দেখা হয়নি। আমার কিছু হবেনা। তোমার মনে পড়ে মা ছোট বেলায় যখন গ্রামে থাকতাম, ঘোর বর্ষায় ঝুম বৃষ্টি হলেই আমার জামিল কাকু কদমফুল হাতে ভিজে জুবু থুবু হয়ে আমাদের দরজায় দাড়িয়ে থাকতেন। কখন আমি গিয়ে কাকুর গলা জড়িয়ে ধরবো এ অপেক্ষায়। হাত ভর্তি কদম ফুল নিয়ে বসে যেতাম সাজগোজ করতে। মনে পড়ে মা.........!
ঃ হুম, মনে পড়বেনা কেন? থাক, মিতুকে ফোন করে বলে দিও যে, এখন যেতে পারছনা। তারপর ফ্রেশ হয়ে খেতে এসো, অনেক বেলা হয়ে গেছে।
ঃ আম্মু প্লীজ, আমার তা না হলে মন খারাপ হয়ে যাবে, বলে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে মৃত্তিকা। এবার একেবারে নরম হয়ে যান শায়লা। হাত বুলান মেয়ের মাথায়। মেয়ের মন খারাপ হবে এমন কিছু তিনি করতে চান না। প্রয়োজনে কোন বিষয়ে তিনি সন্তব্য করবেন না, তারপর ও মেয়ের ভালো লাগেনা এমন কোন কাজে তিনি কখনো সমর্থন করেন না। এ ক্ষেত্রে ও মেয়ের আব্দারে তিনি আপত্তি করলেন না। শুধু কোমল কন্ঠে কললেন যে,
ঃ দেখো মামনি, সামনে তোমার এইচ এস সি ফাইনাল পরীক্ষা, তাছাড়া নিয়মিত তোমার স্যারও আসবেন। আর এ সময় বাড়ীতে গেলে তোমাকে কমপক্ষে দুটি রাত ওখানে কাটিয়ে আসতে হবে। এবার তুমিই বলো, যাওয়াটা কী ঠিক হবে? আরেকটা কথা, সামনে কিন্তু তোমার আপুর ও মাষ্টার্সের পরীক্ষা শুরু। এবার তুমিই স্থির করো তুমি কী করবে। একনাগাড়ে কথা গুলো বলে দম নেন শায়লা।
ঃ তুমি ভেবোনা, আমি পারবো মা, আমার সো কিউট মাম' বলে মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় মৃত্তিকা। মেয়ের শিশুসুলভ আচরণে হেসে উঠলেন মা। সত্যিই মেয়েটা এখনো এতটুকু বড় হয়নি। সেই শৈশবের চঞ্চলতা, দুরন্তপনা, কোন কিছুরই পরিবর্তন ঘটেনি। সেই ছোট বেলার মতো এখনো সুযোগ পেলে ভাইবোনদের সাথে খনুসুটিতে মেতে উঠে। মায়ের অনুমতি পেয়ে আর অপেক্ষা করেনা মৃত্তিকা। ফোন অন করে কল করে মিতুকে।
ঃ হাই মিতু!
ঃ কীরে সেই সকাল থেকে কল করছি ফোন কেন ধরছনা আপি। মোবাইলও বন্ধ করে রেখেছ।
ঃ সরি রে, ভুল হয়ে গেছে, এখন বল কখন আসব? কাল না পরশু?
ঃ সত্যিই তোমরা আসছ?
ঃ হুমম কেন বিশ্বাস হচ্ছেনা?
ঃ না তা নয়, জেঠি মাম্মা বলেছিল তোমাদের নাকী আসা সম্ভব হবেনা। আর এজন্যই আমি জেঠিমাম্মাকে বোঝানোর জন্য তোমাকে বার বার বিরক্ত করছিলাম। সত্যি তুমি আসবে এটা ভাবতে আমার কীযে মজা লাগছে আমি বোঝাতে পারছিনা। আপি যাই আম্মুকে বলে আসি। আনন্দে কন্ঠস্বর পাল্টে যায় মিতুর।
ঃ এই শোন ছোট মাম্মা কেমন আছেরে?
ঃ আমি এখন রাখছি। সবাই ভালো আছে। ও আরেকটা কথা তুমি আসার সময় মৃন্ময় ভাইয়াকে আসতে বলবে? দ্রুত কন্ঠে বলে মিতু।
ঃ মাথা খারাপ! মৃন্ময় কী ভাবে যাবে? সবাই কী ভাববে? হেসে উত্তর দেয় মৃত্তিকা।
ঃ তোমাকে একটা কথা বলবো আপি, কিছু মনে করবেনাতো? একটু ইতস্তত স্বরে বলে মিতু।
ঃ হুমম! বলনা। এতো দ্বিধা করার কী আছে?
ঃ তুমি আর মৃন্ময় ভাইয়া তোমরা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসো তাইনা?
ঃ হুমম, কেন?
ঃ না এমনিতে বললাম। আচ্ছা কে আগে প্রেমে পড়েছে, মৃন্ময় ভাইয়া না কী তুমি?
ঃ মানে? ওতো আমার সবচেয়ে একজন ভালো বন্ধু। এ বেষ্ট ফ্রেন্ড, নাথিং মোর এলস। বুঝলি?
ঃ ও শুধুই তোমার বন্ধু? কিছুটা বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল মিতু।
ঃ হঁ্যা। শোন, আর পাকামো করিসনা। এবার বেশ জমিয়ে পল্লী বর্ষা উপভোগ করবো কী ভাবে সেটা পরিকল্পনা কর।
ঃ তুমি আজো কারো প্রেমে পড়নি আপি? কাওকে ভালোবাসোনা? মৃত্তিকার কথাকে কর্নপাত না করে দুষ্টুমির ছলে বলে মিতু। এবার কেমন যেন চুপ হয়ে যায় মৃত্তিকা। একটু থেমে বলে বলে। না পড়িনি। শোন এবার কিন্তু ঝুম বৃষ্টিতে দারুণ করে ভিজব। এই বলে হা হা হা করে হেসে উঠে মৃত্তিকা। হাসির আড়ালে কীযেন ছোট ব্যথাটাকে ধামাচাপা দিতে গিয়ে হোচট খেল সে। নীরবে ফোনের লাইন কেটে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে বসে ভাবতে চেষ্টা করে বাড়ীতে কাটানো বর্ষামুখর দিন গুলোর স্মৃতি। নিমিশেই মনটা অন্যরকম ভালোলাগায় ভরে ওঠে। এবারে অনেক মজা করবে সে, প্রকৃতির অঝোর বারি ধারায় ভেজাবে শরীর। ভেজাবে অস্থির চিত্তটা। আর সেই সি্নগ্ধ বারিধারায় ধুয়ে যাবে হৃদয়ের যতো অপরসীম আকুলতা।........


সন্ধ্যা ৭টা। বিদু্যত নেই বাসায়। চার্জলাইটের আলোতে স্যারের মুখোমুখি বসে স্যারের দেয়া পড়াগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে মৃত্তিকা। মাথায় কিছু ঢুকছেনা। বাড়ীতে যাবার পরিকল্পনাটা ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। বেতের চেয়ারটাতে পা দুলিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা ম্যগাজিন দেখছেন স্যার। মৃত্তিকার আজ পড়ায় মোটেও মন নেই। ইচ্ছে করছে বাড়ীতে যাবার আনন্দ অনুভূতিটা স্যারের সঙ্গে শেয়ার করতে। চুপচাপ পল্লব, শুধু জানতে চাইল পড়া শেষ হয়েছে কীনা।
ঃ না স্যার, শেষ হয়নি। একটা কথা বলবো স্যার? আমতা আমতা করে প্রশ্ন করে মৃত্তিকা।
ঃ হঁ্যা বলো, ম্যাগাজিন থেকে চোখ না তোলে বলে পল্লব।
ঃ না মানে স্যার আগামীকাল আমি বাড়ী যাবো। দু তিন দিন থাকতে হতে পারে ওখানে।
ঃ কী জন্য? এই বৃষ্টি বাদলের দিনে গ্রামে গিয়ে কী করবে? হালকা বিরক্তি নিয়ে বলে পল্লব।
ঃ বর্ষাযাপন করবো স্যার পল্লীবর্ষা। জানেন স্যার কবি জসিমউদ্দিন এর পল্লী বর্ষায় বর্ণিত গ্রামের মতোই আমাদের গ্রামটা। হিজল ফুল, বনের কৃমার আরো কতো কী? কথার খৈ ফুটে মৃত্তিকার মুখে। এবার ম্যগাজিন থেকে মুখ তোলে পল্লব। পরিপূর্ন দৃষ্টি রাখে মৃত্তিকার দিকে। একটু পর মুচকি হেসে বলে, সামনে না তোমার পরীক্ষা। বৃষ্টিতে ভিজে অসুখ টসুখ বাধিয়ে বসলে কী হবে ভেবে দেখেছ?
ঃ কিছু হবেনা স্যার। আমি ঠিকই ভালো করতে পারবো ইনশাআল্লাহ, তাছাড়া বাড়িতে গেলে আমার মনটা ভীষন ভালো হয়ে যাবে। টিনের চালের রিমঝিম শব্দ, বৃষ্টি জলে সস্নান করার নিবিড় মূহুূর্ত গুলো ক্যামেরায় বন্দী করবো। দুর্বাঘাসের কোলে শুয়ে মেঘ থেকে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির ফোটা গুলোর অকৃত্রিম ছোয়ার আলিঙ্গন কে হারাতে চায় বলুন স্যার। স্যারের চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলে মৃত্তিকা। ঠোটের কোণে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে রেখে গভীর দৃষ্টিতে মৃত্তিকার চোখে চোখ রাখে পল্লব। মনে মনে কিছুটা অবাক হয় সে। সত্যিই অন্যরকম মেয়েটা। অনেক পরিপাটি, আর শিশুর মতোই চঞ্চল।
ঃ স্যার বৃষ্টি কী আপনার ভালো লাগে? উৎসুখ দৃষ্টিতে প্রশ্ন করে মৃত্তিকা।
ঃ তোমার বর্ণনা শুনে ভালো লাগছে।
ঃ সত্যিই স্যার, বৃষ্টি আপনার ভালো লাগে? একরাশ উচ্ছ্বাসা ঝরে পড়ে মৃত্তিকার চোখে মুখে।
ঃ হুমম ভালো লাগে। মৃত্তিকার দিকে তাকিয়েই মৃদু স্বরে কথাটা বলে পল্লব। ভালোলাগার অন্যরকম শীতল স্রোত বয়ে যায় মৃত্তিকার শরীরে। স্যারের সাথে কখনো এতক্ষণ কথা বলার সুযোগ সে পায়নি। স্যার কখনো ভালোভাবে কথা বলেনি তার সাথে। কিন্তু আজ! মনে হচ্ছে এই মূহূর্তে সে সবচেয়ে সুখী। গভীর ভালোলাগার দৃষ্টিতে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে স্যারের দিকে।
ঃ কী ভাবছো? স্যারের ডাকে সম্বিত ফিরে পায় মৃত্তিকা।
ঃ সবচিন্তা আপাতত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। তুমি আমার ভালো একজন ছাত্রী। পড়াশোনাটা ভালোভাবে চালিয়ে নাও। অনেক বড় হও তুমি। এই বলে আস্তে করে মৃত্তিকার কাঁধে হাত রাখে পল্লব। সারা শরীরে শীহরন খেলে যায় মৃত্তিকার। অদৃশ্য ভালোবাসার অনুভূতিতে অজান্তে বুজে আসে দুচোখ। রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে সারা মুখে। ক্রমশ কাঁপছে চোখের পাতাদুটো। খুব ইচ্ছে করছে তার কাধে রাখা স্যারের হাতটা ধরতে। একটি বার ........ মৃত্তি, ভালো করে পড়াটা শেষ করে ফেলো, মৃত্তিকার কাধ থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলে পল্লব। চুপচাপ মৃত্তিকা। একটু পর আস্তে করে বলে, আজ থাক স্যার। অন্যসময় বেশী করে পড়ব। আজ আমি ভীষন খুশী। মাথা দুলিয়ে হড়বড় করে বলে মৃত্তিকা। আর কোনো কথা বলেনা পল্লব। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। মনের গভীরে আনন্দের তুফান উঠেছে মৃত্তিকার। প্রেম আর খুশীর ঘূর্নিবলয়ে ইচ্ছেগুলো বাধন হারা হয়ে উঠেছে। আনন্দ চিত্ত্বে বারবার দুহাত বুকে ছোয়ায় আর এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে পল্লবের চলে যাবার গন্তব্যের দিকে।


ঘুম ভাঙ্গতেই ঘড়ি জানিয়ে দিল সকাল আটটা বাজার সংবাদ। তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে বোনের রূমের দিকে ছুট দেয় মৃত্তিকা। মৃত্তিকার বড় বোন হৃদ্দিকা সবে সকালের নাস্তা করে আবার একটু শুয়েছে। রাত জেগে পড়ার কারনে খুব বেশি ক্লান্ত লাগছিল বলে। তা ছাড়া এমন ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজে শুধু ঘুম পাচ্ছে তার। ঠিক সময় ছুটে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে হৃদ্দিকার গায়ের উপর পড়ে মৃত্তিকা। 'কীরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিস? কয়টা বাজে মনে আছে? বাড়ী যাবিনা? হাঁপাতে হাঁপাতে কথাগুলো বলে মৃত্তিকা। গায়ের উপর জোরে হুমড়ি খেয়ে পড়ার কারনে খুব বিরক্ত হয়েছে হৃদ্দিকা।
ঃ শোন মৃত্তিকা, বিরক্ত করিসনা। আচ্ছা, হুমড়ি খেয়ে গায়ে পড়া এটা কোন ধরনের স্বভাব তোর? আমাকে একটু বলবি? মহা বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে ঝাঁঝালো স্বরে কথগুলো বলে হৃদ্দিকা।
ঃ আগে কখনো পড়েছি? ঘুমাচ্ছিলি বলে আবোল তাবোল বকছিস। যাই হোক, তাড়াতাড়ি ওঠ। বাড়ী যাবো। ছটফট উত্তর মৃত্তিকার।
ঃ শোন মৃত্তিকা, তোর কী এমন শখ হয়েছে বলতো যে এখন গ্রামে যাবি! জানিস ওখানের কী অবস্থা? কাদায় ভরপুর চারদিক....।
ঃ এটাইতো মজা, গেলেই বুঝতে পারবি কতো মজা। এখন ওঠনা ভাই।
ঃ ঠিক আছে, উঠছি, কিন্তু আবার বৃষ্টি আসবে কীনা কে জানে, সারারাত ধরে অবিরাম বৃষ্টি ঝরেছে। এখন দেখ আবার চারদিক কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে। আবারো আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামবে নিশ্চয়.... হৃদ্দিকার কথায় বাইরে চোখ রাখে মৃত্তিকা। সত্যিই আকাশ জুড়ে কৃষ্ণমেঘের মেলা বসেছে। ঠান্ডা হিমেল হাওয়ার তুমুল ঝড় বৃষ্টির পূর্বাভাস। সারারাত ও কী বৃষ্টি হয়েছিল আপু? কিছুটা বিস্মিত কন্ঠে বলে মৃত্তিকা।
ঃ বুৃষ্টি মানে? যাকে বলে অঝোর ধারার বর্ষন। আর তুইতো কিছু জানিসনা। নিশ্চয় নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলিস? আর এখন উঠে আমার ঘুম নষ্ট করা হচ্ছে তাইনা? মৃদু হাসি চেপে বলে হৃদ্দিকা।
ঃ ফালতু কথা রাখতো এখন। উঠে রেডি হয়ে নে। বৃষ্টি শুরু হলে আবার আম্মু বের হতে দেবেনা। জলদি কর। এবার বাধ্য হয়ে শোয়া থেকে উঠতে হয় হৃদ্দিকাকে। না উঠে উপায় নেই। এবার দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে বসে পড়ে মৃত্তিকা। মায়ের হাতের গরম ভাপ উঠা গলদা চিংড়ির সাথে নুডলস করা বাটিটা নিজের দিকে টেনে নেয়। কোনো কিছু না ভেবে গপাগপ সাবাড় করে ফেলে সব। অদূরে দাড়িয়ে মেয়ের কান্ড দেখে মুখ টিপে টিপে হাসেন মৃত্তিকার মা শায়লা। খাওয়া শেষ করে ঝটপট ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে পড়ে সে। ড্রয়ার খোলে সাজগোজের জিনিসগুলো সব নামিয়ে নেয়। বাড়ীতে যাবার সময় খুব সুন্দর করে সাজবে সে। সোনালীর উপর টিয়া রঙ্গের কাজকরা একটা সালোয়ার কামিজ পড়ে সে। ওড়নাটা শাড়ীর মতো করে পিন করে দেয়। সরু আকৃতির ছোট্ট একটা হালকা সবুজ রংয়ের পাথরের সেট গলায়, কানে ও হাতে পড়ে নেয়। চোখের কোল জুড়ে সযত্নে আইলাইনারের অাঁলপনা আকে। পাপড়ি দুটিতে গাঢ় বেগুনী রংয়ের মাশকারা গর্জিয়াস করে লাগাতে ভুল করে না সে। সোনালী আর সবুজ আইশ্যাডোতে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে ডাগর চোখ দুটো। হালকা গোলাপী রংয়ের ব্লাশনে আলতো করে অধর বুলিয়ে দেয়। খয়েরি রংয়ের লিপলাইনারে নিপুণভাবে ঠোট আকে। অতঃপর লিপগ্লসের ব্রাশ চালিয়ে নেয় ঠোটে। এবার চোখ রাখে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। সত্যিই অচেনা লাগছে নিজেকে মৃত্তিকার। এমন রূপে নিশ্চয় কোন কঠিন হৃদয়ের পুরুষ ও গলে যাবে। নির্ঘাত প্রেমে পড়ে যাবে তার। এমন কী মৃন্ময়ের মাথাটাও নিশ্চয় ঘুরে যাবে। যদিও গাধাটা একজনকে মন দিয়ে বসে আছে। মনে মনে ভেবে হাসে মৃত্তিকা। ড্রেসিং টেবিল থেকে উঠে ফোন দেয় মৃন্ময়কে। মৃন্ময় কল রিসিভ করা মাত্রই গদ গদ কন্ঠে বলে : জানিস মৃন্ময় আমি কী করছি?
ঃ আমি কী করে জানবো আজব? হেসে বলে মৃন্ময়।
ঃ গ্রামের বাড়ী যাচ্ছি। অনেক সুন্দর করে সাজগোজ করেছি। জানিস?
ঃ হুমম, নিশ্চয় খুব সুন্দর লাগছে? আমি দেখতে পাচ্ছি কল্পনায়, কিন্তু ম্যাডাম, এই ঘোর বর্য়ায় গ্রামে গিয়ে কী করবেন শুনি?
ঃ বর্ষা বলেইতো যাচ্ছি। যাই হোক, পরে কথা বলবো, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ঃ কী আজব ব্যপার, ফোন করলি আবার এখন রেখে দিচ্ছিস বাড়ীতে যাবার খবরটা জানিয়েই? আজব একটা মেয়ে তুমি মামা।
ঃ হুমম, এটা জানানোর জন্যই ফোন করেছিলাম। হাসি মুখে উত্তর দেয় মৃত্তিকা।
ঃ ঠিক আছে ' বলে লাইন কেটে দেয় মৃন্ময়। একটু পরেই রেড়ি হয়ে মৃত্তিকার পাশেএসে দাড়ায় তার বড়বোন হৃদ্দিকা।
ঃ কীরে তোর হয়েছে? নাকী এখনো সাজুগুজু করছিস? খোচা মারা ভঙ্গিতে বলল হৃদ্দিকা।
ঃ হুমম! হয়েছে। দেখতো আপু আমাকে কেমন লাগছে? এই বলে হৃদ্দিকার মুখোমুখি দাড়ায় সে।
ঃ হুমম! মাশাআল্লাহ,আমার বোনটাকে অসাধারণ লাগছে। এবার চল। বাইরে গাড়ী দাড়িয়ে আছে।
ঃ আপু, রিঙ্ায় করে যাওয়া যাবেনা? আব্দারে ভরপুর স্বরে বলে মৃত্তিকা।
ঃ ভালোইতো হতো, কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। ভাইয়ার গাড়ী বাইরে অপেক্ষা করছে।
ঃ ওমা গাড়ী ও যোগাড় করে ফেলেছ ইতিমধ্যে? চোখ বড় করে বলে মৃত্তিকা।
ঃ তো কী! বসে থাকব? আমার কাজ হল ঝটপট। আর কথা বাড়ায়না মৃত্তিকা। তড়ি ঘড়ি মাকে বিদায় জানিয়ে গাড়ীতে উঠে বসে। ঘন মেঘের ভীড় ক্রমশ সূর্যের আলো ম্লান করে দিচ্ছে। প্রবল বর্ষনের শঙ্কিত মুখে মেয়েদের কে বাড়ীর উদ্দেশ্যে বিদায় জানান মৃত্তিকার মা শায়লা.........


দুপুর বেলা খাওয়া শেষ না হতেই প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়া শুরু হল। বাতাসের তুমুল গতিবেগে শনপাতার চালগুলো উড়ে যাবার উপক্রম। বেড়ার ছোট্ট রান্না ঘরটাতে মাটিতে পাটি বিছিয়ে খেতে বসেছিল সবাই। খাওয়া শেষ করে একটু গল্প গুজব করবে বলে চাচাত ভাইবোন সবাইকে নিয়ে পা টেনে বসেছিল মৃত্তিকা। অমনি জোরে বাতাস শুরু হল। সেই সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির ঝাপটা।
ঃমিতু, ঝড় আসছে প্রচন্ড ঝড়, তোর আপুদের নিয়ে ভেতরে যা, গলা উচিয়ে বলেন মৃত্তিকার ছোট চাচী। সবাই মিলে একসাথে ভেতরের রুমে চলে আসে। একতলা মাটির ঘর মিতুদের, টিনের তৈরী ছাদ। রান্নাঘরটা বেড়ার তৈরী। অনেক পুরনো আমলের। শনপাতার চালা দেয়া। বৃষ্টি বেশি হলে বিভিন্ন স্থান থেকে পানি পড়ে। ছোট বেলায় অনেক দেখেছে মৃত্তিকা। যে দিক দিয়ে পানি পড়তো সে দিকে মা একটা বালতি কিংবা ডেকচি বসিয়ে দিতো। ঠিক আগের মতো একই রকম আছে রান্না ঘরটা। ভীষন মজা লাগছে মৃত্তিকার। ভেতরের রূমে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় মৃত্তিকা। অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করছে তার ভেতর। বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে হৃদ্দিকা। মৃত্তিকার কাধে হাত রেখে বসে আছে মিতু। সেও বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। মৃত্তিকারা বাড়ীতে ঢোকার পর থেকে তাদের কাছ থেকে একমূহুূর্তের জন্য ও নড়েনি মিতু। বৃষ্টি আর বাতাস একাকার হয়ে ঝড়ে রুপান্তরিত হয়েছে নিমিশেই। এক একটা বাতাসের গতিতেই টিনের ছাদগুলো অদ্ভূত রকম শব্দ করছে।। সেই শব্দে ক্ষনে ক্ষনে ভয় পেয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে মিতু। এসবে বেশ মজা পায় মৃত্তিকা।
দুষ্টুমীর ছলে বলে, কীরে ভয় পাচ্ছিস, নাকিরে পাগলী।
ঃ হুমম, ভয় পাবোনা! আমি কী এখনো বড় হয়েছি? ঠোট বাকিয়ে বলে, মিতু।
ঃ উঁহু, ক্লাস টেনে পড় আর তুমি বড় হওনি তাইনা? ভেংচি কেটে হেসে ফেলে মৃত্তিকা।
ঃ হুমম, তাতে কী?
ঃ তাতে কী মানে? কদিন পরেই কারো কাধে ঝুলে পড়বি, বউ হবি...........
ঃ এঁ্যা, আগেতো তুমিই বউ হবে। এবার ক্ষেপে যায় মিতু।
ঃ ঠিক আছে বাবা, দেখা যাবে, এখন শুয়ে পড়ি কিছুক্ষণ। উদ্বেল আনন্দে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে দুবোন। ্ি#৭১৩;্নগ্ধতার আবেশে বুজে আসে দুচোখ।


প্রচন্ড মেঘের গর্জনে ঘুম ভেঙ্গে মৃত্তিকার। ভয়ে পিলে চমকানোর মতো অবস্থা তার। একাধারে বৃষ্টির শব্দ জোরালো ভাবে কানে ঠেকছে। টিনের গায়ে বৃষ্টি পড়ার শব্দটা বেশ ভালো লাগছে। একটু পর পরই বজ্রপাতের শব্দ হচ্ছে। বাইরে অন্ধকার। এখন ঠিক সময় কতো বোঝা মুশকিল। পাশে ঘুমন্ত চাচাত বোন মিতুকে জাগাতে চেষ্ট করে সে। পায়ের গোড়ালিতে সুড়সুড়ি দিতেই লাফিয়ে উঠে বসে মিতু।
ঃ কীরে আপি বজ্রপাত হচ্ছে নাকিরে? অবাক কন্ঠে বলে মিতু।
ঃ হুমম, ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে তুমুল ভাবে। মৃত্তিকার কথা শেষ হতে না হতেই জোরে কোথাও বজ্রপাতের বিকট শব্দে আৎকে উঠে দুজন। সেই সাথে ইলেকট্রিসিটিও উধাও। নিকষ অন্ধকারে ডুবে গেছে ঘরটা। প্রচণ্ড ভয়ে মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরে মিতু। অন্ধকারের মাঝে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে বিজলির আলো। ভয়ে চুপসে আছে দুজন। এবার নীরবতা ভেঙ্গে মৃত্তিকা বলে উঠে, চল রান্না ঘরে গিয়ে দেখি চাচী কী করছেন। আর কোনো কথা না বলে উঠে দাড়ায় মিতু।
ঃ আপু কী এখনো শুয়ে আছেরে মিতু?
ঃ না। মনে হয় মায়ের কাছে। তুমি বস। আমি একটু আসি। এই বলে দৌড়ে রান্না ঘরের দিকে ছুটে যায় মিতু। একটু পরেই ফিরে আসে একটা হারিকেন হাতে। আবার পা বাড়ায় রান্না ঘারের দিকে। মৃদুভাবে জ্বলছে হারিকেনটা। মৃদু আলোতে হাত ঘড়িটার কাঁটা জানিয়ে দেয় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বাজার সময়। দুর হতে কোথাও ভাজা চাউলের লাড্ডুর সুঘ্রান লাগছে মৃত্তিকার নাকে। অসাধারন স্বাদের মিষ্টি সেঘ্রান। মাটিতে বিছানো শীতল পাটির দিকে চোখ পড়ে মৃত্তিকার। নিশ্চয় দুপুরে একটু গড়িয়ে নেবার জন্য পাটিটা বিছিয়ে ছিলেন চাচী। যাক, ভালোই হল। মনে মনে চাচীকে ধন্যবাদ জানায় সে। হারিকেনের আলোটা কমিয়ে দিয়ে পাটির উপর গুটি সুটি হয়ে বসে পড়ে সে। এমন ঝড় বৃষ্টির সন্ধ্যাটা তাকে চুম্বকের মতো আকর্ষন করছে। নানান গল্প গেঁথে যাচ্ছে মনের ভেতর। ছোট বেলায় একটা গল্প পড়েছিল সে। গঁ্যাদার মা বুড়ির গল্প। গঁ্যাদার মা বুড়ির বাড়িতে গিয়েছিল দবির মিয়া। তখন ছিল তুমুল ঝড় বাতাসের রাত। গঁ্যাদার মায়ের কুচকানো গালের ভাঁজ পড়া চামড়া দেখে দবির মিয়ার মনে পড়ছিল পুরনো কথাগুলো। ছোট্ট হারিকেনের আলোতে পা টেনে পান চিবোতে চিবাতে দবির মিয়াকে বলল গঁ্যাদার মা, কিগো নয়া দামানের কী পিরিতের ভাব উঠছে। অমন ভাবে রইলা ক্যান। বুড়ির কথার দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ করেনা দবির। সে ভাবে অন্য কথা। কিশোরী বয়সে গঁ্যাদার মায়ের পেটে কে যেন মানুষের বীজ ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। সেই বীজটাই আজকের গঁ্যাদা। যে সময় পেলেই সিগারেট আর জুয়ার পসরা সাজিয়ে বসে........... এতটুকু ভেবে ফিক করে আপন মনে হেসে ফেলে মৃত্তিকা। গঁ্যাদার মা বুড়ির জীবন কাহিনীটা খুবই অশ্লীল। ভাবতে গা শির শির করে উঠে মৃত্তিকার। "আপু তোমাকে আম্মু ডাকে, মিতুর ডাকে চমক ভাঙ্গে মৃত্তিকার। উঠে পা বাড়ায় রান্না ঘরের দিকে। চুলায় কী যেন চড়িয়েছে চাচী, অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। চুলার পাশে গাছের ডিব্বার উপর মিট মিট করে একটা কুপি জ্বলছে। এক কোনায় গাছের পিড়িতে পাশাপাশি বসে আছে হৃদ্দিকা ও মিতু। রান্নাঘরের বিভিন্ন স্থানে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন সাইজের বালতি ও গামলা। চালের ফুটো দিয়ে অবিরাম পানি পড়ছে সেগুলোর ভেতর।
ঃ ছোট মাম্মা, এই রান্নাঘরে কী এখনো বৃষ্টি হলে আগের মতো পানি পড়ে? কিছুটা বিস্ময়ের সঙ্গে চাচীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মৃত্তিকা।
ঃ হঁ্যারে আম্মু, বলতে পারিস আগের চেয়ে বেশীই পড়ে। চুলা থেকে হাড়ি নামাতে নামাতে উত্তর দেয় মৃত্তিকার চাচী।
ঃ ওটা ঠিক করছনা কেন? পূনরায় প্রশ্ন ছুড়ে মৃত্তিকা।
ঃ ঠিক করলে কী আর এভাবে পানি পড়তো? আর পানি পড়ছে বলেই কিন্তু তুই মজা পাচ্ছিস। দুষ্টুমীর ছলে বলে মৃত্তিকার চাচী। ঠিকই বলেছে চাচী। ভীষণ মজা পাচ্ছে মৃত্তিকা। এবার রান্না ঘরের দরজা খুলে চৌকাঠের বাইরে দাড়ায় সে। চাল ছুয়ে ছুয়ে পড়া পানির জোরালো ধারায় হাত বসিয়ে দেয়।
ঃ মৃত্তিকা, চলে আয়, বজ্রপাত হলে ভয় পাবি, চলে আয়, হাঁক ছাড়ে হৃদ্দিকা।
ঃ আপু আমার কীযে ভালো লাগছে তোকে বোঝাতে পারবোনা.... চেচিয়ে উত্তর দেয় সে।
ঃ এনাফ ইজ এনাফ। চলে এসো। কঠোর শাসনের ভঙ্গিতে বলে হৃদ্দিকা। এবার আর কোন কথা বাড়ায় না সে। বাধ্য শিশুর মতো ঘরে ঢুকে বোনের পাশে গুটি সুটি হয়ে বসার চেষ্টা করে। এমন সময় হঠাৎ আচমকা বাতাসে নড়ে উঠে ঘরের চালটা। কুপিটা গড়িয়ে পড়ে নিভে যায়। ভড়কে যায় মৃত্তিকা।
ঃ কিরে আপি ভয় পেয়েছো? অন্ধকারের ভেতর হেসে বলে উঠে মিতু। এসময় একসাথে হেসে উঠে হৃদ্দিকা ও চাচী।
ঃ কীরে, কী হবে এখন? বলে উঠে মৃত্তিকা।
ঃ কিছু হবেনা। এই নাও অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে কাঠাল বিচি আর দেশী শিমের বীচি খাও। আম্মু চুলায় তাওয়া দিয়ে ভাঙ্গছে। এখনো গরম ধোয়া উঠছে। দেখো ভীষন সুস্বাদু। মৃত্তিকার কোলের উপর একটা বাটি তুলে দিয়ে বলে মিতু। চুপচাপ খোসা ছাড়িয়ে কাঠল বীচির টুকরো মুখে দেয় মৃত্তিকা। অমৃতের মতো লাগছে ভূনা কাঠাল বীচি গুলো।


পুকুর পাড়ের পাইনগাছ দুটোর নীচে কে যেন বসে আছে, মুখটা দেখা যাচ্ছেনা। কোকড়া চুলগুলো দেখে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে মৃত্তিকার। মুখ ফিরিয়ে বসে আছে লোকটা। প্রচন্ড কৌতুহলে কাছে যেতেই ইলেক্ট্রিক শকড্ লাগার মতোই চমকে উঠে সে। চাপা গর্জে উঠে বলে,
ঃ স্যার আপনি? মুখ ঘুরিয়ে মৃত্তিকার বিস্ময়ে ভরপুর দুচোখে চোখ রাখে পল্লব। ঠোটের কোনে ঝুলছে চিরচেনা মুচকি হাসিটা। নিষ্পলক চেয়ে আছে দুজন দুজনের দিকে। কারো মুখে কথা সরছেনা।
ঃ আমাকে এখানে দেখে আবাক হওয়ার কী আছে? তোমার সাথে কী আমি থাকতে পারিনা? আমার লক্ষী ছাত্রীটা গায়ের সহজ সরল প্রকৃতিতে এসে বর্ষা যাপন করবে আর আমি দেখবোনা, তাকি হয়? নীরবতা ভেঙ্গে বলে উঠে পল্লব।
ঃ না মানে, আমার কেমন যেন বিশ্বাস হতে চাইছে না স্যার আপনি এখানে? আমাদের গ্রামের বাড়ীতে? একই রকম বিস্ময় নিয়ে বলে মৃত্তিকা।
ঃ বোকা মেয়ে, কিচ্ছু বোঝেনা। বোঝেনাতো বোঝেনা, ভালোবাসাটা ও বোঝেনা। আজো এতটুকু বোধশক্তি হয়নি মেয়েটার। ভুলেও ভাবেনা যে একটি ছেলে তাকে ভালোবাসে।........... বিড় বিড় করে বলে পল্লব। বিদু্যতের মতো অজানা অনুভূতির ঢেউ খেলে যায় মৃত্তিকার সারা শরীরে। বুঝতে পারছেনা এসব কী হচ্ছে, বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে আসে কন্ঠস্বর। সারা শরীরে এতটুকু শক্তি নেই নড়াচড়া করার। ভাষাহীন দুটি চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে পল্লবের দিকে। কাছে এসো, পাশে বসো আমার। ভালোবাসার সনিগ্ধ আবেগে ছুয়ে যায় পল্লবের কথাগুলো। অদৃশ্য চুম্বক আকর্ষনে স্যারের পাশে বসে পড়ে মৃত্তিকা।
ঃ তুমি আমাকে ভালোবাসো মৃত্তি? মৃত্তিকার চোখে চোখ রেখে বলে পল্লব। চুপচাপ মৃত্তিকা। প্রত্যাশার গোপন দ্বারের তালা খুলে অসীম আকাশের সন্ধান বুঝি খুজে পেল চঞ্চলা কিশোরীর মন। প্রানহীন স্বপ্নরা প্রান ফিরে পেল। দুরন্ত ইচ্ছার বাধাহীন ছুটে চলা কারো ছায়ায় হয়ে উঠেছে ছন্দময়। দুচোখ বুজে হাত বাড়িয়ে জোরে বলতে ইচ্ছে করছে আই লাভ ইউ...........
উচ্ছ্বল পায়রার মতো কিশোরীর অনূভূতি জানিয়ে দেয় পল্লবকে কতোটা ভালোবেসে ফেলেছে মৃত্তিকা। কৈশোরে সতেজ প্রেমে কতোটা জড়িয়ে ফেলেছে তাকে.............।
পেছন থেকে আলতো করে মৃত্তিকার কাঁধে হাত রাখে পল্লব। তারপর কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে বলে, অনেক ভালোবেসে ফেলেছো বুঝি আমাকে.....?
পরম নির্ভরতায় পল্লবের কাধে মাথা রেখে বলে, তোমাকে যে আমি বর্ষার মতোই ভালোবেসে ফেলেছি....... পল্লব জানে বর্ষাকে কতোটা ভালোবাসে মেয়েটা। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একহাতে জড়িয়ে ধরে মৃত্তিকাকে। মৃত্তিকা নিজেও বুঝতে পারেনি কতোটা ভালোবেসে ফেলেছিল স্যারকে ... পল্লবের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে বলে, পৃথিবীতে যদি কেউ তোমাকে অনেক বেশী ভলোবাসে তারচেয়ে ও বেশী ভালোবাসে এই মেয়েটি। পাগলের মতো, তারচেয়েও বেশি.......... মৃত্তিকার কথায় সজোরে হেসে উঠে পল্লব। হাসিতে দোল খাচ্ছে সারা শরীর......। আপি, এই আপি, কী বলছো বিড় বিড় করে? উঠোনা.......। এবার প্রচন্ড ঝাকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল মৃত্তিকার। হাতে একগোছা কদম ফুল নিয়ে শরীরে ঝাকুনি দিয়ে মৃত্তিকার ঘুম ভাঙ্গানোর চেষ্টা করছে মিতু।
ঃ তুই এখানে! পল্লব স্যার কোথায়? ভ্যাবাচ্যকা খেয়ে প্রশ্ন ছুড়ে মৃত্তিকা।
ঃ কে? কার কথা বলছো? স্বপ্ন দেখছিলে বুঝি! ফিক করে হেসে বলে মিতু।
ঃ স্বপ্ন মানে! আমি কী তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম? হাবাগোবার মতো বলে উঠে মৃত্তিকা।
ঃ হঁ্যাগো! এবার উঠোতো! দেখো কেমন জোরে আবারো বৃষ্টি শুরু হয়েছে। দেখলে এসো, উঠোনে কদম ফুল হাতে দাড়িয়ে আছেন জামিল কাকু। ভিজে জুবুথুবু হচ্ছেন তিনি। কিন্তু বাসায় ঢুকছেননা। তোমাকে ওখানে দাড়িয়ে কদম ফুল দেবে বলে। মিতুর কথায় আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসে মৃত্তিকা। বাস্তবতার মুখোমুখি দাড়িয়ে পল্লব স্যারকে হারাতে ইচ্ছে করেনা তার। স্বপ্ন এতো নিখুত হয়! মৃত্তিকার যুক্তি এলোমেলো করে দেয় স্বপ্নে দেখা পল্লব স্যারের দোল খাওয়া হাসি। বাস্তবে হয়তো স্যারকে কখনো এভাবে কাছ থেকে দেখা হবেনা মৃত্তিকার।
ঃ কীরে আপু উঠবেনা? কী স্বপ্ন দেখছিলে আমাকে বলবে? পূনরায় বলে উঠে মিতু।
ঃ নারে কিছুনা। চল ওঠা যাক। মিতুর হাত ধরে রূম থেকে বেরিয়ে পড়ে সে। বৃষ্টির শব্দে কিছু শোনা যাচ্ছেনা। দ্রুত মুখ হাত ধুয়ে বসে পড়ে রান্ন্া ঘরে বিছানো শীতল পাটিতে। বিনি্ন ধানের খই ফুটিয়েছে মৃত্তিকার চাচী। চিনি দিয়ে খইয়ের মুড়কি বানাতে ব্যস্ত হৃদ্দিকা। খুব ভোরে উঠে চাচীর সাথে নাস্তা করে কাজে লেগে পড়েছে সে।
ঃ কীরে মুখটা অমন শুকনো লাগছে কেন? বোনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে হৃদ্দিকা।
ঃ আরে না, ঘুমের ভেতর কী সব যেন দেখলাম। ভারী কন্ঠে উত্তর দেয় মৃত্তিকা।
ঃ কী দেখলি?
ঃ পল্লব স্যার আমাকে....... এতটুকু বলে থেমে যায় মৃত্তিকা। প্রচন্ড কৌতুহলে মৃত্তিকার দিকে চোখ রাখে মিতু।
ঃ তার মানে, তুমি স্যারকে দেখেছো আপি। চট করে বলে উঠে মিতু।
ঃ হুমম। সংক্ষেপে উত্তর দেয় মিতু।
ঃ আচ্ছা শুনেছিসরে দেশে নাকি এবার বন্যা হবে। তাদের কথার মাঝখানে মৃত্তিকাকে উদ্যেশ্য করে বলে উঠে চাচী।
ঃ কে বলল চাচী? কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলে হৃদ্দিকা।
ঃ কেন খবর শুনিস নি! রেডিওতে নাকি বলছিল। হবার কথা। আজ কয়দিন ধরে বৃষ্টি ধরেছে মনে আছে? আল্লাহই জানে কী হয়! বলেন চাচী। ও, জামিলের সাথে দেখা হয়েছেরে মৃত্তিকা? মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলে চাচী।
ঃ না চাচী এখনো করিনি।
ঃ বলিস কী? ঝুম বৃষ্টিতে পাগলটাকে ও ভাবে দাড়িয়ে রেখেছিস? পাগলটা ও ওভাবে দাড়িয়ে থাকবে, যা তাড়াতাড়ি।
চাচীর কথায় আর দেরী করেনা মৃত্তিকা। ছুটে এসে মিতুকে নিয়ে দরজাায় এসে দাড়ায়। উঠোনের এক কোনে জড়োসড়ো হয়ে গাড়িয়ে আছে জামিল কাকু। বিরামহীন বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হচ্ছে। হাতে ডাল সহ কদমের গোছা। জামিল কাকু ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে? হতবাক হয় মৃত্তিকা। দেরি না করে তুমুল বৃষ্টির মাঝে উঠোনে নেমে পড়ে। কীরে কাকু তুমি? ছোট বেলার মতো কাকুকে জড়িয়ে ধরে বলে মৃত্তিকা।
ঃ কেনরে মা, ছোট বেলার কথা তোর মনে নাই, প্রতিদিন কদম আনতাম তোর জন্য। অহন আর তোরা কাছে নাই। আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসে জামিল কাকুর কন্ঠস্বর। কিছু বলার ভাষা খোজে পায়না মৃত্তিকা। হাতে কদমগুলো গুজে দিয়ে চলে যায় জামিল কাকু। ভিজে একাকার হচ্ছে মৃত্তিকা। দরজার সিড়িতে দাড়িয়ে মৃত্তিকাকে চলে আসতে বলে মিতু। বুষ্টির তীব্র গতিবেগে মিতুকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা। চোখ বুজে দুহাত বাড়িয়ে বৃষ্টিকে আলিঙ্গন করছে মৃত্তিকা। হাটু অব্দি কাদার পানিতে পা ডুবিয়ে দ্রুত তালে চলে আসে তাদের বড় পুকুরটার পাশে। যেখানে পাশাপাশি দাড়িয়ে আছে দুটি বিশাল পাইন গাছ। যেখানটায় বসে পল্লব বলেছিল ভালোবাসি তোমায়। স্বপ্নের মতো স্যার কী কখনো আসবেনা আমার কাছে? কখনোই বুঝবেনা একটি মেয়ে কতোটা ভালোবেসে ফেলেছে তাকে? লুবনা মেয়েটা কী আমার চেয়েও বেশী ভালোবাসে? মেয়েটার কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতর কোথাও যেন ছ্যাৎ করে উঠল মৃত্তিকার। অজান্তে চোখের অশ্রু সাথী হতে চাইছে প্রকৃতির অশ্রুর সাথে। আজ হঠাৎ মন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ভালোবাসার নেশায়। তপ্ত অশ্রু ধুয়ে যায় বৃষ্টির জলে। হিজলের পাপড়িরা দমকা হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে মৃত্তিকার পায়ের কাছে। এতো সুন্দর কেন প্রকৃতি! হঠাৎ কারো স্পর্শে চমকে উঠে মৃত্তিকা। দেখে ছাতা মাথায় হাসিমুখে গাড়িয়ে আছে মিতু। কীরে তুই এতক্ষনে আসলি? মুখ ঘুরিয়ে বলে মৃত্তিকা। পেছনে তাকিয়ে দেখো, মিতুর কথায় পেছনে ঘুরে তাকায় সে। সারি সারি কাগজের নৌকা এগিয়ে আসছে মৃত্তিকার দিকে।
ঃ আরে পাগলী, এসব কী! হেসে বলে মৃত্তিকা। কিছুনা, তোমার জন্য। জানো আপি, আজ নাকি বিকেলে তোমরা চলে যাবে। মুখ গোমড়া করে বলে মিতু।
ঃ কে বলেছে;
ঃ জেঠি মাম্মা ফোন করেছিল. আজ বিকেলে নাকি বৃষ্টি একটু কমলেই তোমাদের পাঠিয়ে দিতে হবে।
ঃ ও আচ্ছা, বলে আর কিছু বলেনা মৃত্তিকা। সে জানে আজ চলে যেতেই হবে। মনের মতো করে বর্ষা যাপন করার সুযোগই হলনা ভালো করে। কিন্তু তারপরও চলে যেতেই হবে। ভাবতে কেমন যেন লাগে। হৃদয়ের কোথাও যেন সজোরে টান পড়ে গ্রাম ছেড়ে যেতে। তারপরও যেতে হয়, যেতে হবে। এটাই নিয়ম। ছাতা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে মিতু। মেতে উঠেছে বৃষ্টিতে ভেজার নেশায়। কাগজের নৌকা গুলো ভাসছে তাদের চারপাশে। দুহাতে মুখ ঢেকে মৃত্তিকা বলে ওঠে; Clouds come flooting into my life, no longer to carry rain or usher storm, but to add color to my sunset sky......


পল পল করে সময় গুলো হারিয়ে যায়। চোখের পলকেই কেটে যায় দিন রাত্রি। যায় দিন, মাস, গড়ায় বছর। হৃদ্দিকার বিয়ের পর বাসাটা কেমন শূন্য হয়ে গেছে। পাল্টে গেছে সব। সেই আগের চঞ্চলতার কাঁচা বয়স পেরিয়ে গেছে মৃত্তিকার। গতানুগতিক ধারার পড়াশুনাটা মাঝে মধ্যে খুবই বিরক্তিকর হয়ে উঠে তার কাছে। কিন্তু কিইবা আছে আর জীবনে! বছর খানেক আগে বিয়ে করেছে মৃত্তিকার পল্লব স্যার। এক ঘোর বর্ষার দিনে বিয়ে করেছে স্যার। বিয়ের দিন সন্ধ্যায় মৃত্তিকাকে ফোন দিয়ে বলেছিল; মৃত্তি, তোমার প্রিয় বর্ষাতেই বিয়ে করছি স্যার। কেমন হলো মৃত্তি! বলে হেসে উঠে ছিল পল্লব। সেদিন শুধু সৃষ্টি কর্তাই দেখেছিলেন কারো হাসির অন্তরালে একটি হৃদয়ের প্রচুর রক্তক্ষরণ। পারিবারিক কাজে মৃন্ময় ও চলে গেছে দেশের বাইরে। কেন এমন হয় প্রকৃতির আচরণগুলো?। গালে হাত দিয়ে বেলকনিতে বসে আছে মৃত্তিকা। এখন বর্ষাকাল নয় তারপর ও ঈশান কোণটা কালো মেঘের আবরনে ঢেকে যাচ্ছে ত্রমাগত। যুবতীর অজানা ব্যথায় প্রকৃতিও বুঝি সমব্যাথি। আজ ভীষন কাঁদতে ইচ্ছে করছে মৃত্তিকার। এরই মাঝে আচমকা বৃষ্টি ঝরতে শুরু হল আকাশ থেকে। বৃষ্টির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয় মৃত্তিকা। একসময় ফুঁপিয়ে উঠে। অশ্রুর বাঁধ নামে দুচোখে। বৃষ্টির শব্দে বোঝাই গেলনা মৃত্তিকার কান্নার মৃদু শব্দটা। বৃষ্টি ঝরছে, সেই সাথে ঝরছে বিরহীনি প্রেমিকার অশ্রু। যেটা শুধু এড়াতে পারেনা পরম অন্তর্যামীর চোখকে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
amar ami গল্প তা আগেই পরেছিলাম অনেকটা .... ভালো হয়েছে ....আরো একটু ছোটো করলে কিছু বর্ণনা বাদ যেত , আর সেই কাঠামোই বেশি ভালো হত মনে হয় .....
সূর্য পড়তে পড়তে ভাবছিলাম ৫০০০শব্দের খাড়ায় পড়ে না আবার অসমাপ্ত থেকে যায়। উপন্যাস আঙ্গিকের গল্প। অনেক ভাল লিখেছ। গল্পকবিতাকে ধন্যবাদ ভোট দেয়ার সুযোগটা রাখায়। নইলে শুধু মন্তব্যই দেয়া হতো।
প্রজ্ঞা মৌসুমী 'একটুকু ছোঁওয়া লাগে,একটুকু কথা শুনি' গল্প পড়তে পড়তে ফাগুনের গানটাই আনাগোনা করছিল ভেতরে...বর্ণনা বর্ষাকে ঘিরেবলেই পড়তে ভালো লেগেছে। গ্রামে বর্ষা উদযাপনের ডিটেইলস ভাল লাগল বেশি। শেষে মৃন্ময়ের কি হলো জানার ইচ্ছে ছিল। একটা ধন্যবাদ পাওনা তোমার আপু! 'I wanna feel you' গানটা শোনাই হয়নি এখনো। গল্পটা পড়েই খুঁজে নিলাম; মুহুর্তেই মুগ্ধ। অজানা শিল্পীদের নামও জানলাম- তিন ভাই Barry Gibb, Robin Gibb & Maurice Gibb। শেষের দুভাই ছিল যমজ। অনেক শুভ কামনা
ম্যারিনা নাসরিন সীমা চমৎকার একটা গল্প । মৃত্তিকার চরিত্র ভাল লাগলো । অনেক অনেক শুভকামনা ।
M.A.HALIM গল্পটা পড়ার কিছু বাকি থেকে গেলো। পরে পড়ব। আপনার লিখার স্টাইল ও মান খুব ভালো। শুভ কামনা রইলো।
মোঃ ইকরামুজ্জামান (বাতেন) বোনTanni @@একেবারে বর্ষার সচ্ছ জলের মতো আপনার গল্পটিও। কিছু ভুলত্রুটি না থাকলে কিন্তু অসাধারণকে হার মানাত....। দোআ করি আল্লাহ আপনাকে কামিয়াবী দান করুক (আমীন) ।
তান্নি প্রজাপতি মন, অনেক অনেক শুভকামনা রইলো....
তান্নি মামুন ম আজিজ ভাই, আমার ক্ষেত্রে সেই ব্যতিক্রমী মন্তব্য এবার থাকলো তাইনা? শুভকামনা রইলো...
বিন আরফান. রাগ করব না কেন বলো ?
তান্নি আজহা ভাইয়া, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে. এমন সুন্দর একটি লেখা দেয়ার জন্য....

০৪ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪