১
কবিতার খাতাটা প্রথমে লুকিয়েছিলাম বাটা কোম্পানির জুতার বাক্সে। পরে কেমন যেন বিবেকে বাধলো। বের করে সেটি রাখলাম তাকের উপরে রাখা বড় ডেকচিটার নিচে, তাতেও খুব নিশ্চিত হতে পারিনি।
ঝুরঝুরে হয়ে যাওয়া জানালার কপাটগুলো দিয়ে মা পাশের বাড়ির মিস্ত্রীকাকুকে দিয়ে তাকটা বানিয়ে নিয়েছিলেন। বছরের বারো মাসই আমাশায় ভুগে মিস্ত্রীকাকুর মেজাজটা এমনিতেই চিড়বিড়িয়ে থাকে।
প্রথমে কাজটা করতেই চাননি। জানতেন যেন কাজ শেষে মা শুধু এককাপ চা আর বেলা বিস্কুট ধরিয়ে দেবেন, হলও তাই। চায়ের কাপ নিয়ে আমিই গিয়েছিলাম, ভয় হচ্ছিল কাকু আবার না কাপটাই ছুড়ে মারেন।
যাহোক, মজুরী পাবেননা- এটা জেনেই কাকু যেন খুব হেলাফেলায় কাজটা করলেন। জিআই তারের বাঁধুনিটা খুব একটা যুৎমতো হলনা।
হাড়ি পাতিল, ডেকচীগুলো সব তোলার পর মা যখন রেশমা আপার পুরনো টেক্সট বইগুলো তোলা শুরু করলেন, তখন তাকটা রীতিমত কোঁকোঁ শব্দে কোঁতাতে থাকলো।
এমন একটা ঝুরঝুরে জিনিষের উপর আর কতোই বা ঠ্যাকা দেয়া যায়! তবে তাক ভেঙ্গে পড়বে- এই ভেবে আমি যতোটা না ভাবছিলাম, তারচেয়ে অনেক বেশী আতংক হচ্ছিল কবিতার খাতা সমেত পাকড়াও হবার কথা ভেবে।
শেষমেশ অবশ্য তাক ভেঙ্গে পরতে হলনা, আমি এমনিতেই ধরা পরে গেলাম।
শুক্রবার এলেই রেশমা আপা প্রায় সময় চলে আসেন। এবার আসার সময় নিজেই বাজার থেকে গরুর মাংস আর পোলাওয়ের চাল কিনে এনেছিলেন।
কাটাকুটি শেষে তাকের উপরের বড় ডেকচিটার দিকে তাকাতেই আমার হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
বাসায় আমরা মোটে দুটি প্রাণী, আপা সহ তিন। দুপুরে আসবেন দুলাভাই। সবমিলিয়ে চারজন। কিন্তু দুলাভাই একাই যে চারজনের সমান, বড় ডেকচিটাতো নামাতেই হত- আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল।
এতো বাড়াবাড়ি না করে খাতাটা যদি স্রেফ অবহেলা করেই টেবিলের উপরে ফেলে রাখতাম, তাহলে হয়তো কেউই সেটি খেয়াল করতোনা।
খাতাটা হাতে নিয়ে রেশমা আপা আমার দিকে এমন তাকালেন- যেন ভয়াবহ রকমের নিষিদ্ধ কিছুর সন্ধান পেয়ে গেছেন, ভ্রূজোড়া বেঁকেচুড়ে হয়ে গেছে ফিসপ্লেট উপরে ফেলা রেল লাইনের মত।
- দেখো ছেলের কারবার! তলে তলে তাহলে এসব হয়! ভালোওবাসা! দিল কি ধড়কান! হমম...
দীঘির ধারে, খুব নিশীথে
নামলো পরী, চাঁদটি ছেড়ে
কান্ত চাঁদও, ছুটল পিছু
উঠলো ভেসে, মুগ্ধ জলে ...
আম্মা! আম্মা...!!!
২
‘আকাশেরও আছে একমুঠো নীল। হ্যাঁ, মুঠোই- তবে সেটি ঈশ্বরের। দেখছোনা, ফাক গলে পড়ে যাওয়া একটুখানি নীলে কেমন ভরাট হয়ে গেছে সাত সাতটি মহাসাগর!’
কবিদের আজকাল খুব দুঃসময় যাচ্ছে। কবি পরিচয় শুনলেই মানুষ যখন তখন শ্লেষের হাসি হাসে, পরিহাস করে। কিন্তু তারাতো জানেনা- একটা কবিতার জন্য কবিকে কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়! একমাত্র কবিরাই বোঝে- কবিতা লেখা কি ভীষণ এক পরিশ্রমের কাজ!
আমার কাছে কবিতা যেন এক ভীষণ পাগলা ঘোড়া। মাথায় তো দিনরাত কতোই ভাবনা আসে, সেগুলোকে কাব্যের ছাঁচে বাঁধতে পারি কই!
সেদিন কবিতার খাতার কথা জানাজানি হয়ে যাবার পর বাসায় ভীষণ হুলস্থূল পড়ে গেল।
বিশাল বপুর জন্য দুলাভাই মাদুরে বসতে পারেননা। আমার পড়ার টেবিলে বসে খপাৎ খপাৎ শব্দে বিরিয়ানি খেতে খেতে দুলাভাই বলেছিলেন-
- কবিতা! সেতো খুব ভালো জিনিষ, মনটাকে চাঙা রাখে। শুধু শরীরের জন্য খাবার হলেই চলবে! মনের খাবার লাগবেনা!
- তুমি চুপ করো! উঁহ... মনের খাবার! খাবার খাবার করেইতো আজ এ অবস্থা! কবিতার মধ্যেও খাবার! আর এইযে কবি! আপনার কবিতার খাতা রইলো আমার কাছে। আপাতত কিছু বলছিনা। ভর্তি পরীক্ষায় আগে ডাব্বা মারেন, তারপর আপনাকে ধরা হবে।
আমি কোনরূপ শব্দ না করেই পাতের বিরিয়ানি শেষ করি। দুলাভাই অনেকদিন ধরেই সংসারটাকে টানছেন, আর বেশীদিন হয়তো পারবেননা, ব্যবসার অবস্থা নাকি ভালোনা।
কবিতার অবস্থা আজ তাই ভীষণ লেজেগোবরে। আমি চোখকান বুজে দিনরাত শুধু পড়াশোনাই করি। লোক দেখানো কিছু নয়, নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই পড়ি।
সংসারের অবস্থা খুব শোচনীয়। পলেস্তরা উঠতে উঠতে দেয়ালের অবস্থা এমন হয়েছে যে সামান্য পেরেক ঠুকলেই তা ধ্বসে পড়বে।
তবে আপাটার বুদ্ধিশুদ্ধি একটু কম। কবিতার খাতা কেড়ে নিয়ে কি কবিতাকে থামানো যায়! কবিতা কি ফুটবল খেলা যে বল কেড়ে নিতেই খেলা বন্ধ হয়ে যাবে!
আজকাল তাই আর খাতায় কবিতা লিখিনা। মনে মনে ভাবি, তারপর সেখানেই তাদের ভাসিয়ে দিই। লাইনগুলো যদি কোন দিন আবার ফিরে আসে তো আসলো। না আসলেও ক্ষতি নেই। চারপাশে কি কবিতার অভাব আছে নাকি!
ঘর থেকে বের হলেই কবিতা, পথে কবিতা, বিদ্যুতের তারে কবিতা। রিকশার চাকা, কৃষ্ণচূড়ার ডাল, ভিক্ষুকের ছেঁড়া কাঁথা... এইযে পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছি, এখানেও ভুরভুর করছে কতশত কাব্য!
কবিতা সবার জন্য নয়, সবাই কবিতা বোঝেনা। কিন্তু যারা কবিতার মত শুদ্ধ একটি জিনিষকে সন্মান করতে জানেনা, তাদের আমার কেন যেন অসম্পূর্ণ মনে হয়।
এই যে আপা সেদিন খুব ব্যঙ্গ করে আমার কবিতার চার লাইন পড়লেন, একটু যদি মনোযোগ দিতেন তবে দেখতেন চার লাইনের পর আর কিছু না পেয়ে সেখানে শুধু সায়ন্তনির নামটাই লিখেছি। এমনটা প্রায়ই হয়, চার লাইনের পর মাথাটা কেমন যেন ভোম্বল হয়ে যায়, এরপর আর কিছুতেই এগুতে পারিনা।
শুধু ওই কবিতাটি নয়, পুরো খাতাতে অসংখ্যবার, নানান ভঙ্গিতে, ইনিয়ে-বিনিয়ে, কারনে-অকারনে সায়ন্তনির নামটি এসেছে। আপা সেটি খেয়াল করেনি, করবে কিভাবে! আপা কি কবিতাকে খেয়াল করার উপযুক্ত কিছু মনে করে!
একটুপর সায়ন্তনি এল। পার্কের লোকজন ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায়। সায়ন্তনির সেদিকে কোন খেয়াল নেই।
আমার যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে। সায়ন্তনি ও আমার মত কবিতা ভালবাসে। তবে কবিতার সন্ধান পেতে ওকে নীলাকাশের দিকে তাকাতে হয়না।
সায়ন্তনি সব সময় হাঁটে মাথা নিচু করে। আকাশের দিকে মাথা তুলে তাকাবার কথাই যেন ওর মনে থাকেনা। তার অবশ্য প্রয়োজনও নেই। চোখ বন্ধ করেই যে আকাশের নীল দেখে, সাগরের গর্জন শুনতে পায়- তার সেসবে চোখ তুলে তাকাবার দরকারটাই বা কি!
দুটো ছেলে খুব বিপদজনকভাবে সায়ন্তনির পাশ ঘেঁষে চলে যায়। আমি জানি এসবে ওর কিছু হবেনা। সায়ন্তনির শুদ্ধতা, ওর হৃদয়মাঝে ধারন করা এক টুকরো নীলাকাশই চারপাশের নশ্বরতা থেকে ওকে আলাদা করে রাখবে।
সায়ন্তনি পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে, অল্প একটু হাসে। তাতেই চারপাশে তুমুল শোরগোল বেঁধে গেল। অন্তরীক্ষে বহুকালের নির্বাসন শেষে একদল বজ্রের মুক্তিলাভ ঘটে গেল পৃথিবীর আকাশে, বয়োজ্যেষ্ঠ গাছগুলোও এ খুশিতে উন্মুক্ত করে দিলো তাদের বহু পুরনো প্রকোষ্ঠগুলো। সবুজ ঘাসেদের মাঝেও তুমুল বিবাদ- সায়ন্তনির পায়ের স্পর্শের জন্য...
সায়ন্তনি কাছে আসলে অবশেষে আমি নিঃশ্বাস নিলাম, খুব সন্তর্পণে। তারপর হাভাতেদের মত করে ওর হাতটি তুলে নিই।
লোকজন চেয়ে আছে, কিছু যায় আসেনা। সায়ন্তনিও অবাক হয়না, আমি নাকি প্রায়ই এমন করি।
- সায়ন! তুমি এতো ঐশ্বর্যময়ী, তার পাশে আমাকে দেখায় বানরের মত। তোমায় আমি কিভাবে ধারণ করি? আর যদি আমি ব্যর্থ হই, তুমি অপেক্ষা করবেতো, আমার জন্য?
সায়ন্তনির ঠোঁটে মৃদু কৌতুকের ভঙ্গী, দৃষ্টির গভীরে চিকমিক করে সময়ের অজস্র কবিতা, রত্নকনা... সাগরের মুগ্ধ হাওয়া।
সেদিকে তাকিয়ে আমি আলতোভাবে বলি- তোমাকে আপাতত ছুটি দিতেই হচ্ছে- কবিতা। আমাকে আরো যোগ্য হতে হবে, যোগ্য থেকে যোগ্যতর – তোমার জন্য, হে আমার প্রেম। সে পর্যন্ত কবিতা থাকলো নির্বাসনে...