কৌটো কাহিনী

স্বাধীনতা (মার্চ ২০১৩)

রনীল N/A UNION ALL SELECT NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL,NULL#
মোট ভোট ৫০ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৬.০৪
  • ১৯
  • ৫৩
পরী বিবির স্মৃতি পুরোপুরি ফিকে হয়ে যায়নি। লোক এখনও মাঝে মধ্যে কথা প্রসঙ্গে পরী বিবির রুপের উদাহরণ দেয়। তবে নওয়াব মহল পরিত্যক্ত হয়ে গেছে বহুদিন হল। যত্নের অভাবে মেঝেতে শ্যাওলা জমেছে, দেয়ালে ইতস্তত অশ্বত্থ। উড়িষ্যা থেকে বানিয়ে আনানো মহার্ঘ সেগুন কাঠের পালঙ্কটার ও অবস্থা প্রায় যায় যায়। এক কোনে সেটি ক্যাঁতরে পড়েছিল যক্ষ্মা রোগীর মত।
পরী বিবির খাস কামরাটা দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই পড়ে আছে। সুপারী বাগানের সাথে লাগোয়া খড়খড়ি জানালাটা দীর্ঘদিন জমাটই ছিল। সময়ের ঘুনপোকারা ক্রমান্বয়ে তাতে চিড় ধরায়। একদিন একটুকরো নবীন রোদ্দুর সেই ফোকর দিয়ে উকি মেরে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। পাশের বর্ষীয়ান সুপারী গাছটা সেটা বুঝতে পেরে সন্ত্রস্ত কিশোরের চোখ চেপে ধরে।
পরদিন খুব প্রভাতে সেই কিশোর রোদ্দুরটি পা টিপে টিপে আবার ফিরে এল, সাথে কজন ভাইবেরাদর।
সারারাত ইনসমনিয়ায় ভুগে বুড়ো সুপারী গাছটা সে সময় অল্প অল্প ডুলছিল। নবীন রোদ্দুরের পায়ের শব্দ শুনে সে বিরক্তভাবে চোখ মেলে চেয়ে দেখে, তারপর পাশ ফিরে শোয়।
এরপর থেকে নবীন রোদ্দুর প্রায় প্রতিদিন নিয়ম করে পরী বিবির কামরায় আসা শুরু করলো। দীর্ঘদিনের আবদ্ধ কামরা প্রানের স্পর্শ পায়। নবীন রোদ্দুর সারাদিন ঘুরে ঘুরে কচি হাতে কামরার আসবাবপত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। পুরোনো রঙচটা পিয়ানোটায় মাঝে মধ্যে টুংটাং শব্দ হয়। সারাদিন-দুপুর পর্যন্ত চলে কিশোর রোদ্দুরের দুরন্তপনা।
বিকেলের দিকে তার দুরন্তপনা কিছুটা কমে আর সন্ধ্যা হলেই সে দলবল সমেত থুড়থুড়ে বটগাছটার ঝুরির ফাঁক দিয়ে ভোঁ দৌড় দেয়।
রোদ্দুরের বিদায়ের পর ধূলিকণার দল ও আর সেখানে থাকার সাহস পায়না। হুড়মুড় করে ওরাও সব দলবেঁধে বের হয়ে আসে, বুড়ো সুপারী গাছটা কাশতে কাশতে অস্থির হয়ে পড়ে...
এরপর রাত নেমে আসলেই সবকিছু একেবারে নিঝুম, সুনসান।
নবীন রোদ্দুর কখনো সেগুন কাঠের সেই পালঙ্কটার নিচ পর্যন্ত যেতে পারেনি। বহুকাল ধরে সেখানটায় কোন প্রানের স্পন্দন কিংবা কম্পন অনুভূত হয়নি। এই যে আটলান্টিক সাগরের তলদেশ- লোকালয় থেকে সেটি কতদূর, কত অনতিক্রম্য, অথচ সেখানেও কত মাছ, বালিকনা কিংবা ক্ষুদ্র শৈবাল দিনরাত ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু নওয়াব মহলের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত পরী বিবির অতি প্রিয় সেগুন কাঠে বানানো পালঙ্কের নিচের জায়গাটির কোথাও এতটুকু আলোড়ন নেই। সময় এখানে একেবারেই বাকহীন, বধির... অর্থহীন।
বহুকাল আগে একবার অবশ্য এক নির্বোধ ইঁদুর কোথা থেকে যেন গটগট করে হেঁটে এসেছিল। পালঙ্কের ঠিক নিচটায় এসে গম্ভীরভাবে কি যেন একটা ভাবলো... তারপর যেমনটা এসেছিল, ঠিক তেমনটাই চলে গিয়েছিল।
আপাতদৃষ্টিতে সেই মাথামোটা ইঁদুরের আগমন-প্রস্থানের চিত্রটি এ গল্পে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে, তবে সেই স্বল্পবুদ্ধির অপরিণামদর্শী ইঁদুরই কিন্তু এ পর্যায়ে আমাদের গল্পের মূল স্তরে প্রবেশ করাবে।
সেদিন সেই ইঁদুরটি তার যাত্রাপথের একপর্যায়ে একমুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল। খালি চোখে ব্যাপারটি অহেতুক কিংবা অকিঞ্চিৎকর মনে হলেও আপনি যদি চোখ কচলে আরেকটু গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করতেন, তবে দেখতে পেতেন পালঙ্কের নিচের জমাট আঁধারের মাঝে একটা অতি প্রাচীন সিলভারের কৌটো পড়ে ছিল।
এরপর দীর্ঘদিন ধরে আবার সবকিছু সুনসান। ইঁদুরটা আর কোনদিন ভুলেও এদিকটায় ফিরে আসেনি। নবীন রোদ্দুর তার যৌবনের সূচনালগ্নেই মেঘের প্রেমে মশগুল হয়েছে। পরী বিবির খাস কামরার প্রতি তার আর কোন আগ্রহ নেই।
বেয়ারা অশ্বত্থের শেকড় ক্রমান্বয়ে জানালার সেই ফোকরখানি বুজিয়ে দিতে থাকে। পরী বিবির খাস কামরা একসময় পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। নবীন রোদ্দুর, শিশু ধূলিকণা কিংবা সেই মুসাফির মূষিকছানা- কেউই আর সেখান পর্যন্ত পৌছুতে পারেনা।
তবে মাঝে মধ্যে খুব নিশীথে পশ্চিমের ঘাট থেকে তরুন বাঁশির সুর দুঃসাহসিক অভিযানে বের হয়ে সেই কৌটোটার ধাতব দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছে যেত, কিন্তু ততদিনে যে সেই নিঃসঙ্গ কৌটোটি একেবারে নিরাসক্ত হয়ে গেছে।
অশ্বত্থের দলও এতোদিনে বুঝে গেছে- এ রাজ্যে তাদের আর কেউ আটকাতে আসবেনা। সর্বভুক রাক্ষসের মত গগনবিদারী উল্লাসে ওরা সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়, সাঁড়াশির মত শক্ত শেকড়ে পিষে ফেলে মহলের বুড়ো ঝুরঝুরে ইটগুলোকে।
মহলের পতন একেবারে আসন্ন হয়ে গেছে, পুরোনো সিলভারের কৌটোটি ও বুঝতে পারে, খুব শীঘ্রই সে চাপা পড়ে যাবে ইট কাঠের স্তুপের নিচে।
মাঝে মধ্যে খুব গোপনে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আক্ষেপ করে। বহুদিন আগে ষোড়শী পরী বিবি কোন এক একান্ত দুপুরে এই কৌটোর ভেতরে এক টুকরো রেশমের রুমাল ভরে রেখেছিলেন, আর সেই সাথেই কৌটোর ভেতর বন্দি হয়ে গিয়েছিল পরী বিবির একটুখানি নিঃশ্বাস, চোখের জল আর আত্মার ছোট একটি অংশ।
এরপর প্রাসাদের পতন হয়েছে দীর্ঘদিন হল, বন্দী নওয়াবকে পাঠানো হয়েছিল আরাকান রাজ্যের জেলে আর পরী বিবি সম্ভ্রম বাঁচিয়েছিলেন প্রাসাদের পাঁচিল থেকে লাফিয়ে পড়ে।
শুধু সিলভারে সেই কৌটোটির কোন মুক্তি নেই, অন্তহীন সময় ধরে সে যেন কিশোরী রাণীর দীর্ঘশ্বাস বুকে ধারন করে বসে আছে।
ফার্সি ঠিকাদার ইমারত পোক্ত করার অভিপ্রায়ে ছাদের মাঝে মাঝে রেললাইনের স্লিপার বসিয়ে দিয়েছিলেন। সেগুলোই আজ প্রকারান্তরে ভীষণ বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাকশক্তিহীন দৈত্যের মত সেগুলো চাপা স্বরে গজরাচ্ছিল।
এমন সময় কামরার পুরোনো ভারী দরজাটা হঠাৎ নড়ে ওঠে, বহুদিনের জমাট নিরবতা ভেঙ্গে যায়।
আধবোজা দরজার একটুখানি ফাক দিয়েই আলতোভাবে কামরায় ঢুকে পড়ে চঞ্চলমতি এক দ্বাদশী। দীর্ঘদিনের পথপরিক্রমাতেও তার মুখশ্রীতে পূর্বপুরুষদের আদলটি অক্ষুণ্ণ থেকেছে। লঘুপায়ে কয়েক তাল নেচেই সে নির্ভুলভাবে পৌঁছে যায় জমাট আঁধারে পড়ে থাকা কৌটোটির কাছে।
নিঃসঙ্গ কৌটোর ধাতব বুকের স্থির বায়ুতে ঘূর্ণন সৃষ্টি হয়। বদ্ধ কামরার জমাট বাতাসে নেচে ওঠে সুগন্ধি রেণুরা। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে, মুক্তি এখন কেবল সময়ের ব্যাপার ...
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিলন বনিক রনীল ভাই...বিজয়ের অভিনন্দন....
সোহেল মাহামুদ (অতি ক্ষুদ্র একজন) ।আপনার লেখার সমালোচনা করার মত ধৃষ্টতা আমার নেই।নবীন লেখক(?) হিসেবে শুধু এটুকু বলব, ''লেখাটি পড়ে অভিভূত ও অনুপ্রাণিত হলাম''
তানি হক অনেক অনেক অভিনন্দন রনীল ভাইকে !
মোঃ কবির হোসেন আপনার গল্পটি হৃদয় ছুয়ে গেল. আপনার লেখার মান আমার কাছে অনেক উন্নত মনে হল. শুভ কামনা সতত. ধন্যবাদ.
কবির ভাই, গল্প পড়ার জন্য ধন্যবাদ... একটা কথা বলি, কিছু মনে করবেননা- যে স্পিডে আপনি লেখা পড়া শুরু করছেন, সাইদ সুমন ভাইয়ের জন্য খুব টেনশন হচ্ছে। এতো গল্প কবিতার যোগান দিতে দিতে উনি আবার না ... :P
পন্ডিত মাহী mobile theke porlam. Vasar kaj darun. Tobe Apni ei dhoroner lekha beshi liksen. Onanno dhoroner lekhao chai. Prem, biroho, adventure, fiction... Vinnota proyojon.
ওস্তাদ... মোবাইল থিকা দিল তোড় দিয়া ... যা হোক, আপনার পরামর্শ মেনে নেক্সট সংখ্যায় একটা চটি স্টাইল গল্প দিছি... দাওয়াত রইলো ...
তাপসকিরণ রায় লেখকের মাঝে ভাবনার অভাব নেই--সে সঙ্গে নেই ভাব ভাষার পরিমিতি--তাই তো প্রকৃতি নিয়ে তার আবাধ খেলা,জড়বস্তু,প্রকৃতি ও ছায়াভাস মানুষ তাঁর হাতে হয়ে ওঠে মুখর--বাঙময় ! এখানেও তাই ঘটেছে লেখক অতীত রাজ ঘরানাকে চিহ্নিত করে অনেকটা যেন নীরব থেকেই স্বাধীনতার ভারসাম্যতার কথা একটি কৌটোকে ঘিরে বলে গেলেন পটুহস্ত লেখনী নিয়ে।লেখককে জানাই অনেক ধন্যবাদ।
তাপস দা, মনোযোগ দিয়ে আমার লেখাটি পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা, ধন্যবাদ ...
সূর্য উপমা সমৃদ্ধ গল্প বা কবিতার সবচে ভাল দিক হলো পাঠক লেখকের আবেগ বা বক্তব্য বুঝুক না বুঝুক সে নিজের মতোই সাজিয়ে নিতে পারে পুরো গল্প বা কবিতা। যেমন ভীরু পায়ে এগিয়ে চলা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যদি "ইদুর" হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা (পুরোনো প্রাসাদ) গ্রাস করে নেয়া ধর্মব্যাবসায়ীর (ডালপালা আর জড় ছড়ানো অশ্বথ গাছ যে সব আলো বন্ধ করে দিচ্ছে কামরায়) রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ঢুকে যায়। আবার শাহবাগ তথা গণজাগরণ (নবীন রোদ্দুর) ও ঢুকতে চায় সেই অন্ধকারের মূলে তখন "দ্বাদশী কিশোরী"র উপমায় যেন লাকি আক্তার তথা জাগরণকেই দেখা যায়। নি:সঙ্গ বদ্ধ কৌটায় বন্দি দীর্ঘশ্বাস আর হারানো চেতনাও দেখা যায় অনায়াসে। গল্প এমন হলে অসাধারণ বলতে কি দ্বিধা করতে হয়?
উপমাগুলোর এমন সুন্দর ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছেন যে আমি বরং আপনাকেই অসাধারণ পাঠক বলে বিশেষিত করবো। আমি মূলত একটু ব্রডার পারস্পেক্টিভ থেকে ভেবেছি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে কিছু দায় বহন করে চলেছি। রাজনৈতিক দলগুলো এসব ইস্যু তাদের নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেন, অপরাধীদের পুনর্বাসন করেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে - যে মত করে ইতিহাসকে বিকৃত করে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করছে আর মূল ইতিহাস/ সত্য গল্পের কৌটোর মত করেই হারিয়ে যাচ্ছে... সত্য কথা বলতে, দ্বাদশী কিশোরীর কথা লেখার সময় লাকি আক্তারের কোন কথাই আমার মাথায় আসেনি, আমি বরং সমগ্র তরুণ প্রজন্মের কথাই ভেবেছি, যারা একদিন কৌটোর ভেতর থেকে ভাগ্যহীনা পরী বিবির নিশ্বাসকে মুক্ত করে দেবে ...
বিন আরফান. স্বাধীন দেশে স্বাধীন চিন্তার বহির্প্রকাশ আমাকে মুগ্ধ করেছে. যতি চিহ্ন ব্যবহারে আরো সতর্ক হতে হবে. ভালো থাকবেন আর ভাবীকে সালাম জানাবেন.
ভাবীরে আপনার সালামের কথা বলছিলাম। উনি কইলেন আগে মশারী টাঙ্গাও... তারপর বাকি কথা ... (কান্দুনের ইমো হইবো!)
oi somoy koite kichhi ? asolei aponar somoy gean nei !
রোদের ছায়া একটা ঘোরের মত লাগছিল , রুপকের ব্যবহার আমি কম বুঝি খালি চোখে যা দেখা যায় সেটাই বুঝি , সেই অর্থেও বেশ ভালো লাগলো গল্পের বুনন আর কাহিনীর বর্ণনা .......অনেক অনেক শুভকামনা ......
গল্পটা আসলে খুব সিম্পল, আমি জটিল কোন ইন্ডিকেশন দিতে চাইনি... বুঝতে পারছিনা কেন পাঠক একে জটিল ভাবছে। যা হোক, গল্পের পাঠক হবার জন্য কৃতজ্ঞতা ...

০৪ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩১ টি

সমন্বিত স্কোর

৬.০৪

বিচারক স্কোরঃ ৩.৫৪ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৫ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অভিমান”
কবিতার বিষয় "অভিমান”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ মার্চ,২০২৪