নীল অক্ষর

ভাঙ্গা মন (নভেম্বর ২০১৯)

মনজুরুল ইসলাম
  • ৫৯
এখনও ভোরের আলো ফোটে নি। রাত্রির অবস্থান মধ্যগগন পেরিয়েছে। চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়েছে প্রকৃতি। কাছে, দূরে, কোথাও কোনো ধরনের শব্দ শ্রুত হচ্ছে না। পিনপতন নীরবতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে পুরো শহরটি। যাত্রাপুর। দেশের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত একটি সম্প্রীতির নাম। এই শহরেই বাস করে আদর। জেগে আছে ও। নিজ কক্ষেই। অনেক চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারে নি গত দুদিন। নিয়ন্ত্রণহীন যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে ওর অন্তঃকরণ। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে খাটের ওপর রাখা একটি চেয়ারে। একদম ফ্যানের মুখোমুখি। ফ্যানের পাখাগুলিতে পুরোনো ময়লা জমে আছে। পাখাগুলির রঙ সাদা হবার কারণে তা অধিকতর স্পষ্ট হয়েছে। বুঝতে পারলো ও। চেয়ার থেকে নামলো। পুরোনো একটি কাপড় দিয়ে ময়লাগুলি মুছবার চেষ্টা করলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুছে ফেললো। বিছানায় রাখা মোটা রশিটি হাতে নিলো। হাতে নিয়েই আবার উঠে দাঁড়ালো। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গভীর ভাবনায় নিমগ্ন হলো। এরপর দৃঢ়ভাবে রশিটি লাগালো পাখার সাথে। লাইটটি বন্ধই ছিলো। কিন্তু চাঁদের আলোয় আঁধারের মাত্রা ততটা ঘনীভূত হয় নি। খোলা জানালার মাঝ দিয়ে ওর কোমল মুখখানিতে এসে পড়ছে মৃদু আলোক রেখাটি। ওর মুখের গড়নটি গোলাকার। গালদুটি মাংসল। থুতনির মাঝখানে পড়া টোলটি মুখের সৌন্দর্যে যোগ করেছে পরিপূণ লাবণ্যের। মসৃণ নাকটি মাঝারি আকারের। চোখের উভয় পাতার চুলগুলি দীর্ঘকায় ও শৃঙ্খলিত। দুটিও অদ্ভুত মোহনীয়। গোঁফ জুড়ে রয়েছে হালকা চুল। তবে এখন পর্যন্ত দাড়ি গজায় নি। চুলগুলি ছোট করে ছাটা। ওর পুরো অবয়বটি প্রত্যক্ষ করলে খুব সহজেই সৌন্দর্যের একটি নিখুত প্রতিচ্ছবিকে আবিস্কার করা যায়। প্রশান্ত চিত্তে গলার মধ্যে ঝুলালো রশিটি। অনেকক্ষণ ধরে রইলো ওভাবেই। ধরে থাকা অবস্থায়ই কিছুটা কাঁপতে থাকলো। পুরো শরীর জুড়ে অনুভব করলো প্রবল উত্তাপ। সেই উত্তাপের সূত্র ধরেই ঘামতে থাকলো। আপনা আপনিই প্রিয় মানুষগুলির প্রতিলিপি ভেসে উঠলো। কোথাও দাঁড়াবার জায়গা নেই আজ। নিশ্চিত হয়েই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে ওকে। ওর দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। মাংসল ফর্সা গাল দুটি সেই অশ্রুতে ভিজে গেছে। এবার হাত থেকে রশিটি ছেড়ে দিয়ে চেয়ারটি সরাতে হবে। প্রস্তুত হলো ও। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই উপভোগ্য। আর সেটি জানবার জন্যেই জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন। প্রসিদ্ধ হওয়া না হওয়া তো আপেক্ষিক ব্যাপার। তাই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যতখানি পারো জ্ঞান অর্জন করো এবং সৃষ্টি করে যাও। বৈষয়িক কোনো কিছু প্রাপ্তির ভাবনায় নিরত থাকলে আর যাই হোক প্রকৃত লেখক হতে পারবে না কোনোদিন।' চারটি দেয়াল। চারটি দেয়ালের প্রতিটি থেকেই যেন প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো কথাগুলি। বিপ্লব ভাই বলতেন কথাগুলি। সবসময়ই। রশিটি হাত থেকে ছেড়ে দেয়া এবং চেয়ারটি সরাবার পূর্ব মুহূর্তে কথাগুলি মনে পড়লো আদরের। আবেগবিহ্বল হয়ে পড়লো। অনেকবারই কথাগুলি বুঝবার চেষ্টা করেছে ও। কিন্তু অনুসরণ করতে পারে নি। শেষবারের মতো কথাগুলির মমার্থ উপলব্ধির চেষ্টা করলো। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকবার কারণে অবর্ণনীয় ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়েছে ও। শরীরজুড়ে অনুভব করলো। এরই মাঝে সূর্যের শুভ্র আভাটি ফুটতে শুরু করেছে। রাত্রির অমানিশা কেটে কিছুটা আলোক ফোঁটা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। হয়ত কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোরবেলার চিরাচরিত দৃশ্যগুলি দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। বেঁচে থাকার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করতে হবে, যাই ঘটুক না কেন বাবাকে খুলে বলতে হবে সবকিছু। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলো আদর। অন্তিম মুহূর্তে এসে কাল বিলম্ব না করে ফাঁসির রজ্জ্বটি গলা থেকে সরিয়ে ফেললো।
মায়ের মুখটি দেখার সৌভাগ্য হয় নি আদরের। সন্তান প্রসবের পরপরই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয়েছিল ওর মাকে। দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি বাবা আহসান হাবীব। সরকারি কর্মকর্তা। দীর্ঘদেহী। গায়ের রংটি বাদামী। হালকা মেদ রয়েছে শরীরে। একমাত্র সন্তানই তার কাছে একটি পৃথিবী। সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবার লক্ষ্যে শুরু থেকে আজ অবধি সব ধরনের প্রচেষ্টা অক্ষুন্ন রেখেছেন। নির্মুম ক্লান্তির পাশাপাশি মানসিক চাপে শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত আদর। খাট থেকে নেমে চেয়ারটি সরালো। বিছানার চাদরটি পরিস্কার করবার ইচ্ছে জাগলেও করলো না। কাপড় পরিবর্তন না করেই কোনোরকমে জানালাটি বন্ধ করে বালিশে মাথা রাখলো। বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হবার পরও যখন ঘুম আসলো না তখন ঢক ঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো। বালিশে মাথা রেখে আবারও চেষ্টা করলো ঘুমোবার। স্বল্প সময়েই চোখ দুটি বুজে এলো। প্রায় এগারটা পর্যন্ত ঘুমিয়েই রইলো ও। রাত জেগে পড়াশুনা করেছে ভেবে বাবাসহ কাজের লোক কেউই ঘুম থেকে ডেকে তুলে নি ওকে। বিছানা ছেড়ে দ্রুততার সাথে তৈরী হলো। নাস্তা করেই যাত্রা করলো বাবার অফিসের দিকে। অসময়ে সন্তানকে দেখে আশ্চর্য হলেন আহসান হাবীব। বাবাকে দেখবার পরপরই ভীতির পাশাপাশি আতঙ্কগ্রস্থ হলো আদর। তার চোখের দিকে তাকাতে না পেরে মাথা নিচু করে রইলো। চুলের এলোমেলো অবস্থাটি দৃষ্টিগোচর হলো বাবার। ময়লা ভাঁজহীন ধূসর রঙের গ্যাবার্ডিন প্যান্ট ও পুরু নীল শার্টটির দিকে তাকাতেই উদ্বিগ্ন হলেন। তীক্ষ দৃষ্টি সহকারে নিরীক্ষা করতে থাকলেন সন্তানের মুখখানি। বুঝতে পারলেন নিশ্চিত কোনো সমস্যা হয়েছে। অফিসের ভেতরে না নিয়ে বারান্দার পাশের ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গেলেন। নিজের স্বভাবসুলভ শান্ত ভঙ্গিটি স্থিত রেখে প্রশ্ন করলেন, বলতো, তোর কী হয়েছে? তোকে এত শুকনো লাগছে কেন? কোনো সমস্যা! অভয় দিয়ে ছেলেকে সমস্যার কথা খুলে বলতে বললেন। বেশ কিছুসময় নীরব থাকবার পর প্রবল শঙ্কা নিয়ে বাবাকে সবকিছু খুলে বললো আদর। সমস্যাগুলি শুনবার পর নিবিড় আলিঙ্গনে ছেলেকে বুকের সাথে লীন করে নিলেন আহসান হাবীব। কোনো ধরনের ক্ষুব্ধতা প্রকাশ না করে বরং বললেন, ‘চিন্তা করিস না বাবা, সব ঠিক হয়ে যাবে।' বলেই ছেলেকে নিয়ে কলেজের দিকে যাত্রা করলেন।
অফিস থেকে কলেজের দূরত্ব সামান্য। দ্রুততার মাঝেই চলে এলেন। প্রিন্সিপ্যাল স্যারের কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো আদর ও ওর বাবা। দরজার কাছেই। আজ ফর্ম পূরণের শেষ তারিখ। উচ্চ স্বরে কথা বলছেন প্রিন্সিপ্যাল স্যার। বাইরে দাঁড়িয়েই শুনতে পাচ্ছে। ওরা। এতজন কর্মচারী আর একটা ফর্ম হারিয়ে গেল বুঝতে পারলেন না। তাও আবার ফাস্ট বয়ের। কী করেন আপনারা? যাকে নিয়ে এত স্বপ্ন, সেই আদরের ফর্মটি হারিয়ে ফেললেন! যেভাবে পারুন খুঁজে বের করুন।' স্কুল, কালো ও মাঝারি গড়নের প্রিন্সিপ্যাল স্যার যখন কথাগুলি বলছিলেন তখন তার দু'গালের মাংসগুলি কেঁপে কেঁপে উঠছিল। পাশাপাশি কপালের ভাজগুলিও দ্রুতই ওঠানামা করছিল। অত্যন্ত স্মার্ট প্রিন্সিপ্যাল স্যার। সবসময়ই পরিপাটি পোশাক পরিধান করেন। বিশেষত শীতকালে কম্পিলিট স্যুট ছাড়া কোনোদিনও অন্য পোশাকে দেখা যায় না তাকে। এই মুহূর্তে ঝলমলে আকাশী রঙের কম্পিলিট স্যুটই পড়ে রয়েছেন। দায়িত্বের প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক তিনি। কলেজের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মানোন্নয়নের ব্যাপারে সবসময় তৎপর থাকেন। একজন শিক্ষার্থীও যেন বিপথে যেতে না পারে সেদিকে সবসময়ই সতর্ক ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যা সমাধানে একজন কাউন্সিলরও নিয়োগ করেছেন। নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ও প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণের তাৎপর্যটিকে শিক্ষার্থীদের মাঝে গ্রন্থিত করবার লক্ষ্যে নিয়মিতভাবে আয়োজন করেন সেমিনার, কর্মশালা ও আলোচনা সভা। শিক্ষার্থীরাও তাদের মানসিক প্রতিবন্ধকতাগুলি কাউন্সিলরের সাথে বিনিময় করে পেয়ে থাকে কাঙ্ক্ষিত সমাধান। ধীরে ধীরে এভাবেই নিজ হাতে যাত্রাপুর কলেজটিকে একটি প্রসিদ্ধ কলেজে পরিণত করেছেন প্রিন্সিপ্যাল স্যার। ফলাফল অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। প্রতি বছরই উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থী বুয়েট ও মেডিক্যাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সুযোগ পায়। এ কারণেই দূর দূরন্তর থেকে অজস্র শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে এখানে। এ কলেজ থেকেই এবার এইচ. এস. সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে আদর। ওর অবস্থান প্রথম। প্রিন্সিপ্যাল স্যারের দীর্ঘদিনের ইচ্ছে-এ কলেজ থেকেই একজন শিক্ষার্থী যেন বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় সারাদেশে প্রথম স্থানটি অধিকার করে। প্রতি বছরই একজন না একজনকে টার্গেট করেন। এবার সেই লক্ষ্য পূরণের কাণ্ডারী হিসেবে বেছে নিয়েছেন আদরকে। কিন্তু ওর ফর্মটিই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকটা সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে আদর ও ওর বাবা। অথচ এই সময়টিতে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবার কথা নয় তাদের। আদর ও ওর বাবাকে দেখে আশ্চর্য হলেন প্রিন্সিপ্যাল। বেরিয়ে আসা তেজোময় উজ্জ্বল চোখ দুটির পুরো প্রক্ষেপ ফেললেন আদরের ওপর। ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ইঙ্গিতে ওদেরকে ভেতরে ডাকলেন। আদরের বাবাকে দেখবার পর কিছুটা বিব্রত বোধ করলেন এই ভেবে যে, তার কথাগুলি শুনতে পেয়েছেন কি না। সোফায় আহসান হাবীবকে বসতে বলে আদরকে নিজের কাছে ডেকে নিলেন তিনি।
বুঝলে আদর, একটা ভুল হয়ে গেছে, তোমার ফর্মটাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চাপা স্বরে বললেন প্রিয় ছাত্রকে।
স্যার, আমি তো টাকাই জমা--------।' এতটুকু শুনবার পর ওকে থামিয়ে দিলেন প্রিন্সিপ্যাল স্যার। কী বলছো তুমি! এই যে তোমার রশিদ। পুরো টাকাই জমা হয়ে গেছে। ' বলেই আদরের হাতে রশিদটি দিলেন। ও তো টাকা জমা দেয় নি। আর এ কারণেই তো এত সমস্যা। এই মুহূর্তে সেটি বলবার জন্যেই তো স্যারের কাছে আসা। বুঝতে পারলো না আদর এটি কীভাবে সম্ভব! অবাক বিস্ময়ে রশিদটি দেখতে থাকলো ও। রশিদে লেখা হাতের অক্ষরগুলি দেখেই চমকে উঠলো। এ তো বিপ্লব ভাইয়ের হাতের লেখা। বুঝতে পারলো যে, তিনিই ফর্ম পূরণের জন্যে নির্ধারিত অর্থটি জমা দিয়েছেন। অবলীলায় ওর অন্তরের কুঁড়িটি ফুটে উঠলো। ফুলেল সুবাসে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়লো হৃদয়বৃত্তে। অনুপ্তের তীর্যক অনুভূতিগুলো বিক্ষিপ্ত হলো পুরো শরীরজুড়ে। বিষয়টি বুঝতে পারলেন আহসান হাবীব। স্পষ্ট হবার জন্য সোফা থেকে উঠে আসলেন আদরের কাছে। রশিদটি দেখে নিজেও অবাক হলেন।
‘স্যার, যদি কিছু মনে না করেন আমি কি ফর্মটা আবার পূরণ করতে পারি।' কথাগুলি বলবার সময় নিভার ভাবটি ফুটে উঠলো আদরের শুকনো মুখে।
“ঠিক আছে দাও। তবে আমরা সত্যি দুঃখিত, আদর। এমনটি প্রত্যাশিত নয়। আমাদের কলেজের রেকর্ডে কখনো এমন হয় নি। তুমি কিছু মনে করো না যেন। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে বললেন প্রিন্সিপ্যাল স্যার।
স্যারের আচরণে ভয়ানক লজ্জা পেল আদর। এমন মার্জিত আচরণ অপ্রত্যাশিত যা প্রিন্সিপ্যাল স্যারের কাছ থেকে সবসময় পেয়ে থাকে ওরা। অবশ্য এ কারণেই প্রিন্সিপ্যাল স্যারের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা বজায় থাকে সবার। ফর্মটি পূরণ করেই বাইরে এসে দাঁড়ালো আদর। প্রিন্সিপাল স্যারকে ধন্যবাদ জানিয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে আসলেন আদরের বাবা। বাবা, বিপ্লব ভাইয়ের কাছে যাবো।' ভাই শব্দটি শুনবার পরই আহসান হাবীব বুঝতে পারলেন সাংবাদিক বিপ্লব সাহেবের কথা। একজন সৎ ও প্রাজ্ঞ সাংবাদিক হিসেবে পূর্ব থেকেই জানতেন তিনি তাকে। তাই আদরের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে আশীর্বাদ হিসেবেই নিয়েছিলেন। সন্তানকে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ থেকে রক্ষা করবার বিষয়টি স্বস্তি প্রদান করলো তাকে। ভাইয়াকে বলো, সন্ধ্যায় তার সাথে আমি দেখা করবো।' বলেই আদরকে রিকশায় তুলে দিয়ে অফিসের দিকে হাঁটতে থাকলেন তিনি। মোহিনী ভুবন রোডের দিকে চলতে থাকলো রিকশা। এ রোডের পাশেই বিপ্লব ভাইয়ের বাসা। এই মুহূর্তে আদরের মস্তিষ্কের কোষগুলোয় দ্রুতই ভাবনার শাখাপ্রশাখাগুলি বিস্তৃত হতে শুরু করলো। অতীত হওয়া দু'বছরের স্মৃতিগুলি ভেসে উঠতে থাকলো। যত বারই স্মৃতিগুলি মনে আসছে ততবারই চূড়ান্ত অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে ও। প্রশংসার পরিবর্তে প্রকৃত সমালোচনাই প্রতি মুহূর্তে পাথেয়-নিজ জীবনের ভেতর দিয়ে অর্জিত অভিজ্ঞতায় উপলব্ধি করতে পারলো ও। বহুবার নিষেধ করেছিলেন বিপ্লব ভাই। কিন্তু তার নিষেধাজ্ঞাকে অগ্রাহ্য করেই কাজটি করেছিল ও। এমনকি কাজটি করবার সময় বিপ্লব ভাই নিষেধ করতে পারে ভেবে তাকে এড়িয়েও চলছিল। অথচ আজ এই মুহূর্তটিতে তাকে দেখবার জন্যে হৃদয়াভ্যন্তরে তোলপাড় সৃষ্টি হচ্ছে ওর। কিছুদিন আগেও প্রতিদিনই দেখা হতো তার সাথে। ভুলটি না করলে হয়ত গতকালও দেখা হতে পারতো। কিন্তু এই স্বল্প সময়ের ব্যবধানই একটি দীর্ঘ সময়ে পরিণত হয়ে এসেছে ওর জীবনে। তার কথা বলবার ধরন, বন্ধুসুলভ আচরণ, আতিথেয়তা, বিরামহীন পরামর্শ সব কিছুই যেন ওর চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে উঠছে। এত বড় মাপের একজন ব্যক্তিত্বকে সে এতদিনেও চিনতে পারে নি - ভাবতেই নিজেকেই নিজে প্রবোধ দিতে থাকলো।
স্বল্প সময়ের মাঝেই মোহিনী ভুবন রোডে চলে এলো আদর। মূল সড়ক থেকে গলির ভেতরে সামান্য দূরত্বে বিপ্লব ভাইয়ের বাসা। গলিপথ ধরে মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকলো। দরজার সামনেই দেখতে পেল বিপ্লব ভাইকে। প্রেস ক্লাবে যাবেন বোঝা যাচ্ছে। আদরকে দেখে অবাক হলেন না তিনি। ও যে তার সাথে যে কোনো মুহূর্তে দেখা করতে আসবে, এটি অনুমিতই ছিল। তাই নিজে থেকেই দু'হাত প্রসারিত করে বুকের গহ্বরে জড়িয়ে নিলেন আদকে। আদরও নিজেকে সমর্পণ করলো সেই মানব বৃক্ষের প্রশান্তময় গহ্বরে। এই মুহূর্তটির জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম রে। আমি সব সময়ই চাইছিলাম, তোর যেন ভালো কিছু হয়। কোনো ভুল পথে যেন তুই জড়িয়ে না পড়িস। আশা করি এখন থেকে নতুনভাবে সব কিছু শুরু করবি, বুঝলি।' বিপ্লব ভাইয়ের মানবিক ঠোট দুটি থেকে বেরিয়ে এলো কথাগুলি। এখনও বিপ্লব ভাইকে শক্ত করে জড়িয়ে আছে আদর। জড়িয়ে ধরা অবস্থায়ই ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। বিষয়টি বুঝতে পেরে আদরকে বুক থেকে ছাড়িয়ে নিলেন বিপ্লব। কাঁদবি না বলছি, বললাম তো নতুন করে শুরু করতে হবে। আর শোন, বিষয়টি একদম হাইড রাখবি, কাউকেই বলবি না। বিপ্লব ভাইয়ের কথাগুলি শুনবার পরেও বেশ কিছুক্ষণ কেঁদেই চললো আদর। বাসার সামনেই। অনবরত স্বাভাবিক করবার চেষ্টা অব্যাহত রাখলেন বিপ্লব ভাই। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠলো আদর। তন্ময় হয়ে দেখতে থাকলো তাকে। যে মানুষটি ওর জীবনের গতিপথ পালটে দেবার ক্ষেত্রে এক প্রভাব সম্পাতি ভূমিকা পালন করেছেন। এর আগে কখনোই এত গভীরভাবে দেখেনি তাকে। এমন করে কী দেখছিস পাগল, ফরগেট দি পাস্ট, এখন চল। হাসিমাখা মুখে আদরকে বলতে বলতে দুজনই হাঁটতে থাকলো সামনের দিকে- অনন্তর এক অসীম শুদ্ধ পথের সন্ধানে।
দুই।
বিপ্লব ভাই। যাত্রাপুর শহরের একটি পরিচিত নাম। দীর্ঘকায়, সরু মুখমণ্ডল, বড় বড় চোখ, ঘন ও সাদা ফ্রেমের চারকোণা চশমা পরিহিত একজন সাধারণ মানুষ। উজ্জ্বল সাদা শার্টের সাথে কালো রঙের কটি পড়েন সবসময়। কখনো কখনো শার্ট ও কটির কালারটি পরিবর্তিত হয়ে থাকে। তবে গায়ের বর্ণটি শ্যামলা হবার কারণে যে কোনো কালারই মানায় তাকে। দীর্ঘ ঘন চুলগুলি কখনোই এলোমেলো হতে দেন না তিনি। মধ্যবর্তী সিঁথির দু'পাশের চুলগুলিকে মনে হয় কোনো বৃক্ষ শাখায় বসে থাকা পাখির ডানার মতো পরিপাটি। শার্টের সাথে গ্যাবার্ডিন অথবা জিন্সের প্যান্ট ইন করে পড়েন তিনি। সাথে কালো জুতো পড়ে থাকেন সবসময়ই। এমন পোশাকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করাই বিষয়টির মূল কারণ। গ্রাম গঞ্জ থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই যাতায়াত করেন এই পোশাকেই। কালো রঙের ব্যাগটি নিতেও ভুলেন না কখনও। একটি জাতীয় পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। একসময় লেখালেখি করতেন। বিশেষত স্কুল ও কলেজে পড়বার সময় সেই আগ্রহটি অনেক বেশী ছিল। কবিতার ওপর দুটি গ্রন্থও প্রকাশ করেছিলেন। মানসম্মত না। হওয়ায় তার সেই কবিতাগুলি বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল। তবে লেখক হিসেবে সফল না হলেও পড়াশুনার আগ্রহটি ধরে রেখেছেন। দেশী বিদেশী ধ্রুপদী গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে জ্ঞানের পরিমণ্ডলটিকে ঋদ্ধ করে চলেছেন। শিক্ষার্থী হিসেবে যথেষ্ট মেধাবী ছিলেন। কিন্তু লেখালেখির ওপর মনোনিবেশ করবার কারণে উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফল করতে পারেন নি। পরবর্তীতে ভার্সিটিতে অনার্সে সুযোগ না পেয়ে ডিগ্রি পড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। ডিগ্রি পড়বার কারণে ভালো কোনো চাকরিও পান নি। স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে সখ্যতা থাকবার কারণে সাংবাদিকতার পেশাটিই গ্রহণ করেছিলেন। এক পর্যায়ে এই পেশাটিকেই ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। সাংবাদিকতায় মোটামুটি একটি অবস্থানে আসবার পর থেকে একটি লিটল ম্যাগাজিনও প্রকাশ করে আসছেন। এই লিটল ম্যাগটি সম্পাদনা করবার মাধ্যমে যাত্রাপুর শহর থেকে শুরু করে শহরের বাইরেও বিভিন্ন বয়সী মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার। দিনে দিনে সেই সম্পর্কের গভীরতাটিও বৃদ্ধি পেয়েছে। ছোট বড় সবাই তাকে বিপ্লব ভাই বলেই সম্বােধন করেন। বয়স সাতচল্লিশ ছাড়িয়েছে। আদরের সাথে বয়সের ব্যবধানটিও অত্যন্ত বেশি। তবুও সেও ভাই বলেই সম্বোধন করে। তার সম্পাদিত পত্রিকাটিতে যারাই লেখা পাঠাক না কেন মোটামুটি মানসম্পন্ন হলে নিবিড় যত্ন সহকারে সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন তিনি। মূলত এ কারণেই তরুণ লেখকরা তাকে পছন্দ করবার পাশাপাশি শ্রদ্ধা করে অনন্য উচ্চতায়। আদরের সাথে সম্পর্কের হৃদ্যতা দু'বছর ধরে। কবিতা লিখতে পরম আনন্দ লাভ করে আদর। যদিও লেখক হবার তীব্র বাসনাটি ওর মধ্যে এখনও তৈরী হয় নি। কবিতা লিখতে পারে বলে বন্ধুরা প্রশংসা করে, শিক্ষকরাও ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেন, তাই লেখালেখির প্রতি এত আগ্রহ। ওর লেখার মান উচ্চমার্গীয় না হলেও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয়েছে বিপ্লব ভাইয়ের কাছে। পাশাপাশি আদরের মেধার খর্য ও মার্জিত আচরণের কারণে তিনিও নিজে থেকেই আদরের সাথে অন্তরঙ্গ হয়েছেন। তারপর থেকেই নিয়মিত বিরতিতেই বিপ্লব ভাইয়ের বাসায় যাতায়াত করে আদর। দীর্ঘ সময় অবধি আলোচনা করে সাহিত্য, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে জ্ঞানের বহুমাত্রিক দিক নিয়ে। আজও বাসা থেকে হেঁটে হেঁটেই চলে এসেছে বিপ্লব ভাইয়ের বাসার কাছাকাছি। সবুজ রংয়ের ছোট্ট দরজাটি খোলাই ছিল। তাই কলিংবেলটি চাপবার প্রয়োজন মনে করলো । বিপ্লব ভাইয়ের পরিবারের কাছে পরিচিত মুখ ও। সঙ্গত কারণেই সরাসরি তার কক্ষে প্রবেশ করলো। নিজ রুমে বসেই একাগ্র চিত্তে ল্যাপটপে কাজ করছিলেন বিপ্লব ভাই। শার্ট, প্যান্ট পড়েই। আদকে দেখবার পর ঈঙ্গিতে খাটে বসে অপেক্ষা করতে বললেন। খাটে বসেই কক্ষটির এদিক ওদিক তাকাতে থাকলো আদর। আবার কখনোবা দৃষ্টি সরিয়ে তাকালো বিপ্লব ভাইয়ের ল্যাপটপের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে ল্যাপটপটি শাট ডাউন করে কথা বলতে শুরু করলেন বিপ্লব ভাই।
‘কীরে, শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নিলি?' কুশল বিনিময়ের পরই জিজ্ঞেস করলেন আদরকে। আজ তার কথা বলবার ধরণ কিছুটা অন্য রকম মনে হচ্ছে। সাধারণত যা লক্ষ করা যায় না। বিশেষত সাহিত্য সম্পর্কিত কথোপকথনের সময় তাকে ফুরফুরে মেজাজে দেখা যায়। কারো মনে আঘাত লাগতে পারে এমন কথাগুলিও প্রশান্ত চিত্তে প্রকাশ করে থাকেন তিনি।
‘ভাই, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম প্রকাশ করবো। কিছুটা দ্বিধার সাথে ওর মনের কথাটি প্রকাশ করলো।
‘নো, নো, ইট উইল বি রং। সামনে তোর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, একটু ধৈর্য ধর। আগে ভালো কোথাও ভর্তি হয়ে নে। তারপর না হয় প্রকাশ করিস। আমিই তোকে সাহায্য করবো।' কথাটি শুনবার সাথেই বলে উঠলেন বিপ্লব ভাই। ‘ভাই, আমি ভাবছি সামনে তো একুশে বইমেলা। তাছাড়া বইমেলার পর পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যাবে। তখন না হয় পড়ার গতি বাড়াবো।
‘আর তুই কি মনে করিস বই প্রকাশ করলেই বিখ্যাত হয়ে যাবি। শোন, তোর পড়াশুনার গভীরতা কিন্তু অনেক কম। এত তাড়াহুড়োর কী আছে। আগে পড়তে থাক। সামনে অনেক সময় পড়ে আছে।' আদরের কথাটি শুনবার পর নিজের ক্রোধ সম্বরণ করে বললেন বিপ্লব ভাই।
‘ কিন্তু অনেক লেখকই তো অল্প বয়সেই লিখে বিখ্যাত হয়েছেন। মৃদু স্বরে বললো আদর।
কিন্তু ওই বিখ্যাত হবার নেপথ্যে তাদের কী পরিমাণ সময় ও মেধা প্রয়োগ করতে হয়েছে সে সম্পর্কে কি তোর কোনো ধারণা আছে। তুই তো জানিস আমি সোজা করে কথা বলতে পছন্দ করি। তাদের সৃজিত এক একটি অক্ষর পাঠকের মনোজগতকে তাদের অবচেতনাতেই নীল আকাশের সীমা অবধি পৌছে দেয়। তোর লেখার মান যদি তেমনটিই হতো তাহলে কি আমি নিজে থেকেই তোকে বলতাম না। হ্যাঁ, কলেজে তুই অনেক মেধাবী হতে পারিস। কিন্তু মনে রাখার চেষ্টা করবি, ভালো ছাত্র হওয়া আর ভালো লেখক হওয়ার মধ্যে রয়েছে আকাশ পাতাল প্রভেদ। সাহিত্য হচ্ছে সমুদ্র পাড়ি দেবার মতো সাধনা। ফাস্ট বয় হয়েছিস বলেই ভাবিস না সাহিত্যেও ফার্স্ট হবি। বুঝতে পারছিস না কেন আমার কথাগুলি! মিছেমিছি অর্থের অপচয় হবে, কষ্ট পাবি কিন্তু বললাম।' অনর্গল বলেই গেলেন বিপ্লব ভাই। ক্ষুব্ধতার পাশাপাশি দুঃখবোধের স্পষ্ট চিহ্ন প্রতিফলিত হলো তার অবয়বে।
কিছুক্ষণ নীরব রইলো আদর। কোনো কিছু বলবার সাহস পেল না। তার এই নীরবতার মাঝে চেয়ার ছেড়ে ওর পাশে এসে বোঝাতে লাগলেন বিপ্লব ভাই।
‘শোন, এখন হয়তো মনে হচ্ছে আমি তোর মঙ্গল চাইছি না। বইটি প্রকাশের জন্য অনেকেই হয়তো তোকে তাড়া দিচ্ছে, প্রশংসাও করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যখনই প্রকাশ করবি তখনই সবাই কেটে পড়বে। সত্যি বলতে কি, এখনো তোর পড়াশুনার ভিত্তি অনেক দুর্বল। একটা বিষয় মনে রাখবি- যেহেতু তোর লেখার মান এই মুহূর্তে সমৃদ্ধ নয় সেহেতু প্রকাশ করা মোটেই সমীচিন হবে না। তাছাড়া আমি তো তোকে লেখা বন্ধ করতে বলছি না। লিখবি না কেন, লিখতে থাকবি। আমার পত্রিকায় প্রকাশ করবি। সুযোগ হলে জাতীয় পত্রিকাগুলোতেও প্রকাশ করা যাবে তোর কবিতাগুলি। কিন্তু গ্রন্থ প্রকাশের জন্যে এত তাড়ার তো কোনো যুক্তিই দেখছি না। অন্তত কয়েকটা বছর পড়াশুনা কর, লিখতেও থাক। তারপর না হয় প্রকাশ করিস। আর সামনে তোর ফাইনাল পরীক্ষা। সর্বোচ্চ আন্তরিকতায় কথাগুলি বললেন বিপ্লব ভাই।
“ঠিক আছে ভাই, আপনার সব কথাই আমি বুঝতে পেরেছি। আমি ভালো লিখতে চেষ্টা করবো এবং মনোযোগের সাথে পড়াশুনাও করবো।' কথাগুলির মাঝে বিরক্তির ভাবটি ফুটে উঠলো আদরের চাহনিতে। বিষন্নতায় ছেয়ে গেল ও। যে রঙিন স্বপ্ন বুনে এসেছেন বিপ্লব ভাইয়ের কাছে সেটির সাময়িক মৃত্যু হয়তো ওর মনোজগতে এমন অবস্থার সৃষ্টি করলো।
‘অল রাইট, এখন বাসায় গিয়ে মন দিয়ে পড়াশুনা কর। আর শোন, হাজার বিশেক টাকা হলেই এখন বই প্রকাশ করে লেখক হওয়া যায়। কিন্তু সেই গ্রন্থ পাঠকের হৃদয়ে বিন্দুমাত্র রেখাপাত করতে সক্ষম হবে এ নিশ্চয়তা কি দেয়া যায়! তুই কেন ওই পর্যায়ে পড়বি? আমি তো নিজে এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েই তোকে বলছি। বিশ্বাস কর আমাকে। তাছাড়া এই মুহূর্তে এত টাকা তুই কোখেকে জোগাড় করবি? আশ্চর্যের ভাবটি ঘনীভূত হলো বিপ্লব ভাইয়ের মুখাবয়বজুড়ে।
কথোপকথনের মাঝেই চায়ের পর্বটি শেষ হলো। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হবার কারণে প্রেস ক্লাবে গেলেন না বিপ্লব ভাই। বাসা থেকে মূল সড়ক পর্যন্ত আদরের সাথেই আসলেন। সড়কের পাশেই একটি চায়ের দোকানে আবারও বসলেন। বসা অবস্থায়ই পুনরায় আদকে বোঝালেন। চেষ্টা করলেন একটি তরুণ প্রদীপ যেন ভুল পথে পরিচালিত হয়ে অকালেই নিভে না যায়। বিভিন্ন তরুণ লেখকের ঝরে পড়বার কাহিনীগুলোও বর্ণনা করলেন। ওর জীবনের সম্ভাবনাময় শিখাটি এভাবে নিভে যাক এটি কখনোই চান না তিনি। বিপ্লব ভাইয়ের কথাগুলি যে খুব একটা সুখের উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হলো না তা পুনরায় স্পষ্ট হলো আদরের চাহনিতে। কোনোরকমে এখান থেকে পালাতে পারলে ভালো হয়। ওর অভিব্যক্তিতে যেন সেটিই ফুটে উঠলো। অবশেষে সেই মুহূর্তটি কাছে এলো। যাক বাবা, বাঁচা গেল।' বিপ্লব ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নেবার পর স্বস্তি পেল আদর। তবে বিপ্লব ভাইয়ের কথাগুলি যে ওর মনোজগতে একটি দ্বিধার শক্ত চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেলো তা ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারলো ও। গ্রন্থ প্রকাশের যে অদম্য ইচ্ছে ছিল সেটি ক্ষণিকের জন্যে হলেও স্থিমিত হয়ে এলো। তবুও হাঁটতে হাঁটতেই প্রকাশের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থাকলো। প্রকাশ করবার মুহূর্তগুলি কেমন হতে পারে, মোড়ক উন্মোচনের দৃশ্যপটটি কেমন হবে ইত্যাদি।

তিন
সেদিনের পর থেকে আর কখনোই বিপ্লব ভাইয়ের বাসায় যায় নি আদর। গ্রন্থ প্রকাশ না করবার পক্ষে তার যুক্তিগুলি প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল ওকে। সেই যুক্তি পলিনের আবশ্যকতাগুলি আজ অবধি ক্রিয়াশীল রয়েছে ওর বোধের অন্তরালে। আবার তার কাছে। গেলে একই কথাই শুনতে হতে পারে বিধায় নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে তার কাছ থেকে। নিজে নিজেই গ্রন্থ প্রকাশের পক্ষে যুক্তি উদ্ধার করবার চেষ্টা করে যাচ্ছে অবিরত। গ্রন্থ প্রকাশ করলে ইতিবাচক দিকগুলি কেমন হতে পারে? কত জন ওকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিতে পারে ইত্যাদি। আবার কখনো কখনো নেতিবাচক দিকগুলি কী হতে পারে সেটিও উপলব্ধির চেষ্টা করছে। এ কারণেই প্রচণ্ড দ্বিধা দীর্ণতার দোলাচলে এক একটি মুহূর্ত কাটতে থাকলো । যাত্রাপুর সাহিত্য পরিষদের অনেক লেখকেরই কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণের চেষ্টা করলো। সাহিত্য পরিষদের মাসিক সভাতে গিয়েও ওর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের বিষয়টি তুলে ধরলো। অনেকে অনেক ভাবেই ওকে পরামর্শ প্রদান করবার চেষ্টা করলেন। তবে সবার পরামর্শের সারগর্ভটিই হলো গ্রন্থ প্রকাশ করে ফেলো। তাদের এই কথার প্রেক্ষিতে যখন ও বিপ্লব ভাইয়ের প্রসঙ্গ তুলতো তখন তারা মুখ বাঁকা করে বলতেন উনি তো বলবেনই। ওনার কাজই তো সমালোচনা করা। তাছাড়া তোমার গ্রন্থটি প্রকাশ হলে তার রাজত্বটি তো আর থাকছে না। কেউ কেউ আবার বলতেন “নিজে ব্যর্থ হয়েছেন এখন একটা প্রতিভা ধ্বংসের পায়তারা করছেন। সবসময়ই নেতিবাচক সব মন্তব্যে সবাই তার বিরোধিতা করতেন। পাশাপাশি আদরকে গ্রন্থ প্রকাশ করবার ব্যাপারে উৎসাহ যুগিয়ে যেতেন। বিপ্লব ভাই সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্যগুলি আদরকে যেমন যন্ত্রণায় দগ্ধ করলো তেমনি গ্রন্থ প্রকাশের স্ব-পক্ষের যুক্তিগুলি উৎসাহিত করতে থাকলো। প্রেরণা যোগালো র স্বপ্নটিকে নতুন করে বপন করবার।
ইদানীং অস্থির হয়ে উঠেছে আদর। যা কিছুই ঘটুক না কেন গ্রন্থ প্রকাশের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করলো। স্থানীয় এক প্রকাশকের সাথে কথাও বলে ফেললো। পনের হাজার টাকা হলেই বই ছাপিয়ে দেবেন। অর্থের পরিমাণটি ওর আয়ত্তের মধ্যে হওয়ায় আগ্রহের পরিমাণটি বৃদ্ধি পেলো। বন্ধুমহল, সাহিত্যমহল, শুভাকাঙ্ক্ষী থেকে শুরু করে সাধারণ পাঠকের কাছে যদি ন্যূনতম পঞ্চাশটি গ্রন্থও বিক্রি করা যায় তাহলেও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাটি দূর হবে। কৌশলে সবার কাছে বই বিক্রির একটি অলিখিত সমর্থন নিয়ে ফেলবার চেষ্টা করে গেল। ইতোমধ্যে ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসটিও বিপুল উৎসাহ হিসেবে কাজ করছে। প্রায় পাঁচ শতের অধিক লাইকের সাথে পঞ্চাশ জনের উপর বইটি সংগ্রহের তথ্য ও আত্মবিশ্বাসের পরিধিটিকে বাড়িয়ে দিয়েছে যেন আরো বেশি করে। এত নিশ্চয়তার পর আর বই প্রকাশ না করবার কোনো কারণ নেই। নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসলো ও। স্যারের প্রাইভেট ফি এর দুই, ফর্ম পূরণের পাঁচ, সঞ্চয়ের এক এবং বাবার কাছে পাঁচ হাজার টাকা সহ মোট তের হাজার টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করতে হবে। পরবর্তীতে বই বিক্রি করে প্রকাশকের বাকী টাকা এবং ফর্ম পূরণ ও স্যারের টাকা পরিশোধ করা যাবে। মোটামুটি একটি সিদ্ধান্তে আসলো আদর। তাছাড়া বই প্রকাশের জন্য দীর্ঘদিন ধরে বাবার কাছ থেকে টাকার আবদার করে আসছিল ও।।
* আমি কি তোমার কাছে কখনও কিছু চেয়েছি। একটা ভালো কাজ করবার জন্যেই তো টাকাটার প্রয়োজন। মাঝে মাঝেই বাবাকে এভাবে বলে আসতো আদর। আর্থিকভাবে সচ্ছল হলেও ওর বাবা চান নি পরীক্ষার আগে বিষয়গুলোতে জড়িয়ে পড়ুক তার সন্তান।
* বাকী টাকা প্রকাশকই দেবেন। আমার লেখার মান তো আর যাচ্ছেতাই না।'
*বাকী টাকা কোথায় পাবে?' বাবা জিজ্ঞেস করলে এভাবেই উত্তর দিত আদর। আবার বাবা যাতে ওর সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতে না পারে সে জন্যে পড়াশুনাও ঠিকঠাক চালিয়ে যেতো।
মনোযোগের তীক্ষ তীরটি পূর্বের মতো লক্ষ্য ভেদ করতে না পারলেও রুটিন মেনেই পড়াশুনা চালাতে থাকলো আদর। পড়াশুনার প্রতি তার এই নিরবছিন্ন মনোসংযোগের কারণে এক সময় প্রভাবিত হলেন বাবা। অর্থ না দিলে হয়তো সে পড়াশুনায় মনোযোগ কমিয়ে দিতে পারে। এই ভেবে নির্ধারিত পাঁচ হাজার টাকা প্রদান করলেন ছেলেকে। ছেলের প্রতি অগাধ বিশ্বাস তার। অবশ্য শুরু থেকেই এই বিশ্বাসের মর্যাদাও দিয়ে এসেছে আদর। ছেলের প্রতিভার কারণে বেশ গর্ববোধ করেন তিনি। এক মাস পর ফর্ম পূরণ হলেও নির্ধারিত অর্থটি চাইবার সাথে সাথেই কোনো ধরনের সন্দেহ ব্যতিরেকে প্রদান করলেন। মোট তের হাজার টাকা এখন আদরের হাতে। গত সপ্তাহে নিজ সঞ্চয়ের এক হাজার টাকা প্রকাশককে দিয়ে প্রকাশনার কাজ শুরু করেছে। টাকার পরিমাণটি স্বল্প হবার পরেও দ্রুত গতিতে কাজ করছেন প্রকাশক। প্রকাশকের সাথে পূর্ব পরিচয় রয়েছে তার। বিপ্লব ভাইই পরিচয় করে দিয়েছিলেন। আজ টাকা পাবার পর সাত হাজার রেখে পাঁচ হাজার টাকা প্রদান করলো প্রকাশককে।
বই মেলা শুরু হতে দিন পনের বাকী। প্রচ্ছদের কাজ শেষ হয়েছে। দু'একদিনের মধ্যে কভারও শেষ হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন প্রকাশক। ভেতরে ভেতরে মোহিত হতে থাকলো আদর। প্রত্যাশার স্বচ্ছ নীল চোখ দুটি নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকলো। প্রচ্ছদটি দেখবার পর থেকেই অজানা এক ভালোলাগায় আবৃত হলো ও। বইমেলা শুরুর পূর্বে গ্রন্থ প্রকাশের কাজ শেষ হবে কিনা সেটিও জিজ্ঞেস করলো না প্রকাশককে। অসাধারণ এক অনুভূতিকে জয় করে বাসায় আসলো। আসবার পরপরই পড়ার টেবিলে বসে পড়তে থাকলো। অত্যন্ত উচ্চ স্বরে। প্রচ্ছদের একটি প্রিন্টকপি সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। পড়ার মাঝে মাঝেই সেই কপিটি দেখছে। আর আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছে। এমন অনুভূতির সঙ্গে কখনোই পরিচয় ছিল না ওর। সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই অস্থির হয়ে উঠছে ও। প্রতিদিন বিকেলবেলা যাচ্ছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে। সকাল বেলাতে যাবার ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারছে না। তার মতো আরো বেশ কিছু কবি কবিতা প্রকাশের জন্যে কাজ করছে। তাদের মধ্যেও গ্রন্থ প্রকাশের চূড়ান্ত উন্মাদনা। তবে প্রাইভেট শেষে বাড়ী ফিরবার সময় দূর থেকেই উঁকি দিয়ে কারখানার দিকে তাকিয়ে দেখবার চেষ্টা করছে ওর গ্রন্থটিকে। কখনো কখনো ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু দ্বীপকেও পাঠিয়ে দিচ্ছে খোজ নেবার জন্য। তোর কি মনে হয় আমার বইটি সবাই কিনবে?' দ্বীপের কাছ থেকে পাওয়া প্রশ্নটির ইতিবাচক উত্তর অসীম অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে ওকে। বিখ্যাত হবার রঙিন স্বপ্ন বুনে দিন কাটতে থাকলো আদরের। এদিকে বইমেলার সময় ঘনিয়ে আসছে। বইয়ের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। নির্ধারিত সময়ের মাঝেই বই পেয়ে যাবে বলে আশা করছে ও। গ্রন্থ প্রকাশের খবরটি আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, সাহিত্য পরিষদের সদস্যসহ সবাইকেই জানাতে থাকলো আদর। সকাল বিকেল স্ট্যাটাস দিতে থাকলো ফেসবুকে। স্ট্যাটস দিয়ে বসেও থাকলো না। কতজন কমেন্ট ও লাইক দিচ্ছে সেটি দেখবার জন্য তীক্ষ দৃষ্টি রেখে চলেছে স্ক্রিনে। এবং গভীরভরা আগ্রহ নিয়ে উত্তর দিয়ে চলেছে কমেন্টগুলোর।
আজ থেকে শুরু হয়েছে যাত্রাপুর গ্রন্থমেলা। চলবে পুরো সপ্তাহব্যাপী। আদরের কাব্যগ্রন্থটিও প্রকাশ পেয়েছে। পাঁচশত কপির জায়গায় হাতে পেয়েছে দুইশত কপি। মেলা পার করেন, পরে দেখা যাবে। বাকী বই প্রাপ্তির প্রসঙ্গ তুললে প্রকাশকের এমন উত্তর কপালে ভাঁজ ফেললেও সেটি নিয়ে আর চিন্তার সময় পেল না আদর। এই বইগুলোকেই কীভাবে বইমেলায় বিক্রি করা যায় সেটিই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো ওর কাছে। প্রতি বছরই মেলায় স্টল দেয় যাত্রাপুর কলেজ। এবারও দিয়েছে। স্টলের সদস্য হিসেবে সুযোগ পেয়েছে আদর। গত বছরও ছিল। তবে এবার ওর আগ্রহের সাথে উত্তেজনার মাত্রা অনেক তীব্র। বিকেল থেকে রাত অবধি স্টলে থাকবে ও। কলেজের স্টলটি তুলনামূলক বৃহৎ। গ্রন্থ সমাহারও পর্যাপ্ত। জ্ঞানমূলক পোস্টার ও ফেস্টুন দিয়ে সাজানো হয়েছে স্টলটি। সামনে দুটি টেবিল রয়েছে। পেছন দিকে দুটি এবং ডান দিকে একটি সেলফে শোভা পাচ্ছে অজস্র গ্রন্থ। টেবিলের ওপর থরে থরে সাজানো রয়েছে দেশী বিদেশী গ্রন্থ। এর মাঝেই রয়েছে আদরের গ্রন্থটি। রু থেকেই তীব্র উত্তেজনা নিয়ে স্টলে সময় কাটছে আদরের। নানা রুচির পাঠক বই দেখছেন, ক্রয়ও করছেন। কোনো পাঠক যখনই ওর গ্রন্থটি নাড়াচাড়া করছেন তখনই মনে হচ্ছে একটি মায়াবী প্রজাপতি এসে ওর আবেগীয় রাজ্যে সুখের সমীরণ বয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষীসহ সাহিত্য পরিষদের সদস্যরা যখন স্টলে আসছে তখন আবেগের মাত্রাটি স্বাভাবিকত্বকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মেলা তো কেবল ব্রু, শেষের দিকে কিনবো।' ওদের কাছ থেকে কথাগুলি শুনবার পর কিছুটা নিরুৎসাহিত হয়ে পরমুহূর্তেই ভাবছে-যাক, তবুও তে শেষদিকে কিনবার প্রতিশ্রুতিটি পাওয়া গেল। ধন্যবাদ জানিয়ে সেও তাদেরকে আসবার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। সুযোগ পেলেই উপযাচক হয়ে নিজের গ্রন্থটি দেখাচ্ছে অপরিচিত পাঠকদের। ব্যক্তিগত প্রয়োজনেও স্টল ছেড়ে বাইরে যাচ্ছে না। আবার বাইরে গেলেও বেশীক্ষণ থাকতে না পেরে চলে আসছে। সার্বিক বিবেচনায় অপরিণত আবেগের ভেলায় ভেসে নিশ্চিত ভয়ংকর একটি পরিণতিকে সৃষ্টি করবার প্রেরণায় যেন এগিয়ে চলছে একটি সম্ভাবনাময় তরুন, অনিশ্চিত আগামীর এক কাব্যকার। মেলার ছয়দিন পেরিয়ে গেছে। আজ শেষ দিন। পচা আমের মতো শ্রীহীন ভাবটি ফুটে উঠেছে আদরের চোখেমুখে। বই কিনবার প্রতিশ্রুতি যারা দিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই আর স্টলের সামনে আসেন নি। এ পর্যন্ত একটি মাত্র বই বিক্রি হয়েছে, যে বইটি কিনেছে ওর বন্ধু দ্বীপ। ওর এমন মানসিক অবস্থার বিষয়টি দ্বীপকে জানাতে চাইলেও শেষ মুহূর্তে আর জানায় নি। একজন লেখক নিজের সমস্ত দীনতাকে প্রকাশ করলেও সৃষ্টির দীনতাকে প্রকাশ করতে চান না। যে কোনোভাবেই সে সৃষ্টিটিকে মহার্ঘ হিসেবে তুলে ধরতে চান সবার কাছে। হয়ত এমন প্রবণতা থেকেই দ্বীপের কাছ থেকে বিষয়টি চাপিয়ে রাখলো আদর। যদিও ওর বই বিক্রির প্রচারণায় ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে দ্বীপ। বন্ধুর বইটি সবাইকে কিনতে বলবার পাশাপাশি নিজের ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসও দিয়েছিল। প্রকৃত বিষয়টি শুনতে পেলে দ্বীপ কষ্ট পাবে, সেটিও হয়ত বিষয়টিকে চাপিয়ে রাখবার ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।
শেষ সময়ে ক্ষীণ প্রত্যাশাকে সঙ্গী করে চেষ্টা করছে আজ। তবে কোনোভাবেই শুরুর দিকের উত্তেজনাময় আগ্রহটিকে নিজের মধ্যে সৃষ্টি করতে পারছে না। অবচেতনাতেই অপরাধবোধের অমোচনীয় যন্ত্রণা অনুভব করতে শুরু করলো ও। ওর বুকের ভেতরের হাড়গুলি যেন সঙ্কুচিত হয়ে এলো। চুপচাপ গ্রন্থ বিক্রয়ের কাজটি করতে থাকলো। এই মুহূর্ত থেকে বিপু ভাইয়ের কথাকটি অনবরত সূচের মতো বিধতে থাকলো ওকে। অবলীলায় মনে মনে ভাবতে থাকলো, বিপ্লব ভাইয়ের কথা না শুনে কী ভুলটাই না করে ফেলেছি আমি!
মেলায় প্রচুর লোক সমাবেশ ঘটেছে। কমবেশী সবাই গ্রন্থ কিনছে। বেশিরভাগ পাঠকই ক্রয়ের ক্ষেত্রে বইয়ের গুণাগুণ যাচাই করছে। বিষয়টি শুরু থেকে বুঝতে পেরে কাউকেও আর তার গ্রন্থটি দেখাচ্ছে না আদর। বরং শুরুর দিকে উপযাচক হয়ে পাঠককে নিজের গ্রন্থটি দেখানোর দৃশ্য স্মরণ করতেই লজ্জা পাচ্ছে। পর্যাপ্ত পড়াশুনার পাশাপাশি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় না করে বই প্রকাশ করলে যে কতটা নির্মম পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয় সেটিও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এখন। বাবা ও বিপ্লব ভাইয়ের প্রতিচ্ছবিটি বারবার করে ওর মনোজগতে প্রতিফলিত হচ্ছে। চিন্তার প্রতিটি রেখা স্ফীত করে তুলছে ওর কপালের কয়েকটি বলিরেখাকে। বোধ করছে এক সম্ভাবনাবিহীন অসহায়ত্ব। হঠাৎ আলোর নিঝরনী হয়ে ঠাসা ভীড়ের মাঝে স্টলের সামনে এসে দাঁড়ালেন বিপ্লব ভাই। তাকে দেখবার সাথে সাথে আশ্চর্য হবার পাশাপাশি ভয় পেয়ে গেল আদর। ঠোট দুটি শুকিয়ে এলো, মলিনতার সর্বোচ্চ ভাবটি ফুটে উঠলো ওর মুখমণ্ডলজুড়ে। বেশীক্ষণ দাঁড়ানোর সুযোগ না থাকায় অভিনন্দন জানিয়ে পাঁচটি বই চাইলেন বিপ্লব ভাই। দ্রুত পাঁচটি বই দিলো আদর বিপ্লব ভাইকে। লজ্জা পাবার পাশাপাশি আড়ষ্ট হয়ে গেল আদর। তাকে যে একটি বই সৌজন্য উপহার হিসেবে প্রদান করবে সে সাধারণ বোধটিও এই মুহূর্তে কাজ করলো না ওর মধ্যে। ওর দিকে হাস্যোজ্জ্বলভাবে তাকিয়ে আছেন বিপ্লব ভাই। হয়ত তিনি বুঝতে পেরেছেন আদরের মানসিক অবস্থা। এবং এটি উপলব্ধি করেই অনেক কিছু বলতে চাইলেন স্নেহাস্পদ ছোট ভাইটিকে। কিন্তু সে সুযোগটি না থাকায় বইয়ের মূল্য পরিশোধ করে চলে গেলেন তিনি। বিপ্লব ভাইয়ের চোখের ভাষা পাঠ করে ধড়ফড় করতে থাকলো আদরের অন্তঃকরণ। টনটন করতে থাকলো ওর চোখের উজ্জ্বল মনি দুটি। কিন্তু তাৎক্ষণিকতায় সেই আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারলো না ও। ভেতরে ভেতরেই কাতর হতে থাকলো। অতীতের সমস্ত স্মৃতি বিপুল বেগে তাড়া করতে থাকলো ওকে। এ আমি কি করছি এখানে, কেন এমনটি করলাম!' চিৎকার করে বলতে চাইলো হাজারো লোকের মাঝে। পূর্বের তুলনায় কোলাহল কিছুটা কমেছে। বইমেলা উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভাও শেষ হয়েছে। এরই মাঝে আহসান সাহেব এসে দাঁড়ালেন স্টলের সামনে। বাবাকে দেখে অনেক কষ্টে মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করলো আদর। আব্ব, একটা অটোগ্রাফ দাও।' ছেলের একটি বই হাতে নিয়ে বললেন বাবা। বাবার কাছ থেকে কথাটি শুনবার পর আবেগতাড়িত হলো আদর। আই লাভ ইউ বাবা, আই লাভ ইউ টু মাচ। বড় বড় অক্ষরে নান্দনিকভাবে লিখে স্বাক্ষর করলো। লিখবার সময় যেন নিঃসীম আকাশ থেকে প্রকাণ্ড একটি চিল উড়ে এসে ওর হৃদয়ে আঘাত দিয়ে গেল, চোখ চিরে চিরে জল বেরিয়ে আসতে চাইলো অনুভব করতে পারলো ও। । ছেলের বই নিয়ে চলে গেলেন বাবা। বাবার চলে যাবার দৃশ্যটি গভীর মনোনিবেশের সাথে দেখতে থাকলো আদর।
রাত্রি এগারটা পেরিয়ে গেছে। লোক সমাগম প্রায় শূন্যের কোঠায়। দায়িত্বরত স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিলো আদর। মোট সাতটি বই বিক্রি হয়েছে ওর। হিসেব শেষে দেখতে পেল। নিজেকে সামলে নিয়ে ওর সব বই রিকশায় তুললো। যে বইয়ের প্রতি এত অকৃত্রিম অনুরাগ ছিল সে বইগুলিই এই মুহূর্তে ওর কাছে জঞ্জালের মতো মনে হচ্ছে, তাকাতেও চাচ্ছে না বইগুলির দিকে। টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া কাঁচের মতো বড় অস্পষ্ট মনে হচ্ছে। শীত পড়তে রু করেছে। কুয়াশার কারণে সামান্য দূরত্বেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু শীতের এই তীব্র অনুভূতি কোনোভাবেই শীতল করতে পারছে না ওকে। বিষন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে ক্রমেই ঘেমে যাচ্ছে ও। রিকশার গতি বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে ভাবনার গতিটিও বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে ওর। এখন আমার কি হবে, কী করবো আমি? আপনাআপনিই ভাবনাটি গভীর হয়ে এলো ওর মননের অতলান্তে। দু'চোখ বেয়ে দু'এক ফোটা করে অশ্রু ঝরতে ঝরতে গলা বেয়ে চলে এলো। রিকশা থেকে নেমেই বুঝতে পারলো। অশ্রুতে ভিজে যাওয়া অংশটি দ্রুত মুছে ফেলবার চেষ্টা করলো। কোনো কারণ ছাড়াই বাসার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো কিছু সময়। অতঃপর বিষন্ন মনে প্রবেশ করলো বাসায়- জ্যোতিহীন, সংজ্ঞাহীন এক অসীম শূন্যতাকে সঙ্গী করে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
কেতকী খুব বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। নতুন লেখকদের বেলায় সাধারণত এমনটি খুব হয়। শুরুতে মনে করে পাঁচশ কপি বিক্র‌ি হবে। পরে দেখা যায় পঞ্চাশ কপিও বিক্র‌ি হয় না। তাই নিজেকে শুরুতে খুব ভালো করে তৈরি করে নিতে হয়। গতকাল পড়া শুরু করেছিলাম। লাইন ধরে পড়ার অভ্যাস বলে একবারে শেষ করতে পারিনি। দুদিন লেগে গেল। অনেক শুভেচ্ছা সহ ভোট রইলো।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

বর্তমান সময়ের অধিকাংশ তরুনরা আবেগের ভেলায় ভেসে একুশে বইমেলার পূর্বে মানহীন গ্রন্থ প্রকাশ করে যে ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় সেটিই তুলে ধরবার চেস্টা করা হয়েছে''নীল অক্ষর" শিরোনামে রচিত গল্পটিতে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র 'আদর' যাত্রাপুর কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেনীর ফার্স্ট বয়। বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় ও প্রথম স্থান অধিকার করবে এটি অধ্যক্ষ স্যারের স্বপ্ন। কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের ভাবনা সেই লক্ষ্য পূরনে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিয়মিত কবিতা লিখলেও ততটা মানসম্পন্ন নয় বলে মনে করেন সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক, তার শুভাকাক্ষ্মী বড় ভাই বিপ্লব। তাই আদর গ্রন্থ প্রকাশে উদ্যত হলে বিপ্লব ভাই তাকে নিষেধ করে পড়াশুনায় মনোনিবেশের পরামর্শ দেন। কিন্তু তার এই নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে আদর গ্রন্থ প্রকাশের প্রস্তুতি নেয়। বাবার কাছে মিথ্যে কথা বলে টাকাও নেয়। এমনকি ফর্ম পুরনের অর্থ ব্যয় করে ফেলে এই ভেবে যে- বইমেলায় প্রকাশিত বই বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে ফর্ম পূরণ করবে। তার এমন সিদ্ধান্তে সমর্থন জানাবার পাশাপাশি তাকে উৎসাহ প্রদান করেন যাত্রাপুর সাহিত্য পরিষদের মানহীন কিছু কবি। অবশেষে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে আদর, যদিও বিপ্লব ভাই প্রকাশ না করবার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়ে বুঝেছিলেন। আদর ভাবে - এই গ্রন্থ তাকে সাহিত্য জগতে জনপ্রিয় করে তুলবে। কিন্তু বইমেলা শুরু হলে তার একটি গ্রন্থ ও বিক্রি না হলে সে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। শেষ সময়ে বিপ্লব ভাই, ওর বাবা এবং বন্ধু দীপ বই কিনতে আসলে লজ্জা পাবার পাশাপাশি ভীত হয়ে পড়ে ফর্ম পূরনের কথা চিন্তা করে। বিষনণতার মাত্রা এত তীব্র হয় যে সে আত্তমহত্যার মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সার্বিক দিক বিবেচনায় গল্পটি বিষয়ের সাথে সামজ্জস্যপূর্ন বলে আমার কাছে মনে হয়েছে।

২৯ অক্টোবর - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪