পঞ্চাশ

ভৌতিক (নভেম্বর ২০১৪)

Shimul Shikder
  • ৩০
এরকম জংগলের মধ্যে প্রাসাদের মতো অট্টালিকা দেখে সাদেকুর রহমান অবাক না হয়ে পারলো না। চারিদিকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রাচীরের উপর লোহার বাঁকানো মরিচা ধরা রডগুলো তারকাটা দিয়ে পেঁচানো। দেয়ালের জায়গায় জায়গায় আস্তর উঠে গিয়ে ইটগুলো যেন দাঁত বের করে হাসছে। এতো উঁচু দেয়ালের পেছনে অট্টালিকার মাথাটাই শুধু দেখা যাচ্ছে। সাদেক আস্তে আস্তে লোহার ভারী গেটটার সামনে এসে দাঁড়ালো। এককালে এই গেটের সামনে হয়তো পাইক পেয়াদারা দাঁড়ানো থাকতো। সাদেককে দেখেই বলতো, কেয়া চাইয়ে? নানান প্রশ্নের জবাব দিয়ে হয়তো ভিতরে ঢুকতে হতো। এখন অন্তত সেই ঝামেলা নেই। আশেপাশে কোনো জনমানবের চিহ্ন আছে বলে মনে হচ্ছে না। লোহার ভারী গেটটার নিচে ছোট্ট পকেট গেটটা মনে হল ভেজানো। সাদেক ধাক্কা দিতেই ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে খুলে গেলো। সাদেক উঁকি মেরে আশ্চর্য হল। ভিতরটা বেশ ছিমছাম পরিপাটি। রঙ চটা শেওলা ধরা সাদা অট্টালিকার দোতালায় টানা বারান্দা। বিশাল বিশাল পুরনো গাছ অট্টালিকাকে ঢেকে রেখেছে। সামনে বিশাল একটা পানির ফোয়ারা। চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে। নানা বর্ণের গোলাপের গাছ দিয়ে সাজানো সামনের বাগান। সাদেকের মনে হল এ বাড়িতে মানুষের নিয়মিত বসবাস আছে। হটাৎ সাদেক লক্ষ্য করলো, ভিতর থেকে যেন কোনো মানুষের কণ্ঠ ভেসে আসছে। একটু কান পাততেই সাদেক শুনতে পেল কে যেন বিরতিহিনভাবে বলছে, উনপঞ্চাশ, উনপঞ্চাশ, উনপঞ্চাশ ……। সাদেক বেশ কৌতূহল হলো এই ভেবে, এরকম জঙ্গলের মধ্যে মানুষ বাস করে কিভাবে? চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। বনের ভিতর রাত হয় দ্রুত। শেষে ঘরে ফেরার রাস্তা না হারিয়ে ফেলে এই ভয়ে ভিতরে ঢোকার ইচ্ছা বাদ দিয়ে সাদেক গেটের বাহিরে বেরিয়ে এলো। কিন্তু তখনো সে শুনতে পেল, বাড়ির ভেতর থেকে কে যেন বলেই চলছে, উনপঞ্চাশ, উনপঞ্চাশ, উনপঞ্চাশ ……

ছেরাদিয়া ফরেস্টের রেঞ্জার হিসেবে সাদেকুর রহমান যোগ দিয়েছে কিছুদিন হলো। আগের রেঞ্জার মোসাদ্দেক আলী বন কেটে কেটে আবাদি জমির পরিমাণ বাড়িয়েছে। সেসব জমিতে ধানের চাষাবাদ হয়েছে, পুকুর কেটে মাছ ছাড়া হয়েছে। ঘটনাটা পত্রিকায় খবর হলে বনবিভাগ থেকে তদন্ত হয়। মোসাদ্দেক আলী বক্তব্য, তিনি একজন দেশ প্রেমিক মানুষ। দেশের ভাল মন্দ নিয়ে তার ভাবনার শেষ নেই। বনের গাছ গাছড়ার চেয়ে আবাদি শস্য, মাছ, শাকসবজী জাতীয় অর্থনীতিতে চেয়ে বেশী অবদান রাখতে পারে। দেশের যা ভাল হয় তিনি তাই করেছেন, বন কেটে আবাদি জমির পরিমাণ বাড়িয়েছেন। যদিও বনের কেটে ফেলা গাছ, ক্ষেতের শস্য, পুকুরের মাছের হিসাব তিনি দিতে পারেননি। দুর্নীতির অপরাধে মোসাদ্দেক আলীকে বরখাস্ত করা হলে সাদেকুর রহমানকে জরুরী নিয়োগ দেওয়া হয়। মোসাদ্দেক আলী ছেরাদিয়া ফরেস্টের কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি করেছে তার একটা হিসেব বনবিভাগ চেয়ে পাঠিয়েছে। সাদেকুর রহমান নিজে তার একটা প্রতিবেদন তৈরি করছে। বনের মাঝখানে মাঝখানে বিশাল বিশাল গাছ কেটে বনকে শ্রীহীন করে ফেলা হয়েছে। প্রতিদিন সকালে সাদেকুর রহমান তার সহকর্মীদের নিয়ে বনে ঢুকে পড়ে, কাজ শেষ করে বের হতে হতে বিকেল হয়ে যায়।

প্রতিবেদন তৈরির আজ শেষ দিন। সাদেকুর রহমান আর তার দল ছেরাদিয়া ফরেস্টের শেষটায় চলে এসেছেন। এরপর ছোট্ট নদী। তখন ভর দুপুর। সাদেকুর রহমান নদীর পার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়লো সেই অট্টালিকাটি। সামনে থেকে দেখে বোঝা যায়নি, এ বাড়িটার সীমানা শেষ হয়েছে নদীর পাড়ে এসে। সাদেকুর রহমান হাঁটতে হাঁটতে বাড়িটার লোহার গেটের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি শুনতে পেলেন বাড়ির ভিতর থেকে কে যেন সেদিনের মতো বিরামহীন ভাবে বলেই যাচ্ছে, উনপঞ্চাশ, উনপঞ্চাশ, উনপঞ্চাশ ……। তার কৌতূহল মাথাচাড়া দিলো, কে কেন বিরামহীনভাবে উনপঞ্চাশ, উনপঞ্চাশ, উনপঞ্চাশ……করে যাচ্ছে! উনপঞ্চাশটা কী? তিনি লোহার ছোট্ট গেট দিকে ঢুকে পড়লেন। সামনের গোলাপ বাগানের মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে এগুলেন। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কালো, সাদা নানা রকমের গোলাপ ফুটে আছে। গোলাপের যে এতো বর্ণ হতে পারে তার আগে ধারনা ছিল না। হঠাৎ সাদেকের মনে হল দোতালার জানালা দিয়ে তাঁকে এতক্ষণ কেউ দেখছিল। চোখ পড়তেই জানালা থেকে সরে পড়ে। সাদেকের গা ছমছম করে ওঠলো। উনপঞ্চাশ, উনপঞ্চাশ, উনপঞ্চাশ ……এখনো বাজছে। সাদেক দাড়িয়ে পড়লো। তার মনে হল ভিতরে যাওয়া ঠিক হবে না। ফিরে যাওয়ার জন্য যেই ঘুরে দাঁড়াতে যাবে ঠিক তখনই কোথা থেকে একটা ছুরি উড়ে সাদেকের গলায় এসে বিঁধলো। সাদেক দৌড়ে পালাতে গিয়ে গেটের সামনে এসে উপুর হয়ে পড়ে গেলো। তীব্র যন্ত্রণায় গলা থেকে ছুরিটা টেনে তুলল। সাদেকের সামনে একটা ছায়া এসে থামল। সে বুঝল, তার পেছনে কেউ দাড়িয়ে আছে। ঘুরতে গিয়ে সাদেকের সমস্ত কিছু অন্ধকার হয়ে গেলো।

সাদেকের যখন জ্ঞান ফিরল তখন অনুভব করলো, অন্ধকার একটা কামরায় চেয়ারের সাথে তার শরীর বাঁধা। শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত। শরীরটা যেন বিষের টুকরা হয়ে আছে। শরীর নাড়ানোর কোনো শক্তিই তার নেই। এখন রাত না দিন? চারিদিকটা অস্বাভাবিক নিঃশব্দতা। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ তার কানে এলো না। আজ তার মেয়ে সুখীর জন্মদিন। সাত বছরে পা রাখবে সে। অফিসে আসার সময় সুখী বলেছিল, বাবা, তুমি এলে আমি বেলুন ফুলাব, বাসা সাজাবো। মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে সাদেক তার অফিসের সবাইকে পরিবারসহ দাওয়াত দিয়েছে। সে এখানে নুতন এসেছে। পারিবারিক ভাবে সবার সাথে চেনাজানা হওয়া দরকার। স্ত্রী রেহানা বলল, পারলে অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি এসো। বাসায় অনেক কাজ আছে। সাদেক বলেছিল, দুপুরের মধ্যেই ফিরবে।

দূর থেকে একটা আলো আসছে। টর্চের আলো। আলোটা সাদেকের মুখের খুব কাছে এসে স্থির হয়ে গেছে। দুজন লোক কথা বলছে। সাদেক তাদের ভাষা বুজতে পারছে। টর্চের আলোর জন্য লোক দুটাকেও দেখা যাচ্ছে না। সাদেক চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমাকে তোমরা কেন মারছ? কী অপরাধ করেছি আমি? আমাকে ছেড়ে দাও। তোমরা কী চাও আমার কাছে?

লোকদুটো অজানা ভাষায় নিজেদের মধ্যে কী যেন আলোচনা করলো। তারপর একজন সাদেকের দিকে এগিয়ে এলো। সাদেক একটু আশার আলো দেখতে পেল। কিন্তু সেটা ক্ষণিকের জন্য। সাদেক দেখল তার হাতে একটা কাঁটাচামচ। কাঁটাচামচ দিয়ে ও কী করতে চাচ্ছে? কিছু বুজতে না বুজতেই কাঁটাচামচটা সাদেকের ডান চোখে বসিয়ে দিলো। তীব্র বাথ্যায় সাদেক চিৎকার করে উঠলো, ও খোদা আমায় ক্ষমা কর। তোমরা আমায় ক্ষমা কর। আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। সাদেকের আর্তচিৎকার উপেক্ষা করে কাঁটাচামচ দিয়ে খুঁচিয়ে চোখটা বের করে ফেলল। রক্তে সাদেকের মুখ, শরীর ভেসে গেলো। সাদেক শিশুর মতো চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো, আর বলতে লাগলো, কেন, কেন? আমি তোমাদের কী করেছি? সাদেকের কথা শেষ করতে পারলো না তার আগেই কাঁটাচামচটা বাম চোখে বসিয়ে দিলো। সাদেকের মনে হল বেঁচে থাকার সব ইচ্ছেই শেষ। মৃত্যুর চেয়ে এখন শান্তির আর কিছু হতে পারে না। সাদেক জ্ঞান হারাল।

সাদেকের যখন জ্ঞান ফিরল তখন শুধু সে বুজতে চেষ্টা করলো, সে কী জীবিত না মৃত! তার জগত ভয়ংকর অন্ধকার মনে হল। তখন তার মনে পড়লো, তার চোখ দুটো তুলে ফেলা হয়েছে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে চিৎকার দিতে চেষ্টা করলো। কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হল না। সে বুজতে পারলো তার শ্বাসপ্রশ্বাস এখনো চলছে। সে অনুভব করলো তার শরীর এখনো চেয়ারের সাথে বাঁধা। সে প্রচণ্ড ক্ষুধা অনুভব করলো। তৃষ্ণায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে। সে পানি পানি করে চিৎকার করলো। কেউ কী শুনতে পাচ্ছে?

অনেকক্ষণ পর পায়ের শব্দ শোনা গেলো। সাদেক পানি পানি করে বিড়বিড় করতে লাগলো। পায়ের আওয়াজ সামনে এসে থামল। সাদেক লোহার ঝনঝন শব্দ শুনতে পেল। গরম উত্তাপ টের পেল। ওরা কী করছে? হটাৎ তীব্র যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠলো। উত্তপ্ত রড তার শরীরের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। নিজের শরীরের পোড়া মাংসের গন্ধ সাদেকের নাকে এলো। সাদেক শব্দ করে কাঁদতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হল না। শুধু চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো। সাদেক বলতে লাগলো, তোমাদের পায়ে পড়ি আমাকে মেরে ফেলো, তোমরা আমাকে মেরে ফেলো। আমি আর পারছি না। মৃত্যু ছাড়া আমার এখন আর কিছু কাম্য না...

শেষবারের মতো যখন সাদেকের যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে বুজতে পারলো তার শরীরের বাঁধন খুলে শুইয়ে দেয়া হচ্ছে। তারপরেই সে অনুভব করলো, ধারালো কোন অস্ত্র দিয়ে তার শরীর টুকরো টুকরো করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে তার কোনো ব্যাথা বা কষ্টের অনুভুতি হল না। তবে তার মনের মধ্যে এক কষ্ট তীব্রভাবে জেগে উঠলো। সুখী বলেছিল, বাবা তাড়াতাড়ি ফিরো কিন্তু। সাদেকের আর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা হল না। তাঁকে ছাড়াই সুখী সাত বছরে পা রাখল। সুখীর আর কোনো জন্মদিনেই সে থাকতে পারলো না। মৃত্যুর আগে সাদেকের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলো যখন ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছিল তখন তার কানে শুধু বাজছিল- পঞ্চাশ, পঞ্চাশ, পঞ্চাশ......
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
গোবিন্দ বীন আমার কবিতা বিজয়'৭১ দেখার আমন্ত্রন রইল ।
গোবিন্দ বীন বেশ ভাল চমৎকার।। "আমার চলতি সংখ্যায় কবিতা গুলো পড়ার আমন্ত্রণ করে গেলাম। আশা করি আমার পাতায় আসবেন "
ওয়াহিদ মামুন লাভলু সাদেকের চোখে কাটা চামচ ঢুকিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা সত্যিই ভয়ানক। গল্পটা খুবই হৃদয় বিদারক। নামকরণটা যথাযথ ও দুঃখজনক। খুব ভাল লাগল। শ্রদ্ধা জানবেন।
শাহ্ আলম শেখ শান্ত ভালোই লিখেছেন । আমার লেখায় ভোট ও মন্তব্যের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি ।
আল মামুন খান প্রাঞ্জল ভাষায় ঝরঝরে লিখাটি একটানা পড়ে শেষ করল। ভালো লিখেছেন। অনেক ধন্যবাদ। আমার লিখা দুটি পড়ার আমন্ত্রণ রইলো।
শামীম খান ভাল লিখেছেন । শুভ কামনা রইল ।
Shimul Shikder আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। নভেম্বরের ভৌতিক সংখ্যায় গল্পটি জমা দিয়েছিলাম। কেন যেন প্রকাশিত হল না। আমি নুতন সদস্য। কোথাও ভুল হল কিনা বুজলাম না।
মাহমুদ হাসান পারভেজ হৃদয় বিদারক!! প্রথমে মনে হচ্ছিল আরব্য রজনীর সেই সব গল্পের ভেতর ঢুকে পড়ছি টান টান উত্তেজনা নিয়ে.. ..এরপর টের পেলাম হালের হরর ফিকশন...সেইসব বীভৎসতা ঢুকে গেল একেবারে মগজ অবধি....একজন সুখীর বাবাকেই কেন এই বীভৎসতার শিকার হতে হয়! কেন? বেশ ভালো হয়েছে আপনার লেখা। আগাম শুভ কামনা।

১৬ অক্টোবর - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪