একজন মায়ের বিজয় আনন্দ

বিজয় (ডিসেম্বর ২০১৪)

ruma hamid
  • ২৬
  • ৪১
কৃতজ্ঞতাঃ ডাক্তার সিরাজুন নূর রোজী, ডাক্তার ইউনা এবং বিউটি ফেরদৌস


এক

জীবন মানে যুদ্ধ । আরো গভীরভাবে বললে মহাযুদ্ধ । এই মহাযুদ্ধে আমরা পেয়ে থাকি ক্ষনে ক্ষনে বিজয় আনন্দ । আমাদের মতো ভাগ্যবান স্বদেশীরা পাই দেশ বিজয়ের আনন্দ । কখনো বা পরিবারের সবায় মিলে কাঙ্খিত পাওনা পেয়ে করি বিজয় আনন্দ । সেই আনন্দ হতে পারে নিজেদের কোন লক্ষ্যে পৌছানোর সফলতা ।
আমি নিশ্চিত এই বিজয় আনন্দ উপভোগ করেনি পৃথিবীতে এমন লোক খুব কম পাওয়া যাবে । অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, কেউনা কেউ হেরে যাচ্ছে বলেইতো আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে । আমি বলব, তারা আনন্দকে উপভোগ করতে পারছিলনা তাই । পাপ- মন্দ আর ভালো থাকা এবং নিজেকে সুখি ভাবা সম্পর্কে তাদের ধারনা নেই । অথবা বলতে পারেন ভূক্তভোগী দুঃখী মানুষদের কথা । হ্যাঁ, সেই দুঃখী মানুষগুলোকে কম সংখ্যার মধ্যে রাখলাম ।
এ মুহূর্তে আমি আমার লেখা একটি ছড়া কবিতা যাই বলি -তা আপনাদেরকে না বললেই নয় । যেটি আমার মেয়েকে প্রয়োজনে শিক্ষা দিতে গিয়ে লেখা । কবিতাটি জানালে হয়তো বুঝতে পারবেন আমি ঠিক কি বোঝাতে চাইছি ।যদিও
সহজ ভাষার এ কবিতাখানি আপনাদের ভাল নাও লাগতে পারে । কবিতাটির নাম না বললেও বুঝতে পারবেন ।
কবিতাটি হলো- আমার খুকু গোসসা করে-
‘মাংস খাব, সবজী খাবনা”,
বলি- খুকু রাস্তার টোকায় এটুকুও পায়না -
তাই কোন খাবার নষ্ট করোনা ।

তাওতো তুমি থাকছ ঘরে পাচ্ছ খেতে
পরম করুনাময়ের দান ,
পারলে তাদের হক আছে দাও খেতে
হুকুম আল্লাহ মহান’’!
আমার খুকু বুঝল এখন তাই করে
ভাঙল অভিমান ।

পাঠক নিশ্চয় বোঝে গেছেন কবিতাটির নাম - আমার খুকুর অভিমান ,

কবিতাটি এজন্য লেখা , আমি যখন রাস্তার সেই দুঃখিনী মাকে ডাস্টবিনের খাবার কুড়ে খেতে দেখি । কিনবা কোন মানসিক রোগী যুবতী মেয়েকে আধো পোশাকে রাস্তায় বসে থাকতে দেখি , কিনবা কোন মাঝ বয়সী নারীকে আনমনে ছেঁড়া পোশাকে হাঁটতে দেখি , অথবা একি রোগী উলঙ্গ অবস্থায় কোন পুরুষকে হাঁটতে দেখি । সত্যি বলছি , তখন আমার মনে থাকা দুঃখ কষ্টকে ঝেড়ে ফেলে দিই এই ভেবে , আমিতো অনেক ভালো আছি । আর তাদের জন্যে দুঃখ কষ্টবোধ করে ভাবি – পারবো কি ? কোন একদিন সেই দুঃখিনী মা , বোন কারো বাবা , ভাই -তাদের একটা থাকার ব্যাবস্থা করতে ? একটা ভাল পরিবেশ উপহার দিতে ? কি জানি, আমার এ লক্ষ্যে আমি কোনদিনো বিজয় আনতে পারব কিনা । আমি সেই বিজয়ের হাসি কোনোদিনও হাসতে পারব কিনা আমার জানা নেই । কারন আমি নিজে একজন শুধুমাত্র গৃহিণী, তাও আবার অলস গৃহিণী ।এক কথায় বললে অপ্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ । তাইতো আমার স্বামী মাঝে মাঝে আমাকে কথার ছলে খুনসুটি করে বলেন – আগে বাবার খেয়েছ এখন স্বামীর খেয়ে যাবে । না পাঠক, এটা নেহাতেই স্ত্রীর প্রতি তার দুষ্টামি । কারন একজন বাবা হিসেবে সন্তানের আবদার যতটুকূ তিনি পালন করেন তার চেয়েও অধিক দায়িত্ব পালন করেন সন্তানের মা তা তিনি অকপটে স্বীকার করেন । তবুও তার অমন কথায় কিছুটা অপমানিত হলেও হাসি পাই সত্যি বলেছে ভেবে । সত্যিতো, নিজেকে যদি প্রতিষ্ঠিত করতে পারতাম আজ আমার লক্ষ্যে ঠিক পৌছায়তাম ।

আজ যখন বৃদ্ধ বাবা-মার কথা ভাবি , নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবি , রাস্তার সেই দুঃখী মানুষ গুলোর কথা ভাবি , যাদের সন্তান থেকেও নেই , যত্নহারা সেইসব বাবা কিনবা মায়ের কথা ভাবি , কোন এতিম বাচ্চার কথা ভাবি তখন তাদের প্রতি কষ্টটা আমাকে ভাবাই । এদের জন্য কিছু একটা আমাকে করতেই হবে । কিন্ত কিভাবে ? আমি স্বামী শশুরের খাই । আমি তাদের জন্য করব টা কি । আচ্ছা ? শেষ জীবনে আমিও রাস্তার ঐ ভিখারিনীর মতো ভীক্ষা করবোনাতো ? কি জানি বাপু মাঝে মাঝে কেন তা মনে হয় । আর এই সব কারনেই তো নেমে পড়লাম কিভাবে সৎ উপায়ে অর্থের পাহাড় গড়া যায় । কারন আমার পূর্বপুরুষদের কি আছে কি নেই, সেই বিষয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই । যাই হোক , ভাগ্য এখনো খোলেনি । চেষ্টা করে যাচ্ছি । ভাগ্য খুলতে আল্লাহর রহমত লাগে । কবে সেই রহমত পাব , কবে সেই ভালো কাজটি করে আমার লক্ষ্যে পৌছাব, বিজয়ের হাসি হাসব- তা আমার জানা নেই । এই বিজয় পাবো বলেও মনে হয়না । কারন ভালো কাজ করার জন্যোও আল্লাহর রহমত পাওয়া লাগে , সেই সৈভাগ্য থাকা লাগে ।

পৃথিবীতে সেই বড় সৌভাগ্যবান মানুষ , যে অন্যের উপকার করতে চেয়েও করতে পারে । ঠিক তদ্রুপ সেই বড় দুর্ভাগা যে উপকার করতে চেয়েও শক্তি সামর্থ্য থাকেনা । যেমন আমি । তবুও হাল ছাড়ছিনা । সেই বিজয়ের জন্য আমি সংগ্রাম ও চেষ্টা করে যাচ্ছি । আমার অদুর কিনবা সুদূর ভবিষ্যতেই বলে দেবে সেই বিজয় আনন্দ পাবার সৌভাগ্যবান মানুষ আমি হতে পারব কিনা ।


দুই

তবে একটা বিজয় আমি মুহূর্তে মুহূর্তে অনুভব করি । কেউ জানেনা এই বিজয় আনন্দ আমরা প্রতিটি মা –ই নীরবে মনে আনমনে প্রতিটি ক্ষনে ক্ষনে অনুভব করি । এতক্ষনে নিশ্চয় বোঝে গেছেন সেটা কি ? হ্যাঁ । আমার সন্তান যখন ডাক দিয়ে উঠে আম্মু । এটা দাও, ওটা দাও, এটা খাবনা ওটা খাব । স্কুল থেকে ফেরে যখন বলে – আম্মু আজ তোমার জন্মদিন , তাই আমি তোমার জন্য এই কার্ডটা তৈরি করে রেখে ছিলাম । নাও ।
তখন আমার আনন্দ কতটুকু হয়, তা আমি লিখে প্রকাশ করতে পারবো না । আমার মেয়ে আরো বলতে থাকে –
আর আম্মু এই নাও । এই কলমটা আমি তোমার জন্য কিনে এনেছি । তোমার জন্মদিনের উপহার । এই কলমটা দিয়ে তুমি লিখবে । আমার স্কুলের ডায়েরি সাইন করবে । চাইলে তোমার গল্প লেখার কাজেও লাগাতে পারো ।
-ওহ ! আম্মু থেঙ্ক ইউ .........
তখন এক অন্য রকম অনুভূতি নিয়ে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর দিই । আমার মেয়েটি আরো বলে –
আম্মু আজকে আমার স্কুল ড্রেস , জোতা, মোজা সব আমি নিজে নিজেই চ্যেঞ্জ করব । সকাল বেলা বলেছিলাম না , তোমাকে আজকে আমার কোন কাজ করে দিতে হবে না । আজকে তোমার জন্মদিন না ? আজকে আমিই তোমার সব কাজ করে নেব । আজকে আমি নিজের হাতেই ভাত খাব আম্মু ।
একজন মা হিসেবে ছোট্ট খুকির মুখে এমন কথা শুনে তখন মুগ্ধ হওয়ার পাশাপাশি গর্বিত হই ।


নরমালি পরিবারের জন্য নিজের হাতে শুধুমাত্র রান্না ও নাস্তা বানানো ছাড়া কোন কাজই আমার করা হয়না বা খেয়াল নেই, কারন ঘরের যাবতীয় অন্যান্য সব কাজ দেখাশোনা করার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মচারী আছেই । আর তাদের তদারকি করার জন্য আমার গুরুজনরা আল্লাহর রহমতে এখনো সুস্থভাবে বেঁচে আছেন । ঠিক যেমন আমাদের মাথার উপর ছায়া হয়ে আছেন । আল হামদুলিল্লাহ !
কিন্ত আমার সন্তানের ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভিন্ন মত আমার । শুধুমাত্র পোশাক ধৌওয়া শেয়ার করা ছাড়া তার প্রতিটি খাবার নিজের হাতে তৈরি করা, তাকে খাওয়ানো, পোশাক পড়ানো, স্নান করানো থেকে শুরু করে সব কিছু আমি নিজের হাতে করি শুরু থেকেই । কারন আমার ছোট খুকির কাজ অন্যরা করে দেবে- তাতে একজন মা হিসেবে আমার তৃপ্তি কোনদিনও পূর্ণ হবেনা । হয়ত সেই কারনেই আজ আমার খুকির , মাকে অমন কথা বলার সুযোগ হলো । একজন মা হিসেবে তখন নিজেকে ধন্য মনে করি । আল হামদুলিল্লাহ ! অবশ্যয় যদি কোনোদিন আমার শাশুরি মা, মানে আমার খুকির দাদীমা সখ করে নাত্নিকে নিজের হাতে খাওয়াতে চান বা স্নান করাতে চান, তখন না করিনা । বরং ছবি তুলে রাখি, যাতে দাদীমার আদর সে মনে রাখে । এবং বুঝতে পারে, এ পৃথিবীতে বাবা-মা র আদরের চেয়ে দাদা-দাদীর আদর কোন দিক দিয়েই কম নয় ।
যাই হোক, অমন লক্ষ্মী আদুরে কন্যাকে আমি বুকে জড়িয়ে ধরে আল্লাহর কাছে তার শুভ কামনা করি আর মনে মনে বলি, ধন্য আমি ধন্য , এমন একটা লক্ষ্মী মেয়ে পাবার জন্য । আল হামদুলিল্লাহ ! নতুন করে জেগে উঠে তখন আমার প্রতি মুহূর্তের
সেই বিজয় আনন্দ । মনে পড়ে সেই বিজয় আনন্দের রাতটির কথা । নয় মাস দশ দিন লড়াই করে সেই যুদ্ধে বিজয় লাভ করার কথা । যখন আমি মা হয়ে ছিলাম । যখন আমার কন্যার নিস্পাপ মুখ খানা প্রথম দেখে ছিলাম । যেন পেলাম এ পৃথিবীতে আল্লাহর দেয়া শ্রেষ্ঠ উপহার একটি সুন্দর ফুল । সুবহান আল্লাহ !

আমি দেখেছি একটি সুস্থ শিশু ভুমিস্ট হবার পর পর ডাক্তার নার্সদের বিজয় আনন্দ কেমন হতে পারে । আমার কাছে মনে হয়েছিল, সেই মুহূর্তে বিজয় আনন্দ একজন মায়ের চেয়ে তাদেরও কম নয় । পৃথিবীর এমন শ্রেষ্ঠ সুন্দর অনেক ফুলের মতো একটি ফুলকে হাতে পাওয়ার সাথে সাথে আনন্দে ওরা চিৎকার দিয়ে ওঠে- মাসাআল্লাহ ! ইত্যদি ইত্যাদি । দ্রুত তারা অতি যত্নে নব শিশুটিকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল- তাদের অসাধারন কিছু গুরু দায়িত্ব পালনে । আর আমি আমার নয় মাস দশ দিন অপেক্ষার ফসল কে দেখতে পেয়ে আমার সেই অনভুতি ছিল অন্য রকম ।
আমার মনের অজান্তে মনটা তখন একটি কথা বলে উঠেছিল । এতদিন আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম ! কি আনন্দ ! আজ আমি আমার অস্তিত্বকে দেখলাম যেন ।যদিও সেই আনন্দ অনুভূতি প্রকাশ করার মতো আর কোন ভাষা আমার জানা নেই । একটি কথা বলতে পারি, পৃথিবীর কোন বিজয় আনন্দের সাথে মা হবার বিজয় আনন্দের তুলনা হয়না । এখনো চোখে ভাসছে আমার সেই ছোট্ট সোনামনির ঘনকালো লম্বা লম্বা চুল, ফুটফুটে মুখের আবরন আর ঐ লম্বা লম্বা ঘন কালো পাপড়ি মেলে তাকিয়ে ছিল অন্যদিকে । নার্সদের গুরু দায়িত্ব শেষ হলে, একজন নার্স আমার কলজের টুকরোটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে তৃপ্ত মনে হাসিমুখে আমাকে বলছিল- এবার আপনার পাশে শুইয়ে দিই । আমি এক পাশ থেকে আমার অস্তিত্বকে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম আর মনে মনে মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম ।

আমি জানতাম, এই বিজয় আনন্দ উপভোগ করার জন্য রাত জেগে মহা টেনশান, প্রয়োজনে বাইরে ছুটা ছুটি আর মনো প্রার্থনা করতে করতে বাইরে অপেক্ষা করছে একটি পুরো পরিবার, তাদের আকাংক্ষিত একটি বিজয় আনন্দ মুহূর্তটির জন্য । যারা এতদিন আমাকে অতি যত্ন দিয়ে হাতের তালুই রাখার মতোয় রেখে ছিল । যারা শুরু থেকেই প্রার্থনা করে আসছিল, বংশে প্রথম মেয়ের মুখ দেখবে বলে । তাই আর
দেরী না করে নার্সকে জানালাম- ওর পরিবারের সবায় ওকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছে । তাড়াতাড়ি দিয়ে আসুন । আমি আলতো করে আমার সোনামনির গালে হাত ছুঁয়ে আদর করে দিলে, নার্স খুশি মুখে হ্যাঁ যাচ্ছি, বলে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে তাই করল । আর সেই মুহূর্তে পূর্ণ হল আমার শশুর পরিবারের একটি মেয়ে পাবার আনন্দ ।
যে কথাটি কেউ আজো ভুলেনি- তা হল দাদার কোল থেকে নব শিশুটি তার দুচোখের ঘনকালো পাপড়ি মেলে, তাকে ঘিরে রাখা পরিবারের সবায়কে দেখছিল । আর তা দেখে সবার সাথে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা আমার দেবরের এক বন্ধু বলেই ফেলল –ওমা ! মেয়ে তো চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তার বাব-দাদা-চাচাদের দেখছে । তখনি মুখে হাসি লেগে থাকা পরিবারের সবায় একসাথে সজোরে হেসে দেয় । সেই হাসিতে ছিল একটি পরিবারের বিজয়ের আনন্দের সুর ।
আর সেদিনের সেই মুহূর্ত থেকে প্রতিটা দিন মুহূর্তে মুহূর্তে আমার মা হবার বিজয় আনন্দ অনুভূতির পাশাপাশি মনে মনে প্রার্থনা করি, যাতে আল্লাহ আমার সন্তানকে এবং প্রতিটি মায়ের সন্তানকে সুস্থ রাখে, নিরাপদে মানে-সম্মানে বাঁচিয়ে রাখে । আর আমরা প্রতিটি মা-ই যেন মায়ের গুরু দায়িত্ব পালন করে, মা হবার বিজয় আনন্দ নিয়ে সুখে বেঁচে থাকতে পারি । আমীন !


তিন

এইতো সেদিন । আমার খুকি স্কুল থেকে ফিরে বলছিল –আম্মু এবার থেকে অফিসের মাধ্যমে কেক পাঠানো বারন । আমরা অনেক অনুরোধ করার পর এখন ক্লাস থেকে বলে দিয়েছে । যদি জন্মদিন কেক আনতেই হয়, তা হলে নিজের হাতে করে আনতে হবে । আর তাই সবায় টিফিন বক্স করেই কেক আনছে । কিন্ত আমিতো এবার তিনতালা কেক দিতে চেয়েছিলাম । কিভাবে নেব আম্মু ?

জানিয়ে রাখি, আমার মেয়ের বায়না, প্রতিবছর একতালা করে কেক বাড়াতে হবে । সেই নিয়ম অনুযায়ী এবার আরো বাড়ানোর কথা । যে কারনেই হোক, তার বায়না এখনো তিনতালায় সীমাবদ্ধ আছে । আর আমিও আমার সামর্থ্য জানিয়ে তার জন্মদিনের আবদার টুকু রাখার চেষ্টা করি, কারন এখনো তার বোঝার বয়স হয়নি । যাই হোক, তার কথায় আমি মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম । বললাম – ভালোইতো হয়েছে । বিদ্যুতের যা সমস্যা, অতো গুলো কেক বানাতে আমাকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে । তার চেয়ে বরং একটা কেকেই নিয়ে যেও । আর বাসার জন্য একটাতো হবেই ।
সে চিন্তিত হয়ে বলল- কিন্ত আম্মু, আমার বন্ধুরা এবারও বলে দিয়েছে, কেউ চকলেট কেক খাবে আর কেউ বলেছে ভ্যানিলা কেক আনতে । মিসদের তো সমস্যা নেই । তোমার যে কোন কেকেই মিসদের পছন্দ । আমি চেয়ে ছিলাম এবার কেকটা যেন আগের কেকের চেয়েও সুন্দর হয় । একটা কেক দিলে কি করে হবে আম্মু ?
আমার মেয়ে তার পোশাক এবং খাবার-দাবারের প্রতি তার চাহিদা অনুযায়ী বেশ সৌখীন ও যত্নশীল । পাশাপাশি সে যাতে নিজেকে আত্মবিশ্বাসী হতে শেখে, তাই অন্য সময়ের মত মজা করে বললাম-
আরে দেখইনা । সেটাতো আম্মুর হাতের জাদু ।
আমার কথায় সে নিশ্চিন্ত হয়ে গেল । কারন সে তার মায়ের সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানে । সেই ছোট বেলা থেকে দেখে এসেছে সে । প্রতি বছর তার জন্মদিনে আমার নিজস্ব তৈরি কিছু নতুনত্ব খাবার উপহার দিতে । কিন্ত দুর্ভাগ্য, সেদিন কেক বানাতে গিয়ে ডীম বীট করা শেষ হলে, কোকো পাওডার যেটুকু ছিল হাতে নিয়ে দেখি তা নষ্ট হয়ে গেছে । হঠাৎ বিদ্যুতটাও চলে গেল ।যারা বাসায় কেক তৈরি করেন , এই অবস্থায় একটা গ্যাস ওভেন না থাকলে কি বেকায়দায় পড়তে হয় বেশ বুঝতে পারছেন ।বাকী যাই ঘটুক, এক সময় বিদ্যুৎ এল । শেষ পর্যন্ত আমাকে আর বিলম্ব না করে মেয়ের এক গ্রুপ বন্ধু খুশি হবেনা জেনেও পুরোটাই ভ্যানিলা কেক বানাতে হল । আর আমি যে রাতটা বিজয় আনন্দ পাবার জন্য লড়াই করে ছিলাম, সে রাতের কিছুটা সময় কাটাই, একটা ছোট কেক ডেকোরেশন করে । কাজ শেষে এসে দেখলাম, আমার মেয়েটি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাচ্ছে । তারপর অন্যদিনের মতো তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু দিয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়লাম ।


সকাল বেলা আমার মেয়ে কেক দেখার আর সময় পেলনা । প্রতিদিনের মতো তাড়াহুড়ো করে আমি তাকে স্কুল দিয়ে এলাম । অবশ্যয় আমিই কেক দেখার সুযোগ দিইনি তাকে সারপ্রাইজ দেব বলে । তবে সে জানত, এবার তার জন্মদিনে স্কুলে একটা প্লেইন সবুজ কেক কাটবে । কেক সাজানো বলতে এ টুকুই, তাও শুধু ভ্যানিলা কেক । আর তাই মেয়ের মনটা খুব খারাপ না হলেও খুব যে খুসি হতে পারলনা- তা খুব সহজে বুজতে পারলাম আমি ।
ওর জন্মদিনের কেকটা কেমন হবে- তা নিয়ে তার ক্লাসের বন্ধুদের জল্পনা কল্পনা ও কৌতূহল আগে থেকেই থাকে । আর তাই টিফিন ঢাকনা খোলার আগে সে তার বন্ধুদের জানিয়ে দিল –দেখ তোমাদের অতো খুসি হয়ে লাভ নেই ।এবার যেহেতু টিফিন কেক, তাই কেকটা তোমাদের পছন্দ মতো হয়নি । শুধু দেখে খুসি হবে এবার পুরো কেকটি সবুজ ।
যথারীতি টিফিন ঢাকনা খোলা হল । সাথে সাথে তার বন্ধুরা সবায় হৈ চৈ করে উঠল – ওয়াও!
বাচ্চাদের যতটকু বুদ্ধি ঠিক ততভাবে সকলের প্রশ্ন – আন্টি এত সুন্দর সবুজ কেক কিভাবে বানাল ? সবুজের ভেতর অতো গুলো সাদা ফুল ফুটল কি করে ? পাতাগুলো কিভাবে দিল ? ইত্যাদি ।
আমার মেয়ে চোখ ছানা বড়া করে কেকের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন । বন্ধুদের মতো একি ভাবে অনেকগুলো প্রশ্ন তার মনের মধ্যেও আটকে রইল । তারপর সকলের কথার উত্তরে এক কথায় জবাব দিল শুধু – আরে তোমাদের মতো আমিও সারপ্রাইজ ! তখন মনে পড়ল তার মায়ের কথা । তারপর বলল –এসব আমার আম্মুর হাতের জাদু, বুজেছ ?
তারপর সে আনন্দ মনে স্কুল থেকে ফিরে যখন আমাকে গল্পটি বলছিল, শুনে তৃপ্ত মনে ভাবছিলাম তখন, সবুজের ভেতর সাদা সাদা ফুল ! সাদা মানেইতো শান্তির প্রতীক ! আর কিভাবে করলাম ? আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে একদিন তোমরাও পারবে ইনশাআল্লাহ ! এবং বুঝতে পারবে, আমার এই ছোট্ট সৌখীন জাদু ছিল একজন মায়ের বিজয় আনন্দ । আর কিছুই নয় ।


মন্তব্যঃ আমার মা হবার আনন্দটুকু প্রকাশ করার একটাই কারন । পৃথিবীর কোন বাবা-মা যেন একটি ভ্রুনও হত্যা না করেন । ভালো থাকুন সবায় । ধন্যবাদ !
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ আক্তারুজ্জামান ভালো পর্যবেক্ষক মানে শক্তিমান লেখক। আপনি রাস্তার মানসিক রোগী দেখেন, ডাস্টবিনে খাবার কুড়ানি মাঝ বয়সী মাকে দেখেন, নিজের সন্তানকে উপলব্ধি করেন সুতরাং আপনি এই সমাজচিত্র ভালোভাবেই আঁকতে পারেন। অনেক অনেক শুভকামনা।
মাহমুদ হাসান পারভেজ বাকি অংশটি পড়া হলো। এটি আমার মেয়েরও গল্প হতে পারে। হুবহু এইভাবে না হলেও। ওর মায়ের বিজয় আনন্দ অনুভুতিগুলো অনুভব করতে পারছি। তবে রাস্তার সেইসব ছন্নছাড়া সহায়হীন মানুষগুলোর কথা চিন্তা করলে সে বিজয় আনন্দটা বিষাদে রূপ নিচ্ছে। আপনার জন্য শুভকামনা।
মনোয়ার মোকাররম ছোট ছোট অনুভুতির চমৎকার মেলবন্ধন ... ভালো লাগল ...
শাহ্ আলম শেখ শান্ত অসংখ্য ভাল্লাগা জানালাম । আমার লেখায় আমন্ত্রণ রইল ।
ধন্যবাদ ! আপনার আমন্ত্রনের অনেক আগেই আপনার লেখায় পড়া ও শুভকামনা দিয়েছি ।
এশরার লতিফ এই ছোট ছোট সুখ্গুলোই তো জীবনের সত্যিকার বিজয় যার অভাব অনেক বড় বড় সাফল্যও পূরণ করতে পারে না। ভালো লাগলো এই অতি আন্তরিক লেখাটি।
আপনাদের ভালোলাগা ও অনুপ্রেরনাই আমার গল্পের সার্থকতা । আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ! ভালো থাকবেন ।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি একজন সফল মা হতে গলে এমন লেখার বড় বেশী প্রয়োজন,,,আর মন্তবের কথা গুলো গল্পের মান বাড়িয়েছে...অনেক ধন্যবাদ রুমা
অনেক অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই দাদা । আপনার মন্তব্য পড়ে আমার খুব ভালো লাগলো ।
মিলন বনিক নিজের মনের কথাগুলোর খন্ড খন্ড অনুভুতিগুলো চমত্কার হয়েছে...ভালো লাগলো মানুষ হিসেবে আমাদের মানবিক বোধ টুকু তুলে এনেছেন...শুভ কামনা.....
আপনার মন্তব্য জেনে খুব ভালো লাগলো দাদা । শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানবেন ।
শ্রেয়া চৌধুরী দারুন গল্প ....ভালো লেগেছে আমার .
স্বাগতম শ্রেয়া ! অনেক অনেক ধন্যবাদ !
হাফিজ রাজু চমৎকার সত্যি কথা গুলো বলেছ আপু, মা এবং সন্তানের ভালবাসা ই ফুটে উঠেছে দারুন ভাবে আপনার লেখাটাতে, মায়েরা এমন ই হওয়া চাই।
ধন্যবাদ ছোট ভাইয়া । ভালো থেক ।
রিক্তা রিচি বাহ !!!! দারুন .
অনেক ধন্যবাদ আকলিমা, ভাল থেক ।

১৪ অক্টোবর - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪