আটই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ইং। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শহীদ মিনারের সিঁড়িতে মেয়েটি বসে আছে। একা এবং কিছুটা উত্তেজিত! কিছুক্ষণের ভিতরেই সে আসবে। সবার মত আজ কি সে ওকে প্রপোজ করবে? আজ না প্রপোজ করার দিন!!! যদি না করে?
দূর থেকে বাইকের শব্দে আকৃষ্ট হয়ে মুনা সেদিকে তাকালো। হ্যা! সোহেলই তো!! এক ঝলক অতিরিক্ত রক্ত মুনার হৃদয় থেকে সারা শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে ওকে রাঙিয়ে দিল। বাইক একেবারে সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়ায়। লাল গোলাপ হাতে সোহেল ধীরে ধীরে সিড়ি বেয়ে উঠে আসছে। আজ কেন জানি মুনার কাছে ওকে খুব ম্যানলি লাগছে। আশেপাশে কয়েকটি জুটি হাতে হাত রেখে বসেছিল। সোহেলকে এগিয়ে আসতে দেখে যে যার মতো কেটে পড়ল। সে সোজা মুনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বসা অবস্থায়ই মুনা বলল, 'হাই!' মুনার চোখে চোখ রেখে সোহেল হাসল। হাঁটু ভেঙ্গে ওর সামনে বসলো। এরপর মুনার একটা হাত ধরে বলল, ' কেমন আছ তুমি?' 'ভালো।' ' শোনো মেয়ে। আমি ভান করতে পারি না... কথার পিঠে কথাও বলতে জানি না। তাই সোজাসুজিই তোমাকে বলছি... I Love You মুনা!' কেন জানি কেঁপে উঠল মুনা। সেটা লক্ষ্য না করে সোহেল গোলাপের স্টিকটা মুনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ' Will You Be My Valentine?'
এবার সোহেলের চোখে তাকিয়ে মুনা হাসলো। এক হাত দিয়ে গোলাপের স্টিকটা নিলো। অন্যহাত সোহেলের হাতে রেখে ভাললাগা অনুভব করল। গাঢ় স্বরে বলে, ' আমি তোমার ফুল গ্রহন করলাম। কিন্তু এই মুহুর্তে তোমাকে গ্রহন করতে পারছি না।' 'কেন?' 'আমি এবং তোমার মাঝে এখনো অনেক দূরত্ব রয়ে গেছে। ... তোমার পলিটিক্যাল ইমেজ আমাকে কাছে আসতে দিচ্ছে না।' 'আমি ঠিক বুঝলাম না...' 'তুমি কি লক্ষ্য করেছ, তোমাকে আসতে দেখে অন্য ছেলে-মেয়েরা কীভাবে উঠে চলে গেলো?' ' ওরা আমাকে সম্মান করে। এই জন্যই তো ... ' না সোহেল, ওরা তোমাকে আসলে ভয় পায়। তোমার কোমরের ঐ অদৃশ্য অস্ত্রটাকে ও ওরা ভয় পায়... তুমিসহ তোমাদের ছাত্র সংগঠনের বেপরোয়া মনোভাবাপন্ন কর্মীদেরকে ওরা ক্যাম্পাসে অ্যাকশনে দেখেছে। কতটা নির্মম হতে পারো সেটাও সবার চোখে ভেসে আছে... এজন্যই ওরা তোমার থেকে দূরে থাকতে চায়।' ' কিন্তু আমি তো তোমাকে ভালবাসি!' 'একই হৃদয়ে কীভাবে ভালবাসা ও হিংস্রতা থাকতে পারে? আজ ছোট ছোট ভাললাগা... খুশীকে অনেকে ভালবাসা মনে করছে। কিন্তু এটাই আসলে ভালোবাসা নয়। এভাবে সারাজীবন মানুষ একটা ভুলের ভিতরে থাকে... মনে করে সে কাউকে ভালবাসছে... অথচ এটা সঠিক নয় সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পায় না।' 'তাহলে... এখন কি করতে হবে আমাকে?' সোহেলের প্রশ্ন শুনে ওর চোখে চোখ রাখে... খুব বিষন্ন একটা নদীর ভিতরে হারিয়ে যেতে যেতে মুনা বাস্তবে ফিরে আসে এবং বলে, ' আমি চাই ১৪ তারিখে তুমি এই একই যায়গায় যখন আমার কাছে আসবে- তোমাকে দেখে কেউ ভয়ে সরে যাবে না... ভালবাসা তো একে অন্যের কাছে টানে... দূরে সরাবে কেন?' 'আর?' 'তোমার কোমরের ঐ অস্ত্রটি থাকবে না...' স্মিত হেসে সোহেল জিজ্ঞেস করে, ' আর কিছু ডার্লিং? ... আর শর্ত দিয়ে কি ভালোবাসা হয়?' ' আপাতত আর কিছু নয়... ডার্লিং! শর্তের কথা বলছ? এটা শর্ত নয়... তোমাকে কাছে পেতে আমার ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ!!'
দু'জনে হাত ধরে থাকে দীর্ঘক্ষণ... হাসতে থাকে। যে ভাললাগা এই প্রপোজ ডে'তে ওদের মাঝে তৈরী হল... সেটাকে অনুভব করতে থাকে। দুজনের ভিতরের এই অনাবিল হাসিতে ভালোবাসাই ঠিকরে বের হয়... বয়ে যেতে থাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের সর্বোচ্চ শহীদ মিনারের পাদদেশকে ঘিরে। সেখানে এই মুহুর্তে হিংস্রতার কোনো আভাষ পাওয়া যায় না।
১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ইং।
খুব ভোরে রায়হান ক্যাম্পাসের শিক্ষকদের মসজিদটির দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। আজান কেবল দিচ্ছে। ওর মতো ঘুমকাতুরে মানুষ সেই সারা রাত জেগে ছিল শুধুমাত্র এই ভোরবেলায় ঊঠার জন্য। মসজিদটির পাশে একটি শিউলি গাছ আছে। ফুলে ফুলে ভর্তি। দেখেছে গতরাতে। একেবারে সকালে গেলে গাছের নীচে পড়ে থাকা 'ফ্রেশ ফুলগুলো' নিতে পারবে। একটা মালা গেঁথে কনাকে দিতে পারবে। আজ তো ভ্যালেন্টাইন্স ডে! আর সে হল একজন চরম বেকার... পকেটে একটা টাকাও নেই। কিছু লাগলে কনার কাছে চাইতে হয়। পাঁচ টাকা দিয়ে নার্সারীতে ফিয়ে একটা গোলাপ কিনবে- সেই টাকাটা ও নেই। আর কনার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওকে ফুল দেয়া... নাহ! এটা চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় ও হেংলামো হবে।
শিউলি গাছটির নিকট যখন এলো, মুসল্লীরা তখনো কেউ আসা শুরু করেন নাই। গাছের নীচে তাকিয়ে মনটা ভরে গেলো! ফুল আর ফুল! সৃষ্টিকর্তা মনে হয় ওর জন্য আজ এই অঢেল ফুলের যোগাড়যন্ত্র করে রেখেছেন। পকেট থেকে পলিথিনের প্যাকেট বের করে প্রসন্ন মনে আলতো করে রায়হান ওর হৃদয়ের নির্যাসগুলোকে ব্যাগে ঢুকাতে লাগে...
প্রতিদিনের আয়-ইনকাম প্রায় একই। তাই দিনের শেষে বাজার করে বউ এর কাছে যখন ক্লান্ত দেহে টাকাটা তুলে দেয় তখন কেমন এক বোবা- বিষন্ন ভাবনায় ডুবে থাকে মনটা। গাঁজার নেশায় বুদ হয়ে সারাদিন রিক্সা চালালেও ভাড়া বাসায় এসেও রাতে কল্কিতে এক দু' টান না দিলে ফজলের কেন জানি হয় না। এটা রোজকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এরপর বিছানায় বউকে নিয়ে... ওটাও রুটীন অভ্যাস। কিন্তু এরি মাঝে কখনো বউকে ভালভাবে দেখা কিংবা বলা হয়ে উঠে না নিজের মনের কথাগুলো। বিয়ে তো সে প্রেম করেই করেছিল। প্রেম? নিজের মনেই নিজে হাসে ফজল। একজন রিক্সাওয়ালার কি প্রেম হতে পারে? কিংবা সেটা ফলাও করে ভাববার বা কাউকে বলার মতো কিছু? তবে বাংলা সিনেমায় ওদেরকে নিয়ে অনেক কাহিনী তৈরি হয়েছে। তবে সেগুলো বাস্তবে থৈ পায় না।
আজ বঊকে টাকাগুলো দিতে গিয়ে একটু বিশেষ ভাবে ওর দিকে তাকায়। কিছু টাকা বেশী দেখে বউ ও জিজ্ঞাসু নেত্রে ফজলের দিকে তাকালো। বলল, 'কি, শরীর খারাপ নাকি? ... আইজ যে কিছু না খাইয়া ই আইলা?' কিছু না বলে পকেট থেকে বকুল ফুলের একটা মালা বের করে। আর একটা সুগন্ধি তেল। এই তেলের জন্য ওকে কতদিন বলেছে হাসিনা। কিন্তু বাজার খরচের পর নিজের গাঁজার পোটলা কিনতেই তো টাকা সব শেষ। আজ তিনদিনের গাঁজার টাকা বাঁচিয়ে এ দু'টো কিনেছে। তবে হাসিনা গত তিনদিনে ফজলের পরিবর্তন সেভাবে দেখে নাই। অবাক হয়ে বলে, ' এগুলো কি আমার ?' ' হ্যা রে বউ। তোর গন্ধওয়ালা তেলের শিশি ... আর এই মালাটা রাত্রে খোপায় দিয়া আমার কাছে আইবি... ' এতো সোহাগ যে! মাথা ঠিক আছে তো? নাকি অন্য কিছু খাইয়া আইছ আজ?' ' না বউ। আইজ নাকি ভালোবাসার দিন । ক্যাম্পাসে দেখলাম সবাই একজন আরেকজনেরে কত কিছু দিতাছে... হাতে হাত ধইরা ঘুরতাছে। আমি রিক্সাওয়ালা বইলা কি মানুষ না?' ফজলের কতা শুনে হাসিনার চোখ ভিজে আসার উপক্রম হলে সে কিছু একটা ছূতো ধরে কাজের নাম করে ফজলের সামনে থেকে সরে যায়। তবে বকুল ফুলের মালা ও সুগন্ধি তেলের শিশিটি নিতে ভুল করে না। এটা যে অনেক ত্যাগের মাধ্যমে ফজলের ওর জন্য নিয়ে আসা!
কনা সব কাজ গুছিয়ে বাবুকে ঘুম পড়িয়ে স্কুলের খাতা কাঁটা শেষ করল। এরপর ড্রয়িং রুমে টিভি দেখতে এসে দেখে রায়হান একা বসে আছে। টিভি বন্ধ। তবে রুমটা খুব সুন্দর একটা গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ওর উপস্থিতিতে রায়হান ওর দিকে ফিরে তাকায়। কনা পাশে গিয়ে বসে। জিজ্ঞেস করে, 'কি মন খারাপ নাকি?' 'কেন জিজ্ঞেস করছ?' ' না... চুপচাপ একা বসে আছ... টিভিও বন্ধ। তাই ভাবলাম...' ' আজ ভ্যালেন্টাইন্স ডে!' ' তাই নাকি?' ' হ্যা, তোমার জন্য কিছু গিফট যে আনবো সে সামর্থ তো আমার নেই। তাই...' অবাক হয়ে রায়হানকে দেখে কনা। একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয় এই মুহুর্তেই ওর হৃদয়ে। কিছু একটা ওকে তাড়িত করে বেসামাল করে দেয়ার আগ্মুহুর্তে সে জিজ্ঞেস করে, ' তাই কি?' 'শিউলি ফুলের একটা মালা বানিয়েছি... আমি নিজে! ... তোমার জন্য' 'ফুল কোথায় পেলে? ... আর এতো ভোরে উঠলে কীভাবে?' ' রাতে ঘুমাই নি।' 'ও'। রায়হান মালাটা বের করে কনাকে দেয়। ওলটপালট ভালোবাসায় আক্রান্ত এক যুবতি ভালবাসা দিবসে তার বেকার প্রিয়তমার কাছ থেকে হৃদয়-নিংড়ানো ভালোবাসা গ্রহন করে অভিভূত হয়ে পড়ে... কিছুক্ষণের জন্য! এরপর মালা হাতে ড্রেসিং টেবিলের উদ্দেশ্যে বেডরুমের দিকে চলে যায়।
সর্বোচ্চ শহীদ মিনারের পাদদেশে মুনা আজও একা বসে ছিল। পড়ন্ত বিকেল বেলায় সোহেল এলো। আজ আর বাইকের শব্দে সে কারো ধ্যান ভাঙ্গালো না। হাতে এক গুচ্ছ রজনিগন্ধা ও এক তোড়া টকটকে লাল গোলাপ নিয়ে সে যখন মুনার পাশে এলো তখন দিনের সুর্য অস্ত যায় যায়। মুনা ভালো করে সোহেলকে দেখল। নাহ! আজ শার্ট ইন করে এসেছে। আর কোমরের কাছটা ও অদ্ভুদ ভাবে ফুলে নেই। একটা সুন্দর ভালোলাগার অনুভুতি মুনাকে ফুরফুরে মেজাজ এনে দিলে। সে মুক্ত প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াতে লাগল তার নিজের ভুবনে... যেখানে এই মাত্র ওর প্রিয় মানুষটি একাধারে বন্ধুত্তের ও ভালবাসার রঙে রাঙানো কিছু ভালোলাগা নিয়ে ওর সামনে হাজির হয়েছে। সর্বোচ্চ শহীদ মিনারটি ও যেন আজ ওদের প্রেমের পরিপুর্ণতায় নিজেও পুর্ণ হল!! দীর্ঘক্ষণ সোহেল ও মুনা এঁকে অপরের পাশে নিশ্চুপ হাতে হাত রেখে বসে রইলো। চুপচাপ থাকলেও ওদের কথা হ'লো হৃদয়ে-হৃদয়ে!
রায়হানের বিছানায় কনা এলো খোঁপায় শিউলি ফুলের মালা জড়িয়ে... ফজলের সামনে হাসিনা বেলীফুলের ঘ্রাণে ওকে মাতাল করে দিতে... মুনার হৃদয়ে সোহেল নির্ভরতার প্রতীক হয়ে... এরা সবাই এক অন্যরকম ভালোলাগা নিয়ে এঁকে অপরকে জীবনের মানে নতুনভাবে উপলব্ধি করাতে চাইলো 'ভালবাসার দিনে'! আর এদের ভিতরে উজাড় করা ভালোবাসা ঢেলে দিতে দিতে ভালবাসার সৃষ্টি যেখান থেকে সেই সর্বময় স্রষ্টা সস্নেহে ভাবছেন এরা বছরের সব দিনগুলিতেও কেন এভাবে কানায় কানায় ভালোবাসায় পুর্ণ হয়ে থাকতে পারে না!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
লায়লা মামতাজ
একি ব্যাপার?!! একই লেখকের একটি লেখায় ভোটিং রয়েছে, অন্যটিতে নেই!!! বুঝলাম না। যাহোক, ভালোলাগা রেখে যাচ্ছি। অনেক অনেক অভিনন্দন। আপনি খুব ভালো লেখনে ।
এভাবেই চলছে পুরো দেশ। অযোগ্য লোকগুলোকে গুরুতবপুর্ণ যায়গাতে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্য একজনের কবিতা বিজয়ী হয়েছে, আর এরা আমার লেখায় ভোটিং বন্ধ করেছে বিজয়ী মনে করে। আজ তিন দিন পর্যন্ত এদেরকে বার্তা পাঠিয়েও কুম্ভকর্ণদের ঘুমা ভাঙ্গাতে পারি নাই। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।