শিশির বিন্দু

দিগন্ত (মার্চ ২০১৫)

মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্
  • ১৮
  • ৩২
ফজরের নামাজ পড়েই আর যেন তর সইছিল না বিন্দু’র । ছেলে-ছেলের বউ আর নাতি-নাতনী নিয়ে এখনই সে বেড়িযে পড়তে চায় । ইতোমধ্যেই অটোরিক্সাও বাড়ির সামনে এসে হাজির । অটো ড্রাইভার আরমান ততোক্ষণে চাচী চাচী বলতে বলতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছে । তখণ তখণই বিন্দুও ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে উঠোনে নেমে এসেছে । আলো আধারীর ভেতর দিয়ে তখনও সূর্যের আলো ঠিকরে বেড়োয়নি । বাড়ির প্রধান ফটক দিয়ে বেড়োবার সময় কাঁঠালী চাঁপার ঝাঁঝটা নাকে এসে ঢোকার সাথে সাথে বিন্দুর চোখ দু’টো কাঁঠালী চাঁপার গাছ হয়ে ফিরে আসার সময়ই দেখল, বকুল আর শিউলী ফুল গুলো কেমন অনাদরে পড়ে আছে গাছের তলায় । আলতো করে গায়ে জড়ানো চাদর টা অটোতে ওঠার সময় খসে পড়ছিল গা থেকে । নাতনীটা চাদর সহ দাদীকে ধরে আস্তে করে অটোতে তুলে দিয়ে নিজেও তার পাশেই বসে পড়ল । ছেলে-ছেলে বউ আর নাতিটাও উঠে বসতেই আরমান ছেড়ে দিল অটোরিক্সা । পিচঢালা মসৃণ পথ বেয়ে টানা বিশ মিনিট চলার পর থেমে গেল অটো । সকালের চকচকে সোনা রোদে দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ হেসে উঠলেও হাসতে পারছে না বিন্দু আর তার সহযাত্রীরা । আরমান অটো থেকে নেমে দাঁড়াতেই নাতনীর হাত ধরে নেমে আসে বিন্দু । ফসলের মাঠের উপর দিয়ে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাসের সাথে চোখ দু’টো হারিয়ে যায় দিগন্তে । একটা অব্যক্ত বেদনা সারা দেহ মুখে ছড়িয়ে দিয়েছে ক্লান্তির ছাপ । আসলে আজ ভোরে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই তার মনটা ভাল নেই । বাড়ির সবাই সেটা লক্ষ করেছে অবশ্য সবার মনই প্রতি বছর এই দিনটায় খুব খারাপ থাকে । বিয়াল্লিশটা বছর এভাবেই চলছে ! বিন্দু‘র একমাত্র ছেলে অনন্ত তার মাকে ইশারা করতেই বিন্দু সবাইকে নিয়ে দু’পাশের মাঠ ভরা সোনালী ফসলের মাঝ খান দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া পায়ে হাঁটা আইল ধরে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে থাকে দিগন্ত পেরিয়ে । সকালের মৃদু সমীরণে শিশির বিন্দুকে মাথায় নিয়ে একটু একটু করে দুলছিল সমস্ত মাঠের ফসল যেন ঢেউ খেলে যাচ্ছিল প্রশান্ত সাগরে । ঘাসের ডগায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু শিশিরে ভিজে যাচ্ছিল পা থেকে হাঁটু পর্যন্ত । এমন মৃদু-মন্দ বাতাশে মেজাজটা ফুরফুরে থাকার কথা হলেও বিন্দুর ভেতরে চলছিল বেদনার ঝড়-তুফান ! দীর্ঘ দিনের সঞ্চিত দুঃখবোধ আজ দু’চোখের অশ্রু হয়ে ঝড়ে পড়ছিল ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে । কিছুতেই যেন নিজেকে আর সামলাতে পারছিল না । মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল আর সে কারণেই হঠাৎ করে পা ফসকে পড়ে যাচ্ছিল বিন্দু । কিন্তু পিছনে থাকা আরমান সাথে সাথে চাচী বলে জাপটে ধরায় রক্ষা পায় সে । আরমানের সাথে বিন্দুর রক্তের কোন সম্পর্ক না থাকলেও আত্মার সম্পর্কের কারণেই আরমান বিন্দুর সাথে ছায়ার মত লেগে থাকে বিপদে-আপদে বন্ধুর মত । আরমান বিন্দুর স্বামী শিশিরের প্রতিবেশী এবং সবচেয়ে ঘনিষ্ট বাল্যবন্ধু লুকমানের সন্তান । বাবার নির্দেশেই ফরমান বিন্দু’র সেবা যত্ন করলেও লুকমান কখনও ভয়ে তার সামনে আসে না তবে দুর থেকে ঠিকই মঙ্গল কামনা করে । লুকমান ছিল অনন্ত’র বাবা শিশিরের আত্মার সাথী । যেদিন শিশিরের সাথে বিন্দুর প্রথম সাক্ষাৎ হয় সেদিনও লুকমান শিশিরের সাথেই ছিল । তখন বিন্দু দশম শ্রেণীর ছাত্রী । স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরছিল । থানা সদর থেকেও বেশ খানিকটা দুরে ওদের বাড়ি, তখনও রাস্তা পাকা হয়নি, কদাচিৎ দু’একটা বাস -ট্রাক সারা দিনে ধুলা উড়িয়ে চলা ফেরা করে । তাতে মানুষ তো বটেই এমনকি আশপাশের জীব জন্তুও ভয়ে তটস্থ থাকে । সেদিনও গাড়ির আওয়াজে খুঁটিতে বাধা একটা বাছুর রশি ছিড়ে ধেয়ে আসছিল বিন্দুর দিকে, রাস্তার অপর পাশ দিয়ে সেনা বাহিনীর অফিসার পদে সুযোগ পাওয়া শিশির ট্রেনিং শেষ করে বাড়ি ফিরছিল । লুকমান তাকে ষ্টেশন থেকে আনতে গিয়েছিল । হঠাৎ করে আতঙ্কিত বিন্দুর উর্ধশ্বাসে ছুটতে দেখে বেডিং-পত্র ফেলে ছুটন্ত বাছুরের সামনে থেকে ছোঁ মেরে বিন্দুকে সরিয়ে নিতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে দু’জনাই রাস্তা থেকে পরস্পর জড়াজড়ি করে পানি ভর্তি খালের মধ্যে গড়িয়ে পড়ে । বাছুরের শিং এর গুতো থেকে বাঁচলেও গড়িয়ে পড়ার সময় খেজুরের কাঁটার আঁচরে ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেল না কেউই । সেদিনের সেই কথা মনে করে ওরা দু’জনাই কত দিন যে হেসে গড়াগড়ি খেয়েছে তার আর হিসেব নেই । দু’জনার শরীরেই কাদা-মাটি আর রক্তের মাখামাখি দেখে বিন্দুর বাবা হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারছিল না । তার উপর আবার চেয়ারম্যানের ছেলে শিশির কে এ অবস্থায় দেখে শুধু বিরাট একটা বিস্ময় আর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে । বিন্দুই তার বাবাকে সবিস্তার খুলে বলায় শিশির কে তিনি খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে ফ্রেস হয়ে আসার জন্য তাগিদ দিলেন । কারণ বিন্দুর বাবা সেই আমলের একজন এল,এম,এফ ডাক্তার । দু’জনাই ফ্রেস হয়ে আসার পর ডাক্তার সাহেব যখন তাদের চিকিৎসা দিচ্ছিলেন তখনই তারা পরষ্পর কে যে ভাবে দেখছিল একই এলাকার মানুষ হওয়া সত্বেও আগে কখনও সে ভাবে তারা কেউই পরষ্পর কে দেখেনি । শিশির শুধু চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে তাই নয় উপরন্তু সে সেনাবাহিনীর অফিসার বলে এলাকার সবারই গর্বের ধন । যে কারণে ডাক্তার সাহেবের ব্যস্ততা এবং অস্থিরতা ছিল চোখে পড়ার মত । শিশির অবশ্য বার বারই তেমন কিছু হয়নি বলে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করছিল । এরই কোন এক ফাঁকে শিশির লক্ষ্য করল বিন্দুর কৃতজ্ঞতা ভরা ব্যথিত দু’টি চোখ । আর এই প্রথম খেয়াল করল বিন্দুর অপরূপ সৌন্দর্য্ ।


মাত্র তো একমাসের ছুটি তারমধ্যে বেশ কয়েকটা দিন বিশ্রামেই কাটাতে হ’লো বলে শিশিরের মনে গ্রামময় ছুটে বেড়ানোর আনন্দটা কমে গেল । এতটা বয়স হয়েছে তবুও ছেলে মানুষের মত দস্যিপনা এতটুকুও কমে নাই । কে বলবে যে শিশির চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে এবং সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ! বন্ধুদের সাথে কখনও খেজুরের রস খাওয়া, কখনও রসের নালে ছনের কাঠিতে আঠা লাগিয়ে পাখী শিকার, কখনও বিলে মাছ ধরা, কখনও আবার চাঁদনী রাতে ক্ষেতের কুসোর(আঁখ) ভেঙ্গে বন্ধুদের সাথে স্কুল মাঠে বসে বসে খাওয়া আর আড্ডা পেটা ! কি যে আনন্দ তার উপর এবার গ্রামে এসেছে পুরো দু’বছর পর । শরীরটা খুব বেশী খারাপ না হলেও একটু বিশ্রামে থাকাই উত্তম মনে করে বাড়িতেই শুয়ে ছিল আর সেই ফাঁকেই বিন্দুর কথাটা মনে পড়ে গেল । মেয়েটা আসলেই খুব সুন্দর ! আরও বেশী সুন্দর মনে হ’লো ওর মনটা ! সে নিজেও তো ওর মতই আহত অথচ নিজের কথা না ভেবে শুধু ওর জন্যই তার যত অস্থিরতা ! সেদিনের কথা মনে হতেই হাসিও যেমন পাচ্ছিল তেমনি আবার অন্য রকমের একটা শিহরণও হৃদয়ের মাঝে খেলে যাচ্ছিল ! যে কারণেই নানান রকম সব এলোমেলো ভাবনা এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল উদাসী হাওয়ায় ! বিন্দুর মনেও ভাবনার উদ্রেক কম নয় ! তবে শিশিরের জন্যই তার যত চিন্তা ! বরাবরই শিশিরের এ অবস্থার জন্য নিজেকেই বড় অপরাধী ভাবতে শুরু করেছে ! সে কারণে মাঝে মধ্যেই শিশিরের জন্য আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থণা করছে । আর যখনই ঘটনার কথা মনে পড়ছে তখনই লাজে রাঙা মুখটি নিজের অজান্তেই উড়নার আঁচলে লুকিয়ে শরমে মরে যাচ্ছে ! কি হতে কি হয়ে গেল ! এই ভাবনাই তাকে সারাদিন অন্যমনস্ক করে দিচ্ছিল ! দেখতে দেখতে মাস শেষ, এবার তো শিশিরের কর্মস্থলে ফিরে যাবার পালা । যদিও পরষ্পরের মাঝে কোন দেখা সাক্ষাৎ বা যোগাযোগের কোন ঘটনা ঘটেনি কিন্তু ছুটি শেষে যেন উভয়ের মাঝেই একটা অস্থিরতা পেয়ে বসেছে । অবশ্য বিন্দুর সাথে কখনও সখনও লুকমানের দেখা সাক্ষাৎ হয় সেই সুবাদেই বিন্দু জানতে পারে শিশিরের বিদায়ের সময় সূচী । শিশিরও যে একেবারেই খোঁজ খবর নেয় নাই তা নয়, কিন্তু সেক্ষেত্রেও মাধ্যম ছিল লুকমানই । প্লাটফরমে ট্রেন দাড়িয়ে আছে, লুকমান গিয়েছে টিকিট আনতে এরই মাঝে শেষ পর্যন্ত লাজ শরম ত্যাগ করে বিন্দু এসে হাজির ! শিশিরের মনেও বিন্দুকে একবার দেখার আগ্রহ যে জাগে নাই তা নয় কিন্তু এভাবে যে দেখা হয়ে যাবে তা কখনও ভাবে নাই । ঘটনার আকস্মিকতায় পরষ্পর অনেক্ষণ শুধু তাকিয়ে রইল নির্বাক পরষ্পরের দিকে ! কি বলবে কেউই বুঝে উঠতে পারছিল না । এর মাঝেই লুকমান টিকিট নিয়ে হাজির । লুকমান নিজেও যার পর নাই অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ওদের দিকে । এমন সময় ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠতেই লুকমান নিজের উপস্থিতি জানান দেয়ায় তারা দু’জনাই অপ্রস্তুত হয়ে গেল । কিন্তু সময় অভাবে কিছুই বলা হ’লো না । তবুও এক প্রকার জোর করেই বিন্দু শিশিরকে বলে বসল, “আপনার শরীর এখন কেমন ? কিছুদিনের মধ্যেই আমার পরীক্ষা, দো’য়া করবেন ।” একটানা কথা গুলো বলেই যেন একেবারে হাঁপিয়ে উঠল । শরমে লাল হয়ে গেল সমস্ত মুখমন্ডল ! শিশিরের অবস্থাও তার মতই, সেও কাঁপা কাঁপা কন্ঠেই উত্তর দিল, “ভাল আছি, তুমিও ভাল থেক !” লুকমান আর মোটেই শিশিরকে সময় না দিয়ে এক প্রকার জোর করেই তুলে দিল চলন্ত ট্রেনে !


বিন্দুর সাহসিকতায়ই শুরু হয় নতুন অধ্যয়, মাধ্যম হিসেবে সেতু বন্ধন রচনা করে লুকমান । চলতে থাকে পত্র মারফৎ মন বিণিময়ের, কথা বিনিময়ের পালা । দু’টি হৃদয়ের মাঝে সৃষ্টি হয় ভালবাসার অনির্বান শিখা । কিন্তু বিন্দুর পরিবার তার বিয়ের জন্য ব্যস্ত হওয়াতেই জানাজানি হয়ে যায বিষয়টা । অবশ্য কোন পরিবার থেকেই আপত্তি না উঠায় শিশিরের কর্মস্থল থেকে বিয়ের অনুমতি পাবার পরই ধুমধামের সাথে বিয়ে পর্বটা সমাপ্ত হয় । বর্ণিল জীবনের আনন্দকে ওরা শুষে নেয় অনিন্দ বাসরে । কল্পনার সমস্ত রঙ দিয়ে ওরা আঁকতে থাকে সুখের আল্পনা ! এভাবেই সুখের সংসারে আসে প্রেমের নিদর্শনের আগমনী বার্তা ! চেয়ারম্যান আর ডাক্তার বাড়িতে খুশির বন্যা বয়ে যায় । বিন্দু এবং শিশির দু’জনই দুই বাড়ির বড় সন্তান সে জন্য আরও বেশী বেশী আয়োজন, আদান-প্রদান ! দিন গননার অন্য রকম এক আনন্দের আমেজ ! ইতোমধ্যে সদরের লেডী ডাক্তার আনুমানিক তারিখ ঘোষনা করল যে, মার্চের শেষ সপ্তাহে বেবী আসতে পারে । শিশির মার্চ’ একাত্তরের সাত থেকে এপ্রিলের সাত পর্যন্ত আগাম ছুটি নিয়ে দারুন এক উত্তেজনার মধ্যে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে ! কিন্তু মার্চ মাসের শুরু থেকেই দেশে চলতে থাকে দারুন রাজনৈতিক উত্তেজনা ! চারিদিকে সাজ সাজ রব ! ভীষণ দুঃশ্চিন্তার মাঝে সময় যেন আর ফুরায় না, ভয় ছিল ছুটি শেষ পর্যন্ত দেবে কিনা ! কিন্তু না, তাকে আর আটকালো না । আল্লাহর রহমতে ভাল ভাবেই বাড়ি এসে পৌঁছাল শিশির, ঢাকার রেসকোর্ষে চলছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ! শিশিরের সেদিকে ভ্রুক্ষেপও নাই, তার মাথায় এখন একটাই চিন্তা, সব কিছু যেন ঠিকঠাক মত সম্পন্ন হয় । লুকমান শিশিরের সাথে ছায়ার মত লেগে আছে । শুরু হয়ে গেছে দেশব্যপি অসহযোগ আন্দোলন ! পাশাপাশি পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সাথে বঙ্গবন্ধু আলোচনাও চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু সুরাহার ব্যাপারে সবার মাঝেই একটা সন্দেহ, হতাশা, আশংকা কাজ করছে, যদি সুরাহা না হয় তাহলে কি হতে পারে ! পঁচিশে মার্চ, প্রচন্ড ব্যাথায় বিন্দু শুধু কাতরাতে থাকে । বিন্দুর মা আর লুকমানকে সাথে নিয়ে শিশির জেলা সদরে ডাক্তারের স্বরণাপন্ন হলে ডাক্তার তাকে সদর হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিলেন এবং নিজেও রোগীর দেখাশোনা করতে লাগলেন । এদিকে রাতেই শোনা গেল যে আলোচনা নাকি ভেস্তে গেছে এবং বঙ্গবন্ধুকে নাকি গ্রেপ্তার করা হয়েছে । যদিও এ খবরটার সত্যতার ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা পাওয়া গেল না । অপরদিকে ঢাকায় পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ব্যাপক ভাবে হামলা চালিয়ে মানুষের উপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে ! বেবীর জন্ম নিয়ে ডাক্তারও দোটানার মধ্যে পড়ে গেলেন । শিশিরকে বলে দিলেন, হয় আরও একটা দিন অপেক্ষা করতে হবে নইলে অস্ত্রোপচার করতে হবে ! সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকেন শিশিরও । একটা দিন অপেক্ষা করলে ক্ষতির আশংকা নেই জেনে তারা অপেক্ষা করার সিদ্ধানতই গ্রহণ করল । দারুন উত্তেজনা ও ভয়ের মাঝে রাতটা পার করে দেবার পরদিন ছাব্বিশে মার্চ বেবীর স্বাভাবিক জন্ম লাভের কারণে সবাই যার পর নাই খুব খুশি । কিন্তু ডাক্তার একটা দিন হাসপাতালে থেকে পরের দিন বাড়ি যাবার পরামর্শ দিযে বাসায় চলে গেলেন । ডাক্তারের পরামর্শ অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস নেই শিশিরের, তাই অগত্য আরও একটা দিন থেকে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিল ওরা । পরের দিন প্রত্যুষেই বাড়ি থেকে খবর নিয়ে শিশিরের এক আত্মীয় হাজির । শিশির প্রশ্ন করতেই হাউ মাউ করে কেঁদে কেটে একাকার । শুধু বলছে সর্বনাশ হয়ে গেছে ! বাড়ি গিয়ে সব জানতে পারবে । এদিকে জেলা সদরের সমস্ত শহরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর টহলে মানুষ দিকবিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে যে যেদিকে পারছে পালাবার আয়োজনে ব্যস্ত কারণ ঢাকা থেকে আসার পথে রাস্তার দু’ধারের সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই নির্বিচারে হত্যা করেছে । শিশির একটু বেশীই ভয় পেয়ে গেল সে নিজে একজন বাঙালী সামরিক অফিসার হওয়ার কারণে । তাই লুকমানকে দিয়ে ঝুঁকি থাকা সত্বেও সমস্ত ওষুধ সংগ্রহ করে শহরের পিছন দিক দিয়ে একটা গরুর গাড়িতে করে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে রওয়ানা হয়ে গেল । এর বাইরে তাদের কাছে আর কোন বিকল্প ছিল না । এক সময় ঠিকই ওরা নিরাপদে বাড়ি পৌঁছাল, কিন্তু বাড়ি এসে যা দেখল তা যে কোন মানুষের কল্পনার চেয়ে অনেক বেশী ভয়ংকর ! শয়তানদের একটা ট্রুপ থানা দখলে নিয়ে আশপাশের তিন মাইলের মধ্যে আর কিছু রাখে নাই । সব কিছু পুড়িয়ে ফাঁকা মাঠে পরিণত করে দিয়েছে । শুধু তাই নয়, তাদের হাত থেকে শিশিরের বাবা আর শ্বশুর সহ গ্রামের অনেকেই শাহাদত বরণ করেছেন । এমন পরিস্থিতিতে কারও পক্ষেই স্বাভাবিক থাকা সহজ ছিল না কিন্তু তারপরও অনেক দায়িত্ব শিশিরের উপর এসে যওয়ায় নিজেকে যতদুর সম্ভব আড়ালে রেখে সব কিছুই করতে থাকলো । সব কাজ শেষ করেই আবার রওনা দিল আরও তিন মাইল গভীরের আরও প্রত্যন্ত অঞ্চলের খালার বাড়ির উদ্দেশ্যে । পরিস্থিতিটা এমন ছিল যে, শোক প্রকাশেরও কোন সুযোগ ছিল না ।


গ্রামের যুবক তরুণদের আনাগোনায় শিশিরের কর্মব্যস্ততা যথেষ্ট বেড়ে গেছে । সেই সাথে আছে আক্রান্ত হওয়ার প্রচন্ড আশংকা । অন্য দিকে নিজের ও শ্বশুর বাড়ির সবাইকে যথাসম্ভব পূনর্বাসনের বিষয় তো আছেই । সব কিছু গুছিয়ে নিতে বেশ কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেল শিশিরের । দিনটা ছিল সতেরোই এপ্রিল উনিশ’শ একাত্তর । বাবা এবং শ্বশুরের মৃত্যুর কারণে শিশিরের মাঝে এমনিতেই প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল তার উপর বর্তমান প্রজন্মেরও যেখানে বেঁচে থাকার কোন নিশ্চয়তা নেই সেখানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিশ্চয়তা কোথায় ! ফলে তার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়ে গেল বিশেষ করে তার সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে । সে তার সন্তানকে মরতে দিতে রাজী নয়, বাঁচাতে চায়, এজন্যই সে তার সন্তানের নাম রাখল অনন্ত ! তার জন্য একখন্ড মুক্ত ভূখণ্ড আবশ্যক । সন্ধ্যায় সবাই এসেছে তার সিদ্ধান্ত জানতে । আজ আর কাউকে সে নিরাশ করলো না । জানিয়ে দিল বাহিনী গঠনের জন্য আজ থেকেই কাজ শুরু করার কথা । ট্রেনিং পর্ব শেষ করে চোরা গোপ্তা হামলার মাধ্যমে অস্ত্র সংগ্রহ করে করে গড়ে তোলে এক দুঃসাহসী গেরিলা যোদ্ধা বাহিনী ।যাদের তৎপরতায় একে এক মুক্ত হতে থাকে বিশাল বিশাল অঞ্চল, সুসংহত করতে থাকে তার বাহিনী, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে গড়ে তোলে খাদ্য নিরাপত্তা এবং সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক কাঠামো । যোদ্ধাদের জন্য সুচিকিৎসা কে অগ্রাধিকার দিতে সে মোটেও ভূল করেনি । এভাবেই চলতে থাকে তার বিজয়াভিযান । চতুর্দিক থেকেও ক্রমেই আসতে থাকে সুসংবাদ । একসময় চুড়ান্ত বিজয়ের আভাসও আসছিল । শিশির এমনই এক পরিস্থিতিতে থানায় হামলা করে বহু সংখ্যক পাকিস্তানী সেনা সদস্যদের হতাহত করে কিন্তু শেষ রাতের দিকে কিছু সংখ্যক সৈনিক পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও রাস্তা ঘাট অপরিচিত হওয়ায় বেশী দুর না যেতেই লুকমানের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে পিছন থেকে তাড়া করে তাদের পরাভূত করার জন্য হামলা করে বসে এবং পরাভূতও করে কিন্তু অসতর্ক এক মুহুর্ত্তের সুযোগে আহত এক শত্রু সৈন্যের গুলিতে শাহাদত বরণ করে । দিনটি ছিল ষোলই ডিসেম্বর, উনিশ’শ একাত্তর । তার সঙ্গে আরও শহীদ হয় অমল কুমার, ডেভিড জন এবং অনিল বড়ুয়া । সেখানেই সেই নদীর কোল ঘেঁষে দিগন্ত জুড়ে রচিত হয় তাদের সারি সারি স্মৃতি সৌধ । যেখানে প্রতি বছরের এই দিনে সমবেত হয় শত শত গ্রামবাসী । আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি । ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসন এবং গার্ড অব অনার জানানোর জন্য পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ পৌঁছে গেছেন । বিউগলের করুন সুরে গার্ড অব অনার পর্ব শেষ করে সবাই যখন যার যার পথে পা বাড়াল তখনও স্মৃতি সৌধের পাদদেশে ঠায় দাড়িয়ে লুকমান । গায়ে শিশিরের নাম ও ছবি সম্বলিত গেঞ্জি, যেটা সে প্রতি বছর এই দিনটাতেই গায়ে চড়িয়ে স্মৃতি সৌধে আসে, আবার যত্ন করে রেখে দেয় এই দিনটার জন্য । আজ কিছুটা ব্যতিক্রমী একটা ঘটনা ঘটে গেল । যদিও শেষ যুদ্ধটার পর থেকে লুকমান বিন্দুর সামনে আসতে ভয় পেত, কারণ সেই যুদ্ধের শুরুটা হয়েছিল তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই । এতদিনে বুঝি বদলে গেল বিন্দু ! নিজের গায়ের চাদরটা খুলে চড়িয়ে দিল লুকমানের গায়ে । চারদিক থেকে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠল শিশিরের শত শত ভক্ত আর সহযোদ্ধাগণ । যে বিন্দু তার জীবন, যৌবন, প্রেম, ভালবাসা উৎসর্গ করেছিল এই স্মৃতির মিনারে, ফিরে চলল সেখান থেকে তার চির চেনা নিঃসঙ্গ একাকিত্বের নিভৃত আঙিনায় ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ruma hamid সুন্দর গল্প । শুভকামনা রাখলাম ।
কৃতজ্ঞতার সাথে ধন্যবাদ । আগামীতে আপনার লেখা পাবার অপেক্ষায় । ভাল থাকবেন সব সময় ।
রবিউল ই রুবেন onek valo kaglo. vote korlam,
চমৎকার মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, অফুরন্ত ভালবাসা আর শুভেচ্ছা রইল । ভাল থাকবেন নিরন্তর ।
আখতারুজ্জামান সোহাগ দারুণ গল্প। সবচেয়ে ভালো লেগেছে শব্দচয়ন। শুভকামনা গল্পকার।
অাপনার মূল্যবান মন্তব্যে আমি দারুন ভাবে অনুপ্রাণিত এবং মুগ্ধ । অসংখ্য ধন্যবাদ, অফুরন্ত ভালবাসা এবং শুভেচ্ছা রইল । ভাল থাকবেন সব সময় ।
প্রিন্স ঠাকুর খুব ভাল লাগল। শুভকামনা নিরন্তর।
অামিও আনন্দিত । আপনার জন্য রইল অফুরন্ত ভালবাসা এবং শুভেচ্ছা ।
মোঃ আক্তারুজ্জামান অনেক অনেক ভালো লাগা নিয়ে গল্পটা পড়লাম। আপনি অবশ্যই শক্তিমান লেখক। সবসময় এমনি লেখা নিয়ে সবার মাঝে হাজির হবেন এই আশা রাখি, ধন্যবাদ।
অাপনার মত একজন নন্দিত লেখকের কাছ থেকে এমন চমৎকার মন্তব্য পেয়ে সত্যিই ভীষণ ভাল লাগছে । সে জন্যে আপনার প্রতি রইল আমার পক্ষ্য থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ এবং আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ! ভাল থাকবেন সব সময় ।
মির্জা মুকুল জীবন ঘনিষ্ঠ দারুন গল্প ! খুব ভাল লেগেছে । ভোট আপনার অবশ্যই প্রাপ্য ।
চমৎকার মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি । শুভ কামনা রইল ।
Fahmida Bari Bipu সুন্দর গল্প ভাল লেগেছে। ভোট রইল। গল্পটা পড়তে একটু কষ্ট হয়েছে। ছোট ছোট অনুচ্ছেদে লেখা হলে হয়ত কষ্টটা বোধ করতাম না।
অাপনার মূল্যবান পরামর্শ অবশ্যই মনে রাখব, আর গল্পটা ভাল লেগেছে জেনে আমারও খুব ভাল লাগছে । কৃতজ্ঞতা এবং শুভ কামনা জানাই ।
শফিক রহমান দেশপ্রেম তথা দেশের জন্য ত্যাগের যে নিদর্শন গল্পে ফুটে উঠেছে তা সত্যিই অসাধারণ ! মনে রাখার মত ! ।
আপনার অসাধারণ মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ এবং শুভ কামনা ।
গোবিন্দ বীন অসাধারন গল্প পাতায় আমন্ত্রন রইল।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ । ভাল থাকবেন ।
নাইমুল খান একটা বলিষ্ঠ এবং অসাধারণ ঘটনা বহুল গল্প পড়ে মুগ্ধ হলাম ! শুভ কামনা এবং ভোট রেখে গেলাম ।
আপনার ভাল লাগার মাঝেই আমার আনন্দ ! শুভ কামনা এবং কৃতজ্ঞতা ।

০৭ সেপ্টেম্বর - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৩২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী