চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই রাহুল তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিকে প্রসারিত করে দিল তারই বোনের দেবর ভৌতিক ছবির প্রখ্যাত পরিচালক সাঈদ শোভনের দিকে।
নবীন লেখক হিসেবে রাহুলের লেখার হাত চমৎকার ! “গল্প কবিতা ডট কম”র মাসিক ছোট গল্প প্রতিযোগিতায় ভৌতিক বিষয় বস্তুর উপর সেও লিখতে চায় কিন্তু সমস্যা হ’লো ভূত-প্রেত সম্পর্কে রাহুলের জ্ঞান খুবই সীমিত। রাহুলের ধারণা, ভৌতিক ছবির পরিচালক হিসেবে সাঈদ শোভন এ ব্যাপারে যথেষ্ট অভিজ্ঞ। সে কারণেই সাঈদ শোভনের শরণাপন্ন হয়েছে রাহুল। রাহুলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে শোভনও পরিস্থিতিটা বেশ উপভোগ করছে, তবে রাহুলের প্রতি শোভন ও বেশ আস্থাশীল তাই রাহুলের উৎসাহকে কিছুতেই খাট করতে চায় না কিন্তু বিষয়টা এমনই ! তবুও সঠিক চিত্রটাই তার কাছে পরিষ্কার করার জন্য বলল, “দেখ রাহুল, তোমার ধারণাটা সঠিক নয় !”
বিস্ময়ের সাথে রাহুল প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল , যেমন ?
যেমন, শোভন বলে চলল, “আমার ধারণা তোমার বিশ্বাস, ভূত সম্পর্কে আমি অনেক অভিজ্ঞ !”
যদিও শোভন রাহুলকে হতাশ করতে চায়নি কিন্তু তারপরও সে চেষ্টা করতে থাকে, ভূত বা ভৌতিক বিষয়টাকে যতদুর সম্ভব রাহুলের কাছে পরিষ্কার করতে। তাই সে রাহুলকে ইনিয়ে বিনিয়ে বহু ভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে যে, চলচ্চিত্রকার বা নাটক নির্মাতাগণ আসলে ব্যবসায়ীক দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে এ জাতীয় নাটক সিনেমা নির্মাণ করে।–
“আসলে ভূত-প্রেত সম্পর্কে আমার বিশ্বাস, এ ব্যাপারে কারো কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। শুধু মাত্র দর্শককে মোহমুগ্ধ করে তার পকেট থেকে কাঙ্খিত অর্থ বের করে নেয়ার জন্যই প্রযোজক-পরিচালকগণ মনগড়া কাহিনীকে অবলম্বণ করেই সিনেমা বা নাটক নির্মাণ করে থাকে। ” সে আরও বলতে থাকে, “আচ্ছা রাহুল তুমিই বল, আজ পর্যন্ত তুমি কী এমন কোন ঘটনার কথা শুনেছ যে কোন মানুষ বলেছে যে, আমি সরাসরি ভূতকে দেখেছি !” কথাটা শুনে রাহুল দারুণ ভাবে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। ইতোমধ্যেই চায়ের কাপে শেষ চুমুক দেয়া শেষ। তাই আর রাহুল অপেক্ষা না করে সেখান থেকে বিদায় নিয়ে শোভনের প্রোডাকসন অফিস থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় নেমে এলো। একটা মান সন্মত গল্প লেখার জন্য রাহুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিষয় টা সম্পর্কে যতদুর সম্ভব একটা ধারণা অর্জন করতে হবে। সে জন্য সে কয়েক জনের সাথে কথা বলতে চায়। সে কারণেই সে এবার আলাপ করতে চায় রাহুলেরই বন্ধুর বাবা আশরাফ সাহেবের সাথে, যিনি ইসলামী ধ্যান-ধারণা লালন করেন। তখনও মাগরিবের আযান পড়তে বেশ খানিকটা সময বাঁকী। রাহুল পা চালিয়ে গিয়ে তাঁকে বাসায়ই পেয়ে গেল, সালাম দিয়ে বিষয়টার অবতারণা করতেই আশরাফ সাহেব একটু মিট মিট করে হাসলেন তবে চেষ্টা করলেন রাহুলের দৃষ্টি এড়াতে। তবে রাহুলের লেখার হাত সম্পর্কে তিনিও অবগত তাই তাকে সরাসরি নিরাশ না করে শুধু বললেন,-
“দেখ রাহুল, এ সম্পর্কে আমার যৎ সামান্য জ্ঞান যা আছে তা তো কেবল ইসলামী সংস্কৃতির পরিমন্ডলের মধ্যেই আবদ্ধ তাই দুঃখের সাথেই তোমাকে বলতে হচ্ছে যে, আসলে ভূত বা ভৌতিক বিষয়টা আমার মনে হয় একেবারেই মনের ব্যাপার, যেটাকে ব্যবহার করে ওভার স্মার্ট কিছু মানুষ নিজেদেরকে অতি মানব হিসেবে জাহির করতে চায়।”
এ বারে ও রাহুল হতাশ হ’লো ! তারপরও রাহুল আগ্রহ ত্যাগ না করে অধ্যক্ষ এবাদুল হক সাগর সাহেবের সাথে কথা বলার চেষ্টা করবে ভেবে বাসায় ফিরে গেল। এদিকে হাতে সময়ও খুব একটা বেশী নেই। তাই আজকেই যাবে সন্ধ্যার পর উনার সঙ্গে দেখা করতে। অধ্যক্ষ সাগর রাহুলেরই বড় ভাইয়ের বন্ধু, একটা বেসরকারী কলেজের অধ্যক্ষ। তিনিও বেশ লেখালেখি করেন। রাহুল তাঁর লেখা, বিশেষ করে কবিতাগুলো মনযোগ সহকারেই পড়ে থাকে, যদিও সাগর সাহেবের কবিতা সম্পর্কে রাহুলের ধারণা খুব একটা আহা মরি ! গোছের নয় । কারন রাহুলের ধারণা, তাঁর শব্দ ভান্ডার খুবই সীমিত ! বিশেষ বিশেষ কিছু শব্দ তিনি তাঁর প্রায় সব কবিতাতেই একই ঢঙে এত বেশী বেশী ব্যবহার করে থাকেন, ফলে তাঁর প্রায় সব কবিতাই একই কবিতার বিভিন্ন অংশ বলে মনে হয়। আর একটা বিশেষ সমস্যা হ’লো, তিনি কবিতার নামে সব সময় পাঠককে উপদেশ দেবার চেষ্টা করেন, যে কারণে তাঁর কবিতায় বিনোদনের চাইতে পাঠ কক্ষের একটা আবহ খুঁজে পাওয়া যায় বেশী ! তবে তাঁর কবিতায় তিনি প্রায়ই আত্মাকে টেনে এনে একটা আধ্যাত্মিকতার পরিবেশ তৈরীর চেষ্টা করেন। হতে পারে তিনি পীরের মুরিদ, তারই একটা প্রভাব হয়তো তাঁর কবিতায় প্রকাশ পায় ! কিন্তু ভূত-প্রেত, আত্মা-প্রেতাত্মা বিষয় গুলো সম্পর্কে তাঁর কোন স্পষ্ট ধারণা আছে কিনা তা অবশ্য রাহুলের জানা নেই। তবুও কেন যেন রাহুলের মনে হ’লো, যেহেতু তিনি আধ্যাত্বিকতার চর্চ্চা করেন হয়তো তাঁর কাছ থেকে কোন ধারণা পাওয়া যেতে পারে। ইতোমধ্যেই সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। সাগর সাহেব হয়তো এতক্ষণে ‘সান সাইন কিন্ডার গার্টেনে’ আড্ডা দিতে চলে এসেছেন। ওখানে পাওযা না গেলে তাঁকে তো পাওয়াই মুসকিল। সে কারণে বেড়োবার প্রস্তুতি নিচ্ছে রাহুল। ইচ্ছে আছে অধ্যক্ষ সাহেবের সাথে দেখা করে পাশের মন্দিরের পুরোহিত মশায়ের সাথেও একটু আলাপ করার চেষ্টা করবে। অর্থাৎ রাহুল একটা সুন্দর ও মান সন্মত লেখা উপহার দিতে চায়। এ ব্যাপারে সে ভীষণ সিরিয়াস ! হাত মুখ ধুইয়ে মায়ের হাতের এককাপ চা খেয়ে দরজা দিয়ে বেড়োবার সাথে সাথে রাহুলের বুকের উপর কী যেন কালো একটা কিছু লাফিয়ে পড়েই শুন্যে হারিয়ে গেল। অল্প পাওযারের বাল্বের আবছা আলোয় দূর্ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে, রাহুল কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটনার আকস্মিকতার ধাক্কাটা সামাল দিতে না পেরে হুড়মুড় করে পড়ে গেল ঘরের জানালার পাল্লার উপর। পাল্লার কোনায় লেগে কপাল কেটে রক্ত ঝরতে লাগল। তবে পড়ে যাবার সময় নিজের অজান্তেই তার মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এলো ইশ্ ! শব্দটা। শব্দটা বেশ জোড়ের সাথে হওয়ার কারণে রাহুলের মা সহ আশ পাশের সবাই ছুটে এসে দেখে রক্তে ভিজে গেছে ওর কাপড় চোপড়। তাড়াতাড়ি করে রাহুলকে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গিয়ে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হ’লো। চার চারটি সেলাই পড়লো তার কপাল জুড়ে। ডাক্তার সাহেব প্রেস্ক্রিপশণ লিখে দিয়ে বলেলেন,“আজকের রাতটা পুরোপুরি বিশ্রামে থাকতে হবে।” কী আর করা ! রাহুল তার মনের ইচ্ছে মনের মাঝে চাপা দিয়ে ফিরে এলো বাসায়। ব্যস ! শুরু হয়ে গেল আতঙ্কিত মায়ের সেবা যত্ন ! অতএব রাহুলের পক্ষে আর কিছুই করা সম্ভব হ’লো না, কারণ মায়ের নির্দেশ মত রাতের খাবার শেষে ঔষধ সেবনের পর পরই ঘুমিয়ে পড়তে হবে।
লম্বা একটা ঘুমের পর সকালে যখন রাহুলের ঘুম ভাঙ্গলো তখন সকাল প্রায় যায় যায়। খুব একটা খারাপ লাগছে না দেখে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নাস্তার পর্বটা শেষ করে ঔষধ গুলো খেয়ে নিল। ভাবছিল কাগজ কলম নিয়ে বসবে। কিন্তু মনে হ’লো ওর মা আগেই ওর মনের খবর গুলো জেনে গেছে ! তাই ভীষণ কড়া ভাষায় জানিয়ে দিল,
“ রাহুল, এখন কিন্তু আবার কাগজ কলম নিয়ে বসোনা কিংবা বাইরেও যেয়োনা। আরও দুই একটা দিন বিশ্রাম নাও।”
মায়ের আদেশ অমান্য করার মত ছেলে রাহুল নয় তবে গত কালের দূর্ঘটনাটার ব্যাপারটা কিছুতেই রাহুলের পিছু ছাড়ছিল না। ও কিছুতেই মেলাতে পারছিল না যে কিভাবে কী হয়ে গেল ! এমন সময় ওর বড় ভাই মৃদুল রাহুলের খবর নেওয়ার জন্য ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করল,-
“রাহুল, এখন কেমন আছিস ? ”
“ভালই আছি ভাইয়া, চিন্তার কিছু নাই।” বলে উত্তর দিতেই মৃদুল আবার শুরু করল,-
“আসলে দূর্ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে তোকে সতর্ক করার সুযোগই পেলাম না, তা ছাড়া তুই যে ঘর থেকে বের হচ্ছিলি তাও তো জানতাম না।”
উত্তরটা শুনে রাহুল কিছুটা বিস্ময়ের সাথেই প্রশ্ন করলো,-
“কেন ভাইয়া কী হয়েছিল ?”
মৃদুল পাল্টা প্রশ্ন করলো,“কেন তুই কিছু বুঝিস নি ? ”
“ না ভাইয়া, আমি তো গতকাল থেকে সেটাই ভাবছি, আসলে কী ভাবে কী ঘটলো আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না ! তুমি কিছু জান নাকি ?”
“আরে সেটাই তো বলছি”, মৃদুল বলতে থাকে,“আমি যখন বাড়িতে ঢুকছিলাম তখন দেখি একটা সাদা বিড়াল আরেকটা কালো বিড়ালকে তাড়াচ্ছে, তাড়া খেয়ে কলো বিড়াল টা কুকুরের বাচ্চার গায়ের উপর গিয়ে পড়লো ! আর যায় কোথায়, কুকুর টা সঙ্গে সঙ্গে কালো বিড়াল টা কে দিল একটা দাবড়ানী ! শালা বিড়াল টা ও পড়ি মড়ি করে জান বাঁচাতে দিল একটা লাফ ! আর তখনই তোর ইশ্ ! শব্দটা আমার কানে এলো, বুঝলাম তোর একটা কিছু হয়ে গেল কিন্তু কিছুই করার ছিল না ! দৌড়ে গিয়ে দেখি তোর এই দশা !”
“হ্যাঁ ভাইয়া এখন বুঝতে পারছি, ওই কালো বিড়ালটাই আমার বুকের উপর লাফিয়ে পড়েছিল অথচ আমি ভাবছিলাম না জানি কোন ভূত-টুতের খপ্পরে পড়লাম নাকি !” বলেই রাহুল এমন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো !
“আরে গাধা, ভূত-টুত বলে কিছু আছে নাকি ? আসলে ভূত বলে কিছু নাই, ওসব বাস করে মানুষের মনে বুঝলি, অন্য কোথাও না । ভাবিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। বাইরে আমার কাজ আছে, আমি গেলাম ঔষধ গুলো ঠিকমত খাস কিন্তু।” বলেই মৃদুল চলে গেল।
“আচ্ছা ভাইয়া, আল্লাহ হাফেজ” বলে মৃদুলকে বিদায় দিয়ে রাহুল ভাবতে থাকে, ভাইয়া যদি বিষয় টা পরিস্কার করে খুলে না বলতো তাহলে তো আমি শালা ভূতকেই দোষ দিয়ে বসেছিলাম ! ভাগ্যিস, ভাইয়া ঘটনাটা দেখেছিল ! কিন্তু আফসোস ! সময়ের অভাবে গল্প টা লেখা হ’লো না !