(এক)
“মা,
কেমন আছো? উত্তরটা আমার জানাই আছে। এই প্রশ্নটির উত্তরে ‘ভালো নেই’ কখনো বলনি তুমি। কিন্তু মা, আমি জানি মানুষ সব সময় ভালো থাকে না, তবুও তুমি কখনোই তোমার ভালো না লাগাটুকু কখনোই প্রকাশ করোনি, হয়তোবা আজও করবে না। হয়ত আমার প্রশ্নের সাথে সাথেই আজও মনে মনে বলেই ফেলেছ ‘ভালো আছিরে বাপ’। কিন্তু জানি এই স্বগতোক্তির পেছনে ছোটো একটি দীর্ঘশ্বাস ছিল আর আমিই হয়ত তার কারণ। মা, আমারও কষ্ট হয় তোমাকে ছেড়ে অনেক দূরে থাকতে। আমি যে আজ বুঝতে পারি তোমার কষ্টগুলো। আমাকে আজকের এই অবস্থানে আনতে তোমার সেই ত্যাগকে আমি কি ভুলতে পারি! আজ আমি জাহাজ ভাসিয়ে চলি নীল সাগরের বুকে, ভেসে চলি বন্দরে বন্দরে। কত কত লোক আমার আগে পেছনে সালাম ঠুকে। সব তোমার জন্য মা। তোমার জন্য যখন এই চিঠি লিখছি তখন আমি ভেসে চলেছি আটলান্টিকের বুকের উপর দিয়ে, কিছুক্ষণ আগে বিজন এসে বলে গেলো ‘স্যার, উই আর এবাউট টু গো দ্য ডেঞ্জারাস জোন, ইট’স নট টু মাচ সেফ টু গো থ্রু ডিউরিং নাইট, শেল উই ওয়েইট টিল মর্নিং ওর নট?’ বিজন জাহাজের সেকেন্ড ইন কমান্ড। বেটা জাতে ভারতীয়, কিন্তু ইংরেজি ছাড়া বলবে না। জানো মা, ও কি বলে গেলো? বলে গেল আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বিপদজনক এলাকা পাড় হতে যাচ্ছি, রাতে এখান দিয়ে যাওয়া খুব একটা সুবিধের নয়। আমরা কি সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবো নাকি নয়। জানো মা, সময় বড় বেহায়া। যতই দোহাই দাও, যতই হাতে পায়ে ধরো সে চলবে তার আপন ধারাতেই। কিন্তু নিরাপত্তা যখন প্রশ্ন তখন সময়কে কিছুটা ছাড় দিতেই হয়, তা সে আমাদের মত দুঃসাহসিক নাবিকই হউক না কেন। বেটাকে বলে দিলাম সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। শুনে বেশ খুশীই হল যেন অন্তত ওর কথাটা আমলে নেয়া হয়েছে বলে। মুখে প্রকাশ করুক বা না করুক মানুষ সব সময়ই তার একটা বিশেষত্ব চায়, চায় অন্যের কাছে কিছুটা দামী হতে। আর কি লিখবো মা, মাথায় আসছে না। জানি আর কিছু লিখলেও তা তোমার কাছে এখন পৌঁছাবে না, কম্পুর এক কোনে একটি ছোটো ডকুমেন্ট হয়ে জমা পড়ে থাকবে এই লেখা। সমুদ্র মাঝে কোন প্রকার মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। হিসেব মতে আর সতেরো দিন পড়ে ভেনিস বন্দরে পৌঁছব। তখনই পাঠাবো তোমার ছেলের এই বৈদ্যুতিক চিঠি, ভেনিস থেকে বাংলাদেশ পৌঁছাতে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের লাগবে, যদি জাহাজটাকে নিয়ে এভাবেই সেকেন্ডে সেকেন্ডে বন্দরে বন্দরে পৌঁছাতে পারতাম...।
আজ এ পর্যন্তই থাক, বাকী কিছু মনে পড়লে পড়ে না হয় লিখবো, আমার জন্য দোয়া করো মা।
তোমার স্নেহের, সাইফ”।
(দুই)
-স্যার, দ্য স্কাই ইজ কোয়াইট ক্লিয়ার নাউ, শেল উই স্টার্ট সেইলিং?
-বিজন?
-ইয়েস স্যার।
-আমি জানি তুমি কোলকাতার মানুষ। আমার সাথে যা বলার বাংলাতেই বলো।
-জ্বি স্যার। আসলে ক্রু, শ্রমিক, ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে ইংরেজি বলতে বলতে ভুলেই যাই কে একভাষী আর কে ভিনভাষী।
-আমার ক্ষেত্রে মনে রেখো, তুমি ছাড়া আর কে আছে যার সাথে একটু মন খুলে বাংলা বলবো। বাংলায় কিছু বললে সব থাই বেটারা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে যেন আমি কোন এলিয়েনের ভাষায় কথা বলছি।
-তা যা বলেছেন স্যার, মায়ের ভাষায় কিছু বলতে না পারলে মনে হয় যেন বুকটা একটা বিরাট পাথরের নিচে চাপা পড়ে আছে। দমবন্ধ দমবন্ধ অবস্থা।
-হুম। তা যা বলেছ। আকাশ এখন বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য উঠবে। আমরা এখন যাত্রা পুনরায় শুরু করতে পারি কি বোলো।
-জ্বি স্যার।
-জেনারেটর ইঞ্জিন কেবল একটা চালু রাখতে বলো। দিনের বেলা অতিরিক্ত শক্তি উৎপাদনের কোন প্রয়োজন নেই। মেইন ইঞ্জিন চালু করো। জিপিএস এর সংকেত এখানে বেশ ভালোই।।
-ইয়ে স্যার একটা কথা বলবো?
-হুম বল।
-ইয়ে আটলান্টিকে এটাই আমার প্রথম যাত্রা, আর আমরা মনে হয় আটলান্টিকের সবচেয়ে বিপদজনক স্থানটিই ক্রস করতে যাচ্ছি কিছুক্ষণের মধ্যে...
-বিজন, আমি জানি তুমি একজন সাহসী বীর আর এও জানি ভয়াল এ সাগর বীরগনেরও কিছুটা বীরত্ব অজান্তেই কেড়ে নেয়। তুমি ভয় করো না, জয়ী আমরা হবই।
-তাই যেন হয় স্যার।
(তিন)
জাহাজ ‘সী হিরো’ চলেছে উত্তর আটলান্টিকের বুক চিরে। বিশাল বিশাল ঢেউয়ের বিপরীতে মৃদু কাঁপছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি ইতিমধ্যে আমরা সেই বিপদ সীমানায় পৌঁছে গেছি। জাহাজের গতি কিছুটা কমাতেই হবে। ইঞ্জিনরুমে মৃদু এলার্ম বাজছে। ইঞ্জিনিয়ার এখন ব্যাপারটা আমাকে জানায়নি কি ঘটেছে সেখানে। খোঁজ নেয়া দরকার।
-হ্যালো, মি. হ্যারাল্ড, ডু ইয়ু কপি? হ্যালো! হ্যালো? ডু ইয়ু?
কি ব্যাপার, ওয়াকিটকিতে কারও উত্তর পাচ্ছি না কেন?
-বিজন তুমি কি একটু ইঞ্জিন রুমে যাবে।
-ওকে স্যার, আমি দেখছি।
কি ব্যাপার, মি. হ্যারাল্ড তো অলস কোন ব্যাক্তি নন, সহকারী ইঞ্জিনিয়ারটাই বা কি করছে, কি যেন নাম ছেলেটার। মনে পড়েছে লুই চুই। একেবারে তরুন ছেলেটা কিন্তু কাজে বেশ পটু।
-“হ্যালো, হ্যালো স্যার...”
-হু ইজ দেয়ার?
-ইট’স মি স্যার, বিজন।
-হ্যাঁ বিজন বলো, ইঞ্জিন রুমে কি সমস্যা।
-স্যার জেনারেটর ইঞ্জিনটা বন্ধ হয়ে গেছে হঠাৎ, দ্বিতীয়টা চালু হচ্চে না। ইঞ্জিনিয়ার, সহকারী ইঞ্জিনিয়ার এবং অন্যান্যরা সেটা চালু করার চেষ্টা করছেন। ইঞ্জিনরুম এখন পুরোপুরি অন্ধকার। টর্চ জ্বালিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।
-দ্বিতীয়টা চালু হচ্চে না কেন? ইঞ্জিনিয়ার কি বলেছে?
-ইঞ্জিনিয়ার বলছে সাকশন পোর্ট দিয়ে ইঞ্জিন সিলিন্দারে পানি প্রবেশ করেছে। হেড খুলে পানি বের করতে কিছুটা সময় লাগবে। আর স্যার জাহাজের গতি আরও কিছুটা কমাতে হবে। বিরাট ঢেউয়ের বিপরীতে প্রপালশনে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। মেইন ইঞ্জিনের উপর লোড পড়ছে বেশী। ইতিমধ্যে কয়েকবার কালো ধোয়া নির্গত হয়েছে। মেইন ইঞ্জিন যে কোন সময় ক্রাশ করতে পারে।
-ও খোদা! ঠিক আছে আমি মিনিমাম স্পীডে সচল করলাম। মেইন ইঞ্জিন এই মুহূর্তে কিছুতেই বন্ধ করা যাবে না।
-স্যার আমার হাতের কম্পাস তা খুব বেশী নরছে। বাইরে কি অবস্থা?
-বাইরের অবস্থার অবনতি হয়েছে। আকাশ পরিষ্কার কিন্তু ঢেউয়ের মাত্রা বেড়েছে। বাতাসের গতিও বেড়েছে অনেকটা।
-(হায় ইশ্বর, রক্ষা করো) স্যার আমি কি উপরে আসবো?
-কন্ট্রোল রুম আমি দেখে নেব... তুমি বরং মি. হ্যারাল্ড কে সাহায্য করো।
-ওকে স্যার।
এ বড়ই বিপদজনক সময়। জাহাজের গতি, দিক দুটোই ঠিক রাখতে হবে। দুটি জেনারেটর ইঞ্জিনই কাজ করছে না। মেইন ইঞ্জিনটাই এখন ভরসা। এই মুহূর্তে তা বন্ধ হয়ে গেলে বড় বিপদে পড়তে হবে। জিপিএসের সংকেত এখানে বেশ অস্পষ্ট। ভাঙা ভাঙা যে সংকেত পাওয়া যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে এ ট্রায়াঙ্গল পাড় হতে আরও ৬০-৭০ নটিক্যাল মাইল যেতে হবে। সামান্য ভুল করা চলবে না। মেইন ইঞ্জিন সচল রাখতে হবে। ওটাই ভরসা। ওটাই এখন জয়ী হবার চাবি, এই পাহাড় সম আটলান্টিকের ঢেউয়ের বিপরীতে। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। নিতে হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। ভয় করা মটেই চলবে না। ভিতুরা জয়ী হতে পারে না।
(চার)
-ইউ আর ক্যাপ্টেন সাইফুল্লাহ, এম আই রাইট?
-ইয়া, ইউ এবসুলিউটলি রাইট। বাট ইউ...
-ও বাডি, লুক এট মি। কি চিনতে পেরেছিস?
-হু...ম... তুই নিশ্চয়ই মঈন। কি পেরেছি কি?
-শুধু মঈন নয়, ক্যাপ্টেন মঈনুল্লাহ হা হা হা।
-হা হা, তা তুই ভেনিসে কেন?
-আমার জাহাজ ভেনিসে তাই আমিও।। অনুমান করছি তুই ও একই কারণে।
-হুম।
-আটলান্টিক ভ্রমন কেমন হল বন্ধু।
-সেই অভিজ্ঞতা তোরও নিশ্চয়ই আছে।
-এই যা বলেছিস। আচ্ছা এখন আসি, ডিনারে আমন্ত্রণ রইল। ঐযে পোর্টে আনলোড হচ্ছে ‘এঞ্জিয়ান’ ঐটা আমার জাহাজ।
-একাডেমীতে তোকে যেমনটা পেয়েছিলাম আজও তেমনটাই রয়ে গেছিস। হুট করে আসিস আবার হুট করেই হাওয়া।
-হা হা।। রাতে তাহলে দেখা হচ্ছে।
(পাঁচ)
“মা, আবার লিখতে হচ্ছে তোমায়। সাগরের বুকে ভেসে ভেসে যতটুকু লিখেছিলাম তার সাথে কিছুটা যোগ করতেই এই লেখা। ছোটো একটু লেখা, লিখতেই হল। না লিখলে যে ঐ লেখাগুলো অসম্পূর্ণই থেকে যেত। কেনোনা ছোটো এই লেখাতেই যে আছে বিজয়ের বার্তা। হ্যাঁ মা, আমি বিজয়ী, জয় করতে পেরেছি সমুদ্রকে, ভয়াল আটলান্টিক কে। আমি ভালো আছি মা। অনেক ভালো। সামনের ছুটিতে ফিরছি বাড়ি। ভালো থেকো”।
এবার লেখা আর কম্পুতে জমে থাকবে না। এখন আমি বেতার তরঙ্গের বাইরে আটলান্টিকের বুকে নই।।