১.
আনন্দ আর মজা পেতে পাড়া সুদ্ধ লোকের হাড় জ্বালাতন করাই যেন সুজন নিজের একমাত্র দায়িত্ব হিসাবে গ্রহণ করেছে! কারো কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস লুকিয়ে রেখে, তাকে যাচ্ছেতাই নাজেহাল করে, নানা ছুতোয় পরে তা বের করে দেয়া; দুধ দোহনের আগেই বাছুর ছেড়ে দিয়ে অকাট্য যুক্তি দাঁড় করানো- ‘আগে বাছুরটা তো বাঁচুক!’ তবে কখনও কখনও লোকের উপকার যে সে করে না- তা নয়। কিন্তু এর উদাহরণের সংখ্যা উৎপাতের তুলনায় অতি নগন্য। কিছু সময় এর আড়ালে থাকে ভিন্ন মতলব! ‘সুজন’ নামধারী দুরন্তপনা এই কিশোরটির কাজ যেন স্বীয় নামের অর্থের ঠিক বিপরীত! কিছু সময় এমন কাজ করে- যা অতি দুর্বোধ্য। আবার আপনার কৃত্রিম সংকট নিরসন হলে মহাবিশ্বের শাশ্বত নিয়মে সে এক ধরনের অদ্ভুদ আনন্দও লাভ করে!
‘আবুল চাচা বাড়ি আছেন? আবুল চাচা।’ প্রতিবেশি আতিক, সুজনের বাবাকে ডাকে।
‘ও, আতিক মিয়া! কি খবর?’
‘খবর আর কি? সুজন আমার গাছের ডাবের খাদি লইয়া গেছে। পূবের জঙ্গলের পাশে বইসা দলবল লইয়া খাইছে! এখনও ডাবের খোসাগুলা পইরা আছে। গিয়া দেইখা আসেন।’
‘এই হারাম-জাদাকে নিয়া আমার হয়েছে যত মরণ ! আর কত সহ্য করা যায়? আসুক আজকে; মজা না দেখিয়ে ছাড়ছি না হতভাগাকে!’
‘মজা দেখান আর যাই করেন; আর সহ্য করা যায় না। আপনার ছেলে আপনি দেখেন। তা না হলে আমরাই ব্যবস্থা নিব। মনে থাকে যেন কথাটা।’ রাগে ফুঁস ফুঁস করে বলতে বলতে বিদায় নেয় আতিক।
কিছুক্ষণ পর মরিচ ক্ষেতের বেড়া ভাঙ্গার জন্য বিচার নিয়ে আসে মুমেন। দুপুরে আসে আকবর, পেঁপে পারার অভিযোগ নিয়ে। এভাবে সারা দিনে প্রায় অর্ধ-ডজন অভিযোগ শুনতে হয় এই সুজন নামক কৃতী সন্তানের জনক-জননীকে!
আবুল রেগে-মেগে আগুন! আজ একটা এসপার-ওসপার করে ছাড়বে। দুই ছেলে মেয়ের মধ্যে সুজন বড় হওয়ায় অনেক সহ্য করেছেন তিনি। আবার কখনও কখনও হালকা-পাতলা শাসনও করেছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। ঐ দিন সন্ধায় বাড়ি ফিরতেই ভয়ানক উত্তম-মধ্যম পড়ে সুজনের উপর।
আপন সন্তানকে এভাবে মেরে আবুল হোসেনের বুকে যে ছাই চাপা আগুন জন্ম নিল, তা সুপ্ত অবস্থায় থাকল- বৃহত্তর স্বার্থে।
২.
সকালে সুজনের মা সাজেদা বেগম রান্নার কাজে ব্যস্ত। এমন সময় সুজন চুপে চুপে তার মায়ের মাটির ব্যাংকে জমানো ভাংতি টাকা ব্লেডের সাহায্যে সরিয়ে রাখল। এই কাজটা সে প্রায়ই করে। ডিম, শাক-সবজি বিক্রি করে তার মা একদিকে টাকা জমায়, অন্যদিকে সে ছুরি বা ব্লেড ব্যাংকের মুখে ঢুকিয়ে তা অক্ষত রেখে সেই টাকা চুরি করে। কিন্তু তার মা কিছুই টের পায় না। কারণ ব্যাংকে শব্দ করার জন্য কয়েকটি পয়সা রেখে দেয়। তাছাড়া কয়েকটি ছোট ছোট লোহার পাতও এর ভিতর ভরে রেখেছে একটু ভারি হওয়ার জন্য। তারপরও তার মা যে মাঝে মাঝে সন্দেহ করে না, তা নয়। সে দিন হঠাৎ করে ঘরে ডুকে দেখল সুজন তা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।
‘কি করছিস এখানে?’ জানতে চান সাজেদা বেগম।
‘কিছু না আম্মা।’ বলেই কথার মোড় ঘুরানোর জন্য আবার বলল, ‘আচ্ছা আম্মা, কত ময়লা জমে আছে, এগুলো একটু পরিস্কার করতে পার না?’
‘ওখানে ময়লা জমে আছে- না? আমি কালও এগুলো পরিস্কার করেছি। তুই কি করছিলি- তা বল।’
‘বললাম তো কিচ্ছু না! আমার কথা কি তুমি বিশ্বাস কর না আম্মা? আমি কি তোমার সন্তান না?’
‘হ্যাঁ, তুমি তো আমার সন্তান! তবে কুসন্তান! সারাটা দিন একের পর এক আচার বিচার শুনতে শুনতে কান ঝালা-পালা হয়ে যায়! এই জন্যই কি তোকে পেটে ধরেছিলাম? কত মানুষ মরে তুই মরতে পারিস না!’
‘ঠিক আছে আম্মা; যাও- মরব-মরব। আগে ভাত দাও। না খেয়ে মরলে তো আবার বেশি কাঁদবে।’ বলেই আবার মহিলাদের কান্নার সুরে বলতে শুরু করল, ‘আমার পুত্রের কি হ-ই-লো রে! আমার কাছে; আমার পুত্র ভাত চাইছিল। আমি কেন্, ভাত দেই নাই গো.....।’ পুত্রের অভিনয়সহ এই প্রাচীন শোকগীতির তাল কেটে দিলেন স্বয়ং সাজেদা বেগম! একটা মুগুর নিয়ে তাড়া করলেন সুজনকে! এক দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে সে আবার তার মায়ের উদ্দেশ্যে বলল-
‘দেখ, দেখ বেটির কান্ড! কত্ত বড় মুগুর লইছে গো! ও আম্মা, আরেকটু ছোট-খাট কিছু লও না; এতে তোমারই সুবিধা হবে যে!’
এমন ইয়ার্কিতে তার মা আরও বহুগুণ রাগান্বিত হয়ে তাড়া করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে, আপন সন্তানের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে ঘরে ফিরে আসলেন।
কিছু দূর যেতে না যেতেই সুজন এক বৃদ্ধকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। ঐ বৃদ্ধ একটা বস্তায় কিছু চাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, কোনো পথচারীর সহযোগিতায় তা মাথায় তুলে নিবেন- এই আশায়। তিনি সুজনকে ডেকে বললেন-
‘বাবা, বস্তাটা একটু মাথায় তুলে দেবে? অনেক ক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু এইডা মাথায় তুলে দেওয়ার মত কেউরে পাইলাম না।’
‘আমি ভাত খাইয়া আসি নাই। শরীরে শক্তি নাই। আমি পারব না।’
‘দেও না বাবা। আমি খুব বিপদে পড়েছি।’
প্রথমে কিছুতেই রাজি হল না। কিন্তু হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলল। মাথায় বস্তায় তুলে দেওয়ার সময় এতে একটা ফুটো করে দিল, যা দিয়ে অল্প অল্প করে চাল পড়তে শুরু করল। বস্তাটাও এমন ভাবে দিল যেন সেই চাল পড়া বৃদ্ধের দৃষ্টি গোচর না হয়।
আর কিছু দূর গিয়ে দেখল একটা ছাগল গাছে বাঁধা। এদিক-ওদিক তাকিয়ে এর বাঁধন খুলে দিল। পথের পাশে মাচায় মিষ্টি কুমড়া গাছ। ডগডগে গাছে ফুল-ফল-পাতায় সারা মাচা ছেয়ে গেছে। এর গোড়া দিল ছিড়ে। এ ভাবে সে সারা দিনে কত মানুষের কত অনিষ্ট করে মাথায় হাত দেওয়াতে বাধ্য করে- কে জানে!
৩.
মহাবিশ্বে এই পৃথিবী নামক গ্রহটাতে সুজনের উৎপাত থেকে একমাত্র নিরাপদে যে প্রাণীটি আছে- সে হল অনুজ সুমনা। এই আদরের বোনটির প্রতি তার আচরণ এমন দায়িত্ব সম্পন্ন এবং সৎ যে- কেউ দেখলে ভাববে, এমন দায়িত্ববান ও সাধু মানুষ বোধ হয় পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টা নেই! সুমনাও তার ভাইয়ের খুব অনুগত। তবে সে বড় ভাইয়ের আকাম-কুকামকে সমর্থন করে না। এর ফলে দুই ভাই বোনের সম্পর্কে সামান্যতম কুপ্রভাব সাময়িক ভাবে পড়ে। কিন্তু তা কেটে যেতে খুব একটা সময় লাগে না। আবার কখনও কখনও মান অভিমানও কম হয় না তাদের মধ্যে। ছোট বোন হিসাবে তার যত আবদার সবই তো সুজনের কাছে!
‘ভাইয়া, আমাকে মেলায় নিয়ে যেতে হবে কিন্তু।’
‘তোকে মেলায় যেতে হবে না। বরং তুই একটা কাজ কর, যা যা লাগবে- তা একটা কাগজে লিখে আমাকে দে। আমি সব নিয়ে আসব।’
‘না, আমিই যাব!’
‘এত মানুষের মধ্যে তোর গিয়ে কি দরকার? বললাম তো, তোর যা যা লাগবে, আমিই সব নিয়ে আসব।’
‘না, তোমাকে আনতে হবে না। আমি গিয়ে তারপর কিনব।’
‘আমি পারব না তোকে নিয়ে যেতে। তোর যা দরকার- তা কাগজে লিখে দিলে দে- না দিলে নাই। বাস!’
‘ঠিক আছে যাও। আমি যাবও না, আমার জন্য কিছু আনতেও হবে না। আমার কিচ্ছু দরকার নাই। তুমি আমাকে এই রকম আদর কর- না? তোমার কি এমন ক্ষতি হবে আমাকে নিয়ে গেলে? যাও তোমার কোনো ক্ষতির দরকার নাই। আমাকে নিতে হবে না তোমার।’
বলেই অভিমানে অন্য রুমে গিয়ে মুখ গোমড়া করে বসে রইল। পিছন থেকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে সুজন বলল- ‘মেলায় যাবি না? উঠ। গিয়ে কাপড় পড়ে রেডি হ।’
শুনে সুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে সে বলল- ‘সত্যিই নিয়ে যাবা আমাকে?’
‘হু.....।’ মুচকি হেসে মাথা নেড়ে জবাব দেয় সুজন।
‘আমাকে কিন্তু নাগর-দোলায় তুলতে হবে।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
‘আমি কাঁচের চুরি কিনব কিন্তু; আর কিনব রাউন্ড বেন্ড, নুপুর.....।’ এভাবে একের পর এক বলতে থাকে। তাই ফিরিস্তিতে ছেদ টেনে সুজন বলে-
‘আরে যা না! তাড়াতাড়ি রেডি হ!’
নিজের জমানো আর মায়ের দেওয়া টাকা নিয়ে দুই ভাই-বোন মেলায় যাত্রা করল। যাওয়ার পথে প্রতিবেশি মুক্তার সাথে দেখা। সেও মেলায় যাচ্ছে। সুজন গত বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল করায় সে আর মুক্তা একই সাথে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।
‘সুজন ভাই, কয় দিন ধরে স্কুলে যাও না কেন?’ জানতে চায় মুক্তা।
‘আমার ইচ্ছা।’ একটু দম নিয়ে সামনের দাঁত কয়টি বেড় করে কিরিমিরি করতে করতে মুখ ভেংচিয়ে বলে, ‘এই এত ইস্কুল ইস্কুল করিস কেন?’
‘স্কুলে না গেলে পড়ায় পিছিয়ে যাবে যে!’
‘আচ্ছা, শুন মুক্তা। তোর নামটা মুক্তা হল কেন রে? তোর নামটা তো নুরি, ধুলি, বালি, কণাও হতে পারত; না কি পারত না?’ খোঁচা দিয়ে বলল সুজন। মুক্তাকে এই ধরনের খোঁচা মেরে কথা বলতে পারলে তার মনে যেন বিশেষ এক ধরনের আনন্দ সঞ্চার হয়।
‘সুজন ভাই ভাল হবে না কিন্তু! গায়ে পরে তুমি এত ঝগড়া করতে চাও কেন সব সময়? কেন এত খোঁচা মেরে কথা বল?’
‘কেন্ন এত্ত খোঁচ্চা মেররে কত্থা বল্ল?’ কথাটা মুখ ভেংচিয়ে বলে সুজন। দম নিয়ে রেগে আবার বলল, ‘এই হতভাগিনী! আমি তোর সাথে ঝগড়া করি? খোঁচা মারি? তুই আমাকে পড়ার কথা বললি কেন? এই, পড়লে কি হবে রে? যারা পড়ে না তাদেরকে কি তোরা মানুষ মনে করিস না?’
এমন সময় হঠাৎ সুজনের চোখ পড়ল একটা দেয়ালে সাটানো বিজ্ঞাপনের দিকে। বিজ্ঞাপনের প্রথম লাইনটা ‘পড়াতে চাই’। এরপর বিষয়, শিক্ষকের নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার ইত্যাদি দেওয়া। এটা দেখে মুক্তার সাথের কথা কাটাকাটি রেখে বলল, ‘এই দাঁড়া, দাঁড়া। কথা বলিস না। আমি একটা কাজ করে আসি।’ সে বিজ্ঞাপনটার দিকে চলে গেল। সুমনা আর মুক্তা উৎসুকের সহিত তাকিয়ে রইল। সুজন একটা কয়লা সংগ্রহ করে ‘পড়া’ শব্দটার আগে একটা ‘থা’ যুক্ত করে দিল! পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ুয়া সুমনা ‘পড়াতে চাই’কে ‘থাপড়াতে চাই’ পড়ে ফিক করে হেসে দিল। কিন্তু মুক্তা কিছুটা রাগের সুরে জানতে চায়, ‘সুজন ভাই এটা কি করলা?’
‘কেন? কি করেছি?’
‘এত বড় একটা অন্যায় করেও আবার জানতে চাও কি করেছ? একটা মহৎ কাজের বিজ্ঞাপনে কালি দিলা?’
‘বলে কিরে ছেমড়ি! এটা মহৎ কাজের বিজ্ঞাপন? আরে এগুলো তো ব্যবসা-ব্যবসা। তুই কি জানিস! সরকার কি শিক্ষকদেরকে বেতন দেয় না? টাকার বদলে তো আর গাছের পাতা গুণে দেয় না তাঁদেরকে ! তাহলে তাঁরা কি করেন? প্রাইভেটের দরকারটা কি? ফালতু একটা ধান্ধাবাজি আর কি! এগুলোর কি দরকার আছে?’
‘তোমার দরকার না থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের তো আছে। আমাদের তো উপকার হচ্ছে। অনেক কিছুই ক্লাসে বুঝা সম্ভব হয় না, তা প্রাইভেটে সহজেই বুঝে নেওয়া যায়।’
সূচিত ঝগড়াটাতে ছেদ পড়ে সুমনার মেলাতে যাওয়ার তাড়াহুড়ার জন্য-
‘তোমরা চুপ কর। তাড়াতাড়ি চলতো। মেলাতে বেশিক্ষণ ঘুরতে পারব না। সন্ধ্যা হয়ে যাবে তো।’
সবাই মিলে দ্রুত হাঁটতে লাগল মেলার দিকে।
৪.
ঘুরে ফিরে গভীর রাতে একদিন বাড়ি ফিরছিল সুজন। বড় বাস্তার মোড়েই বন্ধুদের থেকে বিছিন্ন হয়ে প্রত্যেকেই যার যার গন্তব্যের দিকে গেল। এক প্রতিবেশির বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে ফিসফিস গলার আওয়াজ শুনতে পেল। ভাল করে কান পাততেই বুঝল, এটা চোরের পরামর্শ। পাশের বাড়ির গোয়াল ঘরে গরু চুরির জন্য এরা প্রবেশ করেছে। হঠাৎ একটা নতুন ফন্দি এল তার মাথায়। সে মনে মনে চিন্তা করল, নিশ্চয় চোর সুজা পথে যাবে না। জঙ্গল দিয়েই হয়ত গরু নিয়ে পালাতে চাইবে। গোয়ালের পিছনে ছিল একটি তেঁতুল গাছ। তেঁতুল গাছে ভুত থাকে- এই লৌকিক কথাটাও ব্যাপক ভাবে প্রচলিত ছিল। কিন্তু সুজনের এ বিষয়গুলোর প্রতি তেমন ডর-ভয় ছিল না। সময়ে অসময়ে বন-জঙ্গলে ঘুরলে তাকে ভুত ধরতে পারে- এমন কথা কেউ বললে সে উল্টা বলে দিন, ‘আমিই তো একটা ভুত ধরার জন্য কবে থেকে খুঁজছি; পাই না!’ এই ডানপিটে উচ্ছৃঙ্খল ছেলেকে এ সব বলে কোনো লাভ হবে না বিধায় এ রকম সাবধান করা থেকে লোকেরা এখন ক্ষান্ত থাকে!
চোর গরু নিয়ে গোয়াল থেকে বের হওয়ার আগেই সুজন তেঁতুল গাছের মাঝা-মাঝি একটা ডালে পরিকল্পনা মত বসেছে। যেমনি চিন্তা তেমনি কাজ। চোর গরু নিয়ে জঙ্গলের পথ ধরল। তেঁতুল গাছ সম্পর্কে বিরুপ ধারনা তাদের মনেও ছিল। কিন্তু এই কাজের জন্য এর চেয়ে নিরাপদ ও উত্তম পথ আর ছিল না। তাই তারা সে পথেই যাত্রা করল। তাদের আগমন যথাযথ পর্যবেক্ষণ করে সঠিক আবস্থান নিয়ে বসল সুজন। গাছের তলায় পৌঁছা মাত্রই বিশেষ এক ধরনের প্রকৃতিক গরম পানি চোরদের উপর অবতীর্ণ হতে শুরু করল! এটাকে ভূতের কাজ ভেবে এদের দুই জন গরু ছেড়ে ভয়ে- ‘মা গো-বাবা গো’ বলে পালাল। কিন্তু একজন অজ্ঞান হয়ে সেখানেই পড়ে গেল। এরপর সুজনের চিৎকার শুনে লোকজন ছুটে এসে অজ্ঞান চোরকে আটকাল। এলাকাবাসী ধৃত চোরের দেওয়া তথ্য মত অন্য চোরদেরও ধরতে সক্ষম হল। চোরদের বহুদিনের উৎপাত থেকে রক্ষা পেল এলাকার জনগণ। একই সাথে এই প্রথম বুঝি সুজন এলাকাবাসী কতৃক প্রশংসিত হল!
৫.
কয়েক দিন ধরে সুজনের শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে। জ্বর এসেছে বেশ। শরীর শুকিয়ে গেছে। স্থানীয় চিকিৎসক উপসর্গ দেখে প্রাথমিক চিকিৎসা দিলেও কোনো ফল হয়নি। দ্রুত থেকে দ্রুততর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটল তার। ইদানিং দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত যায়। বমির এবং পায়খানার সাথেও রক্ত যাচ্ছে কিছু কিছু। এই অবস্থায় জেলা শহরের একজন খ্যাতিমান ডাক্তারকে দেখানো হয়। তার পরামর্শে বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এতে তার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। বেশ জটিল অবস্থায় চলে গেছে তা! তাই যত দ্রুত সম্ভব, তাকে আরও উন্নততর চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়া জন্য বলা হয়। কিছু জমি বিক্রি করে টাকা-পয়সা যোগাড় করতে বেশ কয়েক দিন কেটে গেল সুজনের বাবার। এর মধ্যে তার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গিয়েছে।
সন্ধ্যা নেমে এল। সুজনকে দেখতে পাড়া-প্রতিবেশিরা আসছে। পরদিন সকালে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে ঢাকায়। পাশে বসে কাঁদছেন তার মা। মায়ের কান্না দেখে সুজন আরও বিচলিত হয়ে পড়ল।
‘আম্মা গো; তুমি কেঁদ না গো আম্মা। তোমার কান্না দেখলে যে আমার খুব কষ্ট হয়।’
‘তুমি কি কিছু খাইবে বাবা?’
‘না আম্মা। কিছু খাব না।’ বলে একটু থেমে আবার বলল, ‘আম্মা, ক্যান্সার হলে নাকি মানুষ বাঁচে না! আমিও কি মরে যাব আম্মা? আমি কি আর ভাল হব না?’
ছেলের মুখে কথা কয়টা শুনে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে কান্না আসছে সুজনের মার।
‘তুমি ভাল হবে বাবা। অবশ্যই ভাল হবে। ভাল হয়ে আবার আমার কোলে ফিরে আসবে!’
‘না আম্মা! আমি বোধ হয় আর ভাল হব না।’ একটু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার বলল, ‘আমি কত আকাম-কুকাম করেছি! ডাব চুরি করতাম, মানুষের গাছ নষ্ট করতাম, পেঁপে চুরি করতাম। মানুষ কত আচার-বিচার নিয়ে আসত প্রতিদিন! তোমাদেরকে আর আচার-বিচার শুনতে হবে না, তাই না আম্মা? তোমার ব্যাংকের টাকা আর চুরি করব না। তুমি কত বার আমাকে মরে যেতে বলতে! আমি এই সব নিয়ে মজা করতাম! তোমাদেরকে আর জ্বালাতন করব না আম্মা।’
‘বাবারে, আমি এমনটা চাই না-ই রে বাবা! আমি তোর মৃত্যু চাই না- আমি তোর জীবন চাই! আমি রাগে এইগুলি বলতাম রে বাবা!’ বলে দুই হাতে নিজের আঁচলটা আকাশের দিকে তুলে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আয় আল্লাহ্! আমি এমনটা চাই না-ই। আমার কথায় তুমি বিরক্ত হয়ে আমার বুক খালি কর না আল্লাহ্! তুমি আমার সন্তানের জান ভিক্ষা দাও গো আল্লাহ্- আমার সন্তানের জান ভিক্ষা দাও!’ বলে বলে উচ্চ স্বরে আহাজারি শুরু করে সুজনের মা। তাই তাঁকে কয়েক জনে অন্য রুমে নিয়ে যায়। মায়ের কান্নায় সুজনেরও কান্না আসল বুক ভেঙ্গে।
সুমনার চোখ দিয়েও পানি পড়ছিল। মায়ের কান্নার সাথে সাথে তার কান্না আরও বেড়ে গেল। সুজন তা দেখে ইশারা করে তাকে নিজের পাশে বসাল।
‘কাঁদছিস কেন? আমার অসুখ বলে?’
চুপ রইল সুমনা। তাই আবার জানতে চাইল, ‘কি রে কথা বলছিস না কেন?’ ‘তুমি কি আমাকে আর আগের মত আদর করবে না? আমাকে কি আর মেলায় নিয়ে যাবে না ভাইয়া? আমার তো আর ভাই নাই! তোমার মত আমাকে আর কে আদর করবে ভাইয়া? তুমি মরে যেও না ভাইয়া। তুমি আমাদেরকে ছেড়ে কি চলে যাবে? তোমাকে কি আর দেখতে পারব না ভাইয়া?’
আদরে ছোট বোনের এতগুলো প্রশ্ন শুনে সুজন স্তব্ধ হয়ে গেল। শুধু সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘দুর পাগলি! আমার তো কিছু হয়নি। তুই কাঁদিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে!’ বলতে বলতে নিজের গলাটাও ধরে আসল। ছোট বোনের মাথাটা আদর করে নিজের বুকে এনে ঠেকাল।
এমন সময় সুজনের বাবা বাড়ি ফিরলেন। তিনি একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে এসেছেন। ঐ ডাক্তার জানিয়েছেন যে দ্রুত চিকিৎসা নিলে রোগ ভাল হওয়ার সম্ভাবনা এখনও আছে। তাই তিনি সুজনকে খুব ভোরে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্সেরও ব্যবস্থা করে আসলেন।
রাত্রি শেষে আঁধার প্রায় কেটে পড়েছে। অ্যাম্বুলেন্স আসল। সুজনের সাথে তার বাবা, এক ফুফু আর এক ফুফাত ভাই গেল। কিন্তু মা সাজেদা বেগমকে নেওয়া হল না। যাওয়ার সময় সুজনের মা খুব কান্না করছিল। মাকে সান্ত্বনা দিয়ে সে শুধু বলল, ‘আম্মা, দো’আ কর। তোমার কোলে যদি ফিরে আসি, তাহলে সুজন হয়েই ফিরে আসব! তোমার মনে আর ব্যথা দিব না!’ পিছনে পিছনে তার ছোট বোন সুমনাও কান্না করতে করতে আসল।
পূর্ব মূখী রাস্তা ধরে অ্যাম্বুলেন্সটি চলে গেল। তার পিছন দিকে তাকিয়ে আছে সুজনের স্বজনেরা। রাতের শেষ আঁধারকে বিদীর্ণ করে অ্যাম্বুলেন্সটি যাত্রা করল সামনের দিকে। দিনের নবীন সূর্যের উদ্ভাসিত আলো ঠিক তার পাশ দিয়েই বিকিরিত হল।