নীলদিঘি গ্রামের একেবারে উত্তর প্রান্তে সুজনদের বাড়ি। গ্রামটি খুব একটা বড় নয়। মাঠের চারদিকে বৃত্তের মতো ঘুরানো বাড়ি। মাঝখানে সবুজের ঢেউ খেলানো বিশাল মাঠ আর মাথার উপর নীল আকাশ। মাঠের উত্তর প্রান্তের কাছাকাছি শতবর্ষী বট গাছ। চারদিকে ডালপালা শিকড় এমন ভাবে ছড়ানো ছিটানো যে তাকে দেখে এমনিতেই বুঝা যায় এর বয়স অনেক। ক্লান্ত পথিক আর চাষিদের ছায়া দিয়ে শান্ত করাই এই বট গাছের প্রধান কাজ। এখানে সব সময় বিশ্রামরত কোন না কোন মানুষ থাকে। আর গাছে তো আছেই নাম না জানা কত রকমের পাখি, সাপ-বিচ্ছু। তবে কেউ কারো কোন ক্ষতি করে না। আর আছে ভৌতিক সব আজগুবি গল্প। এই বট গাছের অনতি দূরে সুজনদের বাড়ি। শরতের ছুটি। তাই স্কুলে যাওয়ার তাড়া নেই অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া সুজনের। সকাল বেলা ফুরফুরে মেজাজে ঘর থেকে বেড়িয়ে বন্ধুদের নিয়ে বট গাছের নিচে বসে ভাবতে থাকে আজকের দিনটা কি করে কাটানো যায়। এমন সময় মাথায় বুদ্ধি এলো একটি বড় আকারের ঢাউস ঘুড়ি বানিয়ে তা আকাশে উড়িয়ে দেবে। তার কথায় বাঁধ সাধে পলাশ। সে বলে ঘুড়ি উড়ানোর সময় হল চৈত্র বৈশাখ মাস। এখন কিসের ঘুড়ি উড়াবে তুমি ? কিন্তু সুজন নাছোড় বান্দা। সে ঘুড়ি বানাবে এবং উড়িয়েই ছাড়বে। যেই কথা সেই কাজ। ঘুড়ি তৈরির যাবতীয় সরঞ্জাম সাথে নিয়ে বট গাছের নিচে বসে ঘুড়ি বানানোর কাজে লেগে গেল সুজন। কিছুক্ষণ পর ঘুড়ি বানিয়ে সে আকাশে উড়িয়ে দিল। কিন্তু বিধি বাম। ঘুড়ি আকাশে উড়ার সাথে সাথেই আচমকা বৃষ্টি এসে ঘুড়িটিকে ভিজিয়ে বট গাছের উত্তর দিকের উপরের অংশে আটকে ফেলল। এমন জায়গায় ঘুড়িটি আটকে গেল যা সুজনদের বাড়ির উঠোন থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সুজন মনের মত করে ঘুড়ি উড়াতে না পেরে কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। নিজের বাড়ির উঠোন থেকে আটকে যাওয়া ঘুড়ির দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে। আর ঘুড়িটিও বাতাসের আঘাতে সুজনকে যেন বার বার টা টা দিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। সুজন অপলক নেত্রে ঘুড়ির এক ভিন্ন রকম সৌন্দর্য অনুভব করছে। এমন সময় ঢাকা থেকে সুজনের মামা মামি আর মামাতো ভাই রবিন এসে তাদের বাড়িতে হাজির। আচমকা তাদের দেখে সুজন তার ঘুড়ি হারানোর কথা ভুলে গেল। রবিনের স্কুলও শরতের ছুটিতে বন্ধ হয়ে গেছে। তাই তারা এসেছে বেড়াতে। সুজন মনে মনে ভাবে, এই কয়টা দিন অন্তত ভালভাবে কাটানো যাবে। সুজন পরিকল্পনা করে আজ পূর্ণিমার রাত। বাড়ির উঠোনে বসে সবাই মিলে গল্পের আসর বসানো হবে। লাল থালার মত সূর্যটা আস্তে আস্তে পশ্চিম আকাশে মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে নীলদিঘি গ্রামে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। চারিদিক অন্ধকার করে থাকার কথা থাকলেও আজ পূর্ণিমা তিথি হওয়ায় স্নিগ্ধ আলোয় চারিদিক ভরে গেল। এমনি চাঁদনী রাতে সমবয়সী মামাতো ভাই রবিন সুজনসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা মিলে সন্ধ্যার পর যখন উঠোনে বসে গল্প করছিল, ঠিক তখনি রবিনের দৃষ্টি যায় মাঠের বট গাছের উপর। সে দেখতে পায় সেখানে মোটা আকৃতির লম্বা লেজ ওয়ালা কি যেন একটা গাছের উপর বসছে আবার উড়ছে। মনে হয় লেজ দিয়ে মোটা আকৃতির জন্তুটা তাকে ডাকছে। কারণ রবিন বট গাছের অনেক ভৌতিক কাহিনী শুনেছে। রবিনের এ দৃশ্য দেখে এমন অবস্থা হল যে, সে মুখে কোন কথা বলতে পারছে না। চাঁদের আলোতে ঘুড়ির কাগজের রঙ্গে যে পরিবর্তন হচ্ছিল তা যেন রবিনের কাছে ভূতের অট্টহাসি হিসেবে ধরা দিচ্ছিল। রবিনের মনে পড়ে যায় নীলদিঘি গ্রামের শত বর্ষী এ বট গাছের নিচে গত বর্ষায় এক বৃদ্ধের মারা যাওয়ার কথা। বৃদ্ধটি নাকি ভারি বৃষ্টির সময় একা একা এ পথে হেঁটে যাচ্ছিল। বট গাছের নিচে বৃদ্ধটি আসার সাথে সাথেই নাকি ভ‚তের সর্দার ল্যাংড়া ভেংচির সামনে পড়ে যায়। আর অমনই বৃদ্ধ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পা পিছলে পড়ে মারা যায়। এ সবই রবিনের লোক মুখে শোনা কথা। আসলে হয়তো বৃদ্ধটি পা পিছলে পড়ে যাওয়ার পর শারীরিক ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মৃত্যু হয় বৃদ্ধের। গ্রামের সাধারণ মানুষ অনেক সামাজিক কুসংস্কারে লিপ্ত হয়ে ভৌতিক কল্পকাহিনীর নানান গল্প আঁটে। গ্রামের মানুষের অবৈজ্ঞানিক কথাগুলো আজ রবিনের মনে দারুণভাবে দাগ কাটতে লাগলো। সে বাড়ির সবার গল্পগুজবে কান না দিয়ে ভয়ে ভয়ে মায়ের আঁচলের কাছে গিয়ে বলতে থাকে মা দেখ ঐ যে বট গাছের মাথায় ল্যাংড়া ভেংচি ভ‚ত বসেছে। দেখ দেখ কিভাবে ঘাড় নাড়ছে। আমাদেরকে লক্ষ্য করে লেজ নেড়ে কি যেন বলতে চাচ্ছে। মা আমি আর বাইরে থাকবো না। উঠোনে যারা বসা ছিল সবাই এক যোগে সে দিকে তাকাল। কেউ হুড়মুড় করে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়লো। মুহূর্তের মধ্যেই সুজনদের উঠোনে একটা ভৌতিক আবহ তৈরি হয়ে গেল। সবার মাঝেই কেমন যেন একটা আতংক বিরাজ করছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল সুজন। সে রবিনসহ বাড়ির সবাইকে বুঝানোর চেষ্টা করতে লাগলো যে এটা কোন ভ‚ত নয়। তার নিজের হাতে বানানো ঘুড়ি যা বট গাছের উপরে আটকে বাতাসে ভাসছে। ব্যাপারটাকে বাড়ির লোকজন রবিনদের কাছে সুজনের একটা বাহাদুরি জাহির করার অপচেষ্টা বলে কেউই ঘুড়ির কথাটা পাত্তা দিলনা। বরং সুজনকে সবাই জোর করে ঘরের ভিতর নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। এই রাতে আর কেউ ঘরের বাইরে বের হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। রবিনদের ধারণা তারা দূর হতে এসেছে। পথেই এই ল্যাংড়া ভেংচি ভ‚ত তাদের ফলো করেছে। এখন রাতের বেলা তার একটা ভৌতিক আকৃতি নিয়ে রবিনদের উপর আছর করার চেষ্টা করছে। সুজন যতই সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছে ততই সুজনের বাবা মা অতীতে কত জন এই বট গাছের উপর কিকি দেখেছে তার ফিরিস্তি টেনে পরিবেশকে আরও ভারি করার চেষ্টা করছে। সুজন অগত্যা তাদের সাথে তর্কে না জড়িয়ে আপাতত চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। সকাল হলেই দেখা যাবে সুজনের কথাই ঠিক না তাদের ল্যাংড়া ভেংচির আতংকই ঠিক। সবাই ভ‚ত তাড়ানোর বিভিন্ন কৌশল আওড়িয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে যে যার মত ঘুমিয়ে পড়ল। সুজন কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় বেশ মজা পাচ্ছে। ভোর হওয়ার অপেক্ষায় যেন সময় কাটছে না তার। সকাল বেলা বট গাছের মাথায় ঘুড়ি দেখে রবিনসহ বাড়ির লোকজনের কি অনুভূতি হতে পারে এমন নানান কথা ভাবতে ভাবতে সুজন এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। খুব ভোরে মসজিদ থেকে ভেসে আসা আযানের সুরে নীলদিঘি গ্রামের মানুষের ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ভাঙ্গে সুজন রবিনসহ তাদের পরিবারের সকলের। ঘুম থেকে উঠার সাথে সাথেই সুজনের কৌতূহল বেড়ে যায়। সে রবিন ও তার মামা মামীকে উঠোনে ডেকে এনে যখন ঘুড়ির বাস্তব ছবি দেখালো তখন সবার মুখ তো হা হয়ে গেছে। রবিন এখন নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলে আসলে বট গাছটা অনেক বড়। তাই এর কাছে গেলে এক ধরনের মানসিক দুর্বলতা, ভয় ও জড়তা কাজ করে। কিন্তু যে ঘুড়িটাকে ভ‚তের সর্দার বলে ভয়ে আমরা ভীত হয়ে পড়ি ; আসলে বাস্তবে তো এমন কিছুই নেই। পৃথিবী আজ বিভিন্ন গবেষণা ও প্রযুক্তিতে অনেক দূর এগিয়েছে। সকল কিছুর যুক্তিযুক্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। কোন বিষয়ের গভীরে না গিয়ে অনুমান নির্ভর সিদ্ধান্ত নেয়া যে ঠিক নয়, তা এই ভৌতিক অনুভূতিই প্রমাণ করে। সবাই সুজনকে তার কথায় পাত্তা না দেয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। একই সাথে অতীতের ভৌতিক কল্পকাহিনীর বিশ্বাসের ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে নতুন ভাবনার উদ্রেক হয়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মাহমুদ হাসান পারভেজ
আমার বাবার কাছে শোনা তার ছোটবেলায় একসময় নাকি তাদের বাড়ীর (মানে আমার দাদাবাড়ী) লম্বা টিনের চালে পাথরকুচির বড় বড় ঢেলা এসে পড়ত প্রায় সন্ধ্যায় সেই সাথে ঝনঝনঝন করে শব্দ। ছোট বড় সবাই ঘরের ভেতর সারা সন্ধ্যা এমনকি পুরো রাত কাটিয়ে দিত দরজা বন্ধ করে।সেসব আরেক গল্প।
--------------------------ভালো লাগলো আপনার গল্প।শুভকামনা ও শ্রদ্ধা জানবেন।
ওয়াহিদ মামুন লাভলু
আসলে অনেক সময় এ রকমই হয়। এমন কি দিনের বেলায় রাস্তার পাশের যে গাছটা মানুষ সবসময় দেখে সেটাকেই রাতে দেখলে ভৌতিক মনে হয়। চমৎকার গল্পের মাধ্যমে শিক্ষণীয় একটা বিষয় তুলে ধরেছেন। খুব ভাল লাগল। শ্রদ্ধা জানবেন।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।