আঁধার রাত। চারিদিকে অন্ধকার। লাইটপোস্টোরে বাতিটি এতদিনই আলো দিত। আজ কয়েকদিন হয় বাতিটি নষ্ট হয়ে গেছে। তাই অন্ধকারই এখন সাথি আট বছরের রুহিতের। ঘুট ঘুটে অন্ধকারে রুহিত লাইটপোস্টের থামটিকে মাথা গোঁজার শক্ত ভীত বানিয়ে কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু রাখার বস্তাটিকে বালিশ বানিয়ে আকাশ নামক বিশাল ছাদের নিচে ঘুমানোর আয়োজন করেছে। ক্লান্ত দেহ। বস্তার মাঝে মাথা রাখলেই ঘুম এসে যাবে। পর দিন ভোরে আযানের সময় উঠে জঠর জ্বালা মিটানোর জন্য আবার তাকে এটা সেটা টোকানোর কাজে লেগে যেতে হবে। সারাদিন প্লাস্টিকের বোতল এবং অভিজাত শ্রেণীর উচ্ছিষ্ট সংগ্রহ করে যা পাওয়া যায় তা দিয়ে কোন রকমে পেটের চাহিদা মিটিয়ে দিনাতিপাত করাই রুহিতের নিত্য দিনের রুটিন। মাত্র দু’বছরের জীবন রুহিতকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। ঢাকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এলাকায় রুহিতের বাবা, মা আর রুহিত মিলে একটা ছোট্ট ছিম ছাম ঘরে ভাড়া থাকত। বাবা রতন গাজী ছিল গার্মেন্টের একাউন্টস অফিসার। মা ছিল তার সোহাগের ছায়ামণি। বাবার স্বপ্ন ছিল রুহিত অনেক বড় হবে। উচ্চ শিক্ষিত হবে। আদর্শ আর নীতিবান মানুষ হবে। দেশের সেবা করবে। রুহিতের বাবা রতন গাজীর সারা দিনমানের কর্মযজ্ঞ চলতো রুহিতের হাসি মুখ দেখার জন্য। একদিন রুহিতের বাবা অফিসের যাবার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিল। আর ফিরে নি। ছয় বছরের ছেলে রুহিত দেখতে পেল তার মা মোবাইলে কথা বলতে বলতে হঠাৎ কেঁদে উঠল। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল একটি শব্দ করা গাড়ীতে করে একটি লাশ বাসার সামনে আসলো। তাতে তার বাবার লাশ। উচ্চ বিত্তের পাজেরো জীপের চাকায় পিষ্ট হয়ে তার বাবা প্রাণ হারিয়েছেন। লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় রুহিতের বাবা-মার সাজানো গোছানো সংসার। ছয় বছরের রুহিত তখন কিছু না বুঝলেও আজ ঠিকই সে সব কিছু হারে হারে টের পাচ্ছে। বাবা মারা যাওয়ার পর তার মা নতুন জীবন গড়ার জন্য নতুন দিগন্তে হাত বাড়ায়। আর এতে করেই নেমে আসে রহিতের জীবনে এক অমানিশার অধ্যায়। মা যেখানে উঠলো সেখানে রুহিতের ঠাঁই না হওয়ায় একদিন রুহিত নিজের চেষ্টায় বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে কাউকে কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সে আর ঘরে ফিরে যেতে পারে নি। তার বাবার গ্রামের বাড়ি কোন জেলায় তা বলতে পারে না। শুধু এটুকু বলতে পারে তার বাবার বাড়ি যে গ্রামে অবস্থিত তার নাম সবুজ গাঁও। রুহিত কেবল এটা সেটা টোকায় বিষয়টি এমন নয় ; একটি অটোমোবাইল গ্যারেজে তিন ঘণ্টা করে দুপুরের খাবারের বিনিময়ে কাজ করে। সেখানে তার কাজ হলো বড় বড় ইঞ্জিনের নাট-বল্টু খুলতে সহায়তা করা। ওস্তাদকে নাট-বল্টু খোলার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সময় মতো যোগান দেয়া। কোন কারণে বা খেয়ালের ভুলে সময় মতো দিতে না পারলে খেতে হয় বকুনি। রুহিত বকুনি খেয়ে কিছু বলে না, কেবল নীরবে চোখের জল ফেলে আর ভাবে ‘আমার মতো ছোট্ট শিশু তাদের ঘরে যারা আছে তারা কতোই না আদরে আবদারে দিন কাটায়। আর আমি সকালে এক বেলা টোকাইয়ের কাজ করলাম, এখন আবার দুপুরের খাবারের জন্য ওস্তাদের বকুনি খাচ্ছি। আমার তো একটা শিশু মন আছে, আছে প্রাণ খুলে হাসার দূদর্মনীয় ইচ্ছা। সমাজের মানুষগুলো কেন শিশুদের একটু সহানুভ‚তির সুরে কথা বলে না ?’ এমন হাজারো প্রশ্নে রুহিত যখন মনের সাথে বাদ-প্রতিবাদে ব্যস্ত তখন ওস্তাদের রূঢ় কথা তাকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ছোট্ট রুহিতের জীবন সংগ্রামে হাজারো কষ্টের বিন্দু জমলেও সে ক্লান্তি বোধ করে না। তার মনে এক সুপ্ত বাসনা কাজ করে সবসময়। সে বড় হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে। সচেতন হবে। শিক্ষিত হবে। তার বাবার ইচ্ছা পূরণ করবে। কিন্তু এতগুলো ইচ্ছার কথা কাকে বলবে তার সঠিক ঠিকানা সে খুঁজে পায় না। লাইটপোস্টের সাথে রাখা বস্তায় মাথা রেখে অন্ধকারে আনমনে যখন রুহিত এত কিছু ভাবছে তখন দুই চোখ বিশিষ্ট একটি যন্ত্র দানব শাঁ শাঁ করে মাটি কামড়ে গর্জন করতে করতে ছুটে যায়। কিছুক্ষণের জন্য চারিদিকে আলোয় আলোয় ভরে যায়। কিন্তু সে আলো রুহিতের মনকে আলোকিত করতে পারে না। কারণ এ যন্ত্রদানব যানবাহনকে রুহিত খুব ঘৃণা করে । তার বাবা রতন গাজী এ যন্ত্রদানবের কালো থাবায় প্রাণ হারিয়েছে। ভাবনার মহাসাগরে ভাসতে ভাসতে একসময় রুহিতের ক্লান্ত দেহ ঘুমিয়ে পড়ে। খুব ভোরে আযানের শব্দে রুহিতের ঘুম ভাঙ্গে। আযানের সু-মধুর সুর রুহিতকে আকর্ষণ করে। সে সিদ্ধান্ত নেয় হাত মুখ ধুয়ে মসজিদে ফজরের নামায পড়তে যাবে। মসজিদে গিয়ে তার পছন্দ মত কোন ব্যক্তি পেলে তাকে মনের ইচ্ছার কথাগুলি বলবে। বাবা তাকে নিয়ে কি ভাবতেন তা খুলে বলবে। রুহিত ভাবে যদি মনের ইচ্ছার কথাগুলি কাউকে বুঝানো যায় তাহলে তার স্বপ্ন পূরণ হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে মসজিদে যায়। নামাজ আদায় করে। নামাজের মধ্যে ইমামের সুমধুর কুরআনের তিলাওয়াত তাকে মোহিত করে। তাই সে ইমামকে তার কথাগুলো জানাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। নামাজ শেষে ইমামের কাছে গিয়ে রুহিত তার মনের কথা জানায়। ময়লা কাপড় পরনে থাকলেও রুহিতের চেহারায় ছিল এক মায়াবী আবরণ। রুহিতের কথা শুনে ইমাম সাহেবের অন্তর সহানুভ‚তির অশ্রুতে সিক্ত হয়। তিনি তাকে একটি ইসলামিক সেন্টারে ভর্তি করে দেয়ার ব্যবস্থা করে দেন। শুরু হয় রুহিতের নতুন জীবন। নতুন একটি ভোর পৃথিবীর সকল আঁধার দূর করে যেমনি চারিদিক আলোকিত করে, তেমনি রুহিতের জীবনের সকল আঁধার দূর করে আলোকিত নতুন সোপানে পৌঁছার প্রথম সিঁড়িতে পা রাখার সুযোগ পায়। টোকাইয়ের বস্তা পেছনে ফেলে বই খাতা নিয়ে রুহিত মত্ত হয় এক সুন্দর স্বপ্ন রচনায়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Arif Billah
আমাকে যারা অভিনন্দন জানিয়েছেন সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা। সকলের নিকট দোয়া প্রাথী।
ওয়াহিদ মামুন লাভলু
মূল্যবান বাস্তব চিত্র। আযান শুনে রুহিত যেমন নামাজ পড়ার তাগিদ অনুভব করেছে, সেরূপ তাগিদ যদি সবার মাঝে আসতো তাহলে রুহিতের মতো সবাই হয়তো আল্লাহ্র রহমত পেয়ে যেতো। ইমাম সাহেব যে উপকারটি রুহিতের জন্য করেছে সেই উপকারটি তো পাজেরো জীপের মালিকেরই করা উচিৎ ছিলো, তাহলে তো রুহিতকে আর রাস্তায় কাটাতে হতো না। খুব ভালো লাগলো। শ্রদ্ধা জানবেন।
শামীম খান
আমাদের সমাজের কথা , মানুষের কথা খুব ভাল ভাবে তুলে ধরেছেন । খুব ভালো লাগলো লেখাটি । টোকাইরা মাথা গোঁজার ঠাই পাক । দেশটা শান্তিতে ভরে উঠুক । আপনার কলম এগিয়ে চলুক । শুভ কামনা ।
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্
গল্পটা শুধু গল্প নয়। সুন্দর একটা দিক নিদের্শনা লুকিেয় অাছে গল্পের ভেতর, যা অসহায় দিকভ্রান্ত মানুষের মাঝে প্রত্যয় জাগাতে যথেষ্ট অবদান রাখতে সক্ষম হবে। খুব ভাল লাগল। লেখকের স্বচ্ছ ও সুন্দর চিন্তার জন্য ধন্যবাদ।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।