মুক্তির প্রথম স্পর্শ

বিজয় (ডিসেম্বর ২০১৪)

রবিন রহমান
  • ১২
  • 0
  • ৪১
আজ কতদিন হলো একটা প্রেমের সুন্দর কবিতা লিখবে বলে ডাইরি আর কলম নিয়ে ঘুরছে হাসনাত আলিফ। বয়স কম হলো না। চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। সেই কবে একটা কবিতা লিখেছিলো প্রেমের, পাশের বারির মেয়ে টিকে দিতে কতো খুশিই না হয়েছিলো সে। সে অনেক দিন আগের কথা। মেয়েটিকে বড্ড ভালোও বাসতো হাসনাত। কিন্তু যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হয় তখন থেকে প্রায় নিয়মিত নানা আন্দোলন সংগ্রামে জড়িয়ে গেছে। ভাষার সংগ্রাম, নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ইত্যাদি ইত্যাদি। মাঝে মধ্যে রক্তের শিল্পকর্ম পথে পথে যা এক একটি অধ্যায় হয়ে যাচ্ছে এই ভূখণ্ডে। সেগুলোকে নিয়ে গল্প কবিতা লিখে স্মৃতির পাতায় জায়গা করে দিতে নিয়মিত ব্যস্ত থাকতে হয়। এমন কি ওর কিছু কিছু লেখা এতোটা মানুষ কে আকৃষ্ট করছে যে শাসক দলের কঠোর হস্ত ওর দিকে ধেয়ে আসে মাঝে মাঝে। কোন ভাবে মরতে মরতে বেঁচে থাকা। দেখতে দেখতে পাশের বাড়ির মেয়েটারও বিয়ে হয়ে যায়। নিজেও পড়ালেখা শেষ করে পত্রিকা অফিসে চাকুরী করতে থাকে। প্রেম যেন হাসনাতের কাছে দুর্লভ কোন বস্তু হয়ে গেছে। তবুও হাল ছাড়েনি। তবে এখন পরিস্থিতি আরো খারাপ। যুদ্ধের দামামা বাজছে নিয়মিত। পাকিস্তানের এই ভূখণ্ডের মানুষের উপর সরকারের অত্যাচার দিন দিন বাড়ছে শুধু। এদিকের বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। হাসনাত নিজেও কম যায় না। এই প্রকারের সংগ্রাম আর বিদ্রোহের বাণী লিখতে লিখতে সুন্দর একটা প্রেমের কবিতা লিখতে আর পারে না সে। রাতে পত্রিকা অফিসে একটা প্রতিবেদন লিখতে ব্যস্ত হাসনাত। হঠাৎ পাশে টেলিফোনটা বেজে ওঠে। এপাশ থেকে হাসনাত ফোন রিসিভ করতে অপর পাশ থেকে সুমনের কণ্ঠ ভেসে আসে।
কে, হাসনাত।
হ্যাঁ, বল কি বলবি।
হাসনাত, অবস্থা বেশি সুবিধার না। আজ রাতে কি এক অভিযানের আদেশ এসেছে। আমাদের ভূখণ্ডের গুরুত্ব পূর্ণ সকল ব্যক্তির তালিকা তাতে অন্তর্ভুক্ত কারা হয়েছে। তালিকাতে তোর নামটাও দেখতে পাচ্ছি। বন্ধু তুই তাড়াতাড়ি কোথাও পালিয়ে যা।
তখন পঁচিশে মার্চ সন্ধ্যা। নিজের পিছুটান বলতে তেমন নেই। সংসার নেই একা মানুষ। কিন্তু কিছু বুঝতে পারছে না কি করবে সে। আস্তে আস্তে সম্পাদকের রুমে ঢুকে বিষয়টি বলতে সে যেন একটু চিন্তিত হয়ে পড়লো। দ্রুত ড্রয়ার থেকে কিছু টাকা বের করে ওর হাতে দিয়ে বললো : আমার কিছু করবার নেই। আপনি পালিয়েই যান। কিছুদিন দেখেন তারপর অবস্থা বুঝে আসবেন।
হাসনাত নিজের ব্যাগে ডায়রি, কলম, দু তিনটা কাপড় আগে থেকে রাখা ছিলো। নিজের প্রিয় ট্রানজিস্টারটা দড়িতে বেঁধে কাঁধে ঝুলিয়ে নেই। তারপর অফিসের পেছন দিয়ে বেরিয়ে পরে হাঁটতে হাঁটতে। রাত তখন গভীর হয়ে আসতে থাকে। এক সময় দেহে ক্লান্তি বুঝতে পারে হাসনাত। গ্রামের পথ পেতে এখনো অনেকটা পথ বাঁকি। কোন এক নদীর ধারে কাশবনের ঝোপে বসতে চোখ ভেঙে ঘুম চলে আসে। কবির যে সুন্দর মন তা নিয়ে চাঁদকে, আর নদীর মৃদু হাওয়াকে অনুভব করে কোন সুন্দর কবিতা লেখা হয়না হাসনাতের। সকালে ঘুম থেকে উঠতে দূরে একটা রাস্তা দেখতে পায়। সেনাদের কয়েকটা গাড়ি ঘড় ঘড় আওয়াজ তুলে চলে যায়। একটু চমকে যায় হাসনাত, এমন গ্রামে সেনাদের গাড়ি কেনো যেতে শুরু করেছে। তবে কি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। হাসনাত দ্রুত গলা থেকে ট্রেনজেস্টারটা নামিয়ে চালু করতে শুনতে পায় একটা করুন কণ্ঠে, কেউ বলে যাচ্ছে শুধু মৃত মানুষের নাম। যাদের প্রায় সকল কে সে চেনে। গ্রাম থেকে শহরে চলে এসেছিলো প্রায় আজ বছর বিশ হলো। এই সময়ে গ্রামে কে নতুন এসেছে কে মারা গিয়েছে সে সম্বন্ধে ভালোকরে জানে না হাসনাত। বাবা মা মারা গেছে অনেক আগে। ছোট ভাই টা গ্রামে জমিজমা দেখা শোনা করে। এখন শহরে ফিরে যেতে পারছে না হাসনাত। মিলিটারিরা পুরো শহর ঘিরে ফেলেছে। এমন কি গ্রামে গ্রামেউ মিলিটারি ঘাটি গাড়তে শুরু করেছে। দেশ ভাগ করে ইংরেজরা কিজে দিয়ে গেলো। কোকিলের বাচ্চা যেমন কাকের বাসায় জমা দেয়া। কাক কি বুঝতে পারলে কোকিলের বাচ্চা কে রাখবে। না কোকিলের বাচ্চাটাই কাকের বাসায় থাকবে। শোষণ শাসন করে ভালো কথা, তাই বলে এমন হত্যাকাণ্ড। কোথাই পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ড আর কোথাই এই পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ড। সাত সমুদ্র পেরিয়ে অথবা আকাশ পরিবহনে করে এসে এ দেশের সম্পদ আহরণ আর মানুষের শাসন কতো দিন বা ভূখণ্ডের প্রকৃত মালিকরা মেনে নিতে পারে। হাসনাত নিজেও এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছে আজ অনেক বছর। তাইতো প্রিয় ভালোলাগার বা ভালোবাসার মুহূর্ত অনুভব করতে পারে না বায়ান্নর আন্দোলন শুরু হবার পর থেকে। সব কিছু গুছিয়ে আস্তে আস্তে রওনা হয় গ্রামের দিকে। অনেক পথ বাঁকি এখনো । পৌঁছাতে প্রায় দুদিন লেগে যাবে। নদী থেকে পর্যাপ্ত পানি নিয়ে নিলো বোতলে। ব্যাগ থেকে কিছু বিস্কিট খেয়ে রওনা হলো গন্তব্যের দিকে। চারিদিকে কেমন গুমোট হাওয়া। লোকজনে মুখটিপে কথা বলছে। যেন কেউ শুনে ফেললে বিপদ, কখন যেন মিলিটারি তার উপর ঝাঁপিয়ে পরে। অবশেষে বাড়ি পৌঁছে যেতে দুদিন সময় পেরিয়ে যায়। এরি মধ্যে জানতে পারে স্বাধীনতার ডাক দেয়া হয়েছে। এই ভূখণ্ডের দামাল ছেলেরা এমন কি নারী, শিশু বৃদ্ধ যে যেখান থেকে পারছে যুদ্ধে যোগ দিচ্ছে। উদ্বাস্তু হাজার হাজার মানুষ পাশের দেশে সীমান্তে পেরিয়ে যেতে শুরু করেছে। হাসনাত নিজেও একজন কলম যোদ্ধা। কলম হাতে অনেক যুদ্ধ করেছে। শুনতে পাওয়া যায় এ দেশের কিছু মানুষও ওদের সাথে যোগ দিয়েছে হয় ভয়ে নিজেদের রক্ষার জন্য, অথবা নিজেদের আখের গোছানোর কাজ করতে তাদের পোষা প্রাণীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে যখন তখন নিজেদের অস্তিত্বের উপর। কিন্তু এতটাই উদাস আর ভাবলেশহিন হয়ে কি যুদ্ধ করা যায়।ওর দ্বারা হয়তো যুদ্ধ হবে না। গ্রামের আশপাশে পাকিস্তানি মিলিটারির ক্যাম্প হয়েছে। এলাকার যুবকেরা তাদের প্রতিহত করতে গেরিলা ট্রেনিং নিচ্ছে। হাসনাত নিজেও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে থেকেছে, ওর রেডিওটা নানা খবর সংগ্রহ করতে কাজে লেগেছে, কিন্তু ওকে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের সাথে নিতে রাজি নয়। কারণ কবি ও আনমনা মানুষ না জানি কি ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলে। কয়েক মাস কেটে যায়। রেডিও চালু করলেই শুধু বারুদের গন্ধে ভরা মৃত্যুর লেলিহান শিখার মতো আর্তনাদ হয়ে কানে বাজে। অবশেষে হাসনাত সিদ্ধান্ত নেই যুদ্ধে যাবে। তবে তার আগে একটা কবিতা লিখবে প্রেমের, স্বপ্নের আনন্দের আর এই হিংস্রতার থেকে বাহিরে কোন সুন্দর জীবনের কবিতা। যুদ্ধে যদি প্রাণ যায়, তার আগে লিখতে হবে কবিতাটি। রাত বিরাতে কলম যোদ্ধার মতো বেরিয়ে পরে নদীর ঘাটে চাঁদনি রাতে যদি কোন সুন্দর মুহূর্তকে আঁকতে পারে কবিতার ফ্রেমে। কিন্তু না সেখানেও ভেসে আসা লাশের গন্ধ, ফুলে ওঠা কয়েক দিনের মৃত লাশের শেয়াল টেনে নেবার দৃশ্য। দিনে তো এখন বাহিরে মুক্ত হয়ে হাঁটতে গেলে কোন জীবনের নিশ্চয়তা নেই। পালিয়ে আর কতদিন, সিদ্ধান্তে নেই ঢাকায় ফিরে নিজের কলম যোদ্ধাদের সাথে যোগ দেবে। সেই আগের সাজ পোষাকে আবার কোন রাতে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পরে ঢাকার উদ্দেশ্যে। এই জন্ম মাটিতে নিজের লাশটাও ফিরবে কিনা সে জানে না । যেতে পথে নানা বাঁধা পেরিয়ে অবশেষে কোন এক ভোরে যখন ঢাকার রাস্তায় এসে পৌঁছে দূর থেকে ভেসে আসে শ্লোগান, আমরা স্বাধীন, বাংলাদেশ স্বাধীন। চারিদিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ রা¯—ায় বেরিয়ে আসছে বিজয় উল্লাসে। রেডিওতে বেজে যাচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের শ্লোগান। পাকিস্তানিরা হার মেনে নিয়েছে। হঠাৎ পেছন থেকে একটা হাত ওর হাতটাকে চেপে ধরে। মেয়েটির হাতের কব্জিতে তখনো রশির বাঁধনের দাগ, গায়ের কাপড়ের কোথাও কোথাও ছেড়া, মুখের আশপাশে স্পষ্ট কিছু কামড়ের দাগ। চোখ ভর্তি লোনা পানির ফোয়ারা নিয়ে হাসনাতের হাতটাকে উপড়ে তুলে ধরতে ধরতে বলে ওঠে :
আমরা স্বাধীন, আমরা স্বাধীন। ওরা আর আমাকে নির্যাতন করবে না। আর না, আমরা স্বাধীন। মুক্তিযোদ্ধারা সম্পূর্ণ ক্যাম্প সহ দখল করে নিয়েছে। আজ কতদিন, আজ কতদিন পর চার দেয়ালের বাইরে, মুক্ত বাতাসে। ওরা কি আমাকে আর নির্যাতন করবে।
কি হয়ে ছিলো তোমার, কেনো ধরে নিয়ে গিয়েছিলো।
আমার কোন দোষ ছিলোনা। আমার ভাই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলো। ভাইকে খুঁজতে গিয়ে আমাকে ধরে এনে ছিলো। তারপর থেকে কি আর বর্ণনা করবো। দেখতেই তো পাচ্ছেন।
ত্রিশ উর্ধ্বো বয়সী মেয়েটিকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে হাসনাত। সেই সে দিনটির কথা মনে পরে যায়। যেদিন প্রথম পারুলকে প্রেম স্পর্শে টেনে নিয়েছিলো। কবিতা আর বাঁধ মানে না। হাসনাতের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে :
মুক্তির প্রথম স্পর্শে তোমাকে পাওয়া
যে কবিতার জন্য অপেক্ষা করেছি বায়ান্ন থেকে একাত্তুর
আজ তারে কেমনে কোন মহানের ইশারাতে পেয়ে গেছি
তোমার মুক্তির প্রতি বিন্দুতে আমি আছি, আমি থাকবো
অত্যাচারের প্রতিটি ক্ষতো আমি মুছে দেবো বিজয়ের প্রেম স্পর্শে
তোমাদের ত্যাগের মহিমা, আর প্রাণদান কারি শহিদদের আত্তা
অমলিন এক দিগন্তে হয়ে থাকবে বাংলার বুকে
যে দিগন্তেপৌঁছাতে যুগ যুগ ধরে হেঁটে যাবে এই দেশের মানুষ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মাহমুদ হাসান পারভেজ মুক্তির চেতনা বুকে আমরাও হেঁটে যাই। চমৎকার গল্প। শুভকামনা।
ruma hamid বাহ ! খুব সুন্দর একটি গল্প পড়লাম । অনেক ধন্যবাদ !
রবিন রহমান আপনাদের মূল্যবান মন্তব্য ও ভোটের জন্য ধন্যবাদ, অন্যদের কেউ পড়ার জন্য আমন্ত্রণ.............
রাজু খুব সুন্দর । ভালো লাগলো । শুভেচ্ছা জানবেন ।
রিক্তা রিচি চমত্কার . শুভেচ্ছা নিন . পাতায় আমন্ত্রণ.
রুহুল আমীন রাজু ANEK VALO LAGLO GOLPOTI.....(AMAR PATAI AMONTRON ROILO )
আখতারুজ্জামান সোহাগ কবির বিজয় হলো। ভালো লেগেছে গল্প। গল্পকারের জন্য শুভকামনা।
তারেক খান গল্পটি অসাধারণ, কবি শেষে বিজয়ের মধ্যে দিয়ে তার প্রেমের কবিতা খুজে পায়।...............
রেনেসাঁ সাহা বেশ সুন্দর। ভাল লাগল।
Sima Das ভাল লিখেছেন।আমার কবিতা" বিজয়ের জয়গান"পড়ার আমন্ত্রন রইল।

১৩ আগষ্ট - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ১৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪