দুই জন যুবক স্ট্রেচারটি একরকম হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে অপারেশন রুমে ঢুকে পড়লো । এক্সিডেন্ট ভিকটিম । নয়-দশ বছরের একটা ছেলে । অজ্ঞান , রক্তাক্ত । মাথায় বড় আঘাতের চিহ্ন । উদ্ধার কর্মীরা পোশাক খুলে সাদা চাঁদরে ঢেকে দিয়েছে । পুরো শরীর-নাক-মুখ রক্তে একাকার । নাড়ীর স্পন্দন সুক্ষ , তীরে আছড়ে পড়তে ব্যর্থ মৃতপ্রায় নদীর ছোট ছোট ঢেউয়ের মত । যারা দয়া করে তুলে এনেছেন তারা এর কেউ নন। নাম পরিচয় জানা খুব জরুরী । তবে আমার জন্য আরও জরুরী এক্ষুনি অপারেশন শুরু করা । নার্সকে নামহীন হিসাবে রেকর্ড করে অপারেশন টেবিলে তুলতে বললাম । আজ ডাঃ কামরুলের ছুটি । আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট ও । না থাকায় ভালই হয়েছে । কাজে খারাপ না কিন্তু খুবই নার্ভাস । সাবের সাহেব আজ এনেস্থেটিস্ট । রেডিই আছেন । লাইটগুলো জ্বলে ওঠার আগেই সাবের বাচ্চাটির ক্ষীন চেতনাবোধকে কৃত্রিম নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নিয়েছেন । কাজ একটু একটু করে এগিয়ে চলেছে । এক জন নার্স পেছন থেকে রক্তের ক্রস ম্যাচিং রিপোর্ট পড়ে শোনালো , ও নেগেটিভ ! সেরেছে । আমার জানা মতে ডোনার লিস্টে গত ছয় মাসে ও নেগেটিভ ব্লাড আসেনি । অবশ্য আমি নিজেই ও নেগেটিভ । কাজ থেকে মুখ না তুলে অর্ডার করলাম , ‘ ইমিডিয়েটলি দুই ব্যাগ ব্লাড কালেক্ট কর । সাবের ! পালস, প্রেশার আর অক্সিজেন ছ্যাচুরাশন দেখে নেক্সট স্টেপ বল’। কোথাও কাঁদছে কেউ । ও টি’র বাইরে । মনে হচ্ছে চেনা জানা কেউ , বোবা কান্না । সুলতানা নিশ্চয় এত দিন পর ছেলেকে পেয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে । খোকা বোধহয় এতক্ষনে গোসল সেরে মায়ের হাতে খাচ্ছে । ছেলে ফিরেছে , আমাকে একটা কল দিয়ে জানালেও পারতো লতা । লতা ওর আদরে ডাকা নাম । ছোট্ট একটুকরো অভিমানের বাষ্প তৈরি হোল আমার মনের কোনে । মা আর ছেলের প্রতীক্ষিত মিলনের আবেগ ঘন মুহূর্ত । অস্ফুটে বললাম , ব্যস্ত বাবাকে ক্ষমা করে দিস , খোকা ! হঠাৎ একি ! গাউনের ফিতে বাঁধতে বাঁধতে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকছে ডাঃ কামরুল । কামরুলকে কে ডাকল ভাবতেই হোঁচট খেলাম । কানে কানে ও কি যেন বলছে সাবেরকে । ‘নীরব’ শব্দটি শুনেছি শুধু , ও তো আমার খোকার নাম ! মুহূর্তে আমার মাথায় ভেঙ্গে পড়লো প্রকাণ্ড আকাশটা । বোঁ বোঁ করে ঘুরে উঠলো মাথা । হিসাবের পেছনে একটি হিসাব আমি নিমিষেই মিলিয়ে ফেলি । পৃথিবীর করুনতম আর্তনাদ ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে এই মাত্র । আকাশ ছোঁয়া এক সুনামি খড় কুটার মত ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে । আমি জেনে গেছি নামহীন এই বালকের বাবা কে ! পিছন থেকে কামরুল আমাকে জড়িয়ে ধরে পাশাপাশি রাখা দ্বিতীয় অপারেশন টেবিলটিতে শুইয়ে দিতে দিতে বলল , ‘হ্যা স্যার , আপনার জানা খুব জরুরী । শীতের ছুটিতে সব ক্যাডেটদের বাড়ী পৌঁছে দিচ্ছিল ওরা । দুই মাইল দূরে বাসটি এক্সিডেন্ট করেছে । আরও চারটা ক্যাজুয়ালি টি আসছে । সবই আমি সামলে নেব স্যার । একটুও ভাববেন না । যা কিছু আমার আছে আজ আমি সবটা কাজে লাগাবো স্যার । আপনি প্লীজ শান্ত থাকেন , ঘাবড়াবেন না । ও নেগেটিভ রক্তের যে একজন ডোনার ও পাওয়া যায়নি !’ ঘূর্ণাবর্তে উড়তে থাকা পাখির একটা পালকের মত দিগ্বিদিক জ্ঞানহীন হয়ে গেছি আমি । কামরুলের কণ্ঠে দৃঢ়তা শুনতে পাচ্ছি । সে যে একটা ছোট্ট নৌকার মাঝি , সাগরের বিশাল ঢেউয়ে আশা নিরাশায় দুলছে সে নাও। ছইয়ের ভেতর শুয়ে আছে আমার খোকা । কামরুল কি পারবে মৃত্যুর তেপান্তর থেকে আমার সন্তানের নিভু নিভু জ্বলতে থাকা জীবন প্রদীপটিকে বাঁচিয়ে আনতে প্রানের সৈকতে ! ব্লাড ট্রান্সফিউশনের আয়োজন এখানেই নিয়ে এসেছে টেকনিশিয়ান । শুয়ে শুয়ে দেখছি আমি , পাশের অপারেশন টেবিলে নীরবকে সামনে রেখে কামরুলের হাত চঞ্চল হয়ে উঠেছে , অলৌকিক এক দ্যুতি খেলছে তাঁর চোখে মুখে । টেকনিশিয়ান শুন্য ব্যাগটি রাখল আমার পাশে । মোটা একটা সুই আমার শরীর থেকে টেনে নিতে শুরু করেছে জীবনের স্রোত । পৃথিবীর সবটুকু প্রত্যাশা নিয়ে আমি রক্তের থলেটার দিকে তাকিয়ে থাকি । এক বাবা তার ছেলের জন্য আর কি বা দিতে পারে !
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Azaha Sultan
গল্পটি অসাধারণ লেগেছে......একজন পিতার সামনে যখন এমন একটি সন্তান উপস্থিত করা হয় তখন সে পিতা হোক বড় চিকিৎসক অথবা সাধারণ...এমুহূর্তটা দুয়ের জন্য সমান--তার মধ্যে থাকে না তখন হুঁশজ্ঞান.......চিকিৎসক হয়ে যে সে সন্তারের জন্যে অনেক কিছু করতে পারবে.....অন্তত এমুহূর্তটা আমার কাছে এমন মনে হয় না......বেশ সুন্দর উপস্থাপন.....শুভকামনা.....
সেলিনা ইসলাম
সন্তানের বাঁচা-মরা সঙ্কট্কালে একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার বাবাও যে সাধারণ বাবা'র মতই কতটা অসহায় বোধ করেন গল্পে তা সুন্দরভাবে দক্ষহাতে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন...! চমৎকার পটভুমিতে সুন্দর উপস্থাপনায় ভাললাগা একটি গল্পের জন্য শুভকামনা রইল
প্রজ্ঞা মৌসুমী
"না থাকায় ভালই হয়েছে। কাজে খারাপ না কিন্তু খুবই নার্ভাস" সেই কামরুলকে শেষে এসে অসম্ভব ভালো লেগে গেলো। একটা পরিস্থিতি মানুষকে কিভাবে বদলে দিতে পারে... situation will verify who i am... নয়তো চিকিৎসক পিতা আরো কিছু দিতে পারতো সন্তানকে। 'একটা মোটা সুই'- এই ভাবনাটা যেন একজন সার্জেন/ চিকিৎসকের পক্ষে মানালো না। আমার মতো লোক ভাবতে পারে। অভিজ্ঞ সার্জন হয়তো ভাববে আরেকটু ডিটেইলসে/ অন্যভাবে- যেমন () ইঞ্চি পরিমাণ একটা সুই। সে যাক, গল্প পড়ে আমার অসাধারণ লেগেছে। গল্প-কবিতায় এটা আপনার প্রথম গল্প। অনেক শুভকামনা থাকলো আজ এবং আগামীর জন্যে
অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য । আশায় ছিলাম , এক সময় হয়তো আমার লেখাটিও আপনি পড়ে দেখবেন , মন্তব্য করবেন । ভাল লাগা তো পাঠকের সম্মান । আমি ছেয়েছিলাম আপনি বিশ্লেষণ করে , সমালচনা করে আমাকে ভুল ধরিয়ে দিবেন । জীবনে এই প্রথম গল্প লিখলাম , তাই বোদ্ধা পাঠক আর বিদগ্ধ লেখকের মন্তব্য খুজি ।
রক্ত দেয়ার সুই আর সাধারন ইঞ্জেকশানের সুই এক নয় । প্রথমটা অনেক মোটা । আমি differentiate করতে চেয়েছি । তবে আপনার সাজেশন টা ধরতে পেরেছি , ভবিষ্যতে কাজে লাগাবো ।
আন্তরিক ধন্যবাদ , কৃতজ্ঞতা আর শুভ কামনা ।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।