( ১ )
স্লিপ অব দ্যা টাং । ‘মা’ উপন্যাসের লেখকের নাম বলেছিলাম ম্যাক্সিমাম গোর্কি । বোর্ডের মেম্বাররা খোঁচাখুঁচি করতে পারতেন । না , তেমনটি হোল না । সবচেয়ে বড় কথা , কঠিন কোন প্রশ্নই আমাকে জিজ্ঞেস করা হোল না । নিজেকে অবাক করে ওত বড় চাকুরীটা পেয়ে গেলাম । এন জি ওটির অফিস বিল্ডিঙয়ের নীচতলায় ফলাফল ঝুলানো হয়েছে । ডিসট্রিক্ট ম্যানেজারের একটি মাত্র পোস্ট । সেখানে আমার নামটি জ্বলজ্বল করছে । নীচে ওয়েটিং লিস্টে আছে তিন জন । প্রথমেই হাবিব , আমার অনেক দিনের বন্ধু ।
আমি আহামরি গোছের ছাত্র ছিলাম না । সবখানেই অতি সাধারণ একটা সেকেন্ড ক্লাস । হাবিব আমার তুলনায় অনেক এগিয়ে । সবকিছুতে ফাস্ট ক্লাস তো আছেই এম , এস , সি , তে একেবারে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট । এক বছর আগে হলে আমাদের ডিপার্টমেন্টেই লেকচারার হিসেবে যোগ দিতে পারতো । দুর্ভাগ্য , ভ্যাকেন্সী শেষ হয়ে গেছে । আজই প্রথম আমার মনে হোল বিধাতা নামে এক সাধুজন ভাগ্য বলে কিছু একটা দিয়ে সব ঘটনাকে অদৃশ্য হাতে সাজিয়ে ফেলেন । আকাশের নীলে তাকিয়ে তাঁর আরসের দিকে চোখদুটো নত করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুললাম না ।
এ মুহূর্তে খবরটা কাউকে বলার জন্য আমার আর তর সইছে না । দ্রুত পায়ে লজিং বাড়ী ফিরে চলেছি । পদ্মার দীর্ঘ বাঁধের উপর জোড়ায় জোড়ায় কপোত কপোতী , স্বপ্নের জাল ছড়াচ্ছে । একবার মুনিয়াকে আড়ালে পেয়ে বলেছিলাম , ‘কথা আছে , কলেজ শেষে কাল পদ্মার পাড়ে আসতে পারবে’ ? চোখ কপালে তুলে ও আমাকে শাসন করেছিল , ‘কি এমন বলবেন স্যার , যে পদ্মার পাড়ে যেতে হবে ? যা বলার সবার সামনে বলতে হয়’ । কিছু কিছু সুর আছে যার ব্যাঞ্জনা শুধু নিভৃতেই বাজে , কিছু কিছু কথা আছে যা আকাশের নীল মোড়কে ঢেকে নদীর রূপালী ফিতেয় বেঁধে উপহার দিতে হয় । মুনিয়াকে সেদিন এসব বলার সাহস হয়নি ।
চর জুড়ে একদল কিশোর ঘুড়ি ওড়াচ্ছে । তাদের পেছনে পেছনে ঘুরছে আরো ডজন খানেক শিশু-কিশোর । কৈশোরের বিকেলগুলো কেটে গেছে টিউশনির ব্যস্ততায় । জীবনে কখনো ঘুড়ি ওড়ানোর সুযোগ হয়ে ওঠেনি । আজ ইচ্ছে হচ্ছে একসাথে একশো ঘুড়ি ভাসিয়ে দেই নীলাকাশে । নভোলোক জুড়ে বর্ণময় ঘুড়িগুলো আল্পনার মত ছড়িয়ে পড়লে নগরীর যুবতীরা চোখে বিস্ময় এঁকে প্রশ্ন করবে , কে এমন আটপৌরে আকাশটাকে রাঙিয়ে দিল আজ ! মুনিয়ার ঠোঁটে সলাজ হাসিরা খেলতে থাকবে । হাসতে হাসতে সে আমার বুকে লুকিয়ে যাবে ............।
দিবাস্বপ্নে ছেদ পড়লো কয়েক হাত দূরে হাবিবকে দেখে । মাথার চুল উস্ক খুস্ক । দুচোখে কেমন যেন ঘোর লাগা অস্বাভাবিকতা । বিস্ময় আর অবিশ্বাসে মাখামাখি সারা মুখাবয়ব । ‘তোর পরীক্ষা কি খুব ভাল হয়েছিল ?’ হিসহিস করে জিজ্ঞেস করলো হাবিব । এরপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই হঠাৎ ভেঙ্গে পড়লো , ‘জানিস , মাকে কি ভাবে খবরটা দেব ভাবছি । সেদিন ইন্টারভিউয়ের পর থেকে বার বার জানতে চাচ্ছিল রেজাল্ট কবে বেরোবে । মায়ের হার্টের অবস্থা ভাল যাচ্ছে না , সবই তো জানিস । গত মাসে দুইবার হাসপাতালে ভর্তি করতে হল । পরের বার ডাক্তারতো এক রকম আশাই ছেড়ে দিয়েছিল । এখন কি হবে জানিনা’ ।
হাবিবের মা বেশ অসুস্থ । এ বছর একাধিকবার ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে । প্রতিবারই ছুটে গিয়েছি , তার পা দুটো ছুঁয়ে স্নেহাশিস কুড়াতে । আজীবন দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে ভদ্র মহিলা একমাত্র সন্তানকে বড় করেছেন । মৃত্যুর আগে বৃদ্ধার প্রত্যাশা , ছেলেটি পায়ের নীচে মাটি পেয়েছে , দেখে যাওয়া । হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল । আমি যদি চাকুরীতে না যাই তবে ওরা নিশ্চয় হাবিবকেই ডেকে নেবে । পরক্ষনে চেতনা ফিরে এলো । সে কি করে সম্ভব ! আমি যেন নিজেকে বলছি আমার পৃথিবীর সবটুকু আলো দিয়ে অন্যের নিভে যাওয়া প্রদীপটি জ্বালিয়ে দিতে ! মনের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখছিল কিনা জানিনা , ঠিক তখনি হাবিব হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো , ‘নাদের , তুই আমার মাকে বাঁচা’ ।
হাবিবের মাকে বাঁচাতে পারিনি আমরা কেউ । জন্ম মৃত্যু যাঁর হাতে তিনি তাকে একমাসের বেশী সময় দিলেন না । তবে এ ক্ষুদ্র পরিসরে প্রত্যয়ী মায়ের সব কটি আশা মিটিয়ে দিলেন তিনি অক্ষরে অক্ষরে । নির্দিষ্ট সময় পার হতেই আমার বদলে ডাক এলো হাবিবের । আর মহাশুন্য থেকে ছুটে এসে এক সমুদ্র শুন্যতা সহসা আমার বুকের দুকূল ছাপিয়ে দিল । কেউ জানল না কি ভাবে আমি নিজের হৃদপিণ্ডটা উপড়ে এক মায়ের পায়ের বেদিমূলে তুলে দিলাম । শুধু অসহ্য ব্যথায় সে রাতে আমি কেঁপে কেঁপে উঠলাম ।
যার কোন আপনজন নেই , তার জীবন অনেকটা টোপা পানার মত । মন চাইলেই ভর দুপুরে দুর্নিবার স্রোতে নেমে পড়া যায় । সপ্তাহান্তের বিকেলে হাবিবের মা যখন মুনিয়ার জন্য নিজের ছেলের প্রস্তাব নিয়ে এলেন তখন আমাকে দুরন্ত স্রোত ডাকছে । লোকালয়ে সানাই বাজছে । সুরে সুরে দুটো না গাওয়া পংতি অবিনশ্বর একটি গজল হয়ে উঠেছে । আমি ততক্ষণে অথৈ জলে ভাসতে শুরু করেছি । এ ঘাট থেকে সে ঘাট । মাছুয়াদের দ্বীপ থেকে ব্যস্ত বন্দর । ভাসতে ভাসতে পদ্মার পার থেকে চলে গেলাম অনেক দূরে । নীল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে নতুন নগরে , ভিন্ন একটি দেশে ।
( ২ )
পড়তে পড়তে ‘ছিঁচকাঁদুনে উপন্যাস’ গালি দিয়ে যে পাঠক এখনো উঠে যান নি , তাকে অভিনন্দন । কথা দিচ্ছি গল্পের এই বাঁকে আপনার মন ভারী করার মত হীন কাজ আর করবো না । আমি এখন দাম্মাম শহরে । একটি স্টোর হাউজের সুপারভাইজার । হাতে অফুরন্ত সময় । সে কারনে হোক অথবা একজন পটেনশিয়াল ব্যাচেলর হবার সুবাদেই হোক , বন্ধু বান্ধবের সংখ্যা অগণিত । এসব সত্বেও সময় পেলে সাগরের পাড়ে এসে পূর্বমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি । বাংলাদেশের হাওয়া ভেসে আসে । তাতে মিশে থাকে মুনিয়ার তপ্ত শ্বাস । বড় ভাল লাগে । সেদিনও এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম । দূরের ঢেউগুলো এলো-কুন্তল বালিকার মত নাচতে নাচতে পায়ের কাছে এসে লুটিয়ে পড়ছিল । হঠাৎ পায়ে ঠেকল শক্ত কিছু ।
বোতলের ভেতর চিঠি পাঠানো হয় জানতাম , তবে শুধু গল্পেই । সেই বোতলগুলো দুর্বোধ্য একটি উপায়ে ঠিকঠাক এসে পৌঁছে যায় নির্ভুল ঠিকানায় । এসব নিয়ে মনে মনে হেসেছি অনেকবার । হয়তো সারা জীবনই হাসতাম , যদি না নিজেও সমুদ্রজলে ভাসমান বোতল কুড়িয়ে না পেতাম । একটা নয় , এই সাত বছরের দেশান্তরী জীবনে এটি নিয়ে আমি পেয়েছি তিন তিনটি বোতল । আগের দুটো সাজিয়ে রেখেছি বসার ঘরে । প্রথমটায় ছিল একশ ডলার , সাথে ছোট্ট চিরকুট । ফরাসী ভাষায় লেখা সে ছোট্ট চিঠিতে অনুরোধ , সাথের ঠিকানায় টাকাটা পাঠিয়ে দেবার । দ্বিতীয় বোতলটির ভেতরে ছিল খানিকটা লোনা জল । হতে পারে সমুদ্রের জল ঢুকেছিল কোন নাবিকের ফেলে দেয়া শুন্য বোতলে । হতে পারে , কোন অভিমানী প্রেমিকার অশ্রু । আজকের বোতলটিতে একটি বাংলা কবিতার প্রথম চার লাইন ।
“ পারু – তোমার বাড়ী নন্দপুর আর আমার বরের ছন্দপুর
কিসের লাগি ঘণ্টি বাজাও , একলা ঘরে ভর দুপুর
দেবু – ঘণ্টি বাজে ফোনটি বাজে কোনটি বা আজ শোন
মনটি ফেরত পাবার পারু উপায় আছে কোন ?”
সাথে আছে একটা মোবাইল নাম্বার , যার মাঝের দুটো ডিজিট ভিজে ঝাপসা হয়ে গেছে । প্রথমে মনে হোল এ আর এমন শক্ত কি ! আমি শুন্যস্থানে বিভিন্ন কম্বিনেশন নাম্বার বসিয়ে লং ডিসট্যান্স কল করতে শুরু করলাম । প্রচণ্ড ভাবে ব্যর্থ হলাম । বেশীর ভাগই ডেড নাম্বার । যে দুচারটিতে গ্রাহক মিলল তারা লম্বা সময় নিয়ে কথার ফাঁদে আমাকে পাগল কিনা যাচাই করে নিল । দুটো দিন নাওয়া খাওয়া ফেলে আমি নম্বরটার পিছে পড়ে রইলাম । কোন ফলাফল পেলাম না ।
ভাবছেন এসব কেন করছি ? একটা গুরুত্ব তো আছে বটে । কারন কবিতাটি সয়ং আমার লেখা । অপ্রকাশিত । ছাত্রজীবনে , তবে ঠিক কবে , কোথায় লিখেছিলাম , মনে নেই । মূল পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেছি । তবে কথাগুলো আজো মনে গেঁথে আছে । কবিতাটি প্রেরকের গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে নিয়ে দৈবক্রমে হাজির হয়েছে কবির ঠিকানায় । পাকিজা ছবির শাহাবুদ্দীনের কথা মনে পড়লো । পাণ্ডুলিপির টুকরোটি যেন জমিদার নন্দন শাহাবকে লেখা প্রেয়সী নার্গিসের সেই চিঠিটি , সতেরো বছর পরে যেটি এক সহৃদয় ক্রেতা পুরনো বইয়ের দোকান ঘেঁটে উদ্ধার করেছিল , আর পোস্ট করে দিয়েছিল শাহাবের ঠিকানায় । ঘটনার আকস্মিকতায় মনের ঈশান কোনে মেঘ জড় হয়েছে । নিশ্চয় আমি চলে আসার পর মুনিয়া আমাকে বুঝতে পেরেছে । মুনিয়া ছাড়া এর প্রেরক আর কে ই-বা হতে পারে ! একের পর এক কম্বিনেশন সাজিয়ে কল করে চলেছি । মেঘের সাথে মেঘের ঘর্ষণে বজ্র ঝলকাচ্ছে । অবিশ্রান্ত বর্ষণে ভিজে যাচ্ছে মনের দশদিগন্ত ।
( ৩ )
রাজশাহী শহর সাত বছরে এগিয়ে গেছে অনেক দূর । ছাদে দাঁড়িয়ে উত্তর , পূর্ব কিংবা পশ্চিম যে দিকে তাকাই একের পর এক শুধু কংক্রিটের ইমারৎ । দক্ষিনে শ্রাবণের পদ্মা । প্রমত্ত তটিনী নিরবধি ছুটে চলেছে বাড়ীটির ভিত ছুঁয়ে । এসেছি একমাস হবে । এরই মধ্যে এ বাড়ীটি কিনে ঠিকানা পাকাপোক্ত করে ফেলেছি । মুনিয়ার মাকে খালাম্মা বলে ডাকতাম । অনেক দিন বাদে আমাকে দেখে তাঁর মুখটি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো । টোপা পানার জীবনে যে একটি শেকড় মাটি ছুঁয়েছিল একটুও বুঝতে পারিনি । হড়বড় করে জমে থাকা অনেক কথা বলে ফেললেন ।
মুনিয়া থাকে পাবনা । একটি স্কুলে শিক্ষিকতা করছে । অবধারিত ভাবে একা । বিয়ের অল্প পরেই হাবিব এক বিদেশিনীর সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে । এক বছরের মাথায় মুনিয়ার কোল জুড়ে এসেছে নীরব । তবে সন্তানের মায়া হাবিবকে ফেরাতে পারেনি । সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে দুজনার মধ্যে । ডিভোর্স হোলনা তবে সেপারেশন ঠেকানো গেল না । আর দুজনার মাঝে দুই মেরুর দুরত্ব রচনা করে ভিন দেশী মেয়েটিও ফিরে গেল নিজ দেশে । এরপর একের পর এক কূটকৌশল খাটিয়ে ছেলেকে ছিনিয়ে নিল হাবিব । ততদিনে পরিবেশ বেশ নোংরা করে ফেলেছে সে । একরকম বাধ্য হয়েই ছেলে নিয়ে চলে যেতে হোল কানাডায় । ইদানিং সম্পর্কটির ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে চায় সে । এই বর্ষায় সন্তানসহ দেশে আসার কথাও জানিয়েছে খালাম্মাকে ।
পাবনা যেয়ে মুনিয়ার সাথে দেখা করে এসেছি । আমাকে পেয়ে মুহূর্তেই ও হয়ে উঠলো আগের সেই উচ্ছল ঝর্ণাটি । এখানে সেখানে বেড়াতে নিয়ে গেল কাজের ফাঁকে । চলতে চলতে শত বার স্মৃতির আড়ালে হারিয়ে গেলাম আমরা । বিয়ে করে সংসারী হই নি কেন জানতে চাইলে আমি হেসে এড়িয়ে গেলাম । প্রশ্নটি ওকে ফিরিয়ে দিতেই শুন্য চোখে চেয়ে রইল । যতবারই হাবিবের প্রসঙ্গ এলো শামুকের মত গুটিয়ে ফেললো নিজেকে । বোতল কিংবা কবিতা নিয়ে প্রশ্ন করে তাকে বিব্রত করার কোন মানেই হয় না । বিদায় দেবার সময় ওর দুচোখে অশ্রু টলমল করে উঠলো । আমার ভেতর এক বৈরাগী যোগাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে । বুঝলাম , সংসার আমাকে টানছে ।
( ৪ )
হাতে সময় নেই । মুনিয়া আজই আসছে পাবনা থেকে । তড়িঘড়ি সকালেই ওদের বাসায় চলে এসেছি । সুযোগ হলে আজই প্রস্তাবটা দিতে চাই । ফেরাবেনা জানি , ফর্মালিটি । এই কদিনে অসংখ্যবার সেল ফোনে কথা হয়েছে । একাকীত্বের বিরান প্রান্তরে দাঁড়িয়ে দুজনেই ঘর সংসার আর আপনজন খুঁজে চলেছি । বেল বাজতেই আমি এগিয়ে গেলাম । আমাকে কিংকর্তব্যবিমুঢ় করে দরোজায় দাঁড়িয়ে আছে হাবিব । তার হাত ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌম্য শিশুটি , নীরব । আমার সৌজন্য হাসির বিনিময়ে হাবিব বাঁকা চোখে একবার আমাকে নিরীক্ষণ করে নিল । সম্পর্কের সুতোটি ক্ষীন হয়েছে , লীন হয়নি । সেটি ধরে অকম্পিত পায়ে ভেতরে এলো হাবিব । নিজ থেকেই চেয়ার টেনে বসলো । আমি খালাম্মাকে ডাকতে ভেতরে গেলাম ।
ঘটনার আকস্মিকতায় হোঁচট খেয়েছি , তবে হাল ছাড়িনি । হাবভাবে আমার উপর নাখোশ ভাবটা ঢেকে রাখছেনা হাবিব । খালাম্মা অস্বস্তি বোধ করছেন । এতক্ষনে মুনিয়া এলো । মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো নীরব । মা ও ছেলের আবেগের বন্যায় আমি ভেসে গেলাম বহুদুর । হাবিবের সাথেও শুভেচ্ছা বিনিময় হোল মুনিয়ার । সীমিত কিন্তু শিষ্ট । আমার দিকে নজর পড়লো সবার শেষে । ন্যাড়া মাথায় বেলতলায় গেছি অনেক আগে , সম্ভাব্য পরিনতি বুঝে নিয়েছি আমি । আমি আর দাঁড়ালাম না । সৌজন্য দেখিয়ে বিদায়কালে হাবিবের সেল ফোন নাম্বারটি চেয়ে নিলাম । আর তখনি খেয়াল করলাম সংখ্যাগুলো খুব চেনা । মুহূর্তে মনে পড়লো অনার্স পড়ার সময়ে , একদুপুরে হাবিবের খাতায় কাব্যচর্চা করেছিলাম । কে কাকে বোতলে পুরে দীর্ঘশ্বাস পাঠিয়েছে বুঝতে এবার বাকী রইল না । কাবাব মে হাড্ডি বলে একটা কথা আছে । নিজের উপর অভিমানে আমার চোখ ফেটে জল নেমে এসেছে ।
ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে নদীটিকে শেষ বারের মত দেখে নিলাম । দুরন্ত স্রোত ঘূর্ণি কেটে ধেয়ে চলেছে । টোপা পানার পক্ষে সে ডাকে নিজেকে ধরে রাখা ভীষণ কঠিন । নীচে এসে স্যুটকেসটি গোছাতে মন দিতেই হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠেলো । সবটুকু বিরক্তি নিয়ে দরোজায় দাঁড়ালাম । কপালে লাল টিপ , দুচোখে দুর্নিবার আকর্ষণ , নীল শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে মুনিয়া । তার হাত ধরে নীরব । বুকের ভেতর কেউ সর্বশক্তিতে হাতুড়ী পেটাচ্ছে । তখনি তার গাড় কণ্ঠ কানে এলো , ‘পদ্মার পাড়ে ডেকেছিলেন কিছু বলতে । আমি কি নীরবকে সঙ্গে নিতে পারি ?’ মুহূর্তে পৃথিবীর সব শব্দ থেমে গেছে । নভোলোক জুড়ে কে যেন উড়িয়ে দিয়েছে শত শত বর্ণিল ঘুড়ি । পুরোটা বাড়িয়ে দেবার আগেই আমার হাতটি মুঠোবন্দী করে নিয়েছে মুনিয়া ।