চুপিচুপি

ভালোবাসা / ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারী ২০১৫)

সুস্মিতা সরকার মৈত্র
  • ১৯

বেল বাজাতেই হুড়মুড় করে ছুটে এসে দরজা খুলে দিল সায়ন্তনী। ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেশ ওজনদার হয়েছিস কিন্তু’; সায়ন্তনীর মেয়ে সুমনাকে আদর করে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে একথা বলতে বলতেই থেমে গেল তনিমা। তনিমাকে হঠাৎ করে থেমে যেতে দেখে সায়ন্তনী অবাক হয়ে গেল। তনিমার ফর্সা মুখটা এতদিন বিদেশ বসবাসের ফলে আরও চকচকে আর ফর্সা হয়েছে। সেই ফর্সা মুখ আচমকাই টকটকে লাল হয়ে উঠল কেন!
‘কি হল রে? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?’
‘না না, ঠিক আছে, একটু জল দিবি?’
সায়ন্তনী ফ্রিজ খুলে জল বের করে কাঁচের গ্লাসে ঢালছিল, সেই ফাঁকেই তনিমা বড় করে শ্বাস নিল। নিজেকে সামলানোর এটাই সবথেকে সহজ উপায়।
‘ঠিক করে বল, শরীর ঠিক আছে তো?’ জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিতে দিতে উদ্বিগ্ন সায়ন্তনী প্রশ্ন করলো।
‘হঠাৎ করে কেমন যেন মাথাটা ঘুরে গেল রে। একটু চোখ বন্ধ করে থাকি, হয়ত ঠিক হয়ে যাবে এক্ষুনি।’ কিছু ভেবে না পেয়ে একথাটা বলতে বলতে চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রাখল তনিমা।
‘সুমনা, মঞ্জিমাকে সোহম দাদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দাও।’ বসার ঘরের কোনায় ভিডিও গেম নিয়ে ব্যস্ত যুবকের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাল সায়ন্তনী। তারপর তনিমাকে নিয়ে শোওয়ার ঘরে এসে জানলার ভারি পরদাগুলো সব টেনে ঘরটা অন্ধকার করে দিল সায়ন্তনী। ‘তার চেয়ে ঘরে একটু শুয়ে থাক না! আমি চা বানাই, দেখ খেয়ে আরাম পাবি।’
মনে মনে সায়ন্তনীকে অনেক ধন্যবাদ দিল তনিমা। এখন একটু আড়াল, একটু অন্ধকার আর একটু নিজস্ব সময় দরকার ছিল ওর। কি যে হল! নিজেকে এই বয়সেও কেন যে কিছুতেই সামলাতে পারছে না! ক্লান্তির নিঃশ্বাস ফেলে ও চোখ বন্ধ করল। সায়ন্তনী দরজাটাও টেনে দিয়ে গিয়েছে। চোখ বন্ধ করতেই সেই দিনগুলো ছবির মত ফুটে উঠছে একটা একটা করে। তনিমা একা হবে কি করে!

বয়স তখন ‘বায়ো কি তেয়ো’ না হলেও বেশি নয়। ক্লাস নাইনের নতুন বন্ধুর দাদাকে দেখে হাত পা ভেঙ্গে তার প্রেমে পড়ল তনিমা। এদিকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া দাদার কি আর সময় আছে স্কুলের পুঁচকে মেয়ে তনিমার দিকে ফিরে তাকানোর? রাতে ঘুম নেই, দিনেও জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে তনিমা। সায়ন্তনদা যদি একটু ফিরে তাকায়। কিন্তু তা আর হচ্ছে কই?
সেই বছর সরস্বতী পুজোতে হলুদ শাড়ি পরা তনিমাকে দেখে সায়ন্তনদারও চোখ আটকে গেল। এ যেন শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতিতে রূপান্তর। আর তারপরেই শুরু হল দুই বাড়িতে, এমন কি সায়ন্তনীকেও লুকিয়ে দুজনের বাইরে দেখা করা। বছর চার এভাবেই কাটল। স্কুলের গণ্ডী ছাড়িয়ে কলেজে গেল তনিমা। আর ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে পুনেতে চাকরি নিয়ে চলে গেল সায়ন্তনদা। তনিমা রয়ে গেল কলকাতায়।
এতগুলো বছর পেড়িয়ে আজও সায়ন্তনদার জন্য বুকের ভেতর এমন একটা আকুলিবিকুলি ঝড় আটকে আছে সায়ন্তনী জানত না। বুঝতে পেরে নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছে তনিমা। সায়ন্তনীর বাড়িতে ঢুকেই ওর চোখে পড়েছে এক বছর কুড়ির যুবক। নিবিষ্ট মনে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। হুবহু সায়ন্তনদার চেহারা। দেখেই সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। প্রথমে তো ভেবেছিল বুঝি সায়ন্তনদাই। সেই এলোমেলো একমাথা কোঁকড়া চুল। সুঠাম চেহারা। থেকে থেকে চশমাটা ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ঠেলে তুলছে। মাথা স্থির হতে বুঝতে পারল তা কি করে হয়! ওরও তো এখন অনেকটা বয়েস হয়েছে। ওটা তাহলে সায়ন্তনদার ছেলেই হবে! সপ্রতিভ মঞ্জিমা আলাপ করতে এগিয়ে গেল।

‘কিরে, কেমন লাগছে এখন?’ ঘরে ঢুকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিল সায়ন্তনী।
‘ঠিক আছি। মঞ্জিমা কি করছে রে?’ চায়ের কাপে ছোট চুমুক দিল তনিমা।
‘ওকে নিয়ে চিন্তা করিস না। সুমনা আর সোহমের সঙ্গে দিব্যি পটে গিয়েছে। দাদা, বউদি সারাদিনের জন্য দক্ষিণেশ্বর গিয়েছে। ফিরতে ফিরতে রাত হবে। আজকালকার ছেলে, মন্দির দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তাই সোহম থেকে গেল। পুনে থেকে দুই সপ্তাহের জন্য এসে দাদা বউদি অনেক জায়গায় যায় তো। সোহম সব জায়গায় যেতে চায় না। এই নিয়ে শোন না, সেদিন কি হল...’ গল্পের ঝুড়ি খুলে বসল সায়ন্তনী।
প্রশ্ন না করেই উত্তর পেয়ে গেল তনিমা। প্রায় চার বছর পর দেশে এসেছে তনিমা। পনেরো বছরের মেয়ে মঞ্জিমা আর বর জয়ন্তও এসেছে। শেষবার তনিমা একাই এসেছিল। যখন বাবা মারা গিয়েছিলেন। ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে দাদা আর তনিমার কাছে বাবাই সব ছিলেন। তাই বাবার মারা যাওয়ার খবর পেয়ে আর কারোর ছুটির জন্য অপেক্ষা না করে একাই চলে এসেছিল তনিমা। দাদা অনেকদিন থেকেই চেন্নাইতে। কলকাতার পাট চুকিয়ে শেষ জীবনটা বাবা ওখানেই দাদা, বউদি আর ছোট্টুর সঙ্গে থেকেছেন। দেশে এলে ওখানেই আসে তনিমা। তবে কয়েকদিনের জন্য হলেও মঞ্জিমাকে নিয়ে কলকাতায় মামার বাড়িতে একবার ঢুঁ মেরে যায়। তখন সায়ন্তনীর সঙ্গেও দেখা হয়ে যায়। ফোনে নিয়মিত কথা হলেও মুখোমুখি বসে দেখা হওয়ার মজাই আলাদা। এবারও তাই এসেছে তনিমা।
সায়ন্তনী কলকল করে অনেক কথা বলে গেলেও তনিমা শুধু ‘হু, হাঁ’ করে চলেছে।
‘তোর ফোনটা দে তো, ওকে একবার ফোন করি, আমারটা রোমিং এ আছে।’ গল্পের মাঝে হঠাৎ খাপছাড়া ভাবেই বলে উঠল তনিমা।
‘ও, বরের জন্য মন খারাপ করছে? নে, কথা বল, আমি রান্নাঘর থেকে আসছি।’ মুচকি হেসে ফোনটা এগিয়ে দিল সায়ন্তনী।
এরপর গল্প আর জমল না। মঞ্জিমা বরং অনেক খুশি। মঞ্জিমার চোখে কি একটু মুগ্ধতা দেখল তনিমা? কে জানে, হবেও বা! ‘আরেকদিন আসার চেষ্টা করবো’, বলে একটু তাড়াতাড়িই বেড়িয়ে পড়ল তনিমা।

রাতে শুতেই মঞ্জিমা ঘুমে কাদা। তনিমার ঘুম আসছে না। অনেকক্ষণ নিজের ফোনটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে আবার মনে পরে যাচ্ছে সেই দিনগুলোর কথা। ফোনের স্ক্রিনে নম্বরটার দিকে এমন করে তাকিয়ে আছে তনিমা, যেন সায়ন্তনদার দিকেই তাকিয়ে আছে। সেই অবশ হয়ে তাকিয়ে থাকা। প্রথম প্রেম, প্রথম হাতধরা, প্রথম চুমু। ঘরের হাল্কা নীল আলোয় নিজের ডান হাতের পাতার লাল তিলটার দিকে তাকিয়ে সে এক অদ্ভুত শিরশিরানি হল ওর। সায়ন্তনদা ওই তিলটাতেই প্রথম চুমু দিয়েছিল। তখন সায়ন্তনদাকে একটু চোখের দেখা দেখার জন্য কি না করত ও। পাগল করা, মাতাল করা সেইদিনগুলো আজ কেমন যেন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে তনিমার। মনে হচ্ছে আবার যদি ফিরে পাওয়া যেত সেই দিনগুলো!
শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিন সায়ন্তনদা জানিয়েছিল বাবা মা মেনে নেবেন না অন্য কাস্টের মেয়ে বিয়ে করলে। আর বাবা মায়ের মতের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না সে। তাই এই সম্পর্ক টেনে নিয়ে যাওয়ার কোন মানে নেই। তবুও সায়ন্তনদার এক বন্ধুর মেসের ঘরে সেদিন দুপুরে কি পাগলামিই না করেছিল ওরা! সম্পর্ক শেষ, সেটা মেনে নিয়েই যেন শেষ বারের মত দুজন দুজনকে পাগলের মত আদর করেছিল। সেই উদ্দাম দিনটার কথা ভেবে আজও সারা শরীর শিউরে উঠল তনিমার। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। সময়ের পলি সব কিছুই পেলব করে দেয়। দিনগুলো তো ও ভুলেই গিয়েছিল। আজ সোহমই কি আবার সেইসব স্মৃতি উসকে দিল নাকি!
ফোনের দিকে তাকিয়ে কতটা সময় যে পেড়িয়ে গেল তনিমা নিজেও জানে না। অনেকক্ষণ পরে মঞ্জিমা পাশ ফিরতেই চমক ভাঙল ওর। হাতটা বাড়িয়ে মঞ্জিমার মাথায় একবার বুলিয়ে দিল তনিমা। তারপর একটা বড় শ্বাস টেনে আঙ্গুলটা ছুঁইয়ে দিল ডিলিট লেখা বাটনে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রুহুল আমীন রাজু বেশ দক্ষ হাতের লেখা ....অনেক ভালো লাগলো .
ভালো লাগেনি ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
অনেক ধন্যবাদ। আপনার মন্তব্যে উৎসাহ পেলাম।
ভালো লাগেনি ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
পবিত্র বিশ্বাস পড়লাম, ভালো লাগলো এবং ভোট দিলাম। শুভ কামনা সাথে আমার কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ রইল।
ভালো লাগেনি ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
ruma hamid lekhar dhoron valO . onek onek shuvkamona .
ভালো লাগেনি ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
অনেক ধন্যবাদ। লেখার ধরণ ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগল।
ভালো লাগেনি ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
Fahmida Bari Bipu অনবদ্য গল্প...চমৎকার লেখুনি। শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইল, সাথে ভোট।
ভালো লাগেনি ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন চমতকার লিখেছেন। খুব ভাল..। শুভেচ্ছা রইল।
ভালো লাগেনি ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
সবুজ আহমেদ কক্স darun @@@@ susmita sarkar moitra @@@@ thanks
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্ দ্রোহের আগুন কভূ নিভে কী দহনে ! মনের আগুন যদি ফুঁসে ওঠে ফাগুনে ? তারপরও পরাজিত আচার’র প্রাচীরে ! কবি লেখকরা ইচ্ছা করলে কী কলমের আঘাতে বাধার প্রাচীর ভাঙতে পারে না ? তবুও ভীষণ ভাল লাগল, ভোট রেখে গেলাম ।
ভালো লাগেনি ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
ভীষণ ভালো লেগেছে জেনে আমারও ভীষণ ভালো লাগল। ঠিকই বলেছেন, লেখক ইচ্ছে করলে বাধার প্রাচীর ভাংতে পারে। সমস্যা হল এই যে লেখক তো নিজেও পরাজিত এই আচারের প্রাচীরে! তবে ডিলিট বাটনে আঙ্গুল দিয়েছে তনিমা, কনফার্ম করে নি এখন...তাই, কে জানে সত্যি ডিলিট করবে কিনা... পাঠকের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে এই বাধার প্রাচীর ভাঙ্গার... আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। :)
ভালো লাগেনি ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
Elish ভালো লাগল। শুভকামনা সাথে ভোট রইল।
ভালো লাগেনি ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
রবিউল ই রুবেন অসম্ভব সুন্দর গল্প। ভালোলাগা স্বরূপ ভোট রইল। আমার কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ রইল।
ভালো লাগেনি ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
ধন্যবাদ, সময় করে পড়েছেন, ভালো লেগেছে, আর সেই ভালো লাগা জানিয়েছেন তার জন্যও ধন্যবাদ। অবশ্যই পড়ব আপনার কবিতা।
ভালো লাগেনি ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

১০ জুলাই - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪