তুলনার বিশ্বাসের জোর বরাবরই মারাত্মক। হোস্টেলে যখন প্রথম আলাপ হয়েছিল ওর স্নিগ্ধ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। পরে শুনেছিলাম তামাম কলেজের ছেলে নাকি ওর দিওয়ানা। শুনেছিলাম ছেলেরা নিজেদের গার্লফ্রেন্ডের পাশে বসেও তুলনাকে ঘুরে ঘুরে দেখতো। তুলনারও দেখতাম সবার সঙ্গেই ভাব। কাউকে বিশেষ পক্ষপাত করতো না। আবার কাউকেই হতাশ করতো না। তাই দেখে কেউ কোনও মন্তব্য করলে শুধু মুচকি মুচকি হাসতো। বলতো ‘আমার হৃদয়টা অনেক বড়, তবে ওদের কারোর সঙ্গে আমার প্রেম হবে না।’ যেমন অগুন্তি মেয়ে বন্ধু, তেমনই অজস্র ছেলে বন্ধু। ওর এত ছেলে বন্ধু থাকার কারনে কলেজে ওর নামই হয়ে গেল কুইন বী! ওর নেশা হবে না, এই আত্মবিশ্বাসের জোরে মদ, গাজা, সিগারেট সব কিছুই খেয়ে দেখে সিদ্ধান্তে এল যে ওগুলো ভালো লাগার মতো কিছু নয়।
আমি মনে হয় সবথেকে বেশি অবাক হয়েছিলাম যেদিন সৌমিদের নতুন ফ্ল্যাটে গৃহপ্রবেশে সত্যনারায়ণ পুজো ছিল। কয়েকজন বন্ধু মিলে গিয়েছিলাম। সবাই প্রণাম করে প্রসাদ খেলাম। তুলনা কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণামও করল না, প্রসাদও খেল না। বলল সিন্নি খেতে ওর নাকি কেমন যেন লাগে। ঠিক সেই সময়ই লাগল সুমিতের সঙ্গে জয়শ্রীর এক ধাক্কা। আর জয়শ্রীর প্রসাদের বাটি সোজা মাটিতে। জয়শ্রী তাড়াতাড়ি মেঝে থেকে সিন্নি প্রসাদটা তুলে খেয়ে মাথায় হাত মুছে নিল। কেউ কিছু বলল না। কিন্তু তুলনা একটু মুচকি হেসে বলল ‘তুই এক কাজ কর জয়শ্রী। তোর সব সার্টিফিকেটগুলো ছিঁড়ে ফেলে দে। সাইন্স নিয়ে পড়াশোনা করছিস আর এইরকম অস্বাস্থ্যকর একটা কুসংস্কার মেনে চলতে তোর লজ্জা করল না?’ এই নিয়ে সেদিন আমাদের বন্ধুদের মধ্যে একটু রাগারাগিই হয়ে গেল। কিন্তু তুলনা ওর বিশ্বাসে অটল ছিল। ওর মতে, ‘ভাগ্য মানুষকে নিজে গড়ে নিতে হয়। প্রণাম, পুজো, প্রসাদ এসবে কি হবে? নিজের উপর বিশ্বাসটাই সবথেকে বড় জিনিস।’ ওর বিশ্বাসের জোর দেখে অনেক সময় আমারই বিশ্বাস টলে যেত। তবে এটাও ঠিক ওর এই তুলনাহীন বিশ্বাসের জোরই ওকে সবার থেকে আলাদা করে রেখেছিল।
কলেজ পাশ করেও তুলনার সঙ্গে যোগাযোগটা আমার থেকেই গিয়েছিল। মাঝে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে আমাদের বিয়ে, চাকরি, বাচ্চা, বাচ্চার বড় হওয়া আর আমাদের বয়স হওয়া সব নিজের গতিতেই ঘটে চলেছে। অফিসের কাজেই এবার তুলনাদের শহরে এসেছি। জানতে পেরেই তুলনা হইচই শুরু করে দিল যে কোম্পানির গেস্টহাউসে না, ওদের বাড়িতেই থাকতে হবে।
কালই এসেছি। দিনে অফিসের কাজ সেরে তুলনার বাড়ি এসে রাতে দারুণ খাওয়া আর অনেকক্ষণ গল্প করে শুতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। সকালে একটু দেরি করে ঘুম ভাঙ্গল। ঘুম ভাঙ্গতেই খুব সুন্দর ধূপ, চন্দন আর ফুলের মিশ্রিত গন্ধ নাকে এল। অনেকটা যেমন মন্দিরে আসে. স্নিগ্ধ, পবিত্র। কৌতূহলী হয়ে পাশের ঘরে গিয়ে দেখি স্নান সেরে লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে তুলনা পুজোয় বসেছে। ছোট্ট শ্বেত পাথরের মন্দিরে কিছু বাঁধানো ছবি। সামনে পুজোর নানান উপকরণ। আর অনেকগুলো ধূপকাঠি জ্বলছে।
‘একি অবস্থা কুইন বী? তুই এত নিষ্ঠা ভরে পুজো করছিস, আমি তো ভাবতেই পারছি না।’ বিস্ময়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলাম আমি।
‘এতে ভাবার কি আছে? দেখতেই তো পাচ্ছিস যে আমি কেমন সব আচার বিচার মেনে পুজো করছি।’
‘কিন্তু তুই তো কোন কিছুই মানতিস না!’
‘কই, এই পুজো করা তো অনেক দিন থেকেই শুরু করেছি। তোকে তো আগেই বলেছিলাম।’
‘তা বলেছিলিস, কিন্তু এত সিরিয়াস তা বুঝিনি। এনারা সব কারা?’
‘ওনারা আমার গুরুদেব, গুরুমা।’
‘তুই দীক্ষা নিয়েছিস?’ আমার বিস্ময় কিছুতেই কাটছে না।
‘হ্যাঁ। আমি তপর গুরুদেবের কাছেই দীক্ষা নিলাম। তাও বছর কয়েক হল।’
‘কিন্তু কেন?’
‘বিশ্বাস, নীনা, বিশ্বাসের জন্য।’
‘মানে?’
‘যে গুরুভক্তির কারনে আজ পর্যন্ত তপ আমাকে একদিনের জন্যও শান্তি দেয় নি, সেই গুরুভক্তিকে সম্বল করেই আমি রোজ ওর জীবনে অশান্তি কামনা করি।’
স্বামীর জীবনে অশান্তি কামনা করা কথাটা কেমন খট করে কানে লাগল। বললাম, ‘ধুস, এসব কি আজেবাজে বলছিস? এভাবে কিছু হয় নাকি?’
‘কে বলল হয় না? দেখছিস না, কেমন তরতর করে তপর পদোন্নতি হয়ে চলেছে। এখন মাস গেলে তপর কত মাইনে জানিস? সাড়ে চার লাখ। সে কি আর এমনি এমনি দেয় রে? যতক্ষণ জেগে থাকে হয় অফিসে থাকে, নাহলে ফোনে অফিসের কাজ করে। ওর জীবনে কোন শান্তি নেই। ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুম আসে না। এমনকি, ঘুমের ঘোরেও অফিসের কথাই বলে। যে গুরুর জন্য আমাকে, আমাদের ছেলেকে কোনদিন তাকিয়ে দেখল না, আজ সেই গুরুর জন্যও তপর সময় নেই। তাহলেই বুঝতে পারছিস, আমার বিশ্বাসের আর প্রার্থনার কত জোর?’
ঠাণ্ডা গলায়, স্মিত হেসে প্রশ্নটা করে কোন উত্তরের আশা না করেই আবার পুজোয় মন দিল তুলনা। আমার বুকের ভিতরটা কেমন যেন সিরসির করে উঠল। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম এই কি সেই তুলনা, যাকে আমি কলেজে চিনতাম? তারপরই মনে হল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুর বদল হলেও একটা জিনিসের কিন্তু বদল হয় নি। সেটা হল ওর বিশ্বাস। একদিন পুজো, প্রণাম, প্রসাদ মানত না। বিশ্বাস করত নিজের ভাগ্য নিজেকেই গড়ে নিতে হয়। আর আজ পুজো, প্রণাম আর প্রসাদ মেনে সেই বিশ্বাসের জোরেই যেন নিজের ভাগ্য গড়ে নিতে চাইছে। যে ওকে কষ্ট দিয়েছে তাকেও কষ্ট দিতে চাইছে।
বুঝতে পারলাম, ধরনটা নিশ্চয়ই পাল্টেছে, কিন্তু তুলনার নিজের বিশ্বাসের প্রতি বিশ্বাসটা আজও তুলনাহীন।
১০ জুলাই - ২০১৪
গল্প/কবিতা:
৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪