১
টিক টিক টিক টিক। এক, দুই, তিন, চার, ঘড়িতে সেকেন্ডের কাঁটা সরে সরে যাচ্ছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে নীপা অপেক্ষা করছে। অপেক্ষার তিরিশ সেকেন্ডও যে এত দীর্ঘ হতে পারে জানা ছিল না ওর। কিন্তু অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায়ও তো নেই ওর। পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের নখ দিয়ে মেঝেতে আঁক কাটতে গিয়েও থেমে গেল ও। না, এখন তো নড়লে চলবে না। মন যতই অস্থির হোক না কেন, হাত স্থির রাখতেই হবে যে! এত জোরে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে যে এবার রক্তই না বেরিয়ে যায়!
আঠাশ, উনত্রিশ, ত্রিশ। যাক, অবশেষে অপেক্ষার সুদীর্ঘ তিরিশ সেকেন্ড শেষ হল। রেজাল্ট দেখেই বুকের মধ্যে যেন একটা বল লাফিয়ে উঠল নীপার। আর তারপরই হঠাৎ করে কেমন খালি হয়ে গেল। উত্তর না জানা প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার সময় এসেছে সেটা বুঝে হাত ঘেমে উঠল। কিন্তু সবার আগে জানা দরকার অ্যাডাম ওর পাশে থাকবে কিনা। গলাটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে। অবশ পায়ে বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে কিচেনের দিকে এগোল নীপা।
জল খেয়ে গলা ভিজিয়ে শোবার ঘরে এসে অ্যাডামের দিকে তাকাল নীপা। অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ওকে কি এখনি ডাকবে? নাকি ওর ওঠার জন্য অপেক্ষা করবে? থাক, ঘুম থেকে উঠুক বরং। সব অস্থিরতা চেপে রেখে আবার কিচেনের দিকে পা বাড়াল ও। দিনের অন্য সময় কফি খেলেও ঘুম থেকে ওঠার পর সকালে এক কাপ লিকার চা’ই ওর পছন্দ। দুকাপ জল মেপে নিতে গিয়ে হাত ফসকে কাপটা মাটিতে পড়ছিল প্রায়। কোনরকমে কাপটা বাঁচিয়ে নিলেও অনেকটা জল মেঝেতে পড়ে গেল। জল ফুটে উঠলে চায়ের পাতা ভিজিয়ে মেঝের জলটা মুছে ফেলল নীপা। তারপর আবার শোবার ঘরে ফিরল। অ্যাডামের কি ঘুম ভেঙ্গেছে? আর কাউকে কিছু বলার আগে ওকেই বলতে চায় খবরটা। যদিও সন্দেহের কথাটা শোনার পর থেকে গত দুদিনের নীরবতা থেকেই বোঝা যায় এই প্রসঙ্গে ওর কি মনোভাব, তবুও ওকে খবরটা না দেওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না নীপা।
২
গত দেড় সপ্তাহ হল সময়টা যেন কেমন করে কেটে যাচ্ছে নীপার। কিছুতেই মন দিতে পারছে না। সন্দেহটা মাথায় আসার পর থেকেই মনটা সবসময় উসখুস করছে। ল্যাবের কাজে মন বসছে না। থেকে থেকেই চমকে উঠে চারিদিকে তাকিয়ে দেখছে। হঠাৎ হঠাৎ হাত ঘেমে যা তা অবস্থা। যদিও বা কাজ করছে, কাজ করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে পরছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ানো ওর এক বদভ্যাস। অস্থিরতার সঙ্গে সঙ্গে সেটাও বেড়ে গিয়েছে। হিসেবেও ছোটখাটো ভুল হচ্ছে। সেদিন তো বসের কাছে বেশ একটু বকুনিই শুনতে হল এই ভুলের জন্য।
কিচ্ছু ভালো লাগছে না ওর, কিচ্ছু না। কারোর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না। বাড়িতে ফোন করতে ইচ্ছে করছে না। এমনকি অ্যাডামের সঙ্গেও সময় কাটাতে ভালো লাগছে না। নানান প্রশ্ন মনের মধ্যে জাল বুনছে। সন্দেহ যদি সত্যি হয় তাহলে কি করে পরিস্থিতি সামলাবে সেটা ভেবে আরও অস্থির লাগছে ওর। কি করবে, কি করবে না? কাকে বলবে, কাকে বলবে না? কে সাহায্য করবে, কে টিটকারি দেবে? নানান প্রশ্ন!
এই মাসে পিরিয়ডের ডেট পেড়িয়ে যাওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছিল নীপার এই অবস্থার। ওর অবশ্য প্রতি মাসেই একই তারিখে শুরু হয় না। দু চার দিন দেরি হয়। তাই প্রথম কদিন আমল দেয় নি। কিন্তু যখন দশ দিন পেড়িয়ে গেল তখন বারেবারে প্রেগন্যান্সির সম্ভাবনাটা ওর মাথায় ঘুরতে শুরু করল। শেষ পর্যন্ত আর থাকতে না পেরে পরশুদিন সন্ধ্যেবেলায় সন্দেহর কথাটা বলেই ফেলল অ্যাডামকে।
‘আমার মনে হচ্ছে আমি প্রেগন্যান্ট’। কথার মারপ্যাঁচে না গিয়ে সোজাসুজি কথাটা বলল নীপা। কথাটা শুনেই চমকে উঠে নীপার দিকে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকল অ্যাডাম। ও যেন বুঝে নিতে চাইছে কথাটা কতোটা সত্যি। ‘কি ব্যাপার, তুমি কি আমাকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করতে চাও নাকি?’, অ্যাডামের গলার স্বরে বিরক্তি ঝরে পরল। তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই নীপার পাশ থেকে উঠে বাইরের ঘরে গিয়ে টিভিটা চালিয়ে দিল।
৩
অথচ এই রকম তো হওয়ার কথা ছিল না। প্রায় গত দুবছর হল অ্যাডাম আর নীপা এক সঙ্গে থাকা শুরু করেছে। লিভ টুগেদার। তার আগে বেশ কয়েকমাস ডেটও করেছে। উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকায় আসা নীপার লম্বা ঘন কালো চুলের প্রেমে পড়েছিল আফ্রিকান আমেরিকান অ্যাডাম। নীপাকে একবারের জন্য ডেটে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেকি ঝুলোঝুলি।
‘নীপা, প্লিজ, সে ইয়েস। একবার। তোমার যদি আমার সঙ্গ ভালো না লাগে তাহলে আমি আর বলব না’।
‘নো, অ্যাডাম, উই আর ডিফারেন্ট। আমার বাড়িতে মেনে নেবে না’।
‘আমরা তো বিয়ে করছি না নীপা। শুধু বাইরে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে যাচ্ছি একসঙ্গে। আর তাছাড়া, বাড়িতে বলার কি দরকার? প্লিজ নীপা, একবার’।
একসময় নীপা ‘হ্যাঁ’ বলল। বলতে ভালো লাগল। এমন করে কেউ বারবার বললে সেটা মেনে নিয়েও যেন এক অন্য আনন্দ! তারপর একসময় নীপা দেখল অ্যাডামের সঙ্গে সময় কাটাতে ওর নিজেরও ভালো লাগছে। না, বাড়িতে অ্যাডামের কথা বলেনি কোনদিনই।
নীপার চকচকে বাদামি চামড়া আর কৃষ্ণ হরিণ চোখের জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল অ্যাডাম। কত ভাবে যে ওর রূপের প্রশংসা করেছে তার ইয়ত্তা নেই।
সেই অ্যাডাম আজ নীপাকে এই কথা বলল! দুঃখ, অভিমান মিলিয়ে কেমন অদ্ভুত লাগছে নীপার। ও যে ঠিক কিরকম প্রতিক্রিয়া আশা করছিল অ্যাডামের থেকে সেটা ও নিজেও জানে না। এমনিতেই আমেরিকান ছেলেরা মেয়েবন্ধুর বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনায় ঠিক কি বলবে সেটা ঠাহর করা মুস্কিল। কেউ হয়ত খুব খুশি হয়ে তক্ষুনি ঠিক করে ফেলল এবার বিয়ে করতেই হবে। তারপর সঙ্গে সঙ্গে দোকানে ছুটল আংটি কেনার জন্য। প্রোপোজ করতে হবে তো! কেউ হয়তো দায়িত্ব এড়ানোর জন্য সম্পর্ক ভেঙে দিল। আবার কেউ কেউ বিয়ের বাঁধনে না গিয়েই বাবা হতে চাইল। কিন্তু নীপার কোনও ধারণাই ছিল না যে অ্যাডাম এই ব্যাপারে কোনও কথাই বলতে চাইবে না। তবে এক্ষুনি বিয়ে করার মতলব যে ওর নেই সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
৪
সারারাতে নীপার অভিমান গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে। পাশ ফিরে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছে। ধীরে ধীরে অভিমানের বদলে এক অসহায়তার বোধ গ্রাস করছিল ওকে। ও যদি সত্যি প্রেগন্যান্ট হয়ে পরে তাহলে অ্যাডাম যে কোনও সহায়তা করবে না সেটা বুঝে আরও অসহায় লাগছিল। আর অস্থির লাগছিল এটা ভেবে যে প্রেগন্যান্ট হলে বাচ্চাটার কি ব্যাবস্থা করবে ও। নষ্ট করে ফেলবে? নাকি একার দায়িত্বে তাকে পৃথিবীতে আনবে? বাড়ির সবাই কি বলবে? ওর নিজের গবেষণার কি হবে? বাচ্চাকে একা কি করে বড় করবে? একরাশ প্রশ্ন মাথার মধ্যে ভিড় করে আসছে। যে প্রশ্নগুলোর কোনও উত্তর ওর জানা নেই।
পরেরদিন সারাটাদিন ওর কিভাবে যে কাটল সেটা ও নিজেও জানে না। অজানা ভবিষ্যৎ, সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, অ্যাডামের বিরক্তি, ভয় সব মিলিয়ে হঠাৎ করেই নীপার জীবনটা তালগোল পাকানো ভয়ঙ্কর জটিল এক সরল অঙ্কের মত হয়ে গিয়েছে। সেদিন ও কারোর সঙ্গে কথা বলল না। ইচ্ছে করেই বস আর ল্যাবের অন্যদের এড়িয়ে এড়িয়ে থাকল। গত কয়েকদিন থেকেই উচাটন লাগলেও গতকাল অ্যাডামের সঙ্গে কথা হওয়ার পর থেকে সেটা আরও বেড়ে গিয়েছে। ও যেন আর কোনকিছুই ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে পারছে না। কেমিক্যাল রাখার ফ্রিজটা ভুল করে খুলে রাখল কিছুক্ষণ। ভাগ্যিস কেউ খেয়াল করে নি! হাতের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে দুটো বিকার ভাঙল। তারপর একটা ছোট্ট হিসেব করতেই ওর সারাটাদিন লেগে গেল। হিসেব করবে কি করে, ঘুরেফিরে সেই প্রশ্নগুলোই তো ওর দিগভ্রান্ত মস্তিস্কে ভিড় করে আসছে যেই প্রশ্নের কোনও উত্তর আপাতত নেই ওর কাছে। অবশেষে ল্যাবের কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজেই নিজের লাগামছাড়া মনকে বোঝাল। সন্দেহটা সত্যি কিনা সেটা তো জানতে হবে! তারপর সন্ধ্যেবেলায় ল্যাব থেকে ফেরার সময় নিজেই গিয়ে প্রেগন্যান্সি পরীক্ষা করার কিট কিনে ঘরে ফিরল। অ্যাডামকে কিছু বলল না। না, অ্যাডামও কিছু জিজ্ঞেস করল না।
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই তড়িঘড়ি বাথরুমে ছুটেছে নীপা। দিনের প্রথম ইউরিন কি খবর দেবে সেটা জানার জন্য মন চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। তারপর অপেক্ষার সেই সুদীর্ঘ তিরিশ সেকেন্ড। কিটের যোগ চিহ্নের দিকে তাকিয়ে প্রথমে কেমন যেন অবাক লাগছিল। ওর সন্দেহই সত্যি। ও তাহলে সত্যিই প্রেগন্যান্ট!
৫
হ্যাঁ, অ্যাডামের ঘুম ভেঙ্গেছে। এবার দুকাপ ধোঁয়া ওঠা চা আর বিস্কুটের কৌটো নিয়ে বসার ঘরের দিকে এগোল নীপা। পূব দিকের মিষ্টি রোদে ঘরটা আলো হয়ে আছে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে অ্যাডামও এসে বসল জানলার পাশে চেয়ারটাতে। পরশু সন্ধ্যার পর থেকেই কি অ্যাডাম কম কথা বলছে? একটু দূরে দূরেও কি থাকছে? ভাবল নীপা। কিন্ত কিছু করার নেই। ওকে যে বলতেই হবে।
এক চুমুক চা খেয়ে শুকিয়ে ওঠা গলাটা আবার ভিজিয়ে নিল নীপা। ‘উই আর প্রেগন্যান্ট অ্যাডাম’, খবরটা দিয়েই দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে অ্যাডামের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকল ও। অ্যাডামের প্রতিক্রিয়াটা দেখা জরুরি। দেখল অ্যাডাম চমকে উঠে ওর চোখের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল। আর তারপরই চোখ সরিয়ে নিল। না, সেই চোখে কোনও উচ্ছ্বাস বা আনন্দ দেখতে পেল না নীপা। বরং এক শূন্যতা। অ্যাডামের না বলা কথাটা বুঝতে অসুবিধা হল না নীপার। দুজনেই চুপ করে বসে আছে। শুধু দেওয়ালের ঘড়িটা টিক টিক আওয়াজ করে চলেছে।
চায়ের কাপ হাতে অ্যাডাম জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করেই যেন ‘কি হবে, কি হবে’, এই অস্থিরতা থিতিয়ে গিয়ে অদ্ভুত এক প্রশান্তির জন্ম হল নীপার মনে। যাক, গত দুদিনের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছে ও। মুহূর্তেই মনস্থির করে ফেলল ও। বাড়িতে কিভাবে জানাবে সেটা পরে ভাবা যাবে। কিছুই সহজ হবে না। তবে, অ্যাডামের কথা আর ভাববে না ও। ওদের সন্তানকে, ওদের ভালবাসার সন্তানকে ও একাই পৃথিবীতে আনবে। জীবনের চলার পথে এখন থেকে অ্যাডাম আর ওর সঙ্গী নয়। সিদ্ধান্তটা নিতে পেরে ওর খুব শান্তি লাগছে।
‘তোমাকে চিন্তা করতে হবে না অ্যাডাম। আমি একাই সামলে নেব’। শান্ত গলায় বলে উঠল ও। অ্যাডাম আরেকবার চমকে উঠে তাকাল। এবার সেই চোখে স্পষ্ট অপরাধবোধ। ‘আমি এখনও ঠিক তৈরি নই নীপা, আমাকে ক্ষমা করে দাও’। আকুতি ভরা গলায় বলে উঠল অ্যাডাম।
‘আমি বুঝতে পারছি। তুমি আর এই নিয়ে ভেব না। বরং আলাদা বাড়ি খুঁজে নিও তুমি’। ঠাণ্ডা হয়ে আসা চায়ের কাপটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো নীপা। আরেকবার গরম করে নিতে হবে।
১০ জুলাই - ২০১৪
গল্প/কবিতা:
৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪