গত কয়েক দিন ধরে শরীরটা ভাল যাচ্ছেনা তারাবানুর। দিন দিন শরীর অনেক খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কোমরের ব্যাথাটা আরও বেড়েছে, বেশিক্ষন এক জায়গায় বসে থাকলে উঠতে তার অনেক কষ্ঠ হয়। কাজ কর্ম খুব একটা করতে পারেন না। সারাদিন সজিবকে দেখাশুনা করেন। মেয়ে কুলসুম মানুষের বাড়ী বাড়ী কাজ করে, যা পায় তা দিয়ে কোন রকম সংসার চলে। সজিব কুলসুমের ছেলে বয়স আনুমানিক পাঁচ/ছয় বছর হবে, গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস ওয়ান-এ পড়ে। 
অসুস্থ শরীর নিয়ে তারাবানু বারান্দায় বসে আছেন। খাইতামনা, খাইতামনা অ্যাঁ অ্যাঁ কান্না করতে করতে সজিব দৌড়ে এসে নানীর কোলে উঠে বসল।  
খাইতানা কেরে, খাইতানা কেরে সজিবের চোখের পানি মুছে দিতে দিতে কথা গুলো বলল তারাবানু।                                                                  
সজিবের পিছনে পিছনে কুলসুম একটা প্লাষ্টিকের বাটিতে কিছু ভাত নিয়ে আসল এবং হাতের বাটিটা তারাবানুর হাতে দিয়ে বলল-দেহত মা সজিবেরে খাওয়াইতে পার নাহি?                                                                                                                                                          
খাও ভাই খাও, ভাতের বাটিটা হাতে নিয়ে বলল তারাবানু।                                                                                                         
Ñদেহনা ভাই আমরা গরিব মানুষ, আমরার অত ট্যাহা পইশা নাই যে বাজার থাইক্যা মাছ গোস্তু আনবাম। তোমারে ইসকুলে দেয়া তোমার মা এহনেই মাইনষের বাড়ীতে কাম করতে যাইব, নেও ভাই নেও , তাড়াতাড়ি খাইয়ালাও । এক মুঠো ভাত সজিবের মুখে দেওয়ার চেষ্টা করল তারাবানু।                                                                                                                                                                          
Ñনা ডাইল দেয়া আমি খাইতামনা, আমারে এন্ডা ভাইজ্যা দেওন লাগব। নানীর হাতটা মুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে কান্না অবস্থায় কথা গুলো বলল সজিব।                                                                                                                                                                                  
   -হ তোমারে এন্ডা ভাইজ্যা দেয়াম ? মুরগের ঠ্যাং দেয়াম, রউম মাছের কাল্লা দেয়াম ? অক্তে অক্তে এইডা খাইতামনা, হেইডা খাইতামনা, তুমিত রাজা জমিদারের পুত ? সব সময় তোমারে হোলাও খোরমা দেওন লাগব ? আমার আর অত জ্বালা সজ্জি অয়না, আমি অহন মরতে পারলেই বাঁচি। নেও মা খাওত, এই পোলার খাওনের দরহার নাই। কষ্টে তার দু চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে, অথচ রাগে রাগে কথা গুলো বলতে বলতে ভাত ভর্তি একটি প্লেট এনে দিল মায়ের হাতে এবং আরেকটি প্লেট নিয়ে কুলসুম নিজেও খেতে বসল।                                                                                                                                                   
কুলসুম আর তারাবানু খাচ্ছে। সজিব একবার নানীর কোলে উঠে আবার কোল থেকে মাটিতে নামে, আর ঘ্যান ঘ্যান করে কান্না করেই যাচ্ছে।                              
অ্যাঁ..... অ্যাঁ..... অ্যাঁ..... খাইতামনা, খাইতামনা, অ্যাঁ..... অ্যাঁ.....                                                                                                                                     
Ñ এই কুলসুম, খাওয়ার ফাঁকে তারাবানু মেয়েকে ডাকল।                                                                                                                                    
Ñ কও মা । মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল কুলসুম।                                                                                                                            
Ñ আইজ কাল আমার শইলড্যা বেশী ভালা যাইতাছেনা, কহন কি অয় জানিনা। তয় তরে একটা কথা কই।                                                             
Ñ কও মা, কিতা কইবা।                                                                                                                                                           
Ñ সজিবেরে তুই ইসকুল- কলেজে পড়ায়া মাইনষের মত মানুষ বানাইবে, তর যত কষ্টই অউক মা তুই আমার ভাইরে মূর্খ রাহিছনা। এইডাই তর কাছে আমার অনরুধ।                                                                                                                                                       
Ñ অ্যাঁ.. মায়ের যে কথা ! মুখে ভেংছি কাটল কুলসুম। এই পোলা মানুষ অইব, পড়া লেহা হিখব ? তাইলে আর মাইনষের বাড়ী কাম করব কেলা ?                                                                                                                                                                                                        
Ñ দেখ কুলসুম; আমারে রাগাইস না কইলাম। ভাই আমার আই এ- বি এ হাশ করব, বড় বড় চাকরী করব, মাসে মাসে মেলা ট্যাহা বেতন হাইব, তহন আর আমরার কোন কষ্টই থাকবনা। তর আর তহন মাইনষের বাড়ীতে কাম করতে অইব না কুলসুম। না ভাই ? বড় অইয়া তুমি মেলা ট্যাহা কামাই করবা, আল্লায় তোমারে বাঁচায়া রাহউক। খাইয়ালাও ভাই খাইয়ালাও, আর কাইন্দনা, রাইতে তোমার মা তোমারে এন্ডা ভাইজ্যা দিবনে। আই কুলসুম রাইতে কিনতুক সজিবেরে একটা এন্ডা ভাইজ্যা দিবে ? অহন ডাইল দিয়া খাইয়ালাও। সজিবের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে কথা গুলো বলে যাচ্ছেন তারাবানু।                                                                                                                                                                           
তারাবানু আর কুলসুম কথা বলতে বলতে তাদের খাওয়া দাওয়া শেষ করিল। রাতে এন্ডা ভেঁজে দেওয়ার কথা শুনে সজিবের কান্না থামাল, কিন্তু ডাল দিয়ে সে আর ভাত খেল না। সজিবকে স্কুলে দিয়ে আসার জন্য তার মা নিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু সজিব স্কুলে যেতে রাজি হল না। ভাত না খাওয়ার কারনে সজিবকে স্কুলে পাঠাতে তারাবানুও মত দিলেন না। কুলসুমকে কাজে চলে যেতে বললেন। কুলসুম কাজে চলে যাওয়ার আগে সজিবকে কোলে নিয়ে একটু আদর করলেন। 
কুলসুম মজিদ মিয়ার বাড়ীতে কাজ করেন। মজিদ মিয়া এই গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে ধনী লোক। মজিদ মিয়ার বাড়ীতে পৌঁছে কুলসুম দেখল, মজিদ মিয়ার বউ তার সাত-আট বছরের ছেলে রবিনকে দুধ দিয়ে ভাত খাওয়াচ্ছে। রবিনকে খাওয়ানোর দৃশ্যটি দেখে কুলসুমের অন্তরটা যেন ফেটে যাচ্ছে। চোখ দুটি টলমল করছে, এই বুঝি দুচোখ বেয়ে পানি বের হয়ে আসবে। কান্নায় তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।                                                                               
মজিদ মিয়ার বউ রহিমা বেগম কুলসুমকে বললÑ এই কুলসুম যাও, কলপাড়ের বালতিতে রাখা কাপড় গুলো সাবান দিয়ে ভাল ভাবে পরিস্কার করে ফেল।                                      
Ñ যাইতাছি ভাবি, কথাটি বলে কলপাড়ের দিকে চলে গেল কুলসুম।                                                                                                          
কুলসুম কাপড়ে সাবান লাগাচ্ছে আর সজিবের কথা মনে করে দ‘ুচোখ দিয়ে গড়িয়ে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে।                                                         
Ñহাইরে দুনিয়া! একজন ধনী, আরেক জন গরিব, একজন দুধে ভাতে খায় আরেক জন না খাইয়া থাহে। আমার সজিবেরে আমি না খাওয়াইয়া কান্দাইয়া রাইখ্যা আইছি, আর সজিবের মতন বয়সের রবিন তার মা’র কোলে উঠ্যা দুধ দেয়া ভাত খায়তাছে। আমি একটা এন্ডা ভাইজ্যা দিতে পারি নাই দেইখ্যা, আমার মাসুম পোলাডা না খায়া রইছে। এন্ডা ভাইজ্যা দিব কইত্ত ? ঘরে থাকলেত।                                                                                      
এই কথা গুলো বার বার কুলসুমের মনে দাগ কেটে যাচ্ছে, আর কুলসুমের দুচোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কাপড়ে সাবান লাগানোর ফাঁকে ফাঁকে শাড়ীর আঁচল দিয়ে কুলসুম তার চোখ দুটি বার বার মুছে নিচ্ছে। 
কুলসুম বাড়ী থেকে চলে যাওয়ার পর সজিবের কান্না আরও বেড়ে গেল। তারাবানু সজিবকে ভূলিয়ে ভালিয়ে অনেক চেষ্টার পর জোর করে দু’এক মুঠো ভাত খাওয়াতে পেড়েছিল। অনেক ক্ষন পরে কান্না থামিয়ে হঠাৎ সজিবের মনে প্রশ্ন জাগল                                                                                           
Ñ ও নানু মা কই গেছে গো ?                                                                                                                                                                                   
Ñ তর মা মজিদের বাড়ী গেছে।                                                                                                                                                     
Ñ মা মজিদের বাড়ী গেছে কিতা করত ?                                                                                                                                                                         
Ñ কাম করত গেছে, কাম। তর মা যদি কাম না করে তাইলে তুই খাইবে কিতা?                                                                                                                
Ñ ও নানু মা মাইনষের বাড়ীত কাম করে কেরে ? আমরার বাড়ীতে কাম করলেই তো অয়।                                                                                 
Ñ আমরার যে কিছুই নাই, এর লাগ্যাই তোমার মা মাইনষের বাড়ীতে কাম করে। বুঝলা ভাই ?                                                                                     
তুমিত ছোড মানুষ, তুমি কি আর অত কিছু বুঝবা ? আমরারও এক সময় মেলা কিছু আছিনরে ভাই, অহন কিছু নাই। সবি কহালরে ভাই, সবি কহাল। হেই একদিনের ঘঠনাই সব কিছু ভাইঙ্গা ছাড়কার অইয়া গেল। হেই কিচ্ছাটা হুনবা তুমি ? কথাগুলো বলতে বলতে সজিবকে কোলে তুলে নিল তারাবানু। 
তোমারে আর কিতা কইয়ামরে ভাই, আমার বাহে আমারে বড় ঘর দেইখ্যা এই গাঁও বেয়া দিছিন। তহনও আমার বেয়ার বয়স অয় নাই, দশ কি বার বছর বয়সের সময় জমিরউদ্দি বেহারীর পোলা উছমান আলীর সাথে আমার বাহে আমারে বেয়া দিছিন। জমিরউদ্দি বেহারীর মেলা সহায় সম্পত্তি আছিন, গয়াইল ভরা গরু বাছুর আছিন, গরুর গাড়ি আছিন, ধান-চাউল, ট্যাহা-পইশা কোন কিছুরই অভাব আছিননা। তোমার নানা আমারে কোন কাম কাজ করতে দিতনা, কামলা দিয়া সব কাম কাজ করাইত। গোসুল কইরা আমার কাপড়ডা পর্যন্ত আমি নিজে কোন দিন কছি নাই।                                                                                 
অনেক দিন গেল আমাদের কোন পোলা মাইয়্যা অইতাছেনা। একটা পোলা মাইয়্যা দেহার লাইগ্যা আমার শশুরের মনডা সব সময় ছটফট করত। ভাদ্দর মাসের শুক্কুর বারে তোমার মা অইল, তারিখটা আমার মনে নাই। আমার শশুর তোমার মা’রে দেইখ্যা কত খুশি যে অইল, তারচে বেশী খুশি অইল তোমার নানা। তোমার মা আস্তে আস্তে বড় অইতাছে, আতকা শশুরডা আমার মইরা গেল। তোমার নানা বড় একলা অইয়্যা গেল কাম কাজে মন বহায়না। আস্তে আস্তে সব ঠিক অইল। কিনতুক এর হরে যে ঘঠনাডা ঘটল হেই দিনডার কথা মনে অইলে আইজ আমার কইলজাডা ফাইট্টা য়ায়।  
সংরামের  বছর। চৈত মাসে সারা দেশে শুরু অইল সংরাম, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে।  হেরা নাহি আমরার দেশটারে জোর কইর্যা দহল নিত চায়। পশ্চিম পাকিস্তানের মেলিটিরিরা আমরার দেশটারে নেওনের লাইগ্যা দেশের মাইনষের উপর অইত্যাচার করা শুরু করল। তাদের লগে শুরু অইল যুদ্ধু, আমরার দেশের সব মানুষÑ গিরস্থ, কামলা,  মাঝি, কামার, কুমার, ডাক্তর, মাস্টর যারা ইসকুল কলেজে লেহা পড়া করত তারাও যুদ্ধে নাম লেহাইল। আমাদের সারা গেরামের দুই এক জন মুরুব্বি লোক ছাড়া বাকি সবাই যুদ্ধে চইল্যা গেল। তোমার নানার মুখে হুনছি যারা যুদ্ধে নাম লেহায়ছে তারা সবাই মুক্তি বাহিনী। সব মুক্তি বাহিনী হিন্দুস্থান গেয়া টেডিং শিখ্যা, বন্দুক লইয়া দেশে আইয়া পশ্চিম পাকিস্তানের মেলিটিরিদের সাথে যুদ্ধু করছে। বিনা দোষে মিলিটিরিরা আমরার দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ মাইরা ফালাইছে। যুদ্ধের সময় আমাদের গাঁওয়ের পাশের তোষাই নদী দেয়া বাঁশের চালির মতন মরা মাইনষের লাশ বাইশ্যা বাইশ্যা গেছে। কত হেয়াল কাউয়্যায় লাশের গোস্তু খাইছে। ডরে কেউ তহন আর নদীর ঘাটে যাইতনা। লাশের গন্ধে সারা অরিপুর গাঁও ভইরা গেছিন। রাইতে তোমার নানা বাড়ীতে আইতনা, মাঝে মাঝে দিনের বেলা আইত আর রেডু  নিয়া বইস্যা বইস্যা কি যেন হুনত। গেরামের আরও মেলা মানুষ আইত তহন।                                                                                                                                                                                       
নানীর কথা গুলো সজিব শুনতেছে, আর মাঝে মাঝে নানীর কোলে উঠে আবার কোল থেকে মাটিতে নামে কখনও বা নানীর গলায় জড়িয়ে ধরে কিন্তু তারাবানু যে গল্পটা সজিবকে শুনাচ্ছে, সেটা বুঝার বয়স সজিবের এখনো হয়নি। তারাবানু একটার পর একটা কাহিনী বলেই যাচ্ছে, যেন সে কোন জনসভার মঞ্চে উঠে সারা দেশের মানুষকে তার জীবনের গল্পটা শুনাচ্ছে। 
শায়ুন মাস, বুধবার দিন তোমার নানা গেছিন নাজির গঞ্জের বাজারে। কেরায়া নাও ছাড়া নাজির গঞ্জের বাজারে যাওয়া যাইতনা। গেরামের আরও দশ বার জন লোক মিইল্যা একটা কেরায়া নাও ভাড়া কইর্যা নাজির গঞ্জের বাজারে গেছে। আমরার বাড়ী থাইক্যা তেলিগাতী বাজার কাছে, কিনতুক মেলিটিরির ডরে তেলিগাতী বাজারে কেউ যাইতনা। কহন কারে মাইর্যা ফালায়। গত শুক্কুর বারে তেলিগাতী বাজারে সাধন পুদ্দার আর তার পোলাডারে একসাথে বাইন্দ্যা মেলিটিরিরা গুলি কইর্যা মারছে। তোমার নানার মুখে ঘটনাডা হুইন্যা আমার খুব ডর লাগছিল। আমি তোমার নানারে কইছিলামÑ তোমার আর বাজারে যাওনের দরহার নাই। কিনতুক তোমার নানা আর আমার কথা হুনলনা।                                                                                                                                                      
তোমার নানা বাজারে যাওনের পর আমি তোমার মায়েরে লইয়া একটু চাঁনবানু বুজির বাড়ী গেছলাম। আতকা চাঁনবানু বুজির ছোড পোলাডা দৌড়াইয়্যা আয়া তার মায়েরে কইতাছেÑ                                                                                                                                                              
হুনছ মা হুনছ, মাঝি পাড়া মেলিটিরি আইছে, পরেশ মাঝির ঘরে আগুন লাগাইয়্যা দিছে।                                                                                                      
মেলিটিরির কথা হুইন্যারে ভাই আমার খুব ডর লাগল, আমি তাড়াতাড়ি চাঁনবানু বুজিরে কইলামÑ                                                                        
ওবুঝি আমি বাড়ীত যাইতাছি, মাঝি পাড়া মেলিটিরি আইছে তুমি সাবধানে থাইক্য।                                                                                                              
চাঁনবানু বুজির বাড়ী থাইক্যা বাইর অইয়া বড় পুস্কুনির পাড় দেয়া যহন আমি বাড়ীতে যাইতাছি, তহন দেহি উত্তর পাড়ার ছমির মিয়া হথের মাঝে খারইয়্যা রইছে। এই ছমির মিয়া বড় শয়তান, মেলিটিরিরার চাইমচামি করে, হথঘাট দেহাইয়া দেয়, মুক্তি বাহিনীরার বাড়ী বাড়ী মেলিটিরিরারে  লইয়া য়ায়। সারা গাঁওয়ের মাইনষের শত্রæ এই ছমির মিয়া। অনেক মা বইনের ইজজত মারছে মিলিটিরিরা; ছমির মিয়ার সহযোগীতায়।  তোমার নানার মুখে হুনছিলাম হে নাহি শান্তি কুমিটির সদইস্য আছিন। পরেশ মাঝির বাড়ীতেও মেলিটিরিরারে লইয়া আইজক্যা ছমির মিয়া নিজেই আইছে। পরেশ মাঝির সাথে তার কি শত্রæতাম ছিল জানিনা।  
ভাইরে কিতা কইয়্যাম, ছমির মিয়ারে দেইখ্যা আমার বড় ডর লাগতাছে, নাজানি আইজ আমার কহালে কিতা আছে। শইলডা আমার থরথর কইর্যা কাঁপতাছে, আস্তে আস্তে আমি পুস্কুনির পাড় দেয়া হাঁটতাছি। আতকা চায়া দেহি, মাঝি পাড়া থাইক্যা দশ বার জন মেলিটিরি বাইর অইয়া বড় পুস্কুনির পাড় দেয়া ছমির মিয়ার দিকে আইতাছে। মেলিটিরি দেইখ্যা আমার আর জানে পানি নাইরে ভাই, তর মায়েরে কোলে জড়ায়া ধইরা মাটির দিগে চায়া আস্তে আস্তে আগায়া যাইতাছি। যহন আমি ছমির মিয়ার কাছ লাগাত আইছি, ওই শয়তান বেডা আমার হাতটা টাইন্যা ধইর্যা কইতাছেÑ                                                                    
খারউহাইন ভাবি, আপনের সাথে আমার কথা আছে। অনেক দিনের একটা হিসাব আইজক্যা মিডায়া দিয়াম।                                                                                                                                           
ডরে শইলড্যা অবশ অইয়া গেল, গলাডা আমার শুহাইয়া গেল, আমি ওই শয়তান বেডারে কইলাম, না ভাই আমার বাড়ী যাওন লাগব, কুলসুমের পেটটা বেদœা করতাছে। ওই বেডা আমার কোন কথাই হুনলনা, কুলসুমেরে আমার কোল থাইক্যা টান দেয়া নামায়া নিল। আর কইল-                                                                               
না ভাবি আইজক্যা আপনের বাড়ীত যাওন লাগবনা। আপনারে পাইলে স্যারেরা অনেক খুশি অইব।                                                                                     
কথাডা হুইন্যা আমার চোখ দুইডা আন্দাইর অইয়্যা গেল, আমি এহন কি করবাম ভাইব্যা হাইতাছিনা। চায়া দেহি মেলিটিরিরা ছমির মিয়ার পাছে খাড়ইয়া রইছে, শয়তান ছমিরের লগে কি যেন কথা কইতাছে আমি বুঝি নাই। আতকা দানবের মত একটা মেলিটিরি আমার হাত ধইরা হেচকা টান দেয়া পুস্কুনির পাড়ের ঢালে নেয়া, আমার শইলের কাপড় ছোপড় টাইন্যা খুইল্যা ফালাইল। আমার উপর হহিনের লাগান ঝাপাইয়া পড়ল, এইভাবে সব কয়ডাই...,                                                                                                                                                                          
আমি বেউশ অইয়া পইড়া রইলাম, আর কুলসুম পুস্কুনির পাড়ে খারইয়া কান্তেছিল। চাঁনবানু বুজি কার কাছে যেন হুইন্যা, আমার কাছে আয়া আমারে বাড়ীত দেয়াগেল। ঘটনাডা হুনার পর সারা গাঁওয়ের মানুষ আমার সাথে কথা কওয়া বন্ধ কইরা দিল। এরপর আগুন মাসে দেশ ¯^াধীন অইল। 
দেশ ¯^াধীন অওয়ার পর সারা দেশে শুরু অইল আমুদ ফূর্তি আর আমার সংসারডায় নামল অশান্তির আগুন। গাঁওয়ের কিছু খারাপ মানুষ তোমার নানারে কান মন্ত্রনা দেওয়া শুরু করল। আমার কাছে এক কথা কয় আর তোমার নানার কাছে আরেক কথা কয়। আমার সংসারডারে ভাঙ্গার জন্য তারা সবাই উঠ্যা পইড়া লাগল, মনে অয় তাদের সাথে আমরার জনম জনমের শত্রæতা আছিন। কবে যে তাদের পাকনা ধানে মই দিছিলাম বুইজ্যা পাইতাছিনা। আমি গাঁওয়ের অনেক মাইনষেরে ট্যহা পইশা দেয়া পর্যন্ত সাহার্য করছি। কিন্তুক এই নিদানের সময় কেউ আমার পক্ষে একটা কথাও  কইলনা, শেষমেষ অবস্থা এই রহম অইল যে  তোমার নানা আমারে আর রাখবনা, আমার ভাইয়েরে আইতে কইল। সব ঘটনা হুইন্যা ভাই আমার গেরামের মেম্বর, চেরমেন, মাদবর সবাইরে লইয়্যা দরবার বসাইল। মেম্বর, চেরমেনরা তোমার নানারে অনেক বুঝায়া সুঝায়া রাজি করাইল। কিনতুক এর পর থাইক্যা তোমার নানা আর আগের মতন নাই, ঠিক মতন কাম কাজ করতনা, বাড়ী ঘরে আইতনা, রাইতেও মেলা দেরি কইর্যা আইত। আস্তে আস্তে জোয়া খেলা শুরু করল, জোয়া খেলতে খেলতে জমি জমাও সব বেইচ্যা ফালাইছিন।                                                                                                                            
হডাৎ একদিন  টিভি সেন্টার থাইক্যা তিনজন পোলা আর দুইজন মাইয়্যা মানুষ আইল, আমার ফটো উডায়া নিল, আমার কাছ থাইক্যা সব ঘটনা হুনল। আমারে অনেক সানতনা দিল, আমি নাহি দেশের গউরব, ইজজদ দেয়া আমি দেশ বাচাইছি, আমি ’বীরঙ্গনা’। সারা দেশের মাইনষে আমারে সরমান করব। আমরা যারা বীরঙ্গনা আছি সরকার তাদেরকে নাহি মুক্তি যুদ্ধার সরমান দিব। 
তোমার মা‘র বেয়ার বয়স অইছে, কিনতুক বেয়া দেওয়ার মতন কোন রহম ব্যবস্থা অইতাছেনা। আমার ভাইরে কইয়্যা বটতলার একটা পোলার সাথে তোমার মায়েরে বেয়া দিছলাম। কুলসুমের বেয়ার দিনও তোমার নানা বাড়ীতে আইলনা। তোমার বাহের দুই কাডা জমি আছিন আর বটতলা বাজারে পানের দোহান করত, সংসার খুব ভালাই চলত। 
তুমি তহন তোমার মায়ের পেটে, হডাৎ তোমার বাহে তোমার মা’রে লইয়া আইল। কুলসুম আমার পাওয়ে পইড়্যা হাউমাউ কইর্যা কান্দন শুরু করল, আমি তহন কিছুই বুঝদাছিনা, তোমার বাহে কইল আপনের মাইয়্যারে আমি আর রাখতামনা, আপনের কাছে বুঝাইয়া দেয়া গেলাম।
 আপনে নাহি বীরঙ্গনা, আগে হুনলে আমি আপনের মাইয়্যারে বেয়াই করতামনা। এর পর আর কোনদিন তোমার বাহে তোমার মা’রে নিলনা। এহন বুঝলা ভাই, কেরে তোমার মা মাইনষের বাড়ীত কাম করে। আমি ’বীরঙ্গনা ’এইড্যাই আমার দোষ।                                                                                                                                           
কথাগুলো বলতে বলতে তারাবানুর দু’চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি পড়তেছিল, তার গলাটা শুকিয়ে গেল। সজিবকে বুকে জড়িয়ে ধরে অপলক দৃষ্টিতে তারাবানু তাকিয়ে রইল।