রাত ন'টা কুড়ির মেট্রোটা গিরিশ পার্কে নামালো প্রায় পৌনে দশটার কাছাকাছি। ট্রেন থামার আগে অগ্নিবাণের প্লাটফর্মে পা রাখার তাড়াহুড়ো থাকেই। হাত পুড়িয়ে কিছু ফোটালে তবেই কিছু জুটবে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার মুখেই পিঠে একটা হিমশীতল হাতের ছোঁয়ায় পিছনে তাকাতেই চোখ পড়ল।
'সুধাকরদা!'
সুধাকর সামন্ত, অগ্নিবেশের আগে চিফ ক্যাশিয়ার ছিল। বেশ কয়েকবার হিসেবের গড়মিল ধরা পড়েও পার পেয়ে যায়। বাড়ির হাফ ডজন ছেলেমেয়ে। অগ্নিবেশ জয়েন করে তখন ওর রিটায়ার হতে দুটো বছর বাকি ছিলো।
'অনেক দিন থেকেই তক্কে ছিলাম। ঠিক জানতাম তোমার সঙ্গে দেখা হবে।'
অগ্নিবেশ সুধাকারের কনুইটা ধরে ভিড় থেকে একটু পাশে সরে দাঁড়ায়। অগ্নিবেশ লক্ষ করে সুধাকর সমান্তর শরীর খুবই ভেঙে গেছে। চোখের কোনে কালি। মাথার চুলটা এলোমেলো। আগে সামনে দাঁড়ালে দামী জর্দার গন্ধ পাওয়া যেত। মুখে সবসময় পান থাকতো। এখন মুখটা একদম শুকনো। সামনে দাঁড়ালে একটা পচা গন্ধ নাকে আসে। বোধহয় বহুদিন চান করেনি।
'এখন কি করছো?' সুধাকর জিজ্ঞেস করে।
'এই তো মাস ছয়েক হল জেল থেকে বেরিয়ে হকারি করছি।'
অগ্নিবেশ কাঁধের ঝোলা থেকে অনেকগুলো রকমারি রঙিন ফুকো বার করে। শিশিতে সাবানজলে ডুবিয়ে ফুঁ দিলেই শয়ে শয়ে রঙিন গোলাকার বাষ্পগুলো ভেসে গিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
'মেট্রো সিনেমার সামনে, নিউমার্কেটের আশেপাশে পথচলতি বাবা-মা বাচ্চাকাচ্চাদের খুব চাহিদা। খরচ উঠে আসে। মেট্রোয় যাতায়াত করি।'
'বিয়ে থা করোনি?'
'সাহস হয়নি, একার পেটটা চালিয়ে নিউ আর কি।'
এবার সুধাকরের মুখটা একটু ফ্যাকাসে হয়ে যায়। অনেক কিছু বলার জন্যে বুকটা আঁকু পাঁকু করে।
'আপনার বাড়ীর খাবর কিছু পান?' অগ্নিবেশ মানবিকতার তাগিদেই প্রশ্ন করে।
'সে সাহস পাই না। তবে মেয়েগুলো পাত্রস্থ হয়েছে শুনেছি।'
সুধাকর সামন্তর চোখটা ছলছল করে। অগ্নিবেশের মনটা খারাপ হয়ে যায়। চাকরিতে জয়েন করার প্রথম দিনটা মনে পড়ে।
গোবিন্দ খাসনবিশ ডিপার্টমেন্টের খাস লোক। একশো দশ কিলো ওজনের শরীরটা ঘড়ি মিলিয়ে সকাল দশটায় চেয়ারের ওপর চাপিয়ে দিলে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত। অগ্নিবেশের এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা খুঁটিয়ে দেখে বেল বাজায়।
অগ্নিবেশ দাঁড়িয়েই থাকে। সুধাকর সামন্ত ঢোকে।
'এনাকে নিয়ে গিয়ে কাজ বুঝিয়ে দিন।' সুধাকর বাধ্য ছেলের মত বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি করলে গোবিন্দ খাসনবীস-এর হুমকি শোনা যায়।
'কাজ বোঝার নামে গুরুমন্ত্র দেবেন না। সাবধানে থাকুন, আর তো দুটো বছর চাকরি আছে।'
অগ্নিবেশ যন্ত্রচালিতের মতো সুধাকরকে অনুসরণ করে। হিসেব নিকেশ করে পাই পয়সা বুঝিয়ে দেয়, তারপর চাবির গোছাটা অগ্নিবেশের হাতে দেওয়ার আগে আলমারির থেকে জরাজীর্ণ প্লাস্টিকের কভার মোড়া টিফিন বক্সটা বার করে নেয়। অদূরে একটা হাতল ভাঙা চেয়ারের উপর ধুলোটা মুছে চুপ করে বসে পড়ে। অগ্নিবেশ নিজের তোয়ালে ঢাকা ঝকঝকে চেয়ারটায় বসতে একটু সংকোচ করলেও সেদিন থেকেই ক্যাশিয়ারের যাবতীয় কাজ শুরু করে।
রাত কটা বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু গিরিশপার্ক মেট্রো স্টেশনটা বেশ খালি হয়ে যাচ্ছিল।
'আপনার শরীরটা খুব ভেঙে গেছে মনে হচ্ছে।' অগ্নিবেশ সুধাকর সামন্তর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার চেষ্টা করে।
'আমাদের সমাজে শরীরটাই বোঝা। শুধু কিছু করার জন্যেই এটা বয়ে বেড়াতে হয়। আজ প্রায় একটা বছর শুধু তোমাকে সত্যি কথাটা বলার অপেক্ষায় আছি। তোমার কাছে আমার অপরাধ স্বীকার না করে আমি যে মরেও শান্তি পাবো না।'
অগ্নিবেশ সুধাকর সামন্তর কথায় একটু বিস্মিতই হয়, বলে, 'কি কথা?'
তোমারা তো জানোই রেস খেলার বদ নেশাটা আমার বরাবরের। আগে কাজের মধ্যে থাকতাম, তবু সময় সুযোগে শনিবারটায় দু-একদান লাগাতাম। কিন্তু তুমি আসার পর সারাদিনটা অথর্বের তো বসে থাকাটা মাঝে মাঝে অসহ্য মনে হত। তাছাড়া মাথার উপর ছিল তিন-তিনটে অবিবাহিত মেয়েকে পাত্রস্থ করার দুশ্চিন্তা। খেতে পরতে, উঠতে বসতে ঘরে বাইরে, এমনকি অফিসেও লাঞ্ছনা আমাকে অশান্ত করে তুলছিল। অল্প সময়ে অনেকগুলো টাকা রোজগারের সহজ পথটা আমার জানা ছিল না।
হঠাৎ সুযোগটা তুমিই তৈরি করে দিলে। একসাথে লক্ষ টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে যেদিন আলমারিতে গুছিয়ে রাখছিলে, সেই দিনই জ্যাকপটে একটা দান খেলার সুযোগটা হাতছাড়া করতে পারলাম না। ইতিমধ্যেই টিফিন বক্স রাখার বাহানায় তোমার থেকে চাবির গোছাটা হাতিয়ে একদম অবিকল ডুপ্লিকেট বানিয়ে সুযোগের অপেক্ষয় থাকি। শনিবার তুমি ক্যাশ মিলিয়ে আলমারি বন্ধ করে বাড়ি চলে গেলে। বেলা একটার মধ্যে অফিস ভোঁ ভোঁ। আমিও চাবির গোছাটা দিয়ে আলমারি খুলে টাকাগুলো ব্যাগস্থ করি, তারপর সোজা হেস্টিংস। এখন আর তোমায় বলতে দ্বিধা নেই, সেদিন তোমাকে ফাঁসানোর ইচ্ছে ছিল না। ভেবেছিলাম, জ্যাকপটটা মারতে পারলে তুমি অফিসে পৌঁছানোর আগেই টাকাগুলো যথাস্থানে রেখে দেবো।
কিন্তু বিধি বাম্। মাঠ ছাড়ার সময় আমি সর্বস্বান্ত। চোখের সামনে দিয়ে অতগুলো টাকা চলে যাওয়ায় আমার শরীর মন হতাশা আর ক্লান্তিতে ছেয়ে গেছে। কেমন করে যে আমি নিধিরাম সমাদ্দার লেনের ঘুপচি দু'কামরা ঘরটার সামনে পৌঁছেছিলাম খেয়াল নেই। হুঁশ ফিরলো বাড়ির সামনে প্রতিবেশীর জটলা দেখে। বাড়ির ভেতর থেকে বউ ছেলেমেয়ের আর্তকান্না আর আমার আদরের ছোট মেয়ে অনুর নিথর দেহটা দাওয়ায় শোয়ানো আছে। কিছুক্ষণ আমি হতবাক হয়ে যাই। সবকিছু স্বপ্ন বলে মনে হয়। গতকালই ঘটনাটা স্ত্রীর মারফৎ জানতে পেরেছিলাম। পোড়ারমুখীর গর্ভে সন্তান, অনেক করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে, বকে ঝকেও মুখ ফোটাতে পারলাম না যে, কুকর্মের মূল নায়ক কে? হতভাগা শুধু গুমরে গুমরেই থাকে, অবশেষে সুযোগ বুঝেই ঘর বন্ধ করে নিজের শাড়িতেই গলায় ফাঁস দেয়।
টাকার শোকটা হয়তো ভুলতে পারতাম কিন্তু তোমার মতো ভালোমানুষের বিশ্বাসভঙ্গের মাসুল যে এমনভাবে চোকাতে হবে ভাবিনি। হঠাৎ আমি আর নিজের মধ্যে থাকি না। উদভ্রান্তের মতো বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে এদিক ওদিক ঘুরে গিরিশ পার্কের মেট্রো স্টেশনে পৌঁছে যাই। সন্ধ্যে ছটা কুড়ির মেট্রোটা তখন সবে প্ল্যাটফর্মে থেমেছে। আমি ড্রাইভারের কেবিন পেরিয়ে আসতেই ট্রেনটা হর্ন দিয়ে চলতে শুরু করে। শেষ সুযোগটা হাতের মুঠোয়, জয় মা বলে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমি জানতাম যে, এই কটা দিনের চাকরি করে এতগুলো টাকা চুকিয়ে দেওয়ার সমর্থ তোমার হবে না, অতএব চাকরি যাবেই, জেলেও খাটতে হবে। মিথ্যে অপবাদের ভাগি হয়ে শাস্তি পাবে অথচ জানতেও পারবে না যে আসল অপরাধীকে। এই কথাটা তোমায় না বললে মরেও পাচ্ছিলাম না।
সুধাকার সামন্তের স্বীকারোক্তি আর দির্ঘায়িত হওয়ার আগেই অগ্নিবেশ থামিয়ে দিয়ে বলে, আমি ব্যাপারটা সবই জানতাম। সোমবার অফিসে আসা মাত্রই আপনার মৃত্যুসংবাদ পাই। গোবিন্দবাবু আর আমি তৎক্ষণাৎ আপনার বাড়ী পৌঁছেই। আপনার স্ত্রী ছেলেমেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে আমরা যখন বেরোবার জন্য তৈরি হচ্ছি তখনই আপনার স্ত্রী সেই ডুপ্লিকেট চাবির গোছাটা গোবিন্দ খাসনবিশের হাতে দেয়। লাশের পকেটে পাওয়া গিয়েছিলো বলে পুলিশ নিজে এসে স্ত্রীকে হস্তান্তর করে। চাবির গোছাটা দেখেই আমার কেমন সন্দেহ হয়। পড়ি কি মরি করে অফিসে ফিরে টেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে আসল চাবির গোছা নিয়ে আলমারি খুলতেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। গোবিন্দবাবু মায় অফিসের সকরেই আমায় পুলিশের কাছে সবকিছু খুলে বলতে বলে। আমি জানতাম যে সত্যি ঘটনাটা প্রকাশ হলে আপনার সার্ভিসে রেকর্ডে দাগ পড়বে। গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড মায় পেনশন পর্যন্ত আটকে যেতে পারে। আমি তো একা, কিন্তু আপনার ভরাভর্তি সংসারের অতগুলো অসহায় মানুষের করুণ পরিণতি চিন্তা কেরই সিদ্ধান্ত নিই। স্বেচ্ছায় সমস্ত দোষ নিজের কাঁধে তুলে জেলে যাই।
'তুমি মানুষ নও বাবা ভগবান।' সুধাকর সামন্তর গলাটা কান্নায় বুজে আসে। কঙ্কালসার দেহটা একটু অতিমানবিক মনে হয়। পাদুটো বোধহয় মাটিতে ছুঁয়ে নেই। শরীরের অনেকটা অংশই আর দেখা যাচ্ছে না। তারপর সবটাই। অগ্নিবেশ গিরিশপার্কের সিঁড়ি ধরে বাইরে বেরিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলে।
টানা একটা মাস সুধাকর সামন্ত কালাজ্বরে পড়েছিলো। অগ্নিবেশ খুঁজে খুঁজে পৌঁছে যায় এদিন। মাথার শিয়ারে বসে মনের জোর আনতে সাহায্য করে। চা জলখাবার নিয়ে ছোটমেয়ে অনি ঘরে ঢোকে। দুজনের ভরাভর্ত্তি যৌবন। প্রথম দিনই চোখে চোখে অনেক কথা হয়। তারপর তাড়াতাড়ি অফিসের কাজ সেরে সোজা নিধিরাম সমাদ্দর লেনের দু'কামরার বাড়ীতে। হাত পুড়িয়ে খেয়ে অগ্নিবেশের মুখের স্বাদটাই বদলে গিয়েছিল। সুধাকর সামন্তর স্ত্রীর অনুরোধ লুফে নিয়ে রাতের ভুরিভোজটা সেরে বাড়ী ফেরা। অন্ধকার গলিটায় টর্চ নিয়ে বড় রাস্তা অবধি এগিয়ে দেওয়ার অজুহাতে অনু প্রায়ই অগ্নিবেশের তপ্ত আবেশে ধরা দেয়। সুযোগটা তাড়াতাড়িই এসে যায়। সন্ধ্যে থেকেই তুমুল বুষ্টি, ছাড়ার নাম নেয় না। অগ্নিবেশেও কাক ভেজা হয়ে ঢোকে। অতএব রাতটুকুর জন্যে একটা ঘরে বিছানা তৈরি হয়। বাকি একটা ঘরে সুধাকর স্বামী-স্ত্রী ছেলে পিলে নিয়ে গাদাগাদি করেই রাত কাটায়। মাঝরাতে দরজায় টোকা। অগ্নিবেশ অনুকে কাছে পায়। অনেকটা সময়, বাধবন্ধন হীন। একে অন্যকে চেষ্টা করেও আটকাতে পারে না।
রাত অনেক হয়েছে। জনশূন্য রাস্তায় অগ্নিবেশ বাড়ীর দিকে এগিয়ে চলে। মনে তখনও ওর একটা শঙ্কা থেকেই যায়, যদি পরলোক থাকে তাহলে সেখানে নিশ্চয়ই অনুর মুখ থেকে সত্যিটা জেনে সুধাকর সামন্ত একটু অবাকই হবে। নিশ্চয় খুব পস্তাবে আর বলবে মানুষ আর যাই হোক ভগবান হয় না।
১৭ জুন - ২০১৪
গল্প/কবিতা:
২৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪