আলোকিত ঘাঁসফুল

প্রত্যয় (অক্টোবর ২০১৪)

মালেক জোমাদ্দার
  • ১২
এক.
নীল আকাশে কালো মেঘর ভেলা,গুরুম গুরুম শব্দ আর বিজলী চমকাচ্ছে । মাঝে মাঝে প্রবল দমকা হাওয়া । নড়বড়ে একটি ছনের ছাঊনি ঘরে বসবাস রুপালী ও শিউলির । বাবা মোসলেম উদ্দিনের বয়স ৬৫ ছুঁই-ছুঁই, মা রহিমা বেগম মোসেলেম উদ্দিনের দ্বিতীয় স্ত্রী, প্রথম স্ত্রী মারা যায় বিয়ের কয়েক মাসের মাথায় । রহিমার দুই কন্যা সন্তান । মেয়েরা পড়া লেখায় খুব ভালো । হঠাৎ এলো কালবৈশেখি ঝড়, উড়িয়ে নিয়ে গেল ঘরের ছাউনি । থালা বাসন যা কিছু আছে দু'বোন কোন মতে সামলাতে ব্যস্ত ।পাশ থেকে শব্দ এলো “বাবা-মা আমারে বাঁচা” মেয়েরা বৃস্টিতে ভিঁজতে ভিঁজতে দৌড়ে গিয়ে দেখলো বাবার উপর এক বিশাল গাছ পড়েছে আছে । মাথা গড়িয়ে অঝোরে রক্ত ঝরছে। খুব কস্টে বাবাকে গাছের নিচ থেকে তুলে আনলে ও শোয়াবে কোথায় সে যায়গা টুকুন নই। ঘরের চালা উড়ে যাওয়ায় ঘর আর উঠোন সমান জলে থৈথৈ করছে । বাবাকে পাশের বাড়ি হাসেম মোড়ল এর ঘরে নিয়ে তুললো। মেয়েদের অনুরোধে হাসেম মোড়ল রাজি হলো শুধু আজকের রাতটা ওদের বারান্দা ঘরে থাকার।বাইরে বৃস্টি একটু কমেছে।রুপালী ও শিউলির মা রহিমা বেগম তিন মাইল দূরে উপজেলা শহরে বাসায় বাসায় ছুটা বুয়ার কাজ করে। যে টাকা আয় করে তা দিয়েই কোনমতে মেয়েদের পড়াশুনার খরচ চলে। ঈদ আসলে কিছু বাড়তি টাকা পয়সা ও খাবার দাবার পায়।আর মোসলেম উদ্দিনের যে সামান্য চাষের জমি আছে তাতে শাক-সব্জি চাষ করে।রহিমা বেগম কাক ডাকা ভোরে উঠে কাজে যায় আর ফিরে রাতে । মাঝে মাঝে কোন বাসায় মেহমান আসলে কাজের চাপ বেড়ে যায় আর ঘরে ফিরতে আরো দেরি হয়। মেয়েদের জন্য মন পড়ে থাকে ঘরে,একটু ভাল খাবার পেলেই পোটলা করে মেয়েদের জন্য নিয়ে আসে।ঝড়ের দিন রহিমা বেগম এর বাড়িতে ফিরতে দেরি হলো । বাড়ি এসে কিছুই চিনতে পারছেনা।একদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর বন্যায় লন্ড-ভন্ড করে রেখে যাওয়া স্তুপ । ভীষণ ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে দিকবিদিক ছোটাছুটি করছে এমন সময় শিউলি মায়ের কাছে ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে। বাবার কাছে রুপালী আছে শুনে একটু স্বস্তি পেল রহিমা । মা-মেয়ে হাসেম মোড়ল এর ঘরের বারান্দায় যায়। কিছু খাবার নিয়ে এসেছিল তা দিয়ে পেটের ক্ষুধা নিবারণ করলো। মোসলেম উদ্দিনের শরীরে প্রচন্ড জ্বর।মাথায় আঘাত লাগায় বেশ রক্ত ক্ষরণ হয়েছে, রাতে গ্রামে কোন ওষধের দোকান ও খোলা পাওয়া গেল না। সারা রাত নির্ঘুম।
সকালে যথারীতি রহিমা কাজে গেল।মেয়েদের ও স্কুলে যেতে হবে। বই খাতা ভিঁজে গেছে।সকালে বই খাতা শুকাতে দিলো। স্কুলে ভিজিটর আসবে তাই স্কুলে ও যেতে হবে। ভালো জামা কাপড় পড়ে যেতে বলেছেন প্রধান শিক্ষক । বাবাকে একা অন্যের ঘরে রেখে যেতে ওদের মন চাইছে না কিন্তু স্কুলের হেডস্যার আদেশে দু’বোন স্কুলে গেল। স্কুলে ভিজিটর আসবে আসছে করে সন্ধ্যা হলো। কোন আহার জোটেনি দিনে।ঘরে রান্নার ও কোন উপায় নেই। রাতে ঘুম হয়নি তাই শরীর বেশ ক্লান্তিতে ভরা। ভয় নিয়ে মোড়ল এর ঘরে পা রাখতে মোড়ল এর বউ-“কালকে না বলছিলাম রাতটা শুধু থাকবি সকালে চলে যাবি, কি হলো তোদের কানে যায় না ?


শিউলি-‍দাদি আমরা কালকেই চলে যাব।
মোড়ল এর বউ-মনে থাকে যেন, এই বলে ঝামটা মেরে ঘরে ঢুকে গেল ।
রহিমা বেগম আজ ও কিছু খাবার নিয়ে আসল। পাখির বাসায় যেমন মায়ের আসায় থাকে কখন ঠোটে করে খাবার নিয়ে আসবে তেমন ই রুপালী শিউলি মায়ের আসায় ছিল। রাতে খেয়ে শুয়ে পড়ল।
মোড়ল এর দু’টি বখাটে ছেলে আছে, ওরা ওত পেতে আছে কখন ওদের একা পাবে ।রুপালী ও শিউলি ওদের মতলব বুঝতে পেরে দু’জন একসাথেই থাকে। রাত আনুমানিক ১২টা সবাই ঘুমের ঘোরে, হঠাৎ রুপালীর উহ শব্দ!
রহিমা –কি হয়েছে রুপালী?
রুপালী- মা কেযেন আমার শরীরে …।। বল কি হয়ছে!?
না মা কিছু না । দু’বোন কানে কানে কিছু একটা বলছে। মা রহিমা ঘুমিয়ে পড়ল। আবার ঐ বদমাস দ্বয় ওদের বারান্দার পাশে ঘুরঘুর করছে । দু’বোন বসে থাকল, ভয়ে ঘুম আসছে না। সামনে বিপদ ওরা অনুমান করতে পারছে কিন্তু কাউকে কিছু বলতে ও পারছে না । নিজেদের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়লো । রাত তখন আনুমানিক ৪টা; নদীতে নৌকার দাড় বাওয়ার শব্দ, লঞ্চ এর হুইসেল, লোকজন শহরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে । রাখাল হাল চাষের জন্য গোয়ালের গরু বের করছে । শেয়ালের ডাক থেমেছে কিন্তু থামেনি একটি কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ । এমন সময় শিউলি আবার চিৎকার দিয়ে উঠলো বাবা,মা বুবুকে দেখছিনা বুবু কোথায় !?বাতি জ্বালিয়ে খুঁজতে শুরু করলো রুপালীকে । শিউলির সন্দেহ রুপালীকে ওরা নিয়ে গেছে । মা-তুমি দেখো তো মোড়ল এর ছেলেরা ঘরে আছে কিনা!
রহিমা (মোড়লের বউকে)-খালা ও খালা একটু দরজাটা খুলবেন ।
মোড়ল দরজা খুলে - কি এত রাতে তোমরা চিল্লাইতেছো ক্যান ?
রহিমা... খালু আপনারা ছেলেরা কই?
মোড়ল--- আমার ছেলেদের দিয়া এই রাইতে কাম কি ?
ওদিক থেকে মোড়ল এর বউ-- বেডি এত রাইতে আমার ছেলেদের খোঁজে কেন ? আমি আগেই কইছিলাম ঐ বেডির মতলব খারাপ আমার ছেলেদের দিয়ে ওর মেয়েদের ...।।
মোড়ল--চুপ থাকো আগে শুন কি বলে ।
মোড়ল এর বউ- ও এখন তোমার দরদ উৎলাইয়া উঠছে , আমি বুঝিনা মায়ের সাথে তুমি আর মেয়েদের ছেলারা । আমি বলছি আমি বাইচ্চা থাকতে এসব করতে দিমুনা । দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে গেল। শিউলি ত্ত রহিমা খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। মোসলেম উদ্দিন খুবই অসুস্থ্য থাকায় মেয়ের এ বিপদে সে কিছুই করতে পারছে না । মসজিদে মুয়াজ্জিনের আজান ধ্বনিত হলো । পুবাকাশে লালচে আভায় চারি দিক ফরসা হয়ে গেল । একটি ছেলে দৌড়ে এসে - শিউলি শিউলি তোর বোন রুপালী ঐ জঙ্গলের ধারে পড়ে আছে । শিউলি ত্ত ওর মা গিয়ে দেখে রুপালীর সারা শরীরে আঘাতের দাগ, শরীরের উপর চলছে অমানবিক অত্যাচার। রুপালীকে নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে । ডাক্তার দেখালো । যৌন নির্যাতনের সব আলামতই বিদ্যমান । এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়লো চার দিকে, স্কুলে, হাটে মাঠে ঘাটে সব খানে । রুপালীকে একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হলো , মোটামুটি সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরলো কিন্তু তার আর এ সমাজে সাধারণ ভাবে বাস করার কোন উপায় নেই। বেশ কিছু দিন ঘরেই বসে থাকল । সহপাঠিদের অনুরোধে রুপালী আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করলো । আগে পাড়ার লোকজন দেখলে ওকে আদর করতো আর এখন যেন অন্য দৃষ্টিতে দেখে। চোখের চাহনী বলে দেয় ওর কী চায় । রুপালীর ধারণা মা আর শিউলি এড়িয়ে চলছে। অসহয় আর অসহ্য জীবন ও আর ভাল লাগে না তার। একবার আত্মহত্যার চেস্টা ও করেছিল । বাড়ির লোকজন দেখে ফেলায় সে যাত্রা বেঁচে গেল ।
মেয়ের এই অবস্থা, স্বামী অসুস্থ্য সব নিয়ে ভালো নেই রহিমা। সেদিনের কালবৈশাখী ঝড় যে সর্বনাশ করলো তা পূরণ করার মতো নয়। ভাঙ্গা ঘরে খোলা আকাশে ওদের দিনাতিপাত সেটা মানা যায় কিন্তু ইজ্জত লুটে নিলে তা আর কি ফেরত পাওয়া যায় ? মানবের মূল সম্পদ মনুষত্ব তা যখন ঘুণে ধরে তা ঘুণ পোকার কাঠ নস্ট করার চেয়ে ও ভয়াবহ বেদনার । এই নস্ট সমাজকে ভালো করার অঙ্গিকার বা প্রত্যয় কাউকে না কাউকে নিতেই হবে। সে প্রত্যয় নিয়ে শিউলি বা রুপালী সফল হতে পারবে ? তবুও এগিয়ে যেতে হবে । পড়া শোনা যত টুকু সম্ভব দিনের বেলায় শেরে ফেলে ওরা।শত বাধা আর অভাবের মধ্যে এগিয়ে চলে ওরা।
দুই.
বাবা মোসলেম উদ্দিন ধীরে ধীরে ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে । মরে গিয়ে সে হয়ত বেঁচেই গেল কিন্তু মেয়েদের ও বিধবা রহিমা যে অথৈ সাগরে ভাসছে তাদের দেখার কেউ রইল না। মেয়েদের নিয়ে কিভাবে বাঁচবে রহিমা, প্রতিদিন এত দূরে পায় হেটে গতর খাটতে যে আর ভাল লাগেনা কিন্তু নিরুপায় ।পান থেকে চুন খসলেই মেম সাহেবদের বকুনি খেতে আর ভালো লাগেনা । আজ আর কাজে যাবো না ভাবে কিন্তু নিয়তি টেনে নেয় সেখানেই । ওদের পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে । সবাই মহা খুশি। হয়ত করো বাবা নয়ত মা স্কুলে হাজির। রুপালী আর শিউলির কেউ যায় না কেননা ওর মা রেজাল্টের মর্ম বুঝে না । ওরা প্রতি ক্লাসেই প্রথম হয়। সবাই ধরে নিছে ওরা এবার প্রথম হতে পারবে না ।এবারের পরীক্ষা পদ্ধতি ছিল ভিন্ন । শৃজনশীল, যা নিজের মেধা আর বুদ্ধি দিয়ে উওর দিতে হয়। রুপালী আর শিউলি ওদের মেধার কাছে সবাই হার মানলো ।


মেয়েদের পড়নের কাপড় চোপর,খাওয়া দাওয়া পড়াশোনার খরচ চালানো এখন সব দায়িত্ব রহিমা বেগমের । মেয়েদের ইচ্ছা পড়াশুনা করে মানুষের মত মানুষ হত্তয়া । রহিমা বেগম স্বামীর বসত ভিটায় শেষ জীবন টুকু কাটাতে চায় ।
একদিন রহিমার ঘরে মোড়ল হাসেম আলী। রহিমা ঘরে আছ?
-কে?-ও হাসেম চাচা, আসেন, বসেন।
হাসেম মোড়ল- ব্যস্ত হবার কিছু নাই আমি তো তোমাদেরই কাছের লোক ।
-চাচা বলেন, কি জন্য আইছেন ।
হাসেম মোড়ল- তোমারে একটা উপকার করতে চাই ।
-কি উপকার চাচা?
হাসেম – আরে তুমি চাচা চাচা করো কেন? আমি কি তোমার চাচার বয়সী?
-না আপনি তো সর্ম্পকে চাচা হন তাই।বলেন কি হইছে।
রাখ চাচা,ভাই বলো ভাই,আর তুমি চাইলে হাসেম বলেও ডাকতে পার।
রহিমা (মনে মনে) ওরা লুচ্চা, তোর ছেলে আমার মেয়ের সর্বনাশ করছে আর তুই আইছো আমার সর্বনাশ করতে । আইজ তোর একদিন কি আমার একদিন । আস্তে করে ঘরে ঢুকে হাতে গাছ কাটা দাও হাতে নিলো।
হাসেম মোড়ল ও বুঝতে পাড়লো বেশি কিছু বললে দাও এর কোপ খেতে হবে। ঘর থেকে বের হয়ে একটু দূরে গিয়ে ওর একটা চ্যালা পাঠাল – কাকি তোমাকে হাসেম কাকু বিয়ে করতে চায় ।তুমি রাজি থাকলে আজই কাজী ডাকতে পারি। রহিমা সেই প্রস্তাব না করে দিল। কিন্তু রহিমা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। এই হারামি একদিন না একদিন এই "না" এর প্রতিশোধ নিবে। যে কথা সেই কাজ। এক সপ্তাহ পরে এলাকার বেশ কিছু লোক নিয়ে রহিমার উঠানে হাজির। রহিমা কাজে থেকে বাড়ি এসে এত লোক দেখে ভয় পেল। কেন এত লোক!!?
হাসেম মোড়ল- রহিমা তোমার স্বামী মরার আগে আমার কাছে তোমাদের বাড়ির জমি লিখে দিয়েছে এখন থেকে আমি এই জমির মালিক । রহিমা- আমি বিশ্বাস করি না , সে যদি জমি আপনার কাছে লিখে দিত তা হলে আমি জানতাম আর কেন লিখে দিবে ? হাসেম মোড়ল- সে মারা যাবার আগে আমার কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছিল ।

রহিমা তো আকাশ থেকে পড়ল । আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। প্রমাণ দেখান । হাসেম মোড়ল একটি ১০০ টাকার স্ট্যাম্প বের করে দিল আর তাতে লেখা আছে হাসেম মোড়ল এর কাছ থেকে আটানব্বই হাজার টাকা নিয়েছে আর তা এত দিনে সুদে আসলে অনেক টাকা হয়েছে । হাসেম মোড়ল কিভাবে এই কাজটি করল ওরা ভেবে পায় না। মোসলেম উদ্দিন যখন অজ্ঞান অবস্থায় হাসেম মোড়লের বাড়িছিল তখন সুযোগ বুঝে এই টিপ সই নিয়ে ছিল আর সেই তুরুপের টেক্কাটি এখন শো করলো। রহিমা বেগম মেয়েদের নিয়ে বুদ্ধি করলো এই বদ লোকের সাথে দ্বন্দে জড়ানো ঠিক হবে না । ওরা কিছু দিন সময় চাইল । অন্যান্য লোকজন ওদের সাথে এক মত । হাসেম মোড়ল সামান্য মন কস্ট নিয়ে ফিরে গেল। রহিমা পরের দিন রাতে মেয়েদের নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হলো । হাসেম মোড়ল তো টোপ ফেলে রেখেছে যদি রহিমা বিয়েতে রাজি হয় তা হলে মোসলেম উদ্দিন বাড়ি ঘর তার হবে যদি না বিয়ে করে তা হলে সুদ বাড়তে থাকবে একদিন এই বাড়ি ঘর তারই হবে ।একদিন হাসেম মোড়ল রহিমার বাড়ি গিয়ে দেখে ঘর তালা মারা। খোঁজ নিয়ে জানতে পারল অনেক দিন আগেই মেয়েদের নিয়ে রহিমা ঢাকায় চলে গেছে ।
তিন.
রহিমার গ্রামের বন্ধবি সেফালির যে বস্ততিতে বাসা তার কাছে একটি ঘর ভাড়া নিল। সেফালি গ্রামের ছোটবেলার বান্ধবি। অনেক দিন ধরে এই বস্তিতে থাকে। সকালে ওরা অভিজাত এলাকার বাসায় কাজ করতে যায়। মাসে তিন চার হাজার টাকা আয় করে । রহিমাকে নিয়ে এক বাসায় এবং বুয়ার কাজ ঠিক করে দেয় । রহিমা যত্ন সহকারে কাজ করে তাই তার কাজে বাড়িয়ালী খুব খুশি। সে পাশের বাসায় আরো একটি কাজ গেল। বস্তিতে অনেক মেয়েরা সকালে সেজে গুজে অফিসে যায়। একদিন রুপালীর ইচ্ছা হলো অফিস কেমন হ্য় দেখতে । মিতা একটি গার্মেন্টস এ অপারেটর হিসেবে কাজ করে । ওর সাথে রুপালীর বেশ সখ্যতা হয়। একদিন ওর গার্মেন্টসে নিয়ে গেল। রুপালী ঠিক করলো আর এত কস্ট করবেনা,এবার টাকা আয় করবে,বাবার রেখে যাওয়া ঋণ শোধ করবে। রুপালীর ইন্টারভিউর ব্যবস্থা করলো মিতা। রুপালীর হাতের লেখা দেখে হিউম্যান রিসোর্স অফিসার রুপালীকে টাইম কীপারের চাকুরী দিল।মাসিক বেতন ৩৫০০ টাকা সাথে দুই ঘন্টা ওভার টাইম। মা মেয়ের কাজের টাকায় বেশ ভালো ভাবেই কেটে যাচ্ছে ওদের ওদের তিন জনের সংসার।শিউলির ইচ্ছা পড়াশোনা শেষ করা । রুপালী ও চায় ছোট বোন অনেক দূর পড়াশোনা করুক ।
শিউলি একটি ভালো কলেজে ভর্তি হলো । রুপালী ও শিউলি গ্রামের স্কুল থেকে এ প্লাস পেয়ে এস-স-সি পাশ করে এলাকায় আলোড়ন তুলেছিল, কত মিডিয়া, পেপার পত্রিকা ওদের খবর ছেপেছিল । কিন্তু খারাপ লোকদের কারণে গ্রাম ছাড়তে হল ওদের। শিউলির সেই অদম্যই, এবার ও এইচ. এস. সি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে কলেজের সবার নজরে এলো। প্রিন্সিপাল স্যার ডেকে পাঠালেন আর তাঁর অনুরোধ শিউলি যেন তার কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়। সব খরচ কলেজ বহন করবে। শিউলী মহা খুশি। রুপালীর না মত। সে চায় শিউলি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে। শিউলি বোনের কথামত ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয় আর চান্স ও পেয়ে যায়। শুরু হলো আরেক জীবন।
বন্ধুত্ব হলো ক্লাসের অনেকের সাথে । একদিন এক বড় লোক বাবার সন্তানের প্রেমের প্রস্তাব আসে শিউলির কাছে কিন্তু সে প্রত্যাক্ষাণ করে দেয় । তার প্রেমট্রেম করা কাজ না। তাকে নিজের পায়ে দাড়াতে হবে । নিতে হবে বোনের উপর নির্যাতনের প্রতিশোধ । ছাড়াতে হবে বাবার বন্ধকী জমি । পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সে টিউশোনী করে আর তার আয় দিয়ে যাতায়াত খরচ বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে চটপটি-ফুসকার বিল শেয়ার ও করে।কেউ বুজতে পারেনা সে এত গরিব।
অনার্স ফাইনাল রেজাল্ট বের হলো যথারীতি শিউলি ফার্স্ট ক্লাস ফার্ষ্ট। সবাই ঠিক করলো এবার শিউলির বাসায় যাবে। শিউলির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল । আমি থাকি বস্তিতে সেখানে ওদের নিব কিভাবে । কিন্তু বন্ধু-বান্ধবীদের কথা একটাই হোটেল থেকে খাবার কিনে নিয়ে শিউলীর বাসায় শিউলীকে সেলিব্রেট করবে।শিউলির চোখ থেকে টপ্ টপ্ জল গড়িয়ে পড়ছে। সবাই অবাক!! শিউলিকি হয়েছে?? না কিছু না । না, কিছু একটা হয়ছে,বান্ধবিদের অনুরোধে একে একে সব কথা খুলে বললো।সবাই অবাক!!ওদের আগ্রহ আরো বেরে গেল । সব বন্ধুরা ঠিক করলো শিউলিকে সাহায্য করবে। সে দিন ওরা যে যার মতো চলে গেল। এক বান্ধবী ওকে ফলো করে, সে দিন ওর বাসা চিনে চলে আসে । পরের শুক্রবার অন্যান্য সহপাঠিরা শাহবাগে মিলিত হলো । একটি ভালো রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে শিউলির বাসায় হাজির। সেদিন ওর মা বোন তিন জনই বাসায় ছিল । হতবাক রহিমা বেগম ! এত মেহমান বসতে আগে কখন ও দেখেনি আর এদের বসতেই বা দিবে কোথায় !! সারা দিন সবাই ফটোশুট সহ কত মজা করলো ওরা।
চার.
রুপালীর অফিস আর শিউলির ইউনিভার্সিটি ঈদ উপলক্ষে ছুটি । একটানা কত বছর গ্রামের বাড়ির বাইরে, গ্রামে মন পড়ে আছে। শিউলির বান্ধবীরা ধরলো ওর গ্রামের বাড়ি্তে বেড়াতে যাবে । শিউলির গ্রামের বাড়িতে ওদের থাকতে দেয়া যাবে না শুনে ওদের এক বন্ধু উপজেলা শহরের একটি হোটেলে রুম বুক করলো। ওদের এক আত্মীয় সেই উতপজেলার ইউ এন ও। ব্যাস কে আর আটকায় ওদের যাওয়া। গত পাঁচ বছরে বেশ কিছু টাকা জমিয়েছে রহিমা বেগম ।বাড়ি ফিরে লোক জন নিয়ে একটি নতুন টিনের ঘর তুললো । মোড়ল টের পেয়ে লোক জন নিয়ে হাজির, হয় সুদে আসলে টাকা দাও নয় বাড়ি দাও। শিউলী -হাসেম দাদু আপনি দলিলের একটা কপি দিয়ে যান আর আমরা হিসাব নিকেশ করে আপনাকে খবর দিলে আপনি এসে টাকা নিয়ে নিয়েন । হাসেম মোড়ল – হিসাব করলে ঠকবা । আমি বলি কি তোমরা তো আর গ্রামে থাকবা না, আমাকে টাকার বিনিময় বাড়িটা দিয়ে দিলে হয়। তোমরা যদি মাঝে মধ্যে আসো তা হলে এই ঘরেই থাকবে। কি বলেন মিয়ারা, হ্যা হাসেম ভাই ঠিকই বলছেন। হাসেমের চেলা পোলারা (কানাকানি করে)রহিমা এত বড় ঘর দিল আবার মোড়লের টাকা ও ফিরত দিতে চায় কি কাজ করে ? কানা কানি করছে ....মনে হয়…।.।
শিউলি দূর থেকে দেখে-- দাদু আমি কি বলছি শোনেননি? হ্যা শুনেছি । শুনে থাকলে দিয়ে চলে যান। বাবা মেয়ের জোর কত। জোরের দেখছেন কি দেখবেন সামনে। শিউলি ব্যাপারটা নিয়ে ওর বন্ধুদের সাথে আলাপ করলো । বন্ধুরা সবাই উপজেলা শহরে এলো। সবাই মিলে প্রায় এক লাখ টাকার একটি ফান্ড তৈ্রী করলো। পরের দিন ইউ এন ও স্যার কে সাথে নিয়ে সবাই শিউলিদের বাড়ি হাজির । রহিমা বেগম রুপালী রান্না বান্না নিয়ে বেশ ব্যাস্ত আর শিউলি ওদের সাথে আড্ডায় ব্যাস্ত এমন সময় হাসেম মোড়ল হাজির। খুব তাড়া হুড়া ভাব। কৈ টাকা রেডি আমি গঞ্জে যাব। রহিমা-- আসেন, বসেন । ঘরে মেহমান আছে আপনি ভালো কালকে আসেন। শিউলি -না মা, তুমি তোমার কাজে যাও আমি দেখছি । দাদু কাগজটা দিন। -কাগজ দিয়ে তুমি কি করবে, আমি টাকা পাব টাকা দিবে আর এটা তো সবাই জানে।
শিউলী -সবাই জানে আমরা ও জানি তবে আপনার কাগজ দিতে অসুবিধা কোথায় ? হাসেম মোড়ল রেগে - নাও এই নাও। শিউলি কাগজটি নিয়ে ইউ এন ও স্যার এর হাতে দিলো। আর শিউলির একজর দেখে মনে হলো এটি একটি ভুয়া কাগজ। যে দিন-তারিখ এখানে বসানো আছে সেদিন বাবা অজ্ঞান ছিল আর সেদিন স্কুলে ভিজিটর আসার কথা ছিল। বাবা একা মোড়লের বারান্দায় ছিল। সেই সুযোগে এই আঙ্গুলের টিপ নিয়েছে ।
ইউ এন ও-- হাসেম সাহেব এই টিপ কার?
-কেন মোসলেমের,
ইউ এন ও-- মোসলেম সেদিন কার কার সামনে টিপ দিয়েছিল?
সেটা কি আপনাকে বলতে হবে ? আপনি কে?
আমি এই উপজেলার ইউ এন ও। আপনার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আর আমার সামনে একটি প্রমাণ পেলাম। শিউলী আমার মেয়ের মত। এতিম বাচ্চাদের সাথে আপনার প্রতারণা করতে একটু বুক কাপলো না ? হাসেম মোড়ল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। স্যার আমার ভুল হইছে, আমারে ক্ষমা করে দেন। আমি আর এ রকম কাজ করব না।
শিউলির চতুরতা বন্ধু বান্ধবীদের সহায়তায় বিনা টাকায় বাড়িটি রক্ষা পেল। বন্ধু বান্ধবীদের সহায়তার এক লক্ষ টাকার ফান্ডটি তো কাজে লাগাতে হবে কি ভাবে কাজে লাগানো যায়, ইউ এন ও স্যার এর আইডিয়া এই টাকা দিয়ে রুপালীর বিয়ে দিয়ে দিলে কেমন হয়। সবাই এক সাথে - খুব ভালো । দূর থেকে রুপালীর কানে বিয়ের কথা গেল। শিউলিকে ডেকে নিয়ে --- আমার পছন্দ আছে ।
-ওরে শয়তান তা আগে বলনি কেন ? কোথায় ? কে?
রুপালী (কানে কানে) আমাদের অফিসের এইচ আর স্যার।
শিউলি- তোর স্যার তোকে বিয়ে করবে ? শিউলির মনে পড়েছে বুবুকে কালকে যে চিঠি দিলো সেই কি ওর পছন্দের ? শিউলি দৌড়ে গিয়ে রুপালীর ব্যাগ থেকে চিঠিটি বের করে পড়তে লাগলো…

“তোমার কাছে লিখব চিঠি কলম নিলাম হাতে
লিখতে গিয়ে শুন্য দেখি কালি নেই যে তাতে,
কোথায় পাব কলম কালি এত মধ্য রাতে
বুদ্ধি এলো অনেক কালি আছে আমার সাথে।
হাতের ভিতর সূঁই ফুটিয়ে রক্ত করলাম বের
লিখতে লিখতে রাত পোহাল পেলাম না যে টের।
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি ঝরে গাছের পাতা নড়ে
চিঠির মাঝে আমি আছি বুঝবে লিপি পড়ে
মনটা আমার শুধুই থাকে তোমার কাছে পড়ে
কেমন ছিলে ? কেমন আছ ? জানতে ইচ্ছে করে ।
তোমায় আমি বাসবো ভালো জনম জনম ধরে
তোমায় আমি রাখবো আমার মনি কোঠায় ভরে।“
ভুল বুঝনা প্রিয় আমার আমি তোমার সেই
ছিলাম আমি, আছি তোমার অন্য কারো নই।

শিউলি ওর মাকে ওদের পরিকল্পনার কথা বললো। শিউলী তার বোনের হবু বরকে আগামি পরশু দিন শুক্রবার আসতে অনুরোধ করল এবং তার আত্মীয় সজন নিয়ে আসতে বললে ছেলে পক্ষ রাজি তাই সবার মনে মহাখুশির বান বইছে ।
রুপালীর এই আনন্দঘন মুহূর্তটা সত্যি সবার মনে আশার সঞ্চার করেছে । সে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার মায়াই ছেড়ে দিয়েছিল । মানুষের জীবনে অনেক ঝড়ঝাপ্টা আসবেই তা ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করে একসময় সমাজের কীট পতাঙ্গকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার এক উজ্জল দৃস্টান্ত রাখলো রুপালী শিউলিরা । রুপালীর বিয়ের দিন এলাকার গন্যমান্য অনেককেই দাওয়াত দেয়া হয়েছিল যাতে মোড়লের বখাটে ছেলেরা কোন ঝামেলা করতে না পারে। উপজেলার ইউ এন ও স্যার বিশেষ অতিথি থাকায় ছেলে পক্ষ মহাখুশি। রুপালীর বর নয়ন সবার সামনে ডিক্লার করলো রহিমা বেগম আজ থেকে রুপালীর মা আমার ও মা । মা এখন থেকে এই বাড়িতেই থাকবে । ছেলে হিসেবে আমি তার সংসারের সব দায়িত্ব নিলাম । শিউলি তার বন্ধু-বান্ধবিদের সাথে ঢাকায় গিয়ে ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে সীট নিল। পড়ার ফাঁকে শিউলি বি.সি.এস পরীক্ষায় অংশ নিল আর একটি ভাল ক্যাডারে চান্স ও পেয়ে গেল । মাস্টার্স ফাইনাল দিয়ে প্রশাষণ ক্যাডারে জয়েন্ট করলো। রহিমা বেগম আজ একজন সফল মা ।শিউলিরা পথের ফুটন্ত ঘাঁষফুল, যে ফুল শুধু সুঘ্রাণই দেয় না আলোও ছড়ায়, যে আলো সমাজের আঁধার দূর করে সমাজ ও জাতিকে আলোকিত করে।এই আত্মপ্রত্যয়ী সফল মানুষদের প্রতি রইল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এফ, আই , জুয়েল # সামাজিক নোংড়ামির করুন বাস্তবতা অনেক সুন্দরভাবে লেখনীতে ফুটে উঠেছে ।।
ধন্যবাদ জুয়েল ভাই।
শামীম খান ভাল লাগলো গল্পটি । শুভ কামনা ।
শামীম ভাই অশেষ ধন্যবাদ।
মাইদুল আলম সিদ্দিকী সুন্দর বলেছেন! ভালো লেগেছে।
ধন্যবাদ পড়া ও সুন্দর মতামতের জন্যে। শুভেচ্ছা মাইদুল ভাই।
ওয়াহিদ মামুন লাভলু মোড়লের বখাটে ছেলেরা সমাজের আগাছা। তাদের কারণেই রূপালীদের মত মেয়েদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের প্রত্যয়ই তাদের মাথা উঁচু করে দেয়। চমৎকার শিক্ষামূলক গল্প। খুব ভাল লাগল। শ্রদ্ধা জানবেন।
ধন্যবাদ ওয়াহিদ উদ্দিন ভাই। শুভেচ্ছা।
মালেক জোমাদ্দার ধন্যবাদ মামুন ভাই আর হ্যা পড়ব ইনশ আল্লাহ
আল মামুন খান খুব সাবলীল ভাষা! সুন্দর লিখেছেন। আমার গল্পটি পড়বার অনুরোধ রইলো। ভালো থাকবেন।

০২ জুন - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪