শিকল তত্ত্ব

মা (জুন ২০১৪)

সজল চৌধুরী
  • ৩৩
আব্বু আজ মাকে ভীষণ মেরেছে। গতকালও মেরেছিল, আগামীকালও মারবে। মাকে কারণে মারবে, অকারণে মারবে। চুলের মুঠি ধরে মারবে। থুতনি চেপে ধরে মারবে। মাকে মারতে মারতে মাটিতে শুইয়ে দেবে। প্রতিদিন মারবে ...

আর মা কেবল কাঁদবে। নীরবে কাঁদবে, সরবে কাঁদবে, ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদবে, চিৎকার করে কাঁদবে। আব্বুর মারমুখী হাত ধরে কাঁদবে। পা ধরে কাঁদবে। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল, নাকের জল এক হয়ে একাকার হয়ে যাবে।চোখ রক্তবর্ণ হয়ে যাবে। প্রতিদিন কাঁদবে...

আমি শুধু দেখি, নীরব দর্শক হয়ে। নীরব শ্রোতা হয়ে। নীরব সাক্ষী হয়ে। ছোটবেলায় মায়ের সাথে আমিও কাঁদতাম। নীরবে কাঁদতাম। দরজার পর্দা ধরে কাঁদতাম। ভয়ে কাঁদতাম। দুঃখে কাঁদতাম। এখন আর কাঁদি না। শুধুই দেখি। প্রতিদিন দেখি...

এখন আব্বু মারে আর আমি দেখি।কখনো কখনো ভাবি, ভবিষ্যতের ভাবনা। আমিও কি আমার বউয়ের গায়ে হাত তুলব?মারব? কারনে কিংবা অকারণে? মারলে কোথা থেকে মারা শুরু করব? মাথা থেকে পা, নাকি পা থেকে মাথা? নাকি এলোপাথাড়িভাবে? প্রতিদিন নাকি...

আবার ভাবি কেন মারব? দোষ করলেই মারব? আমিও তো দোষ করি। আমাকে তো সবসময় মারে না। তবে তাকে কেন মারব? সেও মানুষ, আমিও মানুষ। আর মানুষ মাত্রই ভুল করে। তারপরও কি তাকে মারা উচিত? প্রতিদিন প্রতিক্ষণে...

ছোটবেলায় ভাবতাম, কেন মা নীরবে সব সহ্য করে? তার কি হাত নেই? শরীরে শক্তি নেই? আমার সমবয়সীরা আমাকে মারলে, আমিও তো তাদের মারি। তবে মা কেন মারে না? নীরবে সব সহ্য করে।প্রতিদিন নীরবে...

আমার জন্ম হয়েছিল মা-বাবার বিয়ের পর ষষ্ঠ মাসে। না, আমার মা-বাবার প্রেমের বিবাহ ছিল না। আমার মা ধর্ষিত হয়েছিল।আমার আব্বু একজন ধর্ষিতকে বিয়ে করে খুব ভালো কাজ করেছেন, আবার আমাকে গ্রহণ করেছেন, কত মহৎ তিনি। কত ভালো তিনি। তাই একটু একটু মারা তো তারই সাজে। এটাই কেবল ভাবতাম, যতদিন না জানতাম সেই ধর্ষণকারী ছিল আমার আব্বু। এখন শুধু ঘৃণা করি তাকে। প্রতিদিন ঘৃণা...

ধর্ষণ করে তার শাস্তি তিনি পান নি কখনো। যখন আমি আসার ইঙ্গিত দেই, তখন আমার মাকে জোর করে এই ধর্ষণকারীর সাথেই বিবাহ দেন,যাতে কথা না ছড়ায়। আমার মায়ের কিছুই করার ছিল না। কিচ্ছু না। ধর্ষণ করে আমার আব্বু তিরস্কারের বদলে পেয়েছে পুরস্কার। আগে মা একবার ধর্ষিত হয়েছিল। আর এখন হয় প্রতিদিন। প্রতিদিন ধর্ষিত...

ইচ্ছা হয়, ভেঙ্গে চুরে ছুড়ে ফেলে দেই এই সমাজ ব্যবস্থাকে। এর কোন দরকার আদৌ আছে কিনা জানি না। যত দোষ নন্দ ঘোষ। সব দোষ আমার মায়ের, আমার আব্বু ধোঁয়া তুলসি পাতা। তুলসি পাতা না, ধুতুরা পাতা। ধর্ষণ করেও শান্তি পায় নাই। এখন শুধু মারে। কারণে, অকারণে মারে। কেন এত মারে? কেউ তাকে থামায় না কেন? কেন মারে? প্রতিদিন মারে...

দাদির কাছে গল্প শুনতাম। আলাদিন আর তার জাদুর চেরাগের গল্প। ভাবতাম, আমার কাছে অমন একটা চেরাগ এলে, ঐ চেরাগের দৈত্য এলে, আমার তিনটা ইচ্ছা কি হবে? পেন্সিল দিয়ে নীল দাগ টানা খাতায় ইচ্ছাগুলো লিখতাম। প্রথম ইচ্ছা, আব্বু যেন মাকে না মারে। দ্বিতীয় ইচ্ছা, আব্বু যেন মাকে না মারে। তৃতীয় ইচ্ছা, আব্বু যেন মাকে না মারে। তাই সবসময় চেরাগ আর দৈত্যের প্রতীক্ষায় থাকতাম। প্রতিদিন প্রতীক্ষায়...

বড় হয়ে যখন গল্প পড়া শিখলাম,নানা রকম গল্প পড়তাম। আর কেবল ভাবতাম, মায়ের জীবনটা কেন গল্পের মত নয়? কেন এমন হয় না যে, আব্বুটা ভালো হয়ে গেল কিংবা মা অনেক সাহসী হয়ে গেল। কেন আমাদের জীবনটা প্রত্যেকটি রাজা-রানির গল্পের শেষ লাইনটার মত হয় না। ...“অতপর তারা সবাই সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো” ... প্রতিদিন ভাবতাম...

আরও বড় হয়ে যখন সিনেমা দেখতে শিখলাম, তখন মনে হত লাগলো আব্বু কেন নায়কের মত হয় না, কেন ভিলেনের মত হয়? কেন মা গাঁয়ের বধূর মত? কেন শহরের মেয়ের মত সাহসী না? সিনেমা দেখতাম আর ভাবতাম। আমাদের জীবন কেন এমন হয় না। কেন কিছু ঘটে না। প্রতিদিন ঘটে...

আমি স্বপ্ন দেখি, আব্বু ভালো হয়ে গিয়েছে। আব্বু আর মাকে মারে না। দুজনই অনেক হাসিখুশি। আব্বু মারে না। মা কাঁদে না। মা টুনির মত করে পিঠা বানায়। আব্বু টোনার মত করে মজা করে খায়। তারপর দুজনই ঘুরতে বের হয়। জানি এ শুধুই স্বপ্ন। তারপরও দেখি। প্রতিদিন দেখি...

যেদিন আমার বুকে সাহস জন্ম নিল, আমি দাঁড়ালাম আমার মারমুখী আব্বুর সামনে। বললাম, আমার মাকে মারেন ক্যান? আব্বু রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে বলেন, “মেয়ে মানুষ হল বান্দরনীর জাত। একটু লায় পাইলে মাথাত অটে। তাই অকে মাইরের উপর রাখতে হয়। বুঝছিস?” এসব শুনে আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়।আমি রাগ্রত গলায় চেঁচিয়ে বললাম, তা হইলে আপনি কোন বান্দরনীর পোলা?
-কি কইলে রে হারামজাদা? আইজ তোর একদিন কি মোর একদিন।
তারপর থেকে আব্বু আমাকেও মারেন। মা এসে আমাকে আগলে ধরতে গিয়ে তিনিও মার খান। আমিও খাই, তিনিও খান। প্রতিদিন খাই,খান...

আর সহ্য হয় না। একদিন রাগের চোটে, বন্ধুদের পাল্লায় পরে ধূমপান করা ধরলাম। তারপর বাংলা মদ, তারপর গাঁজা, তারপর হেরোইন। এভাবে প্রতিদিন আমি তলিয়ে যেতে লাগলাম অতলে। প্রতিদিন তলিয়ে...

এরকম অবস্থায় আব্বু আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। মোটা টাকার যৌতুক। আমি বিক্রি হয়ে গেলাম।হাটে গরু ছাগলের মত বিক্রি হয়ে গেলাম।আমার আব্বু আমাকে বিক্রি করে দিলেন।বিক্রি হয়ে গেলাম। প্রতিদিন হলাম...

আমার মা আমাকে সাজিয়ে দিলেন। আমাকে দু’হাতে প্রাণভরে দোয়া করে দিলেন। কত মার খেয়েছেন, তারপরও তার হাতদুটো কত কোমল! কত স্নেহময়ী! ভাবি আর অবাক হই। আজও হলাম। আগেও হতাম। আগামীতেও হব। প্রতিদিন হব...

বাসর ঘরে ঢুকে দেখলাম বউ কালো। পেত্নীর মত কালো। সাথে এক পা নেংড়া। আব্বুর কাছে টাকাই সুন্দরী! আমার বউ কিছুই না! বউটা আমাকে দেখে হাসলো। দেখে আমার পিত্তি জ্বলে গেল। দুই বোতল বাংলা মদ সাবাড় করলাম। তারপর বউকে পিটাতে শুরু করলাম। কেন সে কালো হল? কেন নেংড়া হল? কেন? পিটাতে লাগলাম। প্রতিদিন লাগলাম...

আমার একটা মেয়ে হয়েছে। ওর মায়ের মত কালো। তাই এটা আমার মেয়ে না। বড় হয়ে যেদিন কথা বলতে শিখল, সে আমাকে বাবা আর ওর মাকে আম্মু বলে ডাকতে লাগলো।প্রতিদিন বাবা...
--------------------*******--------------------

বাবা আজ আম্মুকে ভীষণ মেরেছে। গতকালও মেরেছিল, আগামীকালও মারবে। আম্মুকে কারণে মারবে, অকারণে মারবে। চুলের মুঠি ধরে মারবে। থুতনি চেপে ধরে মারবে। আম্মুকে মারতে মারতে মাটিতে শুইয়ে দেবে। প্রতিদিন মারবে...
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ওয়াহিদ মামুন লাভলু শিক্ষা গ্রহণ করার মত দুর্দান্ত একটা লেখা উপহার দিয়েছেন। এ রকম লেখা আরও চাই। খুব ভাল লাগল। শ্রদ্ধা জানবেন।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ...

২৫ এপ্রিল - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪