কাল বৈশাখী

উচ্ছ্বাস (জুন ২০১৪)

সুগত সরকার
দিনটা ছিল ২৮ শে মার্চ ।ঘড়িতে তখন তিনটে পনেরো । চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে বেঙ্গল কেমিক্যাল এর ফাইলটা নিয়ে বসলাম। মোটামুটি চারটের নাগাদ বেরিয়ে, বাড়ি ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আই পি এল -এ কলকাতা আর দিল্লির খেলাটা দেখবার প্লান করছি। এমন সময় নবদা টেবিল -এ আরও চারটে ফাইল দিয়ে বলল ‘ ‘বস বলেছে সামনে ইয়ার এন্ডিং সবকটা ফাইল সেরে তারপর বাড়ি যেতে ।’’ ঝাড়টা পুরো জ্বলে গেল। কিন্তু কি করব বসের হুকুম অমান্য করতে পারি না ।
অগত্যা কাজ সেরে অফিস থেকে যখন বেরলাম তখন ছটা পাঁচ । বাইরে বেরিয়ে দেখি গুমট গরম, আকাশ জুড়ে কালো মেঘ। বুঝলাম কালবৈশাখীর পূর্বাভাস। চটপট পা চালাতে লাগলাম।
এসস্প্লানেড থেকে হাওড়ার বাস ধরলাম। গরমে সেদ্ধ হয়ে যখন হাওড়ায় নামলাম তখন পৌনে সাতটা । আকাশে মেঘ আরও ঘন হয়েছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝড়ো হওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। ফুটপাতের দোকানিরা দোকান গুটোতে ব্যস্ত ।
আমি চটপট পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মের দিকে হাঁটা দিলাম। সাধারণত এখান থেকেই কর্ড লাইন লোকালটা ছাড়ে । আমি ট্রেন-এ উঠে চার নম্বর সিটে কোনরকমে ঠেকালাম। ঠেকালাম বললাম কারন যেভাবে বসলাম, সেটাকে আর যাই হোক ঠিক বসা বলা যায় না । আর এভাবে না ঠেকালে গুড়াপ স্টেশন পর্যন্ত আমাকে প্রায়ই দাঁড়িয়েই যেতে হবে। ছয় নম্বর প্লাটফর্মে হাওড়া – দিল্লি পূর্বা এক্সপ্রেস সিগন্যাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি ব্যাগটা সিটে রাখলাম।তারপর বোতলটা বের করে দরজার কাছে গিয়ে মুখে জলের ঝাপটা নিচ্ছি, এমন সময় দেখলাম পূর্বা এক্সপ্রেস হর্ন মেরে ছেড়ে দিল । হঠাৎ চলন্ত ট্রেন-এর কামরায় এমন একটা পরিচিত মুখ দেখতে পেলাম যে মনটা আনন্দে ভরে গেল।সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেল।রোমে রোমে জেগে উঠল শিহরণ। সব ক্লান্তি এক মুহূর্তে দূর হয়ে গেল।উচ্ছ্বাস যেন আর চেপে রাখতে পারছি না !
আবার বুকের ভিতর সেই উথাল পাতাল অনুভব করলাম যেমনটা পাঁচ বছর আগে অনুভব করতাম।
আমি চটপট ব্যাগটা নিয়ে অফ সাইডে নেমে পড়লাম। তারপর ছুট লাগিয়ে কোনরকমে শেষ রিজার্ভ কামরাটায় উঠে পড়লাম ।
সুছন্দা চ্যাটার্জি আমার সাথে রবীন্দ্রভারতীতে পড়ত । বাংলায় এম এ পড়ছিল। আমি তখন ইংলিশে এম ফিল করছি। লেখালিখির শখটা আমার বরাবরই। তাই সেবার ইউনিভার্সিটির ম্যাগাজিনের দায়িত্বটা যখন আমার ঘাড়ে দেওয়া হল আমি আনন্দের সাথেই সেটা নিয়েছিলাম।
আর সেই সুত্রেই আমার সুছন্দার সাথে আলাপ। ও ছিল ম্যাগাজিনের সহ সম্পাদক ।ওর লেখার হাত ছিল অসম্ভব ভাল। লেখার মধ্যে ছিল অদ্ভুত এক দর্শন। আর এই লেখালেখির সুত্রেই কাছাকাছি আসা।
তারপর বন্ধুত্ব। ভাললাগা।আর সেটা যে কখন ভালবাসায় পরিণত হল তা আমিও জানি না । কিন্তু সেই ভালবাসার কথা ওকে কখনও জানানো হয়নি। সত্যি কথা বলতে সাহসে কুলোয়নি । অবশ্য তার জন্য বন্ধুদের কাছে কম প্যাঁক খেতে হয়নি।
মনে আছে একবার বিপ্লব ওকে প্রপোস করে একটা বিপ্লব আনার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তা সফল হয়নি।ও বিপ্লবকে বলেছিল আগে নিজের পায়ে দাঁড়া তারপর এসব প্রেম ট্রেম…… ।
আসলে ওর পারসোনালিটিটাই একটু অন্যরকম। একটু চুপচাপ। ছিমছাম সাজগোজ। হাতে সবসময় শঙ্খ ঘোষের বই। আবার সুযোগ পেলেই বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা । তবে হ্যাঁ সেখানেও পরিমিত কথা বলা । বাংলা সাহিত্যের অন্ধ ভক্ত । লিটল ম্যাগাজিন থেকে ‘দেশ’। রবীন্দ্রনাথ থেকে সুনীল গাঙ্গুলি, জয় গোস্বামী,শ্রীজাত কিছুই বাদ দিত না । তবে ওর প্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষ । ‘শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ছিল ওর কাছে বেদ ।
ওর প্রিয় আড্ডার জায়গা ছিল লাইব্রেরীর সামনের সিঁড়িটা। সেখানেই ওরা বসে আড্ডা দিত। আমি আড়ালে তিনতলার ব্যালকনি থেকে …….।
আমি যেন ক্রমশ নস্টালজিক হয়ে পড়ছি …..
এরপর পাঁচ পাঁচটা বছর কেটে গেছে।আজ আমি ইনফোটেক কোম্পানির একজন এমপ্লয়ী আর মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। আজ এ সুযোগ….। আজ যেমন করেই হোক ওকে জানাতেই হবে ।
আমি টয়লেটের সামনের আয়নাই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর রিজার্ভ কামড়ার ভিতর দিয়ে এগোতে লাগলাম ।
ঝড়ো হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটছে ট্রেন । আমি চার চারটে কামড়া পেরিয়ে এলাম। কিন্তু সুছন্দা কই ? তাকে তো দেখতে পাচ্ছি না !
বুকের ভিতর হার্টবিট ক্রমশ বেড়েই চলেছে। যার জন্য এই দুর্যোগের আবহাওয়ায়, আমার গুড়াপ পর্যন্ত মান্থলিতে,সুদুর বর্ধমান পর্যন্ত যাওয়ার ঝুঁকি নিলাম তার দেখাই যে …..।
কিছুক্ষণের জন্য আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত চোখ দুটোর উপর অবিশ্বাস জন্মাল। আমি ব্যস্ত হয়ে আরও তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলাম। আরও দুটো কামড়া পেরোনোর পর তার দেখা পেলাম । কি সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। আজও সেই ছিমছাম গোছের সাজ। একটা হলদে কটকী সিল্ক পড়েছে । ওর ফর্সা রঙে শাড়িটা যেন আরও বেশি খোলতাই দেখাচ্ছে। তার সাথে একটা কলার দেওয়া মেরুন ব্লাউজ। চুল বিনুনী করে বাঁধা। মুখের সামনেরদিকের কিছুটা চুল খোলা। জানলা দিয়ে এলোপাথাড়ি ঝড়ো হাওয়া ঢুকে ওর মুখের সামনের খোলা চুলে ছুঁই ছুঁই খেলছে । কপালে ছোট্ট একটা মেরুন টিপ।টিপের উপর একটা স্টোন বসানো । ওর কানে মোবাইলের হেড ফোন গোঁজা।ওর স্বপ্নাতুর চোখ দুটো বন্ধ । ও বোধ হয় মোবাইলে গান শুনছে । মনের ভিতর অদ্ভুত একটা আনন্দ হতে লাগল । আমি ধীরে ধীরে ওর দিকে এগোতে লাগলাম, এমন সময় একটা বেয়াড়া ঝড়ো হাওয়া এসে ওর সামনের চুলগুলোকে পিছনের দিকে ঠেলে দিল। একি ওর সিঁথিতে….. ।
আমি থমকে দাঁড়ালাম ।এক মুহূর্তে সব উচ্ছ্বাস যেন হারিয়ে গেল। সময় যেন কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেল।মনে হল আমি যেন আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে মৃত্যুশয্যায় শেষবারের মত দেখতে এসেছি ।আমি চেতনার মধ্যে থেকেও চেতনা হারালাম । আমি কোনরকমে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে দরজার কাছে পাদানিতে গিয়ে বসলাম।
বাইরে কালবৈশাখী উন্মত্ত বুনো দাঁতালের মত তাণ্ডব শুরু করেছে । অঝোরে বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে। চোখের জল আমার অজান্তেই বৃষ্টির সাথে মিশে আমার শুষ্ক গাল বেয়ে ঝরে পড়ছে ।
আমি কাকভেজা হয়ে ভিজছি । আজ হাওড়া থেকে বর্ধমানের দূরত্বটা এক আলোকবর্ষের মত মনে হচ্ছে ।।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিনতি গোস্বামী ভালো লিখেছেন.আমার ভোট ও শ্রদ্ধা রইলো.
আপনার মত মননশীল মানুষের ভালো লেগেছে এটাই আমার বড় পাওনা। তবে আপনার মত প্রতিটি বিষয়ের উপর সাবলীলভাবে লেখার দক্ষতা আমার নেই। তাই শ্রদ্ধাটা আপনার জন্য রইল। আপনি ভালো থাকুন এবং লিখতে থাকুন , আপনার জন্য অনেক শুভকামনা । ধন্যবাদ ।
ওয়াহিদ মামুন লাভলু বেদনাদায়ক গল্প। হৃদয় ছুঁয়ে গেল। খুব ভাল লিখেছেন। শ্রদ্ধা জানবেন।
আপনার মত মননশীল মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেলে আমার এই গল্প সার্থক । ধন্যবাদ ।
এফ, আই , জুয়েল # গভীর ভাবনার অনেক সুন্দর একটি গল্প ।।

১৩ মার্চ - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪